ঢাকা   শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪ | ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

আজ ২৫ জানুয়ারী মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের ২০০তম জন্মবার্ষিকী

Daily Inqilab আকাশ হাসান

২৫ জানুয়ারি ২০২৪, ০৭:৪৬ এএম | আপডেট: ২৫ জানুয়ারি ২০২৪, ০৭:৪৬ এএম

আজ ২৫ জানুয়ারী মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের ২০০তম জন্মবার্ষিকী। যশোর জেলার সাগরদাঁড়ি গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত কায়স্থ বংশে ১৮২৪ সালের এই দিনে তিনি জন্মগ্রহন করেন।

মাইকেল মধুসূদন দত্তকে বাংলার নবজাগরণ সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব হিসেবে গণ্য করা হয়। তিনি ঊনবিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালী কবি, নাট্যকার ও প্রহসন রচয়িতা। ঐতিহ্যের অনুবর্তিতা অমান্য করে নব্যরীতি প্রবর্তনের কারণে তাকে আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রথম বিদ্রোহী কবি হিসেবেও অভিহিত করা হয়।

ব্রিটিশ ভারতের বাংলা প্রেসিডেন্সির যশোর জেলার সাগরদাঁড়ি গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত কায়স্থ বংশে ১৮২৪ সালের ২৫ জানুয়ারী তিনি জন্মগ্রহন করেন। তবে মধুসূদন দত্ত যৌবনে খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করে মাইকেল মধুসূদন নাম গ্রহণ করেন। পাশ্চাত্য সাহিত্যের দুর্নিবার আকর্ষণবশত ইংরেজী ভাষায় সাহিত্য রচনায় মনোনিবেশ করেন। জীবনের দ্বিতীয় পর্বে মধুসূদন নিজ মাতৃভাষার প্রতি মনোযোগ দেন। এ পর্বে তিনি বাংলায় নাটক, প্রহসন ও কাব্যরচনা করেন। মাইকেল মধুসূদন বাংলা ভাষায় সনেট (চতুর্দশপদী কবিতা) ও অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তক। তার সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি অমিত্রাক্ষর ছন্দে রামায়ণের উপাখ্যান অবলম্বনে রচিত মেঘনাদবধ কাব্য (১৮৬০) নামক মহাকাব্য। মধুসূদনের ব্যক্তিগত জীবন ছিল নাটকীয় এবং বেদনাঘন।

মাইকেল মধুসূদন দত্ত বাবা- মা'র একমাত্র সন্তান ছিলেন। তার বাবার নাম রাজনারায়ণ দত্ত এবং মা'র নাম জাহ্নবী দেবী। জাহ্নবী দেবী ছিলেন রাজনারায়ণ দত্তের প্রথম স্ত্রী। রাজনারায়ণ দত্ত ছিলেন কলকাতার সদর দেওয়ানী আদালতের এক খ্যাতনামা উকিল। মধুসূদনের যখন তেরো বছর বয়স, সেই সময় থেকেই তাকে কলকাতায় বসবাস করতে হত। খিদিরপুর সার্কুলার গার্ডেন রিচ রোডে (বর্তমানে কার্ল মার্কস সরণী) অঞ্চলে তিনি এক বিরাট অট্টালিকা নির্মাণ করেছিলেন।

মধুসূদনের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় তার মা জাহ্নবী দেবীর কাছে। জাহ্নবী দেবীই তাকে রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ প্রভৃতির সঙ্গে সুপরিচিত করে তোলেন। সাগরদাঁড়ির পাশের গ্রামের শেখপুরা মসজিদের ইমাম মুফতি লুৎফুল হকের কাছে তার প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়। বিদ্বান ইমামের কাছে তিনি বাংলা, ফারসী ও আরবী অধ্যয়ন করেন। সাগরদাঁড়িতেই মধুসূদনের বাল্যকাল অতিবাহিত হয়। স্থানীয় একটি স্কুলে কিছুদিন পড়ার পর তিনি তদনীন্তন হিন্দু কলেজে (বর্তমানে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়) ভর্তি হন। মধুসূদন মেধাবী ছাত্র ছিলেন। তার স্মরণশক্তি এতটাই প্রখর ছিলো যে, কোন গ্রন্থ একবার পড়লে তাকে দ্বিতীয়বার পড়তে হত না। তাই অচিরেই কলেজের অধ্যক্ষ ক্যাপ্টেন ডি. এল. রিচার্ডসনের প্রিয় ছাত্র হয়ে ওঠেন। রিচার্ডসন মধুসূদনের মনে কাব্যপ্রীতি সঞ্চারিত করেছিলেন। হিন্দু কলেজের প্রাক্তন অধ্যাপক ডিরোজিওর স্বদেশানুরাগের স্মৃতিও তাকে বিশেষ উদ্বুদ্ধ করত। এছাড়া কলেজে তার সহপাঠী ছিলেন ভূদেব মুখোপাধ্যায় (১৮২৭-১৮৯৪), রাজনারায়ণ বসু (১৮২৬-১৮৯৯), গৌরদাস বসাক (১৮২৬-১৮৯৯), প্যারীচরণ সরকার (১৮২৩-১৮৭৫)। যারা পরে হয়েছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর বিশিষ্ট সাহিত্যিক এবং সমাজসেবী। আঠারো বছর বয়সেই মহাকবি হওয়ার ও বিলাতে যাওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষা মধুসূদনের মনে বদ্ধমূল হয়ে যায়।

