এনসিটিবিতে বই পরিমার্জনের দায়িত্বপ্রাপ্তরা পাঠ্যবইয়ে জুলাই অভ্যুত্থান যথাযথভাবে তুলে ধরতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন বলে মন্তব্য করেছে শিক্ষা অধিকার সংসদের বিশেষজ্ঞরা। পাঠ্যবইয়ে জুলাই অভ্যুত্থানের প্রতিফলন না হওয়া, ইতিহাস বিকৃতি, ব্যবহৃত ছবি নিয়ে প্রশ্ন ও মানহীনতা, বইয়ের অপ্রাসঙ্গিক প্রচ্ছদ এবং বিষয়বস্তু যথার্থভাবে আসেনি বলে মন্তব্য করেন তারা।
শুক্রবার (২৪ জানুয়ারি) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসা শিক্ষা অনুষদের ড. আব্দুল্লাহ ফারক সম্মেলন কক্ষে ‘২০২৫ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যবইয়ে চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান পর্যালোচনা’ শীর্ষক শিক্ষা অধিকার সংসদের এক সেমিনারে এসব কথা বলেন বক্তারা। শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থান নিয়ে নগণ্য কন্টেন্ট যুক্ত হলেও সেগুলোতে ভুল থাকাসহ দায়সারাভাবে এমনভাবে সেগুলো এসেছে যে, এগুলো ইতিহাসের বিচারে বেশিদিন টিকবে না। তার দায় এনসিটিবি দায়িত্বশীল ও পরামর্জনকারীরা এড়াতে পারে না।
সেমিনারে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এবং কারিকুলাম কোঅর্ডিনেশন কমিটি ও বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের সদস্য ড. সৈয়দা সুলতানা রাজিয়া, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রফেসর ড. মনিনুর রশিদ ও প্রফেসর ড. আহসান হাবীব, জাতীয় নাগরিক কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক ড. আতিক মুজাহিদ ও নাগরিক কমিটির শিক্ষা সেলের পরিচালক ফয়সাল মাহমুদ শান্ত, শহীদ শাহরিয়ার খান আনাসের মা সানজিদা খান দিপ্তী, শহীদ ইকরামুল হক সাজিদের বোন ফারজানা হক, ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরীফ ওসমান বিন হাদি, জুলাই বিপ্লব পরিষদের আহ্বায়ক সৌরভ ফাহিম প্রমুখ।
সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন শিক্ষা অধিকার সংসদের আহ্বায়ক ও নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটির প্রফেসরিয়াল ফেলো প্রফেসর ড. নিয়াজ আসাদুল্লাহ। ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যবইয়ের পর্যালোচনা উপস্থাপন করেন শিক্ষা অধিকার সংসদের সদস্য সচিব ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী প্রফেসর মো. শাহনেওয়াজ খান চন্দন। শহীদ শাহরিয়ার খান আনাসের মা সানজিদা খান দিপ্তী বলেন, চব্বিশকে ব্যর্থ করে দিতে যারা কাজ করছেন, তাদের অন্যতম রাখাল রাহা। এবারের পাঠ্যবইয়ের কাজই তার প্রমাণ। আনাসের চিঠি কেন নাই। আবু সাঈদ ও মুগ্ধের পাশাপাশি শহীদ আনাসের চিঠি থাকা জরুরি ছিল। আনাসের মতো নিস্বার্থ অকুতোভয় সৈনিক জুলাই অভ্যুত্থানের অসংখ্য শিক্ষার্থীর প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল। শিক্ষার্থীদের সে ইতিহাস জানাতে হবে।
