হাসিনার সাথে টেকনো মিডিয়ার যশোদা জীবন দেবনাথ পালালেও ব্যাংকগুলো এখনো দখলে

ব্যাংকিং সেবা খাতে এখনো ভারতীয় আধিপত্য

Daily Inqilab হাসান সোহেল

১৫ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:৪৭ এএম | আপডেট: ১৫ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:৪৭ এএম


বাংলাদেশ ব্যাংকিং খাতের বিভিন্ন সেবায় এখনো ভারতীয় আধিপত্য চলছে। বিগত স্বৈরাচার হাসিনার আমলে বাংলাদেশের একটি কোম্পানি নিজেকে ভারতীয় আশীর্বাদপুষ্ট দাবী করে ব্যাংকিং খাতে জেঁকে বসে। ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পরও ব্যাংকিং সেবা খাতে ওই কোম্পানির দাপট কমেনি। টেকনোমিডিয়া লিমিটেড নামে ওই কোম্পানিটির মালিক ড. যশোদা জীবন দেবনাথ। টেকনোমিডিয়া সারা দেশে এটিএম মেশিন, সিআরএম মেশিন, নোট সর্টিং মেশিন, কেনাকাটার ডিজিটাল পজ মেশিন, নোট বাইন্ডিং মেশিন, ব্যাংকিং সফটওয়্যার, চেক বই, অনলাইন চেক ক্লিয়ারিং সফটওয়্যার ও ব্যাংকগুলোতে নিজস্ব সিকিউরিটি সার্ভিসের মাধ্যমে নগদ টাকা সরবরাহ করে। আর ব্যাংকিং খাতের এ সেবাগুলো বিগত সরকারের সময়ে তিনি বাগিয়ে নিয়েছেন ভারতের এজেন্ট হিসেবে পরিচয় দিয়ে। গত ৫ আগষ্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালানোর পরপরই যশোদা জীবন দেবনাথও দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। হাসিনার মতো দেশ ছাড়লেও অধিকাংশ ব্যাংকের এটিএম বুথ সেবাসহ আইটি সার্ভিস এখনো তার দখলে।

ব্যাংকিং খাতের সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, যশোদা জীবন দেবনাথের ছেলেবেলা কেটেছে অনেক কষ্টে। মাত্র ছয় বছর বয়সেই পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন। কখনো দোকানের কর্মচারী। কখনো মেরামত কাজের সহযোগী। আবার কখনো টিউশনি করে কেটেছে তার শৈশব। কিন্তু রাজধানী ঢাকায় এসে তার জীবন পাল্টে দিতে থাকেন। শুরুর দিকে আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি মৃত সুরঞ্জিত সেন গুপ্তের কাছের লোক বলে পরিচয় দিতেন। পরবর্তীতে প্রতিনিয়ত তিনি ভারতের সাবেক প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী এবং রাজনীতিবিদদের সাথে ছবি তুলে দেশটির সাথে তার সখ্যতা তুলে ধরেন। এক পর্যায়ে শুধুমাত্র ব্যাংকিং সেবাখাতে তার ব্যবসা থেমে থাকেনি। তিনি একটি বেসরকারি ব্যাংক এবং ইন্সুরেন্স কোম্পানির পরিচালকও হয়েছেন। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই’র ভাইস প্রেসিডেন্টও হয়ে যান তদবির করে। সুগার মিলের পরিচালক, ইকো রিসোর্ট সবই আছে তার। তার এ উত্থান বিস্মিত করেছে ব্যবসায়ী মহলকে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, বিভিন্ন অজুহাতে যশোদা জীবন দেবনাথ সময়ে-অসময়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে ছবি তুলতেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে তার যাতায়াত ছিলো অবাধ। প্রধানমন্ত্রীর সাথে নিজের ছবি দেখিয়ে ব্যাংকগুলোকে তিনি ব্লাকমেইল করেছেন অনেক সময়। যার ফলে ব্যাংকগুলো অনেক সময় তাকে উচ্চমূল্যে কাজ দিতে বাধ্য হয়েছে। দেশে এটিএম বুথ সেবাদানে সবচেয়ে এগিয়ে এরকম একটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে আঁতাত করে কয়েকগুণ দাম বেশি দেখিয়ে এটিএম মেশিন আমদানি দেখিয়ে ব্যাংকটির টাকা আত্মসাত করেছেন। যদিও শুধু ওই ব্যাংকই ইসলামী ধারার ব্যাংকসহ অধিকাংশ ব্যাংকের এটিএম বুথ অধিক দাম দেখিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাত করেছেন যশোদা জীবন। সাধারণত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে কাজ নিতে হয়। কিন্তু তিনি তদবির এবং ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও এমডিদের সঙ্গে আঁতাত করে কাজ নিয়েছেন। এছাড়া ব্যাংকের বিভিন্ন সেবামূলক যন্ত্রপাতি আমদানিতে বড় অঙ্কের শুল্ক ফাঁকির অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়, কয়েকবছর আগে শুল্ক গোয়েন্দা পরিদপ্তর থেকে বাংলাদেশে আমদানিকৃত এটিএম মেশিন আমদানিতে ব্যাপক গরমিল দেখতে পান। পরে সংস্থাটি অনুসন্ধান করে দেখতে পায় যে, যে পরিমাণ এটিএম মেশিন বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে আছে তার সবগুলোর আমদানি তথ্য এনবিআর এর হাতে নেই। এ তথ্য জানাজানি হলে যশোদা জীবন দেবনাথ প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে তদবির করিয়ে ঘটনাটি ধামাচাপা দেন। এ ধরনের আরো বহু প্রতারণার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

