নকল প্রসাধনীতে সয়লাব
০৯ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০১ এএম | আপডেট: ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০১ এএম
রাজধানী ঢাকার গুলিস্তান, নিউ মার্কেট, ফার্মগেইট, মহাখালি, যাত্রাবাড়ি, মিরপুরসহ বিভিন্ন স্পটে ফুটপাতে থরে থরে সাজানো প্রসাধনী বিক্রী হচ্ছে। ঝকঝকে তকতকে দেশি-বিদেশী ব্যান্ডের দামি দামি এসব প্রসাধনী নকল এবং মানহীন। এসব কম পয়সায় বিক্রী হওয়া এসব প্রসাধনী ব্যবহার করলে চর্মরোগসহ নানা রোগব্যাধি হতে পারে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে এ ধরণের প্রসাধনী ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
জীবনযাত্রার মান উন্নতির সঙ্গে মানুষের চাহিদার ফর্দ বড় হচ্ছে। মানুষের সৌন্দর্য সচেতনতা বেড়ে গেছে। এ কারণে বাড়ছে প্রসাধনী সামগ্রীর ব্যবহার আগের চেয়ে বেড়েছে। ফলে ব্যাপকহারে বাড়ছে প্রসাধনী পণ্যের চাহিদা। চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ভেজাল, নকল, মানহীন, অনুমোদনহীন ও মেয়াদোত্তীর্ণ প্রসাধনী সামগ্রী। দেশে ওষুধ ও কসমেটিকস আইন প্রণয়ন হলেও নিয়ন্ত্রণহীনভাবে চলছে প্রসাধনী শিল্পের বাজার।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নকল ও মানহীন পণ্য ব্যবহার করে একদিকে ভোক্তারা যেমন স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়েছেন তেমনি ব্যবসায়ীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। অন্যদিকে অবৈধ পথে কসমেটিকস পণ্য দেশে আসার কারণে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাই দেশের নকল পণ্য এবং বিদেশ থেকে চোরাই পথে আসা পণ্যের বিরুদ্ধে সরকারকে কঠোর নজরদারির ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এতে ভোক্তা, বৈধ পণ্য উৎপাদনকারী ও দেশের জন্যও মঙ্গল হবে।
নকল পণ্য ব্যবহারের ফলে ভোক্তাদের ত্বকের ক্ষতি প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপ-উপাচার্য এবং চর্ম ও যৌন রোগ বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ শিকদার বলেন, আমাদের কাছে মুখের ত্বকে দাগ পড়া, কিংবা কালো হয়ে যাওয়া যে রোগী আসে হরমোনাল সমস্যা ছাড়া, তার ৬০ শতাংশের বেশিই বিভিন্ন রকম প্রসাধনী, আর্টিফিশিয়াল উপাদান ব্যবহারের কারণে হয়। এছাড়া খাওয়া-দাওয়া এবং রোদে যাবার কারণেও মুখে দাগ পড়তে পারে।
অনুসন্ধান করে জানা গেছে, দেশে কিছু অসাধু চক্রের সমন্বয়ে নকল, ভেজাল, মানহীন কসমেটিকস পণ্য উৎপাদন হচ্ছে। রাজধানী ঢাকার চকবাজার, মৌলভীবাজার, কেরানীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, মানিকগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় রয়েছে নকল কসমেটিকস তৈরির কারখানা। চরম গোপনীয়তার সঙ্গে এসব কারখানায় চলে নকল পণ্য উৎপাদনের মহোৎসব। এরপর তা ছড়িয়ে দেওয়া হয় ঢাকাসহ সারা দেশে।
পুরান ঢাকার চকবাজার, মৌলভীবাজারসহ বিভিন্ন মার্কেটে প্রকাশ্যেই বিক্রি হয় বিভিন্ন নামি-দামি ব্রান্ডের নকল প্রসাধনী। ভোক্তা অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে প্রায়ই এসব স্থানে অভিযান পরিচালনা করে জরিমানাও করা হয়। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ভোক্তা অধিদপ্তরের সদ্য সাবেক ডিজি বলেন, বাংলাদেশে এমন কোনো কসমেটিকস পণ্য নেই যা নকল হয় না।