শহীদ একরামুল হক সাজিদের বোন ফারজানা হক বলেন, শহীদ আনাসের মায়ের যে দুঃখ সেটা আমাদেরও। পাঠ্যপুস্তকে চাপে পড়ে কিছু ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু এমনভাবে উপস্থাপনা করা হয়েছে যে, কয়েক বছর পর জুলাই অভ্যুত্থানের ইতিহাস যাতে মুছে ফেলতে পারে। এ বছর যদিও সময়ের অজুহাতও দেওয়া হয়েছে, আগামী দিনে যেন শহীদদের নামগুলো পাঠ্যপুস্তকে পাওয়া যায়। এই প্রজন্ম যেন জুলাই অভ্যুত্থানের ইতিহাস থেকে বঞ্চিত না হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রফেসর ও জাতীয় পাঠ্যপুস্তক কমিটির অন্যতম সদস্য ড. মনিনুর রশিদ বলেন, পাঠ্যবই শতভাগ সঠিক ছাপানো কঠিন। এখানে ক্রিটিসিজম থাকবে, সেগুলো মেনে নেওয়ার মানসিক থাকা দরকার। আমি নিজেও একটা কমিটির সদস্য, সেখানে বলা হয়েছে, যাতে শহীদের বিষয় সঠিকভাবে ডকুমেন্টেড করা হয়। কিন্তু সেভাবে হয়নি। বাংলাদেশের প্রতিটি শহীদই গুরুত্বপূর্ণ। শহীদদের মধ্যে যেন বৈষম্য না হয়। যখন যারা ক্ষমতায় তখন তারা ভুলে যায়।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এবং কারিকুলাম কোঅর্ডিনেশন কমিটি ও বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের সদস্য ড. সৈয়দা সুলতানা রাজিয়া বলেন, কারিকুলামের কমিটিতে আমাদের একটা মাত্র মিটিং হয়েছে। আমরা কীভাবে পরিবর্তন আনবো? যারা লিখবেন, রিভিউ করবেন তাদেরই মূল দায়িত্ব। তাছাড়া শিক্ষা কমিশন গঠন করা জরুরি। শিক্ষা অধিকার সংসদ এভাবে সুপারিশ দিতে পারে কিন্তু কতটা বাস্তবায়ন হবে। জুলাই গণঅভ্যুত্থান পাঠ্যপুস্তকেও আনতে চাই কিন্তু সেটা কত শতাংশ? চব্বিশের ঘটনার গুরুত্ব দিতে হবে। কিন্তু ধারণা থাকতে হবে, কিভাবে আমরা একে সঠিকভাবে কনটেকচুয়ালাই করবো। ২০১২ এর পাঠ্যপুস্তকে যে ফিরে গেলাম, তার মানে আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি। এখন নতুন বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পাঠ্যপুস্তক করতে হবে।
শিক্ষা অধিকার সংসদের আহ্বায়ক ড. আসাদুল্লাহ বলেন, পাঠ্যপুস্তকে অসঙ্গতির বহুমাত্রিক দিক উঠে এসেছে। এটা নতুন নয়। ফ্যাসিস্ট সরকারের সময়কার শিক্ষার সংকট এখনও কাটেনি। যে ধরনের পরিবর্তন দরকার, সেভাবে হচ্ছে না। শিক্ষার দায়িত্বে যারা আছে তাহলে তারা কী করছেন? এখানে নীতির সমস্যা নাকি নেতৃত্বের সমস্যা? আজকের মতো এ ধরণের অনেক আলোচনা হচ্ছে কিন্তু বাস্তবায়ন নাই। অন্তর্ভূক্তিমূলক পাঠ্যক্রমের জন্য নেতৃত্বের পরিবর্তন জরুরি। শিক্ষা ক্ষেত্রে গুণগত পরিবর্তনে আমরা কাজ অব্যাহত রাখবে।
সেমিনারে আরও বক্তব্য রাখেন জাতীয় নাগরিক কমিটির শিক্ষা ও গবেষণা সেল সম্পাদক ফয়সাল মাহমুদ শান্ত, জাতীয় নাগরিক কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক ড. আতিক মুজাহিদ, ঢাবির শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রফেসর ড. আহসান হাবীব। আরো উপস্থিত ছিলেন শিক্ষা অধিকার সংসদের অ্যডভোকেসি কোঅর্ডিনেটর মিসবাহুর রহমান আসিম, মিডিয়া কোঅর্ডিনেটর মাহফুজুর রহমান মানকি ও অফিস কোঅর্ডিনেটর মিনহাজুল আবেদিন।