মাতৃভক্তি

Daily Inqilab ফারুক আহম্মেদ জীবন

১৭ মে ২০২৪, ১২:১৫ এএম | আপডেট: ১৭ মে ২০২৪, ১২:১৫ এএম

সময়টা ঠিক বৈশাখ মাসের মাঝামাঝি। বেলাটাও প্রায় শেষ। এদিকে আকাশের পশ্চিম কোণে নিকেষ ঘনো কালো মেঘ জমেছে। মাঝে কালবৈশাখী ঝড় উঠতে পারে। কিন্তু সাত বছরের ছোট্ট ছেলে মনার সেদিকে যেনো কোন খেয়াল নেই। মনা শুধু বেহুঁশের মত ছুটেই চলেছে। ছুটছে তো ছুটছেই। উদ্দেশ্য তার পাশের গাঁ- মধুপুর গঞ্জ থেকে একটা গ্রাম্য ডাক্তার ডেকে আনবে তার মায়ের চিকিৎসার জন্য। তার মা যে দুপুরের পর থেকে অচেতন অবস্থায় প্রচন্ড জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকছে। মাটির ঘরের দোচালা বারান্দায় শুয়ে আছে মনার মা। মনার বোন কণা মাথায় জল ঢেলে দিচ্ছে। অবশ্য ডাক্তার ডাকতে কণা যেতে চেয়েছিল। কিন্তু মনা বোন কণাকে মায়ের মাথায় জল দিতে বলে নিজেই ছুটেছে ডাক্তারের কাছে। মা-কে যে তার বাঁচাতেই হবে। কেননা কণা আর মনার মা ছাড়া যে, দু কুলে কেউ নেই। ওদের দু ভাই বোনের কাছে যেনো মা-ই ওদের পৃথিবী।
কণার বয়স এ- বছর দশে পড়েছে। আর ছোট ছেলে মনার বয়স সাত। তাঁরা দুজনেই তাদেরই স্বপ্নপুর গাঁয়ের সরকারি প্রাইমারি স্কুলে পড়ে। কণা পড়ছে পঞ্চম শ্রেণীতে। আর মনা তৃতীয় শ্রেণীতে। ওদের বাবা অবশ্য এখন আর বেঁচে নেই। এইতো বছর দুই মতো হচ্ছে। একদিন দুপুরে মাঠের কাজ শেষ করে বাড়িতে ফিরার পর হঠাৎ হার্ট অ্যাটাক হয়ে মারা যায়। সেই মুহূর্তে কেউ যে ডাক্তার ডাকবে কিম্বা কোন গাড়িতে করে দ্রুত শহরের কোন হসপিটাল বা-ক্লিনিকে নিয়ে যাবে। সেসময়টুকুও কেউ পাইনি। সেদিন মৃত বাবার দেহ জড়িয়ে ধরে কাটা মুরগির মত ছটফট করে কেঁদেছিল কণা আর মনা দু,ভাই বোন। ওদের সেই কান্না দেখে যেনো গাছের পাতা গুলোও ঝরে পড়েছিলো সেদিন।
খুব খাটুনির মানুষ ছিলো সোনা মিয়া। কোন ঝড়-তুফান, বৃষ্টি-বাদল, রৌদ্র- খরা, দেখতো না সে। সোনা মিয়ার স্ত্রী মিনা কতো করে বলতো, ও কণা মনার বাপ। আমি বলি কি, আর তোমার ওতো খাটুনি করার দরকার নেই।
এমনিতেই তোমার শরীর তেমন একটা ভালো না।
মাঝেমধ্যেই বলো তোমার বুকের বাঁ-পাশটাই কেমন চিনচিনে ব্যথা করছে। নিজের শরীরের প্রতি একটু খেয়াল করো। কিন্তু কেবা শোনে কার কথা। সোনা মিয়া কোনো কথায় কানে করতো না। দুটি ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে বউ মিনাকে বলতো, ও বউ, বলি, না খাটলে এ সংসারটা চলবে কি করে
বলো তো শুনি হুম? আরো বলতো, জানো, আমি না বউ কাজে বিশ্বাসী।
কথায় আছে না...
খাটলে-খুটলে পেটের ভাত,
আর দেড়িমজুত সব আল্লার হাত।
সোনা মিয়া একটুআধটু লেখাপড়াও জানতো। আর
তাই পড়াশোনা জানা শিক্ষিতদের মত মাঝেমধ্যেই সে তার বউ মিনাকে বলতো, জানো বউ...
এই পৃথিবীতে....
গাফিলতি আর অলসতা আনে যতো দারিদ্রতা,
পরিশ্রম আর কর্মই আনে জীবনে সফলতা।
দু চোখে কতোই- না স্বপ্ন ছিল মেয়ে কণা আর ছেলে মনাকে নিয়ে ওদের বাবা সোনা মিয়ার। বলতো এইতো আর কিছুদিন বউ। দেখো, তারপর আমাকে আর খাটতে হবে না । আমার মেয়ে চান্দের কণা মা। আর আমার সোনার টুকরো ছেলে মনা লেখাপড়া শিখে বড় হয়ে যখন মানুষের মত মানুষ হবে। কোন চাকরিবাকরি করবে। তখন আমি নিশ্চিন্তে বসে বসে খাবো। আর প্রভুর ইবাদত বন্দেগি করে বাকি জীবন কাটিয়ে দিবো।