এছাড়া ভারত থেকে চোরাই পথে দেশে বিপুল পরিমাণ মানহীন প্রসাধনী প্রবেশ করছে। অবৈধভাবে কিংবা লাগেজে যে পণ্যগুলো আসছে, সেগুলোর কোথাও আমদানিকারকের কোনো তথ্য থাকে না, থাকে না বিএসটিআই লোগো।
দেশি-বিদেশি বিখ্যাত সব ব্র্যান্ডের প্রসাধনীর পরিত্যক্ত কৌটাতে নকল প্রসাধনী ঢুকিয়েও বিক্রি করা হচ্ছে। আবার বিদেশ থেকে নকল মোড়ক এনেও তৈরি করা হচ্ছে কসমেটিকস পণ্য। দেশি-বিদেশি কসমেটিকসের কোনটি আসল আর কোনটি নকল, তা নিশ্চিত করা কঠিন।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী দেশের নকল কসমেটিকসের রমরমা ব্যবসা নিয়ে বলেন, যে পণ্যগুলো কাস্টমসের মাধ্যমে দেশে আসে সেগুলো ছাড়া বিদেশ থেকে আসা বেশির ভাগ পণ্যই ভেজাল, মেয়াদোত্তীর্ণ। এছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে হাটে-মাঠে-ঘাটে, বাস, ট্রেনে হকাররাও বিভিন্ন নকল পণ্য বিক্রি করে। ব্র্যান্ডের কোনো পণ্যের নামের বানান একটু এদিক-সেদিক করে হুবহু নকল করা হয়। ব্যবহার করার পর খালি কৌটা সংগ্রহ করে তাতে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় ভেজাল পণ্য। দেশে কী পরিমাণ কসমেটিকস পণ্য নকল ও ভেজাল হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, দেশে ব্যবহার করা কসমেটিকস পণ্যের আনুমানিক ৪০ শতাংশ নকল, মানহীন কিংবা মেয়াদোত্তীর্ণ থাকে। এসব পণ্য ব্যবহারের ফলে নানা ধরনের ত্বকের সমস্যায় পড়তে হয়।
প্রসাধনীর বাজার নিয়ে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের (বিটিটিসি) একটি গবেষণা থেকে জানা যায়, দেশে কসমেটিকস খাতের প্রায় ৩৪ হাজার কোটি টাকার বাজার রয়েছে।
প্রসাধনী আমদানিকারক সমিতির তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ প্রতিবছর প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার প্রসাধনী আমদানি করে। এ হিসাব বিবেচনা করলে বৈধপথে আমদানি করা ও দেশীয় কিছু উৎপাদন ছাড়া প্রসাধনীর বাজার পুরোটাই কালোবাজারিদের দখলে।
অ্যাসোসিয়েশন অব স্কিন কেয়ার অ্যান্ড বিউটি প্রোডাক্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স বাংলাদেশের শীর্ষ পর্যায়ের একজন নেতা এ বিষয়ে বলেন, বাংলাদেশে বিদেশ থেকে আসা বেশির ভাগ কসমেটিকস পণ্যই চোরাইপথে আসে এবং এগুলো নিম্নমানের। চোরাইপথে পণ্য আসার ফলে দেশীয় উৎপাদনকারীরা টিকতে পারছে না। আমদানিকারকরা আবার ডিকলারেন্স ভ্যালু কম দেখাচ্ছে। দেশে কসমেটিকস পণ্যের এত বড় বাজারে মাত্র পৌনে ৩০০ কোটি টাকার রাজস্ব আসে। অথচ এটা কয়েক হাজার কোটি টাকা হওয়া উচিত। এখানেই বড় একটা কারসাজি রয়েছে। এ বিষয়ে সরকারের নজরদারি বাড়াতে হবে।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, কসমেটিকস পণ্যের মোড়কে আমদানিকারকের তথ্য, সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য, উপাদান, পরিমাণ, ব্যবহারবিধি, উৎপাদনের তারিখ ও মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ উল্লেখ থাকে না। প্রাইস গান মেশিনের সাহায্যে খুচরা বিক্রেতারা বিক্রয়মূল্য লিখে দেন। পণ্যের মোড়কে আমদানিকারকের লেখা মূল্য কেটে বেশি লিখে রাখা হয়। এমনকি বড় বড় স্টোরেও পণ্যের মোড়কে বেশি দাম লিখে ক্রেতাদের ঠকানো হয়। বিদেশি পণ্য নকল করে দেশেই তৈরি হয় বিদেশি ব্র্যান্ডের পণ্য। এসব পণ্যের ক্ষেত্রে কোনো মানদ- বজায় রাখা হয় না। বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) নিষিদ্ধ ও অনুমোদনহীন পণ্যও বিক্রি হচ্ছে।
