ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে বাংলাদেশে
০৯ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০১ এএম | আপডেট: ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০১ এএম
জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশে বছরজুড়েই ছিল প্রকৃতির বৈরী আচরণ। তাপমাত্রার পারদ ওঠানামা ছিল ৪৩-৪৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ঘরে। রেকর্ডমাত্রার তাপপ্রবাহ, অতিবৃষ্টি, ভারী বৃষ্টি, ভারতের ঢলে সৃষ্ট বন্যা, ভূমিধস, বজ্রপাত, ঘন ঘন ভূমিকম্পসহ এ বছর বেশ কয়েকটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয়েছে দেশের মানুষ। এসব দুর্যোগে কয়েকশ মানুষ মারা গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে লাখ লাখ মানুষ। ঘরবাড়ি, সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা, রাস্তাঘাট, ফসলি জমির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। প্রকৃতির বৈরী আচরণের নমুনু এখনো শেষ হয়নি। আবহাওয়াবিদরা বলছেন চলতি নভেম্বর মাসেও বঙ্গোপসাগরে ১ থেকে ৩টি লঘুচাপ সৃষ্টি হতে পারে। যার মধ্যে একটি নি¤œচাপ ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিতে পারে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) কমে যাওয়া নিয়ে বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের জিডিপিতে কৃষিখাত যতটা অবদান রাখছে তার এক-তৃতীয়াংশই হারিয়ে যাবে। কৃষিখাতের অবদান ১২ থেকে ১৫ শতাংশের মধ্যে অবস্থান করছে, যেটি কমে ৮ থেকে ১০ শতাংশে পৌঁছাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এছাড়া ২০৫০ সাল অব্দি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ জলবায়ু অভিবাসীর সংখ্যা প্রায় ২ কোটি ছাড়িয়ে যাওয়ার শঙ্কার কথাও জানিয়েছে সংস্থাটি। অন্যদিকে, ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইআইইডি) নামে একটি থিঙ্ক ট্যাংক এক গবেষণা প্রতিবেদনে জানায়, প্রতি বছর বাংলাদেশে প্রায় দুই বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ হয় কেবল জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়িঘর মেরামত করতে। বিশেষ করে উপকূলীয় অঞ্চলে মাথাপিছু ৬ হাজার ৬৮০ টাকা প্রতি বছর একটি পরিবারকে শুধু তাদের বাসস্থান মেরামতের জন্য ব্যয় করতে হয়।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ না থাকলেও অস্বাভাবিক শীতের অনুভূতির কথা জানিয়েছিলেন বিভিন্ন স্তরের মানুষ। আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, এ বছর জানুয়ারিতে বেশি শীতের অন্যতম কারণ ছিল দীর্ঘ সময় ধরে কুয়াশা পড়া। অন্য বছরের তুলনায় এবার দীর্ঘ সময় ধরে ঘন কুয়াশা পড়তে দেখা গেছে। কোথাও কোথাও ১৮ থেকে ২০ ঘণ্টা পর্যন্ত কুয়াশা ছিল। এই দীর্ঘ সময়ের কুয়াশার কারণে সূর্যের কিরণকাল কমে এসেছে। স্বাভাবিক সময়ে সূর্যের কিরণকাল ৮ থেকে ১২ ঘণ্টা হলেও এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে তিন-চার ঘণ্টায়। এতে ভূপৃষ্ঠ উত্তপ্ত হতে না পারায় দিনের ও রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য অনেকটাই কমে গেছে। ফলে শীতও বেশি অনুভূত হয়।
চলতি বছরের এপ্রিল মাসে স্মরণকালের ভয়াবহ তাপপ্রবাহ ভুগিয়েছে দেশের মানুষকে। তাপমাত্রা ওঠে ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। এ বছর ৩০ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গা জেলায় ৪৩ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়, যা গত ২৯ বছর সর্বোচ্চ। এর আগে ১৯৯৫ সালের ১ মে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ৪৩ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এছাড়া এবার এপ্রিল মাসে টানা ২৬ দিন যে তাপপ্রবাহ হয়েছে, তা গত ৭৬ বছরে হয়নি। তীব্র তাপদাহে এ বছর মৃত্যুর সংখ্যাও বেড়েছে। শুধু এপ্রিলেই মারা গেছে প্রায় ১৫ জন মানুষ।