বাবা নামের জান্নাতি সেই বটবৃক্ষটি কণা আর মনার মাথার উপর ছায়া হয়ে আজ আর বেঁচে নেই।
আজ বাবা হারা ছায়াহীন দু,ভাই বোনের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন তাদের মা। মা-ই তাদের জীবন। স্নেহময়ী মায়ার চির সুখময় জান্নাতের শান্তির ছায়া। সেই মায়ের ছায়া যদি হারিয়ে যায় তাহলে ওরা বাঁচবে কিভাবে?
তখন ঝড় উঠেছে তুমুল বেগে বৃষ্টিও নামছে। ছোট্ট মনা ভিজে দেহে হাঁফাতে হাঁফাতে হাজির হলো ডাক্তার বিবেকবান এর চেম্বারে। চেম্বারে ঢুকেই ডাক্তারের হাত দুটো ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলো...
ও ডাক্তার বাবু....ও ডাক্তার বাবু...তাড়াতাড়ি ব্যাগ ওষুধ নিয়ে আমাদের বাড়িতে চলুন না। আমার মা খুব অসুস্থ। কেমন জানি করছে মা। তখনো ঠকঠক করে কাপছে মনা। ডাক্তার বিবেকবান বললো,
তুই সোনা মিয়ার ছেলে মনা না? মনা বললো জ্বি।
তারপর বললো, একটু তাড়াতাড়ি চলুন ডাক্তার।
ডাক্তার বললো, সে না হয় যাবো। কিন্তু আমি ভাবছি তুই এইটুকু মানুষ এমন ঝড়ঝাপটা মাথায় নিয়ে আসলি কি করে? আর বৃষ্টিতে ভিজে যেভাবে তুই কাঁপছিস!
এ অবস্থায় যদি তোর কিছু হয়ে যেতো? মনা বললো, আমার কিছু হবে না ডাক্তার বাবু। আমার মাকে বাঁচান এই বলে সে ডাক্তারের ব্যাগ নিলো।
ততক্ষণে ঝড় থেমে গেছে। দুই এক ফোটা বৃষ্টি পড়ছে। ডাক্তার বললো, হ্যা চল। তারপর বেরিয়ে পড়লো মনাদের বাড়ির উদ্দেশ্য। কণা তখনো ওর মায়ের মাথায় পানি দিচ্ছে। দু,চোখ জলে ছলছল করছে। কণা মনাকে দেখে বললো তুই এসেছিস ভাই..ডাক্তার কই? মনা বললো হ্যা, এসেছি আপু।
আর এইতো ডাক্তার বাবুকে সাথে করেই নিয়ে এসেছি আপু। ডাক্তার বললো এইতো আমি কণা মা। তুমি আগে মনার গায়ের জল মুছে ওর শুকনো জামা কাপড় পরাও। না হলে বৃষ্টির জলে ঠান্ডা লেগে ওর- ও জ্বর হবে। আর চিন্তা করতে হবে না আমি তোমাদের মাকে দেখছি। তারপর ডাক্তার রুগী মিনার পাশে বসে থার্মোমিটার দিয়ে জ্বর মেপে দ্যাখে প্রায় একশো দুই এর উপর জ্বর। তারপর ব্লাড প্রেসার দেখলো। না বি, পি স্বাভাবিক আছে। তারপর ডাক্তার দ্রুত দেহের জ্বর কমানো ইনজেকশন দিলো। কিছুক্ষণ যেতে না যেতেই হুঁশ ফিরলো মিনা বেগমের। ডাক্তার মুখে হাসি এনে কণা, মনার দিকে তাকিয়ে বললো, আর চিন্তার কিছু নেই। ভয় কেটে গেছে। গায়ে প্রচুর তাপমাত্রা উঠার কারণে তোমাদের মা অমন করছিলো। খুবি মানবিক ডাক্তার বিবেকবান। সে ওদের মা মিনা বেগমের সাথে কণা আর মনার মায়ের সেবা করা।
মায়ের প্রতি মায়া, ভক্তি, শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা দেখে অনেক প্রশাংসা করলো। তারপর কণা মাথায় জল দেওয়ার কারণে অনেক বড় বিপদ থেকে বেঁচে গেছে মিনা বেগম সেকথাও বললো মিনা বেগমকে।
তারপর ওষুধ খাওয়ার নিয়মকানুন সব বুঝিয়ে দিয়ে ডাক্তার চলে গেলো। মিনা বেগম কণা আর মনাকে কাছে ডেকে দুই হাত দিয়ে তার বুকে জড়িয়ে নিলো। তারপর মমতা ভরা চুম্বন দিলো ওদের দু, ভাই বোনের কপালে।আর চোখের জল ফেলে অন্তর থেকে আশীর্বাদ করলো ওরা যেনো সত্যিকারের মানুষের মত মানুষ আর মানবিক মনের অধিকারী হয়। প্রভু যেনো ইহকাল পরকাল দু, কালেই ওদের সুখে শান্তিতে রাখেন।


