ফের কারাগারে হারুন, মশিউরকে ইলেক্ট্রিক শক দেয়া হয় ডিবিতে
২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০১ এএম | আপডেট: ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০১ এএম
হারুন অর রশিদ নামের এক নিরপরাধ তরুণকে মিথ্যা মামলায় জেলখানায় পুরেছে কথিত শিল্প পরিবার ‘নোমান গ্রুপ’। লক্ষ্য, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) ওই শিল্প পরিবারটির বিরুদ্ধে চলমান তদন্ত বন্ধ এবং হাইকোর্টে দায়েরকৃত রিট প্রত্যাহারে বাধ্য করা।
এ লক্ষ্যে কয়েক বছর ধরেই চট্টগ্রাম আধুনগর গ্রামের সরদারনী পাড়া নিবাসী মরহুম ছিদ্দিক আহমেদের পুত্র হারুনের পিছু লাগেন প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার মো: নূরুল ইসলাম। ‘চাচা’ সম্পর্কের সূত্রধরে হারুন অর রশিদ এক সময় নূরুল ইসলামের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ব্যবসা শুরু করেন। এই সূত্রে ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে নোমান গ্রুপের একটি ঋণ চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে বলা হয় তাকে। বেঁকে বসেন হারুন। অন্যায় কাজে রাজী না হওয়ায় হারুনের সঙ্গে নূরুল ইসলামের বিরোধ শুরু সেখান থেকে। এরপর যেখানেই নোমান গ্রুপের স্বার্থপরিপন্থী কিছু ঘটে- সেটির জন্যই দায়ী করা হয় হারুনকে। কারণ, হারুন নূরুল ইসলামের অনেক অবৈধ আর্থিক কেলেঙ্কারি ও ব্যাংক জালিয়াতির তথ্য জানেন। তাই হারুনকে প্রথমে জড়ানো হয় নূরুল ইসলামের অর্থ আত্মসাৎ মামলায়। পরে একের পর এক দায়ের করা হয় বহু মিথ্যা মামলায়। তাকে গ্রেফতার করানো হয়। রিমান্ডের নামে দিনের পর দিন হতে থাকে একের পর এক মিথ্যা মামলায়। তাতে শায়েস্তা করতে না পেরে হারুন পরিবারের অন্য সদস্যদের বিরুদ্ধেও দায়ের করে মিথ্যা মামলা। হাসিনা শাসনামলে হারুনের বড় ভাই মাদরাসা শিক্ষক মাওলানা মো: দেলোয়ার হোসাইনকে ‘জামায়াত-শিবির ও জঙ্গি’ আখ্যা দিয়ে তার বিরুদ্ধে ২০২১ সালে ঢাকায় একই দিনে ৩টি মিথ্যা মামলা করান নূরুল ইসলাম। লোহাগাড়া থানায় করেন ২টি মামলা। চট্টগ্রাম থানায় করান ১টি মামলা। হারুনের ভাই হেলালউদ্দিনের বিরুদ্ধে ঢাকায় ৪টি মামলা, চট্টগ্রামের লোহাগাড়া থানায় ১টি মামলা করেন। হারুনের ছোট ভাই আনোয়ার হোছাইনের বিরুদ্ধে মতিঝিল থানায় ৪টি মামলা, লোহাগাড়ায় ১টি মামলা করেন। এসব মামলায় প্রত্যেকে একাধিকবার গ্রেফতার হন। কারাভোগ করেন। হারুনও ইতিপূর্বে দুই দফা কারাভোগ করেন। সর্বশেষ আইসিটি অ্যাক্টে দায়ের করা মামলা দায়েরের পর আত্মগোপনে চলে যান হারুন। এতে একতরফা ‘বিচার’ হয়। হারুনের অনুপস্থিতিতে দু’টি মামলায় তার ১০ বছর করে ২০ বছর কারাদণ্ড হয়। ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার আমলে ন্যায় বিচার পাবেন না- এ আশঙ্কায় হারুন ফেরারী জীবন যাপন করেন। পরিবার থেকেও হয়ে পড়েন বিচ্ছিন্ন। তবে গত ৫ আগস্ট হাসিনা ভারত পালিয়ে গেলে হারুন আত্মসমর্পণের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এমতাবস্থায় চলমান একটি তদন্তের প্রয়োজনে গত ২০ অক্টোবর দুদক ব্যাংক লুটেরা নূরুল ইসলামের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেয়। তদন্তের ধারাবাহিকতায় তলবি নোটিশের প্রেক্ষিতে গত ১২ নভেম্বর দুদকে সাক্ষ্য দেন হারুনের ছোট ভাই আনোয়ার হোছাইন এবং নূরুল ইসলামের এক সময়কার আইন কর্মকর্তা কাজী মশিউর হোসেন। এতেই যেন মাথা বিগড়ে যায় নূরুলের। সমস্ত শক্তি নিয়ে নূরুল ইসলাম ঝাঁপিয়ে পড়েন হারুন ও তার পরিবারের সদস্য এবং কাজী মশিউর হোসেনের বিরুদ্ধে। হারুনকে গ্রেফতারের পর কাজী মশিউর হোসেনের বিরুদ্ধেও লেলিয়ে দিয়েছেন পুলিশ। আজ উয়ারি থানা তাকে তলব করছে কাল কোতোয়ালি থানা পুলিশ ডেকে পাঠাচ্ছে। এ কারণে ঘরে থাকতে পারছেন না ব্যাংক লুটেরা নূরুল ইসলামের লুটপাটের রাজসাক্ষী কাজী মশিউর হোসেনও। হারুন এবং মশিউরের বিরুদ্ধে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশ হেডকোয়ার্টারসহ বিভিন্ন জায়গায় একের পর এক দরখাস্ত মেরে চলেছেন নূরুল।
নূরুলের মিথ্যা মামলা ও হয়রানির শিকার ভুক্তভোগীরা জানান, আওয়ামী দুঃশাসনের ষোলো আনা সুযোগ নিয়েছিলেন নোমান গ্রুপের কর্ণধার নূরুল ইসলাম। গাজীপুরের এসপি থাকাকালেই নূরুল ডিবি হারুনকে কিনে নেন। হারুন যখন ডিবিতে পোস্টিং হয় তখন নূরুলের পোয়াবারো। যাকেই ‘স্বার্থবিরোধী’ তাকেই ধরে নিয়ে পেটাতেন। আয়নাঘরে নিতেন। ইলেকট্রিক শক দিতেন।
২০১৪ সালে ৫ হাজার কোটি টাকা পাচার অভিযোগের তদন্ত শুরু হলে কিনে ফেলেন দুদকের কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তাকেও। শুধু ডিবি হারুন কিংবা দুদকের শীর্ষ কর্মকর্তাই নন-আওয়ামীলীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, ড.আহমদ কায়কাউস, সম্পদ বড়ুয়া, বিপ্লব বড়ুয়া, ব্য্যারিস্টার নওফেল, ঢাকা উত্তর সিটি মেয়র আতিককেও কিনে নেন। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও গাজীপুর জেলার প্রায় সব থানার ওসি, পুলিশ সুপার, সংশ্লিষ্ট ডিআইজি, আইজি, র্যাব মহাপরিচালক এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পদস্থ আমলারাও ছিলো নূরুলের পকেটে। এদের পেছনে ব্যাংক লুটের অর্থ দু’হাতে ছেটাতেন তিনি। ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলে নূরুল ইসলাম ইচ্ছেমতো ব্যবহার করেন রাষ্ট্রযন্ত্রকে। যাকেই তার স্বার্থ পরিপন্থী মনে করেন- তাকেই শায়েস্তা করেন রাষ্ট্রযন্ত্রের সাহায্যে। আর যাদেরকে নূরুল শায়েস্তা করতেন তারা প্রত্যেকেই নিরীহ,দরিদ্র,মাদরাসা শিক্ষক ও সাধারণ মানুষ। নিরপরাধ মানুষের ভিটায় লাল ঘুঘু চড়াতে প্রশাসনযন্ত্রকে পুরোপুরি ব্যবহার করতেন ফ্যাসিস্ট হাসিনার অন্যতম অর্থ যোগানদাতা, ব্যাংক লুটেরা নূরুল ইসলাম। এখনো একই কায়দায় মরিয়া হয়ে উঠেছেন তিনি। নিজের বাড়িও চট্টগ্রাম বিধায় এ পরিচয় বিক্রি করে নূরুল ইসলাম ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রশাসন যন্ত্রকে আগের মতোই ব্যবহার করতে চাইছেন। এ চেষ্টায় অংশতঃ তিনি সফলও হয়েছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং পুলিশের কিছু পদস্থ কর্মকর্তাদের হাত করে মজলুম হারুন ও কাজী মশিউরের ওপর নবোদ্যমে শুরু করেছেন নির্যাতন।
সর্বশেষ গত ১৮ নভেম্বর চট্টগ্রাম চান্দগাঁও থানা এলাকার প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে গ্রেফতার করা হয় আত্মগোপনে থাকা হারুন অর রশিদকে। পরে তাকে লোহাগাড়া থানায় জনৈক মো: শাহজাহানের করা একটি মামলায় ‘অজ্ঞাতনামা’ আসামি হিসেবে গ্রেফতার দেখানো হয়। শাহজাহানের মামলায় (নং-০৩/২১২), তারিখ-০২ অক্টোবর, ২০২৪) আসামির তালিকায় নাম নেই হারুনের। মামলায় ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ১৪৩/১৪৭/১৪৮/৩২৩/৩০৭/৫০৬(২) এবং ১৯০৮ সালের বিস্ফোরক দ্রব্য আইন প্রয়োগ করা হয়। গ্রেফতারের পর চান্দগাঁও থানা থেকে তাকে নেয়া হয় চট্টগ্রাম মনসুরাবাদ ডিবি কার্যালয়ে। কিছু জিজ্ঞাসাবাদ শেষে সেখান থেকে নেয়া হয় লোহাগাড়া থানায়। এ থানায় নতুন পোস্টিং হওয়া ওসি (তদন্ত) আরিফুর রহমান নোমান গ্রুপের পক্ষ নিয়ে নূরুল ইসলামের সঙ্গে আপসের প্রস্তাব দেন। চাপ সৃষ্টি করেন দুদকে তার ভাই আনোয়ার হোছাইনের দেয়া সাক্ষ্য এবং উচ্চ আদালতে চলমান দু’টি রিট প্রত্যাহারের। অন্যথায় তাকে এবং অন্য ভাইদের এ ভয়াবহ রকম মামলায় আসামি করা হবে-মর্মে হুমকি দেন আরিফ। হারুনের পরিবার জানতে চান- কেন তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে? জবাবে আরিফ বলেন, ‘উপরের নির্দেশে’।
এদিকে হারুন অর রশিদের বোন হামিদা বেগম জানান, হারুনকে প্রথমে কারাগারে কর্ণফুলি-১ সেলে রাখা হয়। সেখান থেকে তাকে নেয়া হয় সাঙ্গু সেলে। এখন তাকে ঢাকার একটি মামলায় শ্যোন অ্যারেস্ট দেখিয়ে ঢাকা কারাগারে নেয়ার চেষ্টা চলছে। বিভিন্ন সূত্র থেকে আমরা আভাস পাচ্ছি, হারুনকে কারাগারের ভেতর নূরুল ইসলাম মেরে ফেলতে পারেন। এ লক্ষ্যে তিনি ভেতরে লোকও ঠিক করেছেন। ভয়ঙ্কর নূরুল ইসলাম নিজে বাঁচার জন্য যেকোনো হীন কাজ করতে পারে। এ কারণে আমরা আতঙ্কিত। তাকে যেন কোনোক্রমেই ঢাকা কিংবা কাশিমপুর কারাগারে নেয়া না হয়।