১৮৪৩ সালে রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮১৩-১৮৮৫) এর নিকট মধুসূদন খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণের ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। এরপর ওই বছরই ৯ ফেব্রুয়ারী মিশন রো-তে অবস্থিত ওল্ড মিশন চার্চ নামে এক অ্যাংলিক্যান চার্চে গিয়ে তিনি খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেন। তাকে দীক্ষিত করেছিলেন পাদ্রী ডিলট্রি। তিনিই তার "মাইকেল" নামকরণ করেন। মধুসূদন পরিচিত হন "মাইকেল মধুসূদন দত্ত" নামে। ফলে রাজনারায়ণ দত্ত তার পুত্রকে ত্যাজ্যপুত্র ঘোষণা করেন। তার এই ধর্মান্তর সমাজে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। খ্রিস্টধর্ম গ্রহণের পর মধুসূদন শিবপুরের বিশপস কলেজে থেকে পড়াশোনা চালিয়ে যান। এখানে তিনি গ্রীক, ল্যাটিন, সংস্কৃত প্রভৃতি ভাষা শিক্ষা করেন। রাজনারায়ণ দত্ত তাকে ত্যাজ্যপুত্র করলেও বিশপস কলেজে পড়াশোনার ব্যয়ভার বহন করেছিলেন। চার বছর পর তিনি টাকা পাঠানো বন্ধ করেন। বিশপস কলেজে কয়েকজন মাদ্রাজী ছাত্রের সঙ্গে মধুসূদনের বন্ধুত্ব হয়েছিল। বিশপস কলেজে অধ্যয়ন শেষে কলকাতায় চাকরির চেষ্টা করে ব্যর্থ হন মধুসূদন। তখন তার সেই মাদ্রাজী বন্ধুদের সঙ্গে ভাগ্যান্বেষণে মাদ্রাজে (বর্তমান চেন্নাই) চলে যান মধুসূদন। কথিত আছে, আত্মীয় স্বজনের অজ্ঞাতসারে নিজের পাঠ্যপুস্তক বিক্রি করে সেই টাকায় মাদ্রাজ গিয়েছিলেন তিনি।

মধুসূদন মাদ্রাজেও বিশেষ সুবিধা করে উঠতে পারেন নি। স্থানীয় খ্রিষ্টান ও ইংরেজদের সহায়তায় তিনি একটি স্কুলে ইংরেজী শিক্ষকের চাকুরী পান। তবে বেতন যা পেতেন তাতে তার ব্যয়সংকুলান হত না। এই সময় তাই তিনি ইংরেজী পত্রপত্রিকায় লিখতে শুরু করেন। মাদ্রাজ ক্রনিকল পত্রিকায় ছদ্মনামে তার কবিতা প্রকাশিত হতে থাকে। এক পর্যায়ে সাংবাদিকতার সাথেও জড়িয়ে পড়েন। হিন্দু ক্রনিকল নামে একটি পত্রিকাও সম্পাদনা করেছিলেন তিনি। কিন্তু অল্পকালের মধ্যেই অর্থাভাবে পত্রিকাটি বন্ধ করে দিতে হয়। ১৮৪৯ সালে পঁচিশ বছর বয়সে নিদারুণ দারিদ্র্যের মধ্যে তিনি "দ্য ক্যাপটিভ লেডি" নামে তার প্রথম ইংরেজী কাব্য রচনা করেন। কবি এবং দক্ষ ইংরেজী লেখক হিসেবে তার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে।