যশোদা জীবন দেবনাথ ছাত্র-জনতার বিপ্লবে গত ৫ আগষ্টের পর দেশ ছেড়ে কানাডাতে পালালেও ব্যাংকিং খাতে তার প্রভাব এখনো আগের মতোই। বিদেশে থেকে তিনি ব্যাংকিং খাতে তার আস্থাভাজন লোকদের সাথে যোগাযোগ রাখছেন। ব্যাংকিং খাতে যেসব সেবা তিনি দেন সেগুলো যাতে অব্যাহত থাকে সে লক্ষ্যে তিনি প্রতিনিয়ত তদবির করে চলেছেন বলে ব্যাংক সূত্র জানায়। তবে, দেশে না থাকার কারণে ব্যাংকিং খাতের সেবাগুলো চালাতে গিয়ে অনেক ব্যাংক হিমশিম খাচ্ছে বলে জানা গেছে। বড় কোন ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হলে তার সরবরাহ করা সেবাগুলো বিঘিœত হতে পারে বলে ব্যাংকিং খাতের একাধিক সূত্র জানিয়েছে। ব্যাংকিং খাতের নির্বাহীরা জানান, ব্যাংকিং খাতে যশোদার টেকনো মিডিয়ার সাথে যে চুক্তিগুলো হয়েছে সেগুলো পুনর্মূল্যায়ন করা দরকার। অন্যথায় যে কোন মুহূর্তে ব্যাংকিং সেবা কার্যক্রম ব্যাহত হতে পারে। অবশ্য একাধিক ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ইতোমধ্যে বিষয়টি বোর্ডে আলোচনাও করেছেন।

শুধু ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রভাব বিস্তার করে যশোদা বসে থাকেননি। তিনি রাজনীতিতেও তার খায়েশ ছিলো আকাশচুম্বি। অর্থের জোরে তিনি ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের নেতা যেমন হয়েছেন সাথে সাথে জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতির পদও বাগিয়ে নিয়েছেন। ফরিদপুরের রাজনীতির সাথে যুক্ত ওয়াকিবহাল মহলের মতে, যশোদার কাছে অসম্ভব কিছুই ছিলো না। সবকিছু তিনি ম্যানেজ করতেন টাকা দিয়ে। বিগত একতরফা জাতীয় নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগ প্রার্থী হবার জন্য উঠেপড়ে লাগেন। কিন্তু দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেন। এমনকি দেশে না থাকলেও এখনো এলাকায় তার একচ্ছত্র প্রভাব। এক্ষেত্রে তিনি পট-পরিবর্তনের পর ফরিদপুরের সুবিধাভোগী বিএনপি-জামায়াত নেতাদের অর্থের বিনিময়ে সখ্যতা গড়ে তুলেছেন। যশোদা জীবন দেবনাথকে বাঁচাতে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যবসায়িক পার্টনার হিসেবেও পরিচয় দিচ্ছেন বিএনপি-জামায়াত নেতারা।

ব্যাংকিং খাতে প্রভাব বিস্তার করতে তিনি শুধুমাত্র ভারতীয় আধিপত্যবাদের দোসরই হননি বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারকে খুশি করতে নানা ধরনের উদ্যোগ নিয়েছেন। এর মধ্যে বই প্রকাশ অন্যতম। বিগত সরকারকে খুশি করতে তিনি যেসব বই নিজের নামে প্রকাশ করেছেন তার মধ্যে আছেÑ মহানায়কের ইতিকথা, জীবন থেকে নেয়া, ফরিদপুরের মুক্তিযুদ্ধ, অপারেশন এক্স, জননেত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন, আমার জীবনের গল্প, এক তর্জনীর আত্মকথা উল্লেখযোগ্য। এসব বইয়ে তিনি বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন গুণগান উল্লেখ করেছেন। বইগুলো তিনি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সিনিয়র নেতাকে উপহার দিয়েছেন।