বিভাগ : সাহিত্য


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

কবিতা
বাঙালি চিন্তা ধারার অনন্য বৈশিষ্ট্য
আলেমার ত্যাগ
বাংলা নববর্ষ এবং মুসলিম হিজরী সনের যোগসূত্র
কবিতা
আরও
X

আরও পড়ুন

ভারতে আবাসিক ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড, যেভাবে নাটকীয়ভাবে বেঁচে গেল একটি পরিবার

ভারতে আবাসিক ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড, যেভাবে নাটকীয়ভাবে বেঁচে গেল একটি পরিবার

অবশেষে পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ পেলেন উখিয়ার ১৩ এসএসসি পরীক্ষার্থী

অবশেষে পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ পেলেন উখিয়ার ১৩ এসএসসি পরীক্ষার্থী

পবিপ্রবি শিক্ষার্থী পানিতে পড়ে আহত হওয়ার পরে চিকিৎসা অবহেলার মৃত্যুর অভিযোগ

পবিপ্রবি শিক্ষার্থী পানিতে পড়ে আহত হওয়ার পরে চিকিৎসা অবহেলার মৃত্যুর অভিযোগ

শেরপুর জেলা উপজেলায় নানা আয়োজনে বাংলা নববর্ষ উদযাপন

শেরপুর জেলা উপজেলায় নানা আয়োজনে বাংলা নববর্ষ উদযাপন

নববর্ষ উদযাপনে মনোহরগঞ্জ উপজেলা বিএনপির আনন্দ শোভাযাত্রা

নববর্ষ উদযাপনে মনোহরগঞ্জ উপজেলা বিএনপির আনন্দ শোভাযাত্রা

মাজারের বার্ষিক ওরসের মেলায় অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে জবাই করে হত্যা করল স্বামী

মাজারের বার্ষিক ওরসের মেলায় অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে জবাই করে হত্যা করল স্বামী

কুমিল্লার রাজগঞ্জ বাজারে অগ্নিকাণ্ডে পৌনে দুই কোটি টাকার মালামাল ভস্মীভূত

কুমিল্লার রাজগঞ্জ বাজারে অগ্নিকাণ্ডে পৌনে দুই কোটি টাকার মালামাল ভস্মীভূত

সরকার নয়, আমরা একটি দেশ হিসেবে কাজ করছি: জ্বালানি উপদেষ্টা

সরকার নয়, আমরা একটি দেশ হিসেবে কাজ করছি: জ্বালানি উপদেষ্টা

মতলবে উপজেলা বিএনপির বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা

মতলবে উপজেলা বিএনপির বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা

ফিলিস্তিনবাসীদের শান্তি কামনায়   বিশেষ দোয়া মাহফিল

ফিলিস্তিনবাসীদের শান্তি কামনায়  বিশেষ দোয়া মাহফিল

বর্ণাঢ্য ‘ড্রোন শো’ দেখে মুগ্ধ লাখো মানুষ

বর্ণাঢ্য ‘ড্রোন শো’ দেখে মুগ্ধ লাখো মানুষ

নতুন বছরে সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা দূর হোক  : মঞ্জু

নতুন বছরে সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা দূর হোক : মঞ্জু

বুধবার ঢাকায় আসছেন যুক্তরাষ্ট্রের দুই উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী

বুধবার ঢাকায় আসছেন যুক্তরাষ্ট্রের দুই উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী

পুরোনো পদে ফিরলেন গাঙ্গুলি

পুরোনো পদে ফিরলেন গাঙ্গুলি

আসছে দক্ষিণ আফ্রিকা ইমার্জিং নারী ক্রিকেট দল

আসছে দক্ষিণ আফ্রিকা ইমার্জিং নারী ক্রিকেট দল

রূপায়ণ সিটিতে শতকন্ঠে বর্ষবরণ

রূপায়ণ সিটিতে শতকন্ঠে বর্ষবরণ

বর্ষবরণকে স্বাগত জানিয়ে গাজীপুরে জেলা বিএনপির শোভাযাত্রা

বর্ষবরণকে স্বাগত জানিয়ে গাজীপুরে জেলা বিএনপির শোভাযাত্রা

আমরা নতুন বাংলাদেশে প্রবেশ করেছি: ফারুকী

আমরা নতুন বাংলাদেশে প্রবেশ করেছি: ফারুকী

ভারতীয়দের হজ কোটা ৮০ শতাংশ কমাল সৌদি

ভারতীয়দের হজ কোটা ৮০ শতাংশ কমাল সৌদি

চীনা দূতাবাসের সৌজন্যে ঢাকার আকাশে ব্যতিক্রমী ড্রোন শো

চীনা দূতাবাসের সৌজন্যে ঢাকার আকাশে ব্যতিক্রমী ড্রোন শো