মাদ্রাজে আসার কিছুকাল পরেই ১৮৪৮ সালে রেবেকা ম্যাকটিভিস নামে এক ইংরেজ যুবতীকে মধুসূদন বিবাহ করেন। ইংরেজী স্কুল অরফান আস্যাইলাম- এ পড়াতে শুরু করার পরই পরিচয় হয় তার ভাবী স্ত্রী রেবেকার সাথে। বিয়ের এই প্রক্রিয়াটি অবশ্য খুব সহজ ছিল না। তার বন্ধু গৌরি দাশকে লিখেছিলেন- "রেবেকাকে পেতে খুব ঝামেলা হয়েছিল, বুঝতেই তো পারছ তার (রেবেকা) সমস্ত শুভাকাঙ্ক্ষী এই বিয়ের বিরুদ্ধে ছিল"। তাদের বিয়ে সম্পাদন হয় ১৮৪৮ সালের ৩১ জুলাই। বিদেশে গিয়ে রোগ ভোগ করা, চাকুরী জোটানো তারপর এই বিদেশিনীকে বিয়ে করা এই সবই হয়েছিল মাদ্রাজ পৌঁছানোর ছ' মাসের ভিতরে। কিন্তু তাদের এই দাম্পত্য জীবন বেশি দিন স্থায়ী ছিল না। তিনি ভেবেছিলেন বিয়ের পর রেবেকাকে সাথে নিয়ে সুখী হবেন। কিন্তু সংসারের নানা ঝঞ্ঝাট, গোলমাল দেখা দেয়। মধুসূদনের একগুয়েমির কারণে স্ত্রী রেবেকার মতের সাথে অমিল হতে থাকে। এর ফলে তিনি ১৮৫৬ সালে রেবেকার সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করেন। উভয়ের দাম্পত্যজীবন আট বছর স্থায়ী হয়েছিল। রেবেকার গর্ভে মধুসূদনের দুই পুত্র ও দুই কন্যার জন্ম হয়।

এর অল্প কিছু সময়ের মধ্যে ১৮৫৬ সালে মধুসূদন এমিলিয়া হেনরিয়েটা সোফিয়া নামে এক ফরাসী তরুণীকে বিবাহ করেন। হেনরিয়েটা মধুসূদনের সারাজীবনের সঙ্গিনী ছিলেন। হেনরিয়েটা ছিলেন মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি কলেজের কোনো এক শিক্ষকের কন্যা। হেনিরিয়েটাও সর্বগুণ সম্পন্ন রুচিমার্জিত মেয়ে ছিলেন। তাদের নেপোলিয়ান নামক এক ছেলে এবং শর্মিষ্ঠা নাম এক মেয়ে হয়েছিলো। তার বংশধরদের মধ্যে অন্যতম হলেন বিখ্যাত ভারতীয় টেনিস খেলোয়াড় লিয়েন্ডার আর্দ্রিয়ান পেজ।

১৮৫৫ সালের শেষদিকে মাইকেল মধুসূদন দত্ত এক কপি "দ্য ক্যাপটিভ লেডি" বন্ধু গৌরদাস বসাককে (১৮২৬-১৮৯৯) উপহার পাঠান। গৌরদাস সেটিকে জে ই ডি বেথুন (১৮০১-১৮৫১) এর কাছে উপহার হিসেবে পাঠান। উক্ত গ্রন্থ পাঠ করে অভিভূত হয়ে যান বেথুন। মাইকেলকে চিঠি লিখে দেশে ফিরে আসতে বলেন এবং বাংলায় কাব্যরচনা করতে পরামর্শ দেন। ১৮৫৬ সালে মধুসূদন কলকাতায় ফিরে আসেন। ততদিনে মাইকেল মধুসূদন দত্তের পিতামাতা উভয়ের মৃত্যু হয়। স্ত্রী হেনরিয়েটাকে সেই সময় তিনি সঙ্গে আনেন নি। তিনি কলকাতায় প্রথমে পুলিশ কোর্টের কেরানী এবং পরে দোভাষীর কাজ করেন। এ সময় বিভিন্ন পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখেও তিনি প্রচুর অর্থোপার্জন করেন।

১৮৫৯ সালে কবি ইংল্যান্ডে আইন বিষয়ে পড়াশোনা করতে যান। কিন্তু সেখানের আবহাওয়া এবং বর্ণবাদীতার কারণে বেশিদিন ইংল্যান্ডে থাকেন নি। তারপর তিনি ১৮৬০ সালে ফ্রান্সের ভার্সাই নগরীতে চলে যান। কিন্তু তার আর্থিক অবস্থা ছিল খুব খারাপ। একমাত্র ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১) এর জন্য তিনি আইন পড়া শেষ করে ভারতে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন।