যশোদা জীবন দেবনাথের ডক্টরেট ডিগ্রী প্রাপ্তি নিয়েও নানা মহলে আলোচনা রয়েছে। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটির ফ্যাকাল্টি অব বিজনেস থেকে এ ডিগ্রি নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন। গবেষণার বিষয়বস্তু ‘ডক্টর অব ফিলোসফি উইথ মেজর ইন ফিনান্স এন্ড ব্যাংকিং’ বলে তিনি দাবি করেন। তবে এই ডিগ্রী নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।

এসব বিষয়ে যশোদা জীবন দেবনাথের মোবাইলে একাধিকবার কথা বলার চেষ্টা করলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। এমনকি রাজধানীর দৈনিক বাংলা এলাকায় তার একটি অফিসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলতে গেলেও কেউ কথা বলতে রাজি হননি।

 


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

টিউলিপের পদত্যাগ ইস্যুতে প্রেস উইংয়ের বিবৃতি

টিউলিপের পদত্যাগ ইস্যুতে প্রেস উইংয়ের বিবৃতি

আজ বায়ুদূষণের শীর্ষে কায়রো, ঢাকার অবস্থান ৬ নম্বরে

আজ বায়ুদূষণের শীর্ষে কায়রো, ঢাকার অবস্থান ৬ নম্বরে

মেয়ের বাড়ি থেকে ফেরার পথে লাশ হলো "মা"!

মেয়ের বাড়ি থেকে ফেরার পথে লাশ হলো "মা"!

মীরসরাইয়ে মুন্না খুনের ঘটনায়, পৌর যুবদলের আহ্বায়ক বহিষ্কার

মীরসরাইয়ে মুন্না খুনের ঘটনায়, পৌর যুবদলের আহ্বায়ক বহিষ্কার

দক্ষিণ কোরিয়ার অভিশংসিত প্রেসিডেন্ট ইউন গ্রেফতার

দক্ষিণ কোরিয়ার অভিশংসিত প্রেসিডেন্ট ইউন গ্রেফতার

আজ সারদায় ৪৮০ এসআইয়ের সমাপনী কুচকাওয়াজ

আজ সারদায় ৪৮০ এসআইয়ের সমাপনী কুচকাওয়াজ

ইসরায়েলি হামলায় গাজায় নিহত আরও ৬৩ জন ফিলিস্তিনি, মানবিক সংকট চরমে

ইসরায়েলি হামলায় গাজায় নিহত আরও ৬৩ জন ফিলিস্তিনি, মানবিক সংকট চরমে

ছাগলকাণ্ডের সেই মতিউর ও তার স্ত্রী গ্রেফতার

ছাগলকাণ্ডের সেই মতিউর ও তার স্ত্রী গ্রেফতার

সেন্টমার্টিনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে তিন রিসোর্ট পুড়ে ছাই

সেন্টমার্টিনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে তিন রিসোর্ট পুড়ে ছাই

শুল্ক রেলস্টেশন দিয়ে ভারত থেকে ২ হাজার ৪৫০ মেট্রিক টন চাল আমদানি

শুল্ক রেলস্টেশন দিয়ে ভারত থেকে ২ হাজার ৪৫০ মেট্রিক টন চাল আমদানি

শুল্ক–কর বৃদ্ধির ফলে দেশের তামাক খাতে কী প্রভাব পড়বে

শুল্ক–কর বৃদ্ধির ফলে দেশের তামাক খাতে কী প্রভাব পড়বে

পরিষ্কার বার্তা চায় জনগণ

পরিষ্কার বার্তা চায় জনগণ

অবশেষে টিউলিপ সিদ্দিকের পদত্যাগ

অবশেষে টিউলিপ সিদ্দিকের পদত্যাগ

কারাগারে এস কে সুর

কারাগারে এস কে সুর

‘গ্রিনল্যান্ডকে সামরিক এলাকা বানাতে চান ট্রাম্প’

‘গ্রিনল্যান্ডকে সামরিক এলাকা বানাতে চান ট্রাম্প’

ছাত্রলীগ নেত্রী নিশি দুই দিনের রিমান্ডে

ছাত্রলীগ নেত্রী নিশি দুই দিনের রিমান্ডে

অভি খালাস! তাহলে খুনী কে?

অভি খালাস! তাহলে খুনী কে?

জল্পনা উড়াল চীনা সংস্থা টিকটক কিনছেন না মাস্ক

জল্পনা উড়াল চীনা সংস্থা টিকটক কিনছেন না মাস্ক

ধামরাইয়ে খাদ্যদ্রব্য তৈরির কারখানায় ফের আবার ডাকাতির চেষ্টা

ধামরাইয়ে খাদ্যদ্রব্য তৈরির কারখানায় ফের আবার ডাকাতির চেষ্টা

রাজউক জোনাল অফিস স্থানান্তর আদেশের প্রতিবাদে মানববন্ধন

রাজউক জোনাল অফিস স্থানান্তর আদেশের প্রতিবাদে মানববন্ধন