হাতিয়া বেড়ে জেলার সমান
১২ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০১ এএম | আপডেট: ১২ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০১ এএম

ভাটির দেশ বাংলাদেশ। উজানে ভারতের পানি আগ্রাসন এ দেশের জনগণের জন্য অভিশাপ। ভারত শুষ্ক মৌসুমে উজানে পানি আটকে রেখে বাংলাদেশকে শুকিয়ে মারে। কিন্তু বর্ষা এলেই সবক’টি নদ-নদীর বাঁধ-ব্যারেজ খুলে পানি ছেড়ে দেয়। উজানের ঢলে বন্যা কবলিত হয়ে ভাসে বাংলাদেশ। তবে এই ঢল-বন্যা আশীর্বাদও হয়ে দাঁড়ায় যখন উজানে হিমালয় পর্বতমালা থেকে উৎপন্ন এবং ভারত হয়ে আসা ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদ, গঙ্গা-পদ্মা নদী ও মেঘনা নদীর অববাহিকাসহ ৫৪টি অভিন্ন বড় বড় নদ-নদী এবং এছাড়াও দেশের এক হাজারেরও বেশি নদ-নদীর প্রবাহ ভাটির দিকে বয়ে আনে কোটি কোটি টন পলিমাটি, বালু ও পাথরকণা। যার বেশিরভাগই প্রতিনিয়ত জমা হয়ে যাচ্ছে বঙ্গোপসাগরের কোলে বা মোহনায়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই পলিমাটির পরিমাণ বার্ষিক ১০ থেকে ১২ কোটি মেট্রিক টন। বিপুল হারে পলিমাটি জমা হতে হতে দক্ষিণে সাগরের বুক চিরে গত ২৫ থেকে ৫০ বছরে জেগে উঠেছে অন্তত ১০ হাজার বর্গ কিলোমিটার দ্বীপ ও চরাঞ্চল। প্রকৃতির আপন নিয়মেই সমুদ্র উপকূলে ভূমি জেগে ওঠার গোটা প্রক্রিয়াটা ঘটছে। মাইলের পর মাইল জেগে উঠছে চর ও দ্বীপভূমি। নয়া চর-দ্বীপ জোয়ার-ভাটায়ও বিলীন হচ্ছে না। বরং টেকসই হচ্ছে। চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, ভোলা, খুলনার সমুদ্র উপকূলে ভূমি জেগে ওঠার হার ক্রমেই বাড়ছে। সেসব চর ও দ্বীপে ধান, বাদাম জাতীয় ফসলের চাষাবাদ, গরু-মহিষসহ পশুপাখি পালন ছাড়াও মানুষ নয়া বসতি স্থাপন করছে। বুনছে নতুন দিনের স্বপ্ন।
গবেষকদের ধারণা, দেশের চর ও দ্বীপাঞ্চলে উত্থিত নতুন পললভূমি ইতোমধ্যে বাংলাদেশের মূল ভূখ-ের দশ ভাগের এক ভাগ সমান আয়তনকে ছাড়িয়ে গেছে। পুরোপুরি জেগে উঠার অপেক্ষায় আছে আরো কয়েকগুণ বেশি। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের ১০ শতাংশ যখন সমুদ্রে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছিল, তখন বঙ্গোপসাগরের কোলে জেগে উঠছে ছোট-বড় দ্বীপ ও চরভূমি। বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে যেন জাগছে অন্য এক নতুন বাংলাদেশ। গত ৩৩ বছরের স্যাটেলাইট চিত্র বিশ্লেষণে জানা গেছে, বঙ্গোপসাগরের কোলে এবং এর সংলগ্ন উপকূলীয় অনেক নদী-খাল-খাঁড়ি দিয়ে আসা পলিমাটিতে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ২০ বর্গ কি.মি. নতুন ভূমি জেগে উঠছে। যুক্ত হচ্ছে মূল ভূখ-ের সাথে। গত চার দশকে ভূমি যোগ হয়েছে দেশের মূল ভূখন্ডের প্রায় ১০ ভাগের এক ভাগ। স্পারসো’র গবেষণায় জানা গেছে, বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষে নতুন দ্বীপ ও চরাঞ্চল ধীরে ধীরে চারপাশে আকারে বড় এবং উঁচু হচ্ছে। জেগে ওঠার অপেক্ষায় আছে আরো অনেক ডুবোচর, দ্বীপ।