১৮৬৭ সালে দেশে ফিরে তিনি কলকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসায় যোগ দেন। কিন্তু ওকালতিতে সুবিধে করতে না পেরে ১৮৭০ সালে মাসিক এক হাজার টাকা বেতনে হাইকোর্টের অনুবাদ বিভাগে যোগদান করেন। দুবছর পর এ চাকুরী ছেড়ে তিনি পুনরায় আইন ব্যবসা শুরু করেন। এবারে তিনি সফল হন। কিন্তু অমিতব্যয়িতার কারণে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন। একই কারণে তিনি বিদেশে অবস্থানকালেও বিপদগ্রস্ত হয়েছিলেন। বিদ্যাসাগরের আনুকূল্যে সেবার উদ্ধার পান। ১৮৭২ সালে মধুসূদন কিছুদিন পঞ্চকোটের রাজা নীলমণি সিংহ দেও-এর ম্যানেজার ছিলেন।

মধুসূদন দত্ত তাঁর সাহিত্য জীবনে বিশেষ করে ইংরেজ কবি লর্ড বায়রন (১৭৮৮-১৮২৪) এর সাহিত্যকর্ম এবং তাঁর জীবন দ্বারা অত্যন্ত বেশি অনুপ্রাণিত হয়ে ছিলেন। এসময় তাঁর মহান সৃষ্টি মেঘনাদবধ (১৮৬০) মহাকাব্য প্রকাশ করেন। যদিও এটি প্রকাশ করা এবং পরিচিত করে তোলা খুব সহজ ছিল না। তারপরও তিনি নিজেকে মহাকাব্যটির মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে এক স্বতন্ত্রভাব প্রকাশ করেছিলেন। তারই অংশ হিসেবে তিনি কাব্যে প্রথম হোমেরিক স্টাইলের লেখার প্রবর্তন করেন। তিনি একইসাথে ৪টি কাব্যগ্রন্থ রচনা করেছিলেন বলে জানা যায়। যদিও তৎকালীন অনুন্নত প্রেস ব্যবস্থার কারণে কাব্যগ্রন্থগুলোর প্রকাশকাল হয়ে যায় ভিন্ন। কাব্যগ্রন্থগুলো হলোঃ তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য (১৮৬০), ব্রজাঙ্গনা কাব্য (১৮৬১), মেঘনাদবধ কাব্য (১৮৬১), বীরাঙ্গনা কাব্য (১৮৬২)।

তিনি এক সময় নিজেকে বলেছিলেন : "আমি এক সকালে উঠে নিজেকে সফল হিসেবে পাই নি, এই কাব্যের সফলতা বহু বছরের কঠিন পরিশ্রমের মাধ্যমেই সম্ভব হয়েছে।"

মাইকেল মধুসূদন দত্ত ছিলেন বহু ভাষাবিদ। শিশুকালে গ্রামের টোল থেকে ফারসী ভাষা শিক্ষার মাধ্যমে তার ভাষা শিক্ষার শুরু হয়। মাতৃভাষা ছাড়া তিনি আরো বারোটি ভাষা জানতেন। তিনি ইংরেজী ছাড়াও ল্যাটিন, গ্রীক, ফারসী, হিব্রু, ইটালীয়, তেলুগু, তামিল ইত্যাদি ভাষায় অনায়াসে কথা বলতে পারতেন। এমনকি তিনি ফারসী ও ইটালীয় ভাষায় কবিতাও লিখতে পারতেন।

বাংলা নাটকে মাইকেল মধুসূদনের আবির্ভাব আকস্মিকভাবে। ১৮৫২ সালে রামনারায়ণ তর্করত্ন (১৮২২-১৮৮৬), তারাচরণ শিকদার এবং জে. সি. গুপ্তের হাত ধরে বাংলায় শৌখিন রঙ্গমঞ্চে নাট্য মঞ্চায়ন শুরু হয়। এই সময় লেখা নাটকগুলির গুণগত মান খুব ভালো ছিল না। ১৮৫৮ সালে পাইকপাড়ার জমিদার ঈশ্বরচন্দ্র সিংহ ও প্রতাপচন্দ্র সিংহের পৃষ্ঠপোষকতায় কলকাতার বেলগাছিয়া নাট্যমঞ্চে রামনারায়ণ তর্করত্নের "রত্নাবলী" নাটকটি অভিনীত হয়। শিল্পগুণবিবর্জিত এই সাধারণ নাটকটির জন্য জমিদারদের বিপুল অর্থব্যয় ও উৎসাহ দেখে মাইকেল মধুসূদন দত্তের শিক্ষিত মন ব্যথিত হয়ে ওঠে। এরপর তিনি নিজেই নাট্যরচনায় ব্রতী হন। রামনারায়ণ তর্করত্ন (১৮২২-১৮৮৬) এর সংস্কৃত নাট্যশৈলীর প্রথা ভেঙে তিনি পাশ্চাত্য শৈলীর অনুসরণে প্রথম আধুনিক বাংলা নাটক রচনা করেন।

