হারিয়ে যাচ্ছে উত্তরাঞ্চলের নদী
০৫ এপ্রিল ২০২৫, ১২:২৫ এএম | আপডেট: ০৫ এপ্রিল ২০২৫, ১২:২৫ এএম

ভারত উজানে বাঁধ দিয়ে শুষ্ক মৌসুমে একতরফা ভাবে পানি প্রত্যাহার করায় মারাত্মক নাব্যতা সঙ্কটে পড়েছে রংপুর অঞ্চলের প্রায় সকল নদ-নদী। নাব্যতা হারিয়ে দখলদারদের কবলে পড়ে ইতোমধ্যে মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাচ্ছে এ অঞ্চলের শতাধিক নদ-নদী। পানির অভাব, অবৈধ দখলদারদের কারণে ইতোমধ্যে অনেক নদ-নদী মরা খালে পরিণত হয়েছে। অনেকগুলোই ইতোমধ্যে নিজের অস্তিত্বই হারিয়ে ফেলেছে। স্বাধীনতা পরবর্তী ৮০’র দশকেও এসব নদীতে ছিল উত্তাল যৌবন। কিন্তু এখন সেই যৌবনে ভাটা পড়ায় হারিয়ে যেতে বসেছে অনেক নদ-নদীর অস্তিত্ব। আর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে এ অঞ্চলের পরিবেশ, প্রকৃতি ও কৃষির উপর।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, দেশের উত্তর জনপদের প্রাচীনতম জনপদ বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলের রংপুর, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী জেলায় আছে অসংখ্য নদ-নদী। এসব নদীর অধিকাংশেই (প্রায় সবগুলোই) নাব্যতা হারিয়ে দখলদারদের কবলে পড়ে মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নদীগুলোর মধ্যে ৫ থেকে ৬টি বাদে প্রায় সবক’টি নদীই এখন মৃত প্রায়। এসব নদীতে এখন কোন নাব্যতা নেই। নাব্যতার অভাবে ইতোমধ্যে অস্তিত্বও হারিয়ে ফেলেছে। ফলে এসব নদীতে জীবিকা নির্বাহকারী অসংখ্য জেলে পরিবার তাদের পেশা পরিবর্তন করে অন্য পেশায় জীবিকা নির্বাহ করছে। ৯০’র দশকেও এসব নদীর বুকে পাল তোলা নৌকা চলাচল করত। পারাপারেও ব্যবহার হত ডিঙ্গী নৌকাসহ বড় বড় নৌকা। জেলেরা মাছ ধরত দিন-রাত। অথচ মাত্র ২০ থেকে ২৫ বছরে পানির অভাবে এসব নদী এখন অস্তিত্ব হারাতে বসেছে। এসব নদীতে এখন মানুষ পায়ে হেঁটে চলাচল করছে। নদীর বুকে চাষাবাদ করছে। সর্বকালের সর্বনিম্ন পানি প্রবাহ এখন তিস্তায়। ভারত উজানে ব্যারেজ নির্মাণের মাধ্যমে এক তরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করে নেয়ায় বাংলাদেশের ১১২ মাইল দীর্ঘ এই নদী শুকিয়ে এখন মৃতপ্রায় অবস্থায় পড়েছে। পানি না থাকায় নদীর বুক চিরে জেগে উঠেছে অসংখ্য চর। বর্ষাকালে ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করা করতোয়া নদীও এখন পানির অভাবে অস্তিত্ব হারাতে বসেছে। কোথাও নেই আগের সেই পারাপারের ডিঙ্গি নৌকা কিংবা পালতোলা নৌকা। রংপুরের পীরগাছা উপজেলার উপর দিয়ে এক সময় প্রবাহিত আলাইকুড়ি নদী এখন পরিণত হয়েছে মরা খালে। কালের আবর্তনে মরে যাচ্ছে রংপুরের গঙ্গাচড়ার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঘাঘট নদী। রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার লোহানীপাড়ার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া মরা নদী এখন অস্তীত্বহীন। দীর্ঘদিন পানি শুন্য থাকায় এটি দখলদারদের কবলে পড়ে এখন পুরোপুরি অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলেছে। এ নদীর বুকে আবাদ হচ্ছে বিভিন্ন ফসল। এখন শুধু স্মৃতির পাতায় রয়েছে এ নদী। আর কয়েক বছর পর হয়তো স্মৃতির পাতা থেকেও হারিয়ে যাবে এই নদী।
নদীগুলো শুকিয়ে যাওয়ায় বেকার হয়ে পড়েছেন শত শত মৎসজীবী। অভিজ্ঞ লোকজনের ধারণা এসব নদী খনন করা হলে মৎস্য, চাষাবাদসহ আবাদি জমিতে সেচের ব্যবস্থা করা যাবে। এতে কৃষকরা উপকৃত হবে।