নতুন চর-দ্বীপ ভূমি যুক্ত হওয়ার ফলে পাল্টে যাচ্ছে বাংলাদেশের মানচিত্র। যা বদলে দিতে পারে দেশের অর্থনীতি। চরে চরে উর্বর পলিমাটি। আদিগন্ত সবুজের সমারোহ, ফল-ফসল, ক্ষেত-খামার, পাখির কলতান, হাঁসের ঝাঁক, শত শত মহিষের পাল, গরু-ছাগলের বাথান, হাঁসের খামার, চপল হরিণের দলে দলে বিচরণ, সর্বোপরি মানুষের কর্মচাঞ্চল্য নিত্যদিনের দৃশ্যমান বাস্তবতা।
বঙ্গোপসাগরের বুকে বিশেষত নোয়াখালীর হাতিয়া দ্বীপাঞ্চল ঘিরে নতুন নতুন জেগে ওঠা চর-দ্বীপ ভূমি বয়ে এনেছে বহুমুখী অর্থনৈতিক সম্ভাবনা। কৃষি-খামার সম্প্রসারণ, গবাদি পশুপাখি পালনের মাধ্যমে নতুন ভূখ-ে ভূমিহীনদের পুনর্বাসন এবং কর্মসংস্থানের পথ খুলে গেছে। সেই সাথে সামুদ্রিক সম্পদ, প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদ, পর্যটন, কৃষিজ শিল্পে সম্ভাবনার হাতছানি দিচ্ছে। এই সুবাদে বাংলাদেশের মানচিত্র বদলে যাবার সাথে সাথে বদলানো সম্ভব হবে দেশের অর্থনীতি।
সমুদ্র উপকূলে জেগে ওঠা চর ও দ্বীপভূমির অর্থনৈতিক সম্ভাবনা প্রসঙ্গে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি একুশে পদকপ্রাপ্ত বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. মইনুল ইসলাম ইনকিলাবকে বলেন, নতুন জেগে ওঠা চর-দ্বীপগুলো প্রভূত অর্থনৈতিক সম্ভাবনাময়। বাংলাদেশ পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ। উজানে ভারত থেকে আসা ঢল-বন্যায় বিপুল পরিমাণে পলিমাটি আসছে। সেই পলিমাটি ক্রমাগত জমা হচ্ছে বঙ্গোপসাগরের উপকূলভাগে। এই প্রক্রিয়ায় চর ও দ্বীপ জেগে ওঠার হার আরো বৃদ্ধি পাবে। নতুন নতুন চর-দ্বীপ ভূমি সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। তাছাড়া নতুন বিস্তীর্ণ চর ও দ্বীপাঞ্চলে কৃষি-খামার, পর্যটন, কর্মসংস্থানের বিকাশে পরিকল্পিত সদ্ব্যবহার করতে হবে।
নতুন নতুন চর ও দ্বীপভূমি জেগে ওঠার প্রক্রিয়ায় প্রধানত উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বৃহত্তর নোয়াখালী জেলা। এখানে বঙ্গোপসাগরের কোলে ছোট ছোট অনেকগুলো দ্বীপ ও চরাঞ্চল। শত শত নদ-নদী দিয়ে মেঘনার মোহনা হয়ে আসা পলিমাটি-বালু সাগর উপকূলে গিয়ে জমতে জমতে জেগে উঠেছে বিস্তীর্ণ চর ও দ্বীপ ভূমি। তাছাড়া জেগে ওঠার অপেক্ষায় আছে কয়েক ডজন চর ও দ্বীপাঞ্চল। ভূমি মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, ১৯১৩ সাল থেকে ২০১৩ পর্যন্ত একশ’ বছরে বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষে নোয়াখালী উপকূল ৫৫ কিলোমিটার দক্ষিণে সরে গেছে। দ্বীপভূমিতে চাষাবাদ শুরু হওয়ার সাথে জনবসতি গড়ে উঠেছে।