মাইকেল মধুসূদনের নাট্যচর্চার কাল ও রচিত নাটকের সংখ্যা দুই-ই সীমিত। ১৮৫৯ থেকে ১৮৬১ - এই তিন বছর তিনি নাট্যচর্চা করেন। এই সময়ে তার রচিত নাটকগুলি হলঃ শর্মিষ্ঠা (১৮৫৯), একেই কি বলে সভ্যতা (১৮৬০), বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ (১৮৬০), পদ্মাবতী (১৮৬০), কৃষ্ণকুমারী (১৮৬১)। এছাড়া মৃত্যুর পূর্বে মায়াকানন (১৮৭৪) নামে একটি নাটক রচনা শুরু করেছিলেন। তবে তা অসমাপ্ত থেকে যায়। বাংলা সাহিত্যে পত্রাকাব্য প্রথম দেখা যায় বীরাঙ্গনা কাব্যে। ১৮৬২ সালে এই গ্রন্থ প্রকাশিত হয়।

মাইকেল মধুসূদন দত্তের শেষ জীবন চরম দুঃখ ও দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়। আইন ব্যবসায়ে তিনি তেমন সাফল্য লাভ করতে পারেন নি। তাছাড়া অমিতব্যয়ী স্বভাবের জন্য তিনি ঋণগ্রস্তও হয়ে পড়েন।
শেষজীবনে তিনি উত্তরপাড়ার জমিদারদের লাইব্রেরি ঘরে বসবাস করতেন। ১৮৭৩ সালের ২৯ জুন কলকাতার আলীপুর জেনারেল হাসপাতালে কপর্দকহীনভাবে মাত্র ৪৯ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাকে কলকাতার সার্কুলার রোডে সমাধী দেওয়া হয়। উনবিংশ শতাব্দীর বাংলা ভাষার আধুনিক কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত জীবনের অন্তিম পর্যায়ে রেখে যান অবিস্মরণীয় এই পংক্তিমালা-

'দাঁড়াও পথিকবর, জন্ম যদি তব
বঙ্গে! তিষ্ঠ ক্ষণকাল! এ সমাধি স্থলে
(জননীর কোলে শিশু লভয়ে যেমতি
বিরাম) মহীর পদে মহা নিদ্রাবৃত
দত্তকুলোদ্ভব কবি শ্রীমধুসূদন!
যশোরে সাগরদাঁড়ি কপোতাক্ষ-তীরে
জন্মভূমি, জন্মদাতা দত্ত মহামতি
রাজনারায়ণ নামে, জননী জাহ্নবী'

মাইকেল মধুসূদন দত্ত রচিত গ্রন্থাবলীর মধ্যে রয়েছে -

বাংলা রচনা- নাটক ও প্রহসন: শর্মিষ্ঠা নাটক (১৮৫৯), একেই কি বলে সভ্যতা? (প্রহসন; ১৮৬০), বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ (প্রহসন; ১৮৬০), পদ্মাবতী নাটক (১৮৬০), কৃষ্ণকুমারী নাটক (১৮৬১), মায়া-কানন (১৮৭৪)। কাব্য: তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য (আখ্যান কাব্য; ১৮৬০), মেঘনাদবধ কাব্য (মহাকাব্য; ১৮৬১), ব্রজাঙ্গনা কাব্য (গীতিকাব্য; ১৮৬১), বীরাঙ্গনা কাব্য (পত্রকাব্য; ১৮৬২), চতুর্দশপদী কবিতাবলী (সনেট; ১৮৬৫)। অনুবাদ গ্রন্থ: হেক্‌টর-বধ (১৮৭১)।

