ঐতিহাসিক ৫ আগস্ট বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে সারাদেশে পরিবর্তনের বাতাস বইলেও সে বাতাসের ছোঁয়া লাগেনি ধর্ম মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন ইসলামিক ফাউন্ডেশনে। এখনো অফিস চালাচ্ছেন ফ্যাসিস্ট আওয়ামী কর্মকর্তারা। বহাল তবিয়তে রয়েছেন বঙ্গবন্ধু পরিষদের লোকজন। নিরাপদ আছেন ইফার সাবেক ডিজি মরহুম শামীম মো. আফজালের আত্মীয়-স্বজন, ওবায়দুল মুক্তাদির চৌধুরীর নিকটজন এবং মরহুম শেখ আব্দুল্লার লোকজন। ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন বায়তুল মোকাররমের স্বনামে-বেনামে দোকান আত্মসাৎকারী দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা।
প্রায় ১০ বছরের অধিক সময় ইসলামিক ফাউন্ডেশনের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী মহাপরিচালক শামীম মো. আফজাল তার শতাধিক আত্মীয়-স্বজনকে চাকরি দিয়েছেন নিজ হাতেই। তার বোনের মেয়ে ভাইয়ের ছেলেসহ শতাধিক ব্যক্তিকে অফিসার এবং কর্মচারী হিসেবে নিয়োগ দান করেন শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত এ দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা। কোনো প্রকার শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও বায়তুল মোকাররমের ইমাম পদে নিয়োগ দেন নিজের আপন ভাগিনাকে। শামীম মো. আফজালের এলাকার লোক এবং ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বোর্ড সদস্য হয়ে নিজের আপন ভাতিজাসহ বিপুল সংখ্যক আত্মীয়-স্বজনকে চাকরি দেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তৎকালীন এমপি হাসিনার দোসর উবায়দুল মুক্তাদির চৌধুরী। তারা এখনো প্রধান কার্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় বহাল রয়েছেন। প্রথমে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বোর্ড সদস্য এবং পরবর্তীতে ধর্ম প্রতিমন্ত্রী পদে আসিন হওয়া গোপালগঞ্জের রাজনীতিবিদ মরহুম শেখ মো. আব্দুল্লাহ দিয়েছেন প্রায় ডজন খানেক লোকের চাকরি। কোনো প্রকার শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও এবং বয়স পার হয়ে যাওয়ার পর বয়স কমিয়ে আবার নতুন করে দরখাস্ত করে চাকরি দিয়েছেন তার আপন ভাগিনা মহিউদ্দিন কাশেমকে। মহিউদ্দিন কাশেম ৫ আগস্টের ঘটনার পরে কয়েক দিন পলাতক থেকে পরে আবার কয়েকজন হেফাজত ও জামায়াত নেতাকে নিয়ে মসজিদ আঙ্গিনায় আসেন এবং নামাজ পড়ানো শুরু করেন। তার বয়স ৩৩ হয়ে যাওয়ার পরেও নতুন করে বয়স কমিয়ে সনদপত্র এনে তিনি চাকরি নেন। আগে ২০১২ সালে তিনি যখন চাকরির আবেদন করেছিলেন তখন তার বয়স ২৯ ছিল।
এর পাঁচ বছর পরও তিনি যখন আবেদন করেন তখনো তার বয়স ২৯। চাকরি নেয়ার পর তিনি দুর্দণ্ড প্রতাপশালী হয়ে উঠেন বায়তুল মোকাররম এবং সংলগ্ন এলাকায়। হয়ে যান বিপুল অর্থবিত্তের মালিক। অসমর্থিত সূত্র মতে, পরবর্তীতে তিনি জড়িয়ে পড়েন নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ডে। বিষয়টি বায়তুল মোকাররম ও সংলগ্ন এলাকায় টক অফ দা টাউন।

ইসলামিক ফাউন্ডেশনে বঙ্গবন্ধু পরিষদের নাম ভাঙিয়ে টেন্ডারবাজি এবং নিয়োগ-বাণিজ্যের সাথে জড়িত কর্মকর্তাদের বেশির ভাগ এখনো ইফার অফিস নিয়ন্ত্রণ করছেন। বঙ্গবন্ধু পরিষদের সেক্রেটারি কৃষিবিদ সাইফুল ইসলাম এখনো প্রধান কার্যালয়ে মডেল মসজিদ প্রকল্পে কর্মরত। পরিষদের অপর প্রভাবশালী নেতা সেলিম সরকার কিছু দিন আগেই বদলি হলেও এক দিনের মধ্যে ওই বদলি স্থগিত হয়ে যায়। অদৃশ্য কারণে বর্তমান মহাপরিচালক এবং সরকারের অতিরিক্ত সচিব সাইফুল ইসলাম ওই বদলি স্থগিত করে তাকে আগের পদে স্বসম্মানে বহাল রাখেন।