শুধু তাপপ্রবাহ নয়। এর প্রভাব কাটতে না কাটতেই সাগরে ঘূর্ণিঝড়। এই ঘূর্ণিঝড় রিমাল দীর্ঘক্ষণ বাংলাদেশে অবস্থান করে ক্ষতির মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। ২৬ সন্ধ্যা থেকে ২৭ মে সকাল নাগাদ স্থলভাগ অতিক্রম করে এই ঝড়। ঘূর্ণিঝড় রিমাল উপকূলে আঘাত হানার পর থেকে প্রায় ৫০ ঘণ্টা পর্যন্ত বাংলাদেশে অবস্থান করে। রিমাল বিপজ্জনক সাইক্লোন ছিল না। কিন্তু তারপরও এর এত দীর্ঘ স্থায়িত্বকাল ক্ষতির পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে দেশের সাত জেলায় ১৬ জন মানুষ মারা যায়। রিমালের তা-বে উপকূলের ছয় জেলার ১৫টি উপজেলায় ৬৯ হাজার ৭৮৮ মেট্রিক টন মাছ ভেসে গেছে। এছাড়া অতিবৃষ্টিতে ১ লাখ ৭১ হাজার ১০৯ হেক্টর ফসলি জমির ক্ষতি হয়েছে। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, রিমাল দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার অন্যতম কারণ হলো জলবায়ু পরিবর্তন। এছাড়া বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে বঙ্গোপসাগরে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর পাশাপাশি ভূমির তাপমাত্রাও বৃদ্ধি পেয়েছে। এ দুইয়ের গরমিলের কারণে এটির শক্তিমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। রিমালের তা-বে উপকূলীয় ১৯টি জেলার প্রায় ৪৬ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পৌনে দুই লাখ বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয়েছে।
চলতি বছর আকস্মিক বন্যায় চরম ক্ষতিগ্রস্ত দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের মানুষ। এর আগে সর্বশেষ ১৯৮৮ সালে ভয়াবহ বন্যার মুখোমুখি হয়েছিলেন ফেনীর মানুষ। গত ৩৬ বছরে অনেকবার বন্যা হলেও এ ধরনের ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়নি তাদের। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডি জানিয়েছে, দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে সাম্প্রতিক ভয়াবহ বন্যায় ১৪ হাজার ৪২১ কোটি টাকা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, যা জিডিপির দশমিক ২৬ শতাংশ। এরমধ্যে কৃষি ও বন খাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে। জেলা হিসাবে নোয়াখালীতে সবচেয়ে ক্ষতি হয়েছে। এই ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৪ হাজার ১৯১ কোটি টাকা। চলতি বছরে ফেনীতে বন্যা পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি হলেও টানা দুই মাসের বেশি সময় ধরে বন্যার পানিতে সীমাহীন কষ্টে জর্জরিত ছিল নোয়াখালী-লক্ষ্মীপুরের ২০ লাখেরও বেশি বাসিন্দা। আগস্ট মাস থেকে কিছুদিন পরপর সাগরে সৃষ্ট লঘুচাপের প্রভাবে টানা বৃষ্টি ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ ছিল এ অঞ্চলের বাসিন্দাদের জন্য। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুর অঞ্চলের রেকর্ড বৃষ্টি এই অঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত করেছে।
জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক বিশেষজ্ঞ ও ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ইনটেনসিটি, ফ্রিকোয়েন্সি, টাইমিং, ন্যাচার সবই এখন বদলাচ্ছে। এটা পৃথিবীজুড়েই হচ্ছে। বৈশ্বিক তাপমাত্রা দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, তাপমাত্রা ৩ ডিগ্রিতে যখন উঠবে, তখন সবকিছু আন প্রেডিকটেবল হয়ে যাবে। ফলে পূর্বাভাস দেওয়াও অসম্ভব হয়ে পড়বে। তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশে যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়বে, এটা