ইংরেজী রচনা- কাব্য: কালেক্টেড পোয়েমস, দি অপ্সরি: আ স্টোরি ফ্রম হিন্দু মিথোলজি, দ্য ক্যাপটিভ লেডি, ভিশনস অফ দ্য পাস্ট। কাব্যনাট্য: রিজিয়া: ইমপ্রেস অফ ইন্ডে। অনুবাদ নাটক: রত্নাবলী, শর্মিষ্ঠা, নীল দর্পণ অর দি ইন্ডিগো প্ল্যান্টিং মিরর। প্রবন্ধ সাহিত্য: দি অ্যাংলো-স্যাক্সন অ্যান্ড দ্য হিন্দু,অন পোয়েট্রি এটসেট্রা, অ্যান এসে। অন্যান্য রচনার মধ্যে রয়েছে- আ সাইনপসিস অফ দ্য রুক্মিণী হরণ নাটক।


বিভাগ : সাহিত্য


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের গল্প
গণ-অভ্যুত্থান ২০২৪ : সাহিত্য সংস্কৃতি ভাবনা
প্রার্থনার মূল কাজ সংযোগ স্থাপন
গ্রাফিতি বাংলাদেশ
তোমাকে
আরও

আরও পড়ুন

বাংলাদেশের বিপক্ষে যে একাদশ দিয়ে মাঠে নামছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ

বাংলাদেশের বিপক্ষে যে একাদশ দিয়ে মাঠে নামছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ

কিশোরগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা আনোয়ার কামালসহ তিনজন গ্রেফতার

কিশোরগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা আনোয়ার কামালসহ তিনজন গ্রেফতার

প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানের সাক্ষাৎ

প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানের সাক্ষাৎ

বেইজিং সংস্কৃতি ও পর্যটন ব্যুরো ও আটাবের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত

বেইজিং সংস্কৃতি ও পর্যটন ব্যুরো ও আটাবের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত

উইন্ডিজের বিপক্ষে মাঠে নামছে বাংলাদেশ

উইন্ডিজের বিপক্ষে মাঠে নামছে বাংলাদেশ

গাজায় যুদ্ধবিরতি ছাড়া বন্দী বিনিময় হবে না : হামাস

গাজায় যুদ্ধবিরতি ছাড়া বন্দী বিনিময় হবে না : হামাস

শান্তিরক্ষা মিশন মোতায়েন করতে চায় জাতিসংঘ হাইতিতে

শান্তিরক্ষা মিশন মোতায়েন করতে চায় জাতিসংঘ হাইতিতে

চকরিয়ার বিএনপি নেতা আবু তাহের চৌধুরীর মৃত্যুতে সালাহউদ্দিন আহমদ ও হাসিনা আহমদের শোক

চকরিয়ার বিএনপি নেতা আবু তাহের চৌধুরীর মৃত্যুতে সালাহউদ্দিন আহমদ ও হাসিনা আহমদের শোক

পুতিন পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে দ্বিধা করবেন না : সার্বিয়া

পুতিন পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে দ্বিধা করবেন না : সার্বিয়া

ক্লাইমেট অর্থায়ন ইস্যুতে দেশগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব

ক্লাইমেট অর্থায়ন ইস্যুতে দেশগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব

লালমোহনে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত যুবদল নেতা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু

লালমোহনে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত যুবদল নেতা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু

ট্রাম্পের অ্যাটর্নির বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন আটকে গেল

ট্রাম্পের অ্যাটর্নির বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন আটকে গেল

‘ফিলিস্তিনের পর ইরান, সউদী ও তুরস্ক হবে পরবর্তী টার্গেট’

‘ফিলিস্তিনের পর ইরান, সউদী ও তুরস্ক হবে পরবর্তী টার্গেট’

প্রতি বছর ৩ লাখ নথিবিহীন অভিবাসীকে বৈধতা দানের ঘোষণা স্পেনের

প্রতি বছর ৩ লাখ নথিবিহীন অভিবাসীকে বৈধতা দানের ঘোষণা স্পেনের

প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে সবচেয়ে অসুখী দেশ জাপান-কোরিয়া

প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে সবচেয়ে অসুখী দেশ জাপান-কোরিয়া

মুসলিম চিকিৎসক

মুসলিম চিকিৎসক

শীর্ষে দিল্লি

শীর্ষে দিল্লি

সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সংবর্ধনা

সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সংবর্ধনা

ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর বোর্ড অব গভর্নর সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সম্বর্ধনা

ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর বোর্ড অব গভর্নর সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সম্বর্ধনা

বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার আহ্বান

বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার আহ্বান