নীলফামারী জেলার কিশোরগঞ্জ উপজেলার কুড়িপাড়া গ্রামে তিস্তার শাখা নদী হিসেবে ঘাঘট নদীর উৎপত্তি। ঘাঘট নদী গঙ্গাচড়া উপজেলার পশ্চিম সীমানা দিয়ে নোহালী, আলম বিদিতর ও বেতগাড়ি ইউনিয়নের মধ্যে দিয়ে রংপুর সদর হয়ে পীরগাছা উপজেলায় প্রবেশ করেছে। এরপর আলাইকুড়ি নদীর সঙ্গে গাইবান্ধা জেলার সাদুল্ল্যাপুর হয়ে যমুনায় মিলিত হয়েছে। পানির অভাবে নদীটি ইতোমধ্যে শুকিয়ে গেছে। অধিকাংশটাই স্থানীয় দখলদারদের কব্জায় চলে গেছে। ফলে এ নদীটিও অস্তিত্ব হারাতে বসেছে। স্থানীয় লোকজন বলছেন, এক সময় এ নদীটির ওপর দিয়ে পাল তোলা নৌকা চলতো। দূর-দূরান্ত থেকে ব্যবসায়ীরা আসতো ব্যবসা করার জন্য। কিন্তু সেগুলো এখন শুধুই স্মৃতি। পানির অভাবে শুকিয়ে যাওয়ায় দখলদারদের কবলে পড়ে এসব নদীতে এখন গম, ভুট্টাসহ বিভিন্ন ফসল চাষ হচ্ছে। নদীর বুক চিরে চলছে গরু-ছাগল।
জানা যায়, ১৭৭৬ সালের রেনেল মানচিত্রে প্রদর্শিত তিস্তার একটি শাখা ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার দক্ষিণাংশ থেকে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশের নীলফামারী জেলার ডোমার উপজেলা দিয়ে প্রবেশ করে। নদীটি নীলফামারী জেলা অতিক্রম করে রংপুর জেলার তারাগঞ্জ, বদরগঞ্জ উপজেলা দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মিঠাপুকুর উপজেলার শেষভাগে করতোয়া নদীর সঙ্গে মিলিত হয়। রেনেল মানচিত্রে এ নদীকে তিস্তা নামেই উল্লেখ করা হয়েছে
১৭৮৭ সালে ভূমিকম্প ও ভয়াবহ বন্যায় গতিপথ পরিবর্তন করে তিস্তা। এর ফলে উত্তরবঙ্গের নদীগুলো স্বাভাবিক গতি হারিয়ে ফেলে। এই শাখা নদীটি তিস্তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিস্তা নামটি বিলুপ্ত হয়ে এলাকা ভিত্তিক চাড়ালকাটা, যমুনেশ্বরী ও দেওনাই নামে পরিচিতি পায়। একইসঙ্গে এর অংশ দখলদারদের নজরে পড়ে সংকীর্ণ হতে থাকে। বন্ধ হতে থাকে নদীর স্বাভাবিক পানি প্রবাহ। সময়ের পরিবর্তনে নিজ নিজ দখলে নিয়ে অনেকেই নদীর মালিক হয়ে যায়। নদীটি না থাকায় অনেক মৎস্যজীবী পেশা হারিয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে হারিয়ে যাওয়া নদী উদ্ধার ও দখলমুক্তকরণে পরিকল্পনা হাতে নেন বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ)। তাদের উদ্যোগে বৃহত্তর রংপুর জেলায় সেচ সম্প্রসারণ প্রকল্পের (ইআইআরপি) মাধ্যমে খাল, ছোট নদী খনন কার্যক্রম শুরু হয়। এরই অংশ হিসেবে বদরগঞ্জের হারিয়ে যাওয়া মরা তিস্তা নদীর প্রবাহ এলাকা শনাক্ত করে গত বছর ১৩.৫০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এ নদীটি খনন করা হয়। এতে নতুন করে প্রাণ ফিরে পয়েছে ‘মরা তিস্তা’ নদী।
বরেন্দ্র কর্তৃপক্ষ’র মতে, ১৩ দশমিক ৫০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ‘মরা তিস্তা’ ও ৩ দশমিক ২৬ কিলোমিটারের ‘ঘিরনই নদী’ দুটি উদ্ধারের পর তা খনন করা হয়েছে। ফলে এ নদী দু’টি নতুন করে প্রাণ ফিরে পেয়েছে।
নদী বিশেষজ্ঞদের মতে, এ অঞ্চলে খরার প্রভাব দূর করতে হারিয়ে যাওয়া ছোট ছোট নদীগুলোর উদ্ধার করে খননের মাধ্যমে পানি প্রবাহ ফিরিয়ে আনা এবং নদী তীরবর্তী কৃষি, প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্য এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় নদী উদ্ধার করা জরুরি প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে মরা তিস্তা উদ্ধার ও খনন অনুকরণীয় হতে পারে বলে মনে করছেন নদী গবেষকরা। তাদের মতে, দেশের প্রত্যেক এলাকার নদ-নদীকে বাঁচাতে সরকারের পক্ষ থেকেই জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে। একইসঙ্গে উত্তরের জীবনরেখা তিস্তা নদীকে ঘিরে প্রস্তাবিত মহাপরিকল্পনার দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন

