২১ ফেব্রুয়ারি যেভাবে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হলো
২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:১৫ এএম | আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:১৫ এএম

২১ ফেব্রুয়ারি স্মরণে:
বাংলার ইতিহাসে বাঙালির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দুটি গৌরববোজ্জল ঘটনা হলো বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। অনেক সংগ্রাম ও ত্যাগের বিনিময়ে আমরা এই দুটি মহান আন্দোলনে বিজয়ী হয়েছি। আজ সেই মহান ফেব্রুয়ারী মাস।
একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা দেওয়ার বিষয়ে প্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করেন কানাডায় বসবাসকারী কয়েকজন বাংলাদেশী। তাদের মধ্যে কানাডার ভ্যাঙ্কুবারের রফিকুল ইসলামের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তার মনেই প্রথম ধারণা জন্মে যে, আমাদের শহীদ দিবস একুশে ফেব্রুয়ারিই হতে পারে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। কেননা পৃথিবীর আর কোনো দেশে কোনো ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য জীবন উৎসর্গ করার ঘটনা কোনদিন ঘটেনি। যেমনটি ঘটেছে একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা বাংলা ভাষার জন্য। সুতারাং একমাত্র এ দিনটিই হতে পারে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। রফিকুল ইসলাম এই উদ্দেশ্যে কে সামনে রেখে অন্যান্য ভাষার উৎসাহী কয়েকজন মানুষ কে নিয়ে কানাডায় একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। সংগঠনটির নাম “মাদার ল্যাংগুয়েজ মুভমেন্ট”।
১৯৯৮ সালের ৮ জানুয়ারি রফিকুল ইসলাম “মাদার ল্যাংগুয়েজ মুভমেন্ট” এর মাধ্যমে তৎকালীন জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানের কাছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণার বিষয়ে প্রথম আবেদন জানান। আবেদনে তিনি সরাসরি একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণার প্রস্তাব পেশ করেন এবং এর প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। কিন্তু জাতিসংঘ মহাসচিব কফি আনান “মাদার ল্যাংগুয়েজ মুভমেন্ট” কে বিষয়টি “ইউনেস্কো” এর নিকট উত্থাপনের পরামর্শ দেন। কেননা এটি ছিলো ইউনেস্কোর আওতাধীন বিষয়।
১৯৯৮ সালের ২৯ মার্চ সাত জাতি ও সাত ভাষার দশজন ব্যক্তির স্বাক্ষর সংবলিত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণার একটি আবেদন প্যারিসের ইউনেস্কো সদর দপ্তরে পাঠানো হয়। সাত জাতি ও সাত ভাষার যে দশজন ব্যক্তি আবেদনে স্বাক্ষর করেছিলেন তারা হলেন-আলবার্ট ভিনজন (ফিলিপিনো), কারমেন ক্রিষ্টোবাল (ফিলিপিনো), জ্যাসন মেরিন (ইংরেজী), সুসান হভগ্রিন্স (ইংরেজী), ড. কেলভিন চাও (ক্যান্তনিজ), নাজনীল ইসলাম (কা-সি) রেনাটে মার্টিন্স (জার্মান), করুনা জোসি (হিন্দি), রফিকুল ইসলাম (বাংলা) এবং আব্দুস সামাদ (বাংলা)। ইউনেস্কো সদর দপ্তরে যোগাযোগ এর ক্ষেত্রে জাতিসংঘে কর্মরত বাঙালি কর্র্মকর্তা হাসান ফেরদৌস বিশেষ ভূমিকা পালন করেন।
এর মধ্যে এক বছর কেটে যায়। আশাবাদী রফিকুল ইসলাম ইউনেস্কো সদর দপ্তরে টেলিফোন বার্তা পাঠান। জবাবে ইউনেস্কোর শিক্ষা বিষয়ক প্রকল্প বিশেষজ্ঞ মিসেস আনা মারিয়া ১৯৯৯ সালের ৮ এপ্রিল কানাডায় রফিকুল ইসলাম কে একটি চিঠি দেন। মিসেস আনা মারিয়ার চিঠির তথ্যগুলো হলো প্রস্তাবটি গ্রহণ করার জন্য জাতিসংঘের একটি সাধারণ অধিবেশন ডাকতে হবে। দ্বিতীয়টি হলো যে কোনো একটি দেশের পক্ষ থেকে প্রস্তাবটি উপস্থাপনা করতে হবে। সর্বশেষ প্রস্তাবটি হলো “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস” ঘোষণার জন্য ইউনেস্কো ন্যাশনাল কমিশনের দেশসমুহ যেমন - বাংলাদেশ, কানাডা, ফিনল্যান্ড, ভারত, হাঙ্গেরিকে প্রস্তাবক হতে হবে।
মিসেস আনা মারিয়ার চিঠি পেয়ে রফিকুল ইসলাম উল্লিখিত পাঁচটি দেশের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন। বাংলাদেশের তৎকালীন ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেন এবং দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য শিক্ষা মন্ত্রনালয় কে নির্দেশ দেন।
বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ১৯৯৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর সরাসরি ইউনেস্কো সদর দপ্তরে প্রস্তাবটি পেশ করা হয়। প্রস্তাবটিতে স্বাক্ষর করেন “বাংলাদেশ ন্যাশনাল কমিশন ফর ইউনেস্কো” এর সচিব প্রফেসর কফিল উদ্দিন আহমদ। ১৭ লাইনের মূল প্রস্তাবের সঙ্গে ছিল ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করার পক্ষে যৌক্তিকতার একটি স্তবক। মূল প্রস্তাবের শেষ লাইনে লেখা হয়Ñ বাংলাদেশ প্রস্তাব করছে যে, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি যারা জীবন উৎসর্গ করেছেন তাদের আত্মত্যাগের স্বীকৃতি স্বরূপ দিনটিকে সারা পৃথিবীর জন্য আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করা হোক।
১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কোর ৩০ তম সাধারণ অধিবেশনে প্রস্তাবটি উত্থাপিত হয়। প্রস্তাবের সূচনায় বলা হয়Ñ“সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণের ভাষা হচ্ছে সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার। পৃথিবীতে প্রায় ৫০০০ মাতৃভাষা আছে। মাতৃভাষার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও মর্যাদা দানের জন্য একটি দিবস থাকা প্রয়োজন।
প্রস্তাবে আরো বলা হয় “১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে মাতৃভাষার জন্য অভূতপূর্ব আত্মত্যার্গে স্বীকৃতি স্বরূপ এবং সেদিন যারা প্রাণ উৎসর্গ করেছেন তাদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শন স্বরূপ দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণার প্রস্তাব করা হচ্ছে”।
১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর প্যারিসে অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর জেনারেল কনফারেন্স ফর ডিসিপ্লিনারি সেশনে প্রস্তাবটি ১৮৮ ভোটে সর্বসম্মতিক্রমে পাস হয়। এর ফলে আমাদের “শহীদ দিবস” পরিণত হয় “আন্তার্জাতিক মাতৃভাষা দিবস” হিসেবে। ২০০০ সাল থেকে বিশ্বের ১৮৮ টি দেশে একুশে ফেব্রুয়ারি “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস” হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। প্রতিবছরেই দেশের সংখ্যা বাড়ছে। এখন বিশ্বে ১৯১ টি দেশে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালিত হয়।
আমাদের ভাষা আন্দোলনই বিশ্বের সকল মানুষ কে এনে দিয়েছে মাতৃভাষা লালনের সুযোগ, স্বপ্ন ও অধিকার। এই একটি ক্ষেত্রে বিশ্বে আজ আমরা অগ্রপথিক জাতি। এ নিশ্চিয়ই আমাদের জন্য এক দূলর্ভ সম্মান ও অনন্য গৌরবের বিষয়। আমরা এ দিনটির জন্য গর্ব অনুভব করি। আমাদের ভাষা আন্দোলনের মহান দিন একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণার মধ্য দিয়ে বিশ্বের সকল ক্ষুদ্র জাতি ও ভাষা জনগোষ্ঠীকে অনুপ্রাণিত করা হয়েছে।
হাজার বছরের পুরনো আলো আঁধারির ভাষা বাংলা আজ কত ঐশ্বর্য্যে ঐশ্বর্য্যমন্ডিত। এ ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ৫২’র ভাষা আন্দোলনে আমাদের তরুণেরা দিয়েছে বুকের তাজা রক্ত ও প্রাণ। এ ভাষার সুরম্য পথ বেয়ে আমরা পেয়েছি বাংলাদেশের স্বাধীনতা। তাই হাজার বছরেরও আগে যে ধুপছায়া পথ দিয়ে আমাদের ভাষার যাত্রা হয়েছিল শুরু, সে ভাষা চর্যাপদের পথ ধরেই আমরা বর্তমান বাংলা ভাষার গৌরবদীপ্ত অবস্থানে উপনীত হয়েছি, উপনীত হয়েছি বর্তমান বাংলা ভাষার অগ্রগতির গৌরবোজ্জল শীর্ষে।
বিভাগ : সাহিত্য
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন

ভারতে আবাসিক ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড, যেভাবে নাটকীয়ভাবে বেঁচে গেল একটি পরিবার

অবশেষে পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ পেলেন উখিয়ার ১৩ এসএসসি পরীক্ষার্থী

পবিপ্রবি শিক্ষার্থী পানিতে পড়ে আহত হওয়ার পরে চিকিৎসা অবহেলার মৃত্যুর অভিযোগ

শেরপুর জেলা উপজেলায় নানা আয়োজনে বাংলা নববর্ষ উদযাপন

নববর্ষ উদযাপনে মনোহরগঞ্জ উপজেলা বিএনপির আনন্দ শোভাযাত্রা

মাজারের বার্ষিক ওরসের মেলায় অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে জবাই করে হত্যা করল স্বামী

কুমিল্লার রাজগঞ্জ বাজারে অগ্নিকাণ্ডে পৌনে দুই কোটি টাকার মালামাল ভস্মীভূত

সরকার নয়, আমরা একটি দেশ হিসেবে কাজ করছি: জ্বালানি উপদেষ্টা

মতলবে উপজেলা বিএনপির বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা

ফিলিস্তিনবাসীদের শান্তি কামনায় বিশেষ দোয়া মাহফিল

বর্ণাঢ্য ‘ড্রোন শো’ দেখে মুগ্ধ লাখো মানুষ

নতুন বছরে সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা দূর হোক : মঞ্জু

বুধবার ঢাকায় আসছেন যুক্তরাষ্ট্রের দুই উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী

পুরোনো পদে ফিরলেন গাঙ্গুলি

আসছে দক্ষিণ আফ্রিকা ইমার্জিং নারী ক্রিকেট দল

রূপায়ণ সিটিতে শতকন্ঠে বর্ষবরণ

বর্ষবরণকে স্বাগত জানিয়ে গাজীপুরে জেলা বিএনপির শোভাযাত্রা

আমরা নতুন বাংলাদেশে প্রবেশ করেছি: ফারুকী

ভারতীয়দের হজ কোটা ৮০ শতাংশ কমাল সৌদি

চীনা দূতাবাসের সৌজন্যে ঢাকার আকাশে ব্যতিক্রমী ড্রোন শো