বিএসটিআই ২০১৮ সালের আইনে আছে, স্থানীয় ব্যবহার, রফতানি বা আমদানি, যাই হোক না কেন, পণ্যসামগ্রী, মালামাল, উৎপাদিত পণ্য এবং খাদ্যসামগ্রীসহ অন্যান্য দ্রব্যের গুণগতমান প্রত্যয়ন করা বিএসটিআইয়ের অন্যতম কাজ।
সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) উপ-পরিচালক মোরশেদা বেগম বলেন, আমরা চেষ্টা করছি পণ্যের মান নিশ্চিতের পর যেন বাজারজাত হয়। নতুন পণ্যের বাজারজাতকরণের আগে পণ্য, মোড়কসহ সব বিষয়ের মান নিয়ে কাজ করছি। আমরা রপ্তানিযোগ্য পণ্যের মান নিশ্চিতকরণে জোর দিচ্ছি। সামগ্রিক উৎপাদনের ৩০ শতাংশ পণ্য বিএসটিআই মান সনদের আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে। তার বক্তব্য অনুযায়ী এখনও দেশের ৭০ শতাংশ পণ্য মান নিয়ন্ত্রণের বাইরে রয়েছে।
বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের সার্টিফিকেশন মার্কস (সিএম) উইংয়ের পরিচালক বলেন, যে কসমেটিকস পণ্যগুলো বৈধ্যপথে বিদেশ থেকে দেশে আসে, সেগুলো বিএসটিআইয়ের পরীক্ষা ছাড়া দেশে ঢোকার সুযোগ নেই। তবে যেগুলো লাগেজে, অবৈধ ও চোরাই পথে আসে সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
জাবিতে অটোরিকশার ধাক্কায় শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনায় সন্দেহভাজন রিকশা চালক আটক
আজ কিশোরগঞ্জের দানবীর, শিক্ষানুরাগী ওয়ালী নেওয়াজ খান এর ৩৮তম মৃত্যুবার্ষিকী
'দুর্বল' দলের বিপক্ষে পয়েন্ট হারাল ইউনাইটেড
সালাহর জোড়া গোলে লিভারপুলের জয়
গুমের দায়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ২২ সদস্য চাকরিচ্যুত
কুরস্ক অঞ্চলের ৪০ ভাগ খোয়ানোর স্বীকারোক্তি ইউক্রেনের
মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে বাংলাদেশ চীনের সাথে কাজ করতে আগ্রহী: বাণিজ্য উপদেষ্টা
হাজীদের সর্বোত্তম স্বার্থ রক্ষায় সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ধর্ম উপদেষ্টা ড. খালিদ হোসেন
শরীয়তপুরে যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদলের যৌথ কর্মী সভা
মানিকগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় সিকিউরিটি গার্ড নিহত
পাকিস্তানকে উড়িয়ে দিল জিম্বাবুয়ে
১৫ দিন রিমান্ড শেষে কারাগারে আব্দুর রাজ্জাক
লক্ষ্মীপুরে ১২০ টাকায় পুলিশে চাকরি পেলেন ৫০ জন
নির্বাচিত সরকারই দেশকে পুনর্গঠন করতে পারে : তারেক রহমান
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন জেলা কমিটিতে অচেনা ৭ জন
মৌলভীবাজারে কৃষি ও প্রযুক্তি মেলা শুরু
দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের মডেল উদ্ভাবন
ব্রহ্মপুত্রে অবৈধ ড্রেজার বসিয়ে চলছে বালু ব্যবসা
বাঘায় কৃষি শ্রমিককে গলা কেটে হত্যা
কেশবপুরে অবৈধ ইটভাটা বন্ধে বিভিন্ন দফতরে অভিযোগ