নোয়াখালী জেলার হাতিয়া উপজেলায় নতুন নতুন দ্বীপ ও চর ভূমি জেগে উঠে ক্রমাগত ভূমি সম্প্রসারণের ফলে হাতিয়া উপজেলা শিগগিরই একটি জেলার সমান আয়তনে রূপ নিতে চলেছে। কাগজে-কলমে হাতিয়া উপজেলার আয়তন ২ হাজার একশ’ বর্গ কি.মি. হলেও ছোট-বড় অন্তত ২৫টি দ্বীপ ও চর মিলে এর আয়তন দ্বিগুণেরও বেশি। অন্যদিকে গোটা নোয়াখালী জেলার আয়তন ৪ হাজার ২০২ দশমিক ৭০ বর্গ কি.মি.। হাতিয়াকে ঘিরে নতুন চর বা দ্বীপের আয়তন কোনো কোনোটি উপজেলার সমান। হাতিয়ায় জেগে ওঠা নিঝুম দ্বীপ, স্বর্ণদ্বীপের আয়তন একেকটি উপজেলার আয়তনের সমান। বঙ্গোপসাগর বুকে জেগে ওঠা ৬৫ বর্গ কি.মি. আয়তনের ভাসানচর (ঠেঙ্গার চর) এখনও হাতিয়ার অন্তর্ভুক্ত। তবে সন্দ্বীপ উপজেলার সীমানায় পড়েছে মর্মে দাবির সমর্থনে তথ্য-উপাত্ত পরীক্ষা করছে চট্টগ্রাম বিভাগীয় প্রশাসন।
হাতিয়ার নিঝুম দ্বীপ লাগোয়া নতুন চর ও দ্বীপ ভূমি জেগেছে চরকবিরা, চরকালাম, চরআলীম, সাগরিয়া, উচখালী, নিউ ডালচর। হাতিয়া দ্বীপের দক্ষিণ এবং উত্তর দিকে জাগছে আরো নতুন ভূমি। মেঘনার ভাঙনে দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ায় যে পরিমাণ ভূমি বিলীন হয়েছে, এর চারপাশে দ্বিগুণ ভূমি জেগে উঠছে। নতুন নতুন চর ও দ্বীপ ভূমির আয়তন প্রায় ২ হাজার বর্গ কিলোমিটার। ডুবোচর কিংবা জেগে ওঠার অপেক্ষায় আছে এর চেয়ে দ্বিগুণ চর ও দ্বীপভূমি। হাতিয়ার দক্ষিণ পাশে যতই নতুন দ্বীপ ও চর জেগে উঠছে, ভোলা জেলার মনপুরা উপজেলার সাথে চরভূমি দিয়ে স্থলপথে যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা ফুটে উঠছে।
হাতিয়াকে ঘিরে কিংবা এর সংলগ্ন দক্ষিণে ও দক্ষিণ-পশ্চিমে বেশ কয়েকটি নতুন চর ও দ্বীপ জেগে উঠেছে। এরমধ্যে রয়েছে প্রায় একশ’ কি.মি. আয়তনের গাঙ্গুরিয়া চর। তাছাড়া আছে পশ্চিমে ঢাল চর, চর মোহাম্মদ আলী, সাহেব আলীর চর, চর ইউনুস, চর আউয়াল, মৌলভীর চর, তমরদ্দির চর, উত্তরে নলের চর, জাগলার চর, কেয়ারিং চর, জাহাইজ্জার চর, ইসলাম চর, নঙ্গলীয়ার চর, কালাম চর ইত্যাদি। হাতিয়া ঘিরে আগেই জেগে ওঠা চর নূর ইসলামে পুরোদমে চাষাবাদ হচ্ছে। বুড়িরচরের রহমত বাজারের দেড় কি.মি. পূর্বে মেঘনা মোহনায় গত ১০ বছরে ৫০ বর্গ কি.মি. ভূমি জেগেছে। কালিরচর সংলগ্ন নতুন জেগে ওঠা ভূমিতে চাষাবাদ ও শুঁটকি তৈরি হচ্ছে।
হাতিয়ার তমরদ্দি ঘাট থেকে পশ্চিমে ভোলা জেলার মনপুরা উপজেলা। হাতিয়া ও মনপুরার মাঝখানে হাতিয়া নদীতে ৭টি চর জেগেছে। এরমধ্যে কলাতলী, তেলিয়ারচর, বদনার চর, ঢালচর ও মৌলভীর চরের আয়তন ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসব চর-দ্বীপে ২৫ থেকে ৩০ বছর আগেও ছিল বঙ্গোপসাগরের উত্তাল নীল জলরাশি। আরও ৩০ থেকে ৪০টি ডুবোচর ভাটার সময় জেগে উঠে, জোয়ারের সময় ডুবে যায়। সেসব চর ও দ্বীপ ভূমি পুরোপুরি জেগে ওঠার অপেক্ষায় রয়েছে। পুরনো নৌপথে অচেনা, বেনামী নতুন চর-ডুবোচরে আটকে যাচ্ছে কোস্টার-ট্রলার-নৌযান। বাড়ছে নৌ দুর্ঘটনা। #
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও






আরও পড়ুন

শেরপুর ভোগাই নদীতে অভিযান, ২০ ড্রেজার মেশিন ধ্বংস ও ১ লাখ টাকা জরিমানা

বিএনপি নেতাদের গোশত ছিনিয়ে নেয়ার হুমকি, ছাত্রদল আহবায়ককে শোকজ

অর্থনৈতিক অপরাধে জড়িতদের বিচারে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে

চিত্রশিল্পী মানবেন্দ্র ঘোষের বাড়ি পূর্ণ-নির্মাণের আশ্বাস দিলেন জেলা প্রশাসক ড. মানোয়ার হোসেন মোল্লা

মোংলায় বজ্রপাতে বিএনপি নেতার মৃত্যু

ব্যাংকের ভেতরেই প্রতারক চক্রের ফাঁদে নারী!

শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে একমত চীন ও মালয়েশিয়া

হাইকোর্টের ৪৮টি বেঞ্চ গঠন, রোববার থেকে চলবে বিচারকাজ

কালীগঞ্জে পৌরসভাকে পরিস্কার রাখতে প্লাসটিকের ডাস্টবিন স্থাপন

‘আগামী মাসে দেশে ফিরতে পারেন খালেদা জিয়া’

তামাকের প্যাকেট দেখিয়ে পাকিস্তানী এফ-১৬ যুদ্ধবিমান বিদ্ধস্তের খবর দিলো ভারতীয় মিডিয়া!

পুলিশ পরিদর্শক মামুন হত্যা : আরাভ খানের যাবজ্জীবন

সদরপুরে স্বর্ণেরবার দেখিয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণার অভিযোগে এক ব্যক্তি গ্রেফতার

‘বৈঠকে আমরা সন্তুষ্ট নই, দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলন চলমান থাকবে’

সালথায় ডাকাত দলের ৫ সদস্য আটক

নগরীতে পানি সরবরাহ বন্ধের হুমকি

অবৈধ ভাবে ভারতের অনুপ্রবেশকালে দুই যুবক বকশীগঞ্জ সীমান্ত থেকে আটক !

কর্ণফুলীতে ৫ টাকা বেড়েছে ঘাট ভাড়া; বিপাকে পড়েছেন এই পথে চলাচলকারী যাত্রীরা

৫০ লাখ ডলারে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসের সুযোগ, বিক্রির প্রক্রিয়া শুরু

রাঙ্গাবালীতে দাখিল পরীক্ষায় অনিয়ম, ১৪ শিক্ষার্থী সাসপেন্ড ও ৫ শিক্ষককে জরিমানা