ঠেকানোর উপায় নেই। এটা হবেই। কারণ বিষয়টা হচ্ছে বৈশ্বিক পর্যায়ে। এই যে আশ্বিন মাসেও এত তাপমাত্রা ছিল, এগুলো মনিটরিং করতে হবে। গতানুগতিক হলে চলবে না। নতুন করে মাস্টারপ্ল্যান করে চলতে হবে। আমরা কম কার্বন নিঃসরণ করেও ক্ষতিগ্রস্ত। উন্নত বিশ্বের সঙ্গে আমাদের অ্যাডাপটেশন প্ল্যান করতে হবে। আইনুন নিশাত বলেন, ২০১৭ সাল থেকে দু-তিনটি বন্যায় ফসল উৎপাদন কমেছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে পরাগায়ন প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে। এই যে বছরজুড়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগ গেলো এতে সবচেয়ে বড় বিষয় হলো খাদ্যনিরাপত্তার শঙ্কা। আবার বন্যার সময় আমন ধান লাগাতে পারেনি লাখ লাখ কৃষক। এই মৌসুমি ফসলগুলোর বীজ লাগানোর একটা সময় রয়েছে। নির্দিষ্ট সময়ে বীজ না লাগালে ভালো ফসল হয় না। এ বছর নোয়াখালী, কুমিল্লা অঞ্চলে যে বন্যা হলো কৃষি মন্ত্রণালয়ের কাজ ছিল রংপুর, দিনাজপুর অঞ্চল থেকে ধানের চারা এনে এই অঞ্চলের জন্য প্রস্তুত রাখা যেন পানি নামার সঙ্গে সঙ্গে চারা রোপণ করতে পারে। কিন্তু তারা সেটি করেনি। এখন জরুরি হলো দুর্যোগের কারণে ফসলের ধরন পর্যায়ক্রম বদলাতে হবে।
স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান বলেন, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এখন বিশ্বজুড়ে। ফলে একের পর এক হিটওয়েভ (তাপপ্রবাহ), কোল্ডওয়েভ (শৈত্যপ্রবাহ), ভারী বৃষ্টিপাত, সাগরে ঘূর্ণিঝড়, আকস্মিক বন্যা হচ্ছে। অন্যদিকে, জলবায়ুর যে পরিবর্তন, সেটির সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় পরিবেশ বিধ্বংসী যে কার্যকলাপ সেগুলো জলবায়ু পরিবর্তনকে আরও বিরূপ পরিস্থিতির দিকে নিচ্ছে। তিনি বলেন, জলবায়ুর পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব কমাতে হলে স্থানীয়ভাবে জলাধার সংরক্ষণ, বৃক্ষরোপণ, শহরে পর্যাপ্ত খোলা জায়গা রাখা, ভবন নির্মাণে চারপাশ খালি রাখা, জীবাশ্ম জ্বালানি কমিয়ে আনা দরকার। নবায়নযোগ্য জ্বালানি বাড়ানো ও দূষণ-দখল বন্ধ করতে হবে।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
পিটিআইয়ের বিক্ষোভের ডাক,লকডাউন ইসলামাবাদে
জাবিতে অটোরিকশার ধাক্কায় শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনায় সন্দেহভাজন রিকশা চালক আটক
আজ কিশোরগঞ্জের দানবীর, শিক্ষানুরাগী ওয়ালী নেওয়াজ খান এর ৩৮তম মৃত্যুবার্ষিকী
'দুর্বল' দলের বিপক্ষে পয়েন্ট হারাল ইউনাইটেড
সালাহর জোড়া গোলে লিভারপুলের জয়
গুমের দায়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ২২ সদস্য চাকরিচ্যুত
কুরস্ক অঞ্চলের ৪০ ভাগ খোয়ানোর স্বীকারোক্তি ইউক্রেনের
মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে বাংলাদেশ চীনের সাথে কাজ করতে আগ্রহী: বাণিজ্য উপদেষ্টা
হাজীদের সর্বোত্তম স্বার্থ রক্ষায় সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ধর্ম উপদেষ্টা ড. খালিদ হোসেন
শরীয়তপুরে যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদলের যৌথ কর্মী সভা
মানিকগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় সিকিউরিটি গার্ড নিহত
পাকিস্তানকে উড়িয়ে দিল জিম্বাবুয়ে
১৫ দিন রিমান্ড শেষে কারাগারে আব্দুর রাজ্জাক
লক্ষ্মীপুরে ১২০ টাকায় পুলিশে চাকরি পেলেন ৫০ জন
নির্বাচিত সরকারই দেশকে পুনর্গঠন করতে পারে : তারেক রহমান
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন জেলা কমিটিতে অচেনা ৭ জন
মৌলভীবাজারে কৃষি ও প্রযুক্তি মেলা শুরু
দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের মডেল উদ্ভাবন
ব্রহ্মপুত্রে অবৈধ ড্রেজার বসিয়ে চলছে বালু ব্যবসা
বাঘায় কৃষি শ্রমিককে গলা কেটে হত্যা