নারায়ণগঞ্জে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল পরিদর্শনে বিনিয়োগকারীরা

সারাদেশে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাঙচুরের ঘটনায় গ্রেপ্তার ৪৯

প্রবাসীদের ভোটের সুযোগ খুব সহজ নয় : সিইসি

তেল আবিব-লোহিত সাগরে মার্কিন নৌবহরে হামলার দাবি হুথিদের

বিচ্ছেদকে প্রাঙ্ক বলে ঢাকার চেষ্টা,প্রাক্তনের সম্মান রক্ষার্থে অভিনেতার মিথ্যার আশ্রয়

গাজাবাসীকে অন্য দেশে পাঠাতে ট্রাম্প-নেতানিয়াহু বৈঠক

আপাতত স্বাধীনতা কনসার্ট হচ্ছে না

জিম্মি মুক্তির লক্ষ্যে নতুন আলোচনা চলছে: নেতানিয়াহু

প্লাস্টিক দূষণ রোধে দক্ষিণ এশীয় ঐক্যের ডাক দিলো বাংলাদেশ

মিয়ানমারে ভূমিকম্পে নিহত ৩৬০০, নিখোঁজ শতাধিক

চোখের সামনে যাকে পেয়েছি, তাকেই হত্যা করেছি : ইসরায়েলি সেনার স্বীকারোক্তি

সাগরে মাছ ধরতে চাঁদা দিতে হয় বিএনপি নেতাকে

খুলনায় বাটা শোরুম ও কেএফসিতে ভাঙচুর-লুটপাটের ঘটনায় আটক ৩১

গাজায় গমের একটা দানাও ঢুকবে না : ইসরায়েল

বরিশাল জাতীয় পর্যায়ের ‘জাটকা সংরক্ষণ সপ্তাহ’র উদ্বোধন করছেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা

ট্রাম্প ইসরায়েল ও ইহুদিদের ‘অসাধারণ বন্ধু’: নেতানিয়াহু

এবার জরুরি খাদ্য সহায়তাও বন্ধ করছে যুক্তরাষ্ট্র

ফিলিস্তিনে গণহত্যা প্রতিরোধে মুসলিম দেশগুলোকে ঐক্যের বিকল্প নেই -হাফেজ নুরুন্নবী

আসছে হরর সিক্যুয়েল 'ফাইনাল ডেস্টিনেশন : ব্লাডলাইন'

ভূরুঙ্গামারী সীমান্তে সড়ক নির্মাণে কাজে বিএসএফের বাধা