জনপ্রশাসনসহ দেশের প্রায় সব অফিসেই পদোন্নতি-বঞ্চিতদের পদোন্নতি দেয়ার কাজ শেষ হয়ে গেলেও এখনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রশাসন। কবে নাগাদ এই উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে তা কেউ বলতে পারেন না। ফুলটু প্রশাসনের উপসচিব পদ্ধতি দীর্ঘদিন খালি রাখা হয়েছে। এই পদে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের নিজস্ব লোক পদায়নের কথা থাকলেও এই পদে কাউকে দিচ্ছেন না মহাপরিচালক সাইফুল ইসলাম। ফলে ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রশাসনে মারাত্মক স্থবিরতা সৃষ্টি হয়েছে। সম্প্রতি ধর্ম উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন প্রতিষ্ঠানটি ঢেলে সাজানোর ইঙ্গিত দিলেও দৃশ্যমান কোনো পরিবর্তন নেই। ইসলামিক ফাউন্ডেশন জাতীয় শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি এম এ বারী বলছেন, সুজন আহমেদ চৌধুরী ২০১২ সালে তার চাচা তৎকালীন ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনের সংসদ সদস্য ও ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বোর্ড অব গভর্নরসের সদস্য র. আ. ম উবায়দুল মুক্তাদির চৌধুরীর সুবাদে ইসলামিক ফাউন্ডেশনে সহকারী পরিচালক পদে চাকরিতে প্রবেশ করেন। ২০১২ সালে সিলেকশন কমিটিকে পাশ কাটিয়ে শুধু রাজনৈতিক বিবেচনায় ইসলামিক ফাউন্ডেশনে যে ৩৭ জন সহকারী পরিচালককে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল, সুজন চৌধুরী তাদের একজন। প্রশ্নবিদ্ধ সেই নিয়োগ নিয়ে এখনো আদালতে মামলা চলমান রয়েছে।

বাংলাদেশ ইমাম সমিতির কেন্দ্রীয় সভাপতি প্রখ্যাত মাওলানা লুৎফর রহমান ইনকিলাবকে বলেন, ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পরও ইসলামিক ফাউন্ডেশনে চিহ্নিত আওয়ামী ঘরানার ব্যক্তিদের এখনো বহাল তবিয়তে টিকে থাকার বিষয়টি অত্যন্ত হতাশাজনক। মাওলানা লুৎফর রহমান বলেন, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৯০ শতাংশ মুসলমানের বাংলাদেশের মুসলমানদের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিষ্ঠান। এই দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষ এই প্রতিষ্ঠানকে নিজেদের প্রাণের থেকেও ভালোবাসে। ইফার সাবেক ডিজি মরহুম শামীম আফজাল ধর্মের নামে এই প্রতিষ্ঠানে বেদয়াতি সংস্কৃতি চালু করেছেন। অন্যদিকে রাজনৈতিক ও আত্মীয় বিবেচনায় নিয়োগ ও পদোন্নতি দিয়ে পুরো প্রতিষ্ঠানকে একটি অনৈসলামিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছিলেন। তিনি অনতিবিলম্বে ইসলামিক ফাউন্ডেশন ও বায়তুল মোকাররম থেকে ফ্যাসিস্ট হাসিনার দোসরদের অব্যাহতি এবং অপসারণের জোর দাবি জানান। বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের একজন নিয়মিত মুসল্লি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, পুরো ইসলামিক ফাউন্ডেশনকে মরহুম শামীম আফজাল ও র. আ. ম. উবায়দুল মুক্তাদির চৌধুরী মিলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ফাউন্ডেশনে পরিণত করেছেন। তিনি বলেন, ‘অনতিবিলম্বে বায়তুল মোকাররম পুরুষ ও মহিলা মসজিদ এবং ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রধান কার্যালয়ে কর্মরত সাবেক ডিজি শামীম আফজালের আত্মীয়-স্বজন এবং চিহ্নিত আওয়ামী লীগ কর্মকর্তাদেরকে বায়তুল মোকাররম ও প্রধান কার্যালয় থেকে বদলি করার জোর দাবি জানাচ্ছি।’ অন্যথায় এ দেশের তৌহিদি জনতাকে সাথে নিয়ে এসব কুলাঙ্গার কর্মকর্তাদের বায়তুল মোকাররম থেকে বিতাড়িত করা হবে বলে তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন।

প্রধান কার্যালয়ের সূত্র বলছে, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের শুরুর থেকেই মহিলা মসজিদের অর্গানোগ্রামভুক্ত কর্মকর্তার একমাত্র পদ ছিল লোডি অর্গানাইজিং অফিসার। ওই পদে কর্মরত ব্যক্তি থাকা সত্ত্বেও শামীম আফজাল দায়িত্ব নেয়ার পর মহিলা শাখায় মহিলা কো-অর্ডিনেটর নামে নতুন পদ অন্তর্ভুক্ত করে নিজ ভাগ্নি মোসাম্মৎ সিরাজুম মনিরা ও পুরান ঢাকার আওয়ামী লীগ নেত্রী কামরুন্নেসা মান্নানকে নিয়োগ দেয়। মহিলা কো-অর্ডিটেরটর পদটি এখন পর্যন্ত ইসলামিক ফাউন্ডেশনের তফসিলভুক্ত কোনো পদ নয় বলেও জানা গেছে।