শুধু হারুনের পরিবার নয়। মামলাবাজ নূরুল ইসলামের রোষানলে পড়েছেন একুশে পদকপ্রাপ্ত চিত্রশিল্পী কাজী আনোয়ার হোসেনের পুত্র কাজী মশিউর হোসেনও। মশিউরের অন্তত: ২২ বিঘা জমি বন্ধক রেখে জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ নেন সর্বগ্রাসী নূরুল ইসলাম। একটি মামলায় নূরুল ইসলাম দাবী করেন, এ সম্পত্তির মালিক নূরুল ইসলাম-কাজী মশিউর হোসেন নন। পরে কাজী মশিউরের সম্পত্তি পানির দামে লিখে নেয়ার জন্য চাপ দেন মশিউরকে। তিনি এতে রাজী না হওয়ায় তার ওপরও নেমে আসে মামলাবাজ নূরুল ইসলামের অত্যাচারের স্টিম রোলার। তার বিরুদ্ধে একের পর এক দায়ের করেন মিথ্যা মামলা। একটি মামলায় গ্রেফতার করে ডিবি হেফাজতে নির্মম নির্যাতন করা হয়। তার হাতে-পায়ে, নখে ইলেকট্রিক শক দেয়া হয়। আত্মগোপনে থাকা কাজী মশিউর হোসেন অজ্ঞাত স্থান থেকে এ প্রতিবেদককে জানান, এক সপ্তাহের মধ্যে আমাকে দু’বার পুলিশ ডেকে নিয়েছে। তারা ইসলাম সাহেবের সঙ্গে ‘ঝামেলা’ মিটিয়ে ফেলার প্রস্তাব দিচ্ছে। আমি আতঙ্কিত। নূরুল ইসলাম আমাকে কিংবা আমার পরিবারের বড় ধরনের ক্ষতি করতে পারেন। আমি চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
গুমের দায়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ২২ সদস্য চাকরিচ্যুত
কুরস্ক অঞ্চলের ৪০ ভাগ খোয়ানোর স্বীকারোক্তি ইউক্রেনের
মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে বাংলাদেশ চীনের সাথে কাজ করতে আগ্রহী: বাণিজ্য উপদেষ্টা
হাজীদের সর্বোত্তম স্বার্থ রক্ষায় সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ধর্ম উপদেষ্টা ড. খালিদ হোসেন
শরীয়তপুরে যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদলের যৌথ কর্মী সভা
মানিকগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় সিকিউরিটি গার্ড নিহত
পাকিস্তানকে উড়িয়ে দিল জিম্বাবুয়ে
১৫ দিন রিমান্ড শেষে কারাগারে আব্দুর রাজ্জাক
লক্ষ্মীপুরে ১২০ টাকায় পুলিশে চাকরি পেলেন ৫০ জন
নির্বাচিত সরকারই দেশকে পুনর্গঠন করতে পারে : তারেক রহমান
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন জেলা কমিটিতে অচেনা ৭ জন
মৌলভীবাজারে কৃষি ও প্রযুক্তি মেলা শুরু
দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের মডেল উদ্ভাবন
ব্রহ্মপুত্রে অবৈধ ড্রেজার বসিয়ে চলছে বালু ব্যবসা
বাঘায় কৃষি শ্রমিককে গলা কেটে হত্যা
কেশবপুরে অবৈধ ইটভাটা বন্ধে বিভিন্ন দফতরে অভিযোগ
হামলার শিকার হয়েও মুখ খুলতে পারছে না বোয়ালমারীর বহু পরিবার
ইসলামী আন্দোলনের গণসমাবেশে আ.লীগ নিষিদ্ধের দাবি
বিপিএলের প্রথম দিনই মাঠে নামছে বসুন্ধরা-মোহামেডান
সাগরে মিলছে না আশানুরূপ ইলিশ হতাশায় মীরসরাইয়ের জেলেরা