আইন লঙ্ঘনে মহাসড়কে বাড়ছে দুর্ঘটনা

সড়কে বেপরোয়া গতি

Daily Inqilab কামাল আতাতুর্ক মিসেল

১৩ এপ্রিল ২০২৫, ১২:২৯ এএম | আপডেট: ১৩ এপ্রিল ২০২৫, ১২:২৯ এএম

ট্রাফিক আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগের অভাবে দেশের মহাসড়কগুলোতে বেড়েই চলেছে সড়ক দুর্ঘটনা। প্রতিদিনই সড়কে ঝরছে অসংখ্য তাজা প্রাণ। দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। এতে প্রাণহানিসহ পঙ্গুত্ববরণ করছে অনেকেই। হাইওয়ে পুলিশ বলছে, অধিকাংশ চালক ট্রাফিক আইন মেনে চলেন না। যত্রতত্র পার্কিংয়ের কারণে অনেক সময় দুর্ঘটনা ঘটছে। এছাড়া উল্টো পথে গাড়ি চলাচল করায় দুর্ঘটনার সংখ্যা বেড়েই চলছে।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের জানিয়েছে, এবারের ঈদুল ফিতরে ২৬ মার্চ থেকে ৫ এপ্রিল পর্যন্ত সারা দেশে ২৫৭টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় আহতের সংখ্যা ৫৫৩। সংগঠনটি বলছে, আহতের সংখ্যা দুই সহ¯্রাধিক হবে। ঢাকার জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতালেই ঈদের দুদিনে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে ভর্তি হয়েছেন ৫৭১ জন। যাদের অধিকাংশই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আক্রান্ত।

সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা গবেষকরা জানিয়েছেন, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা পেছনে কতগুলো কারণ রয়েছে। সেগুলো হলোÑ অদক্ষ চালক, বেপরোয়া গতি, ওভারটেকিংয়ের চেষ্টা, বারবার লেন পরিবর্তন, ট্রাফিক আইন না মানা, চলন্ত অবস্থায় মুঠোফোনে কথা বলা, হেমলেট ব্যবহার না করা কিংবা নিম্নমানের হেমলেট ব্যবহার। মোটরসাইকেল বেপরোয়া গতিতে চালানোর ফলে চালক নিজেকেই ঝুঁকিতে ফেলছেন তা নয়; বরং পথযাত্রীদেরও ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।

সরেজমিন দেশের সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান পঙ্গু হাসপাতাল, জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান হাসপাতালটির জরুরি বিভাগে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রায় প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে এখানে চিকিৎসা নেন। তাদের বেশির ভাগ মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার। কেউ চালক, কেউ আরোহী ও কেউ পথচারী। জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের পরিচালক অধ্যাপক ডা. আবদুল গণি মোল্লা বলেন, প্রতিদিন শুধু রাজধানী নয়, দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে রোগী বেশি আসে। চিকিৎসা নিতে আসাদের ৬৫ শতাংশ মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার। এদের মধ্যে অপ্রাপ্ত বয়স্কের সংখ্যাই বেশি।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্য বলছে, দেশে বর্তমানে প্রায় ৫২ লাখ নিবন্ধিত যানবাহন রয়েছে। এর মধ্যে নিবন্ধিত মোটরসাইকেলের সংখ্যা ৩৬ লাখের বেশি। এর মধ্যে শুধু ঢাকাতেই নিবন্ধিত মোটরসাইকেল ১০ লাখের মতো। এর বাইরে একটি বড় অংশের মোটরসাইকেল অনিবন্ধিত। বিপণনকারী কোম্পানিগুলোর হিসাবে, দেশে বছরে প্রায় পাঁচ লাখ নতুন মোটরসাইকেল বিক্রি হয়। শুধু রাজধানী ঢাকা শহরেই নয়, প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও দূরদূরান্তে যাত্রী পরিবহনের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে মোটরসাইকেল। যানজট, কম মূল্যসহ বিভিন্ন কারণে এর চাহিদা তুঙ্গে। তাছাড়া দেশেও এখন এ যানটি তৈরি হওয়ায় বর্তমানে এটি সুলভ মূল্যে কিস্তিতেও কেনা যাচ্ছে।

মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার কারণ জানতে চাইলে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, মোটরসাইকেল চালকদের বড় অংশ কিশোর ও যুবক। এদের মধ্যে ট্রাফিক আইন না জানা ও না মানার প্রবণতা প্রবল। কিশোর-যুবকরা বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালিয়ে নিজেরা দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হচ্ছে এবং অন্যদেরও আক্রান্ত করছে। তিনি বলেন, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার একটি বড় অংশ ঘটছে ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, পিকআপ ও বাসের ধাক্কা, চাপা ও মুখোমুখি সংঘর্ষে। এসব দ্রুতগতির চালকের অধিকাংশই অদক্ষ ও অসুস্থ। তাদের বেপরোয়া যানবাহন চালানোর কারণে যারা সাবধানে মোটরসাইকেল চালাচ্ছেন তারাও দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন। বেপরোয়া মোটরসাইকেলের ধাক্কায় পথচারী নিহতের ঘটনাও বাড়ছে।

বুয়েটের সড়ক ও দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) তথ্যমতে, এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় শীর্ষে অবস্থান করছে বাংলাদেশ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যেহেতু মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার ৭৪ শতাংশ ঘটে মফস্বল এলাকায়, তাই সেখানে ট্রাফিক তদারকি বাড়ানো দরকার। নিয়ন্ত্রণ করা দরকার মোটরসাইকেলের সিসি। কিশোর-তরুণ মোটরসাইকেল চালকদের বিভিন্ন বাইকার্স গ্রুপ আছে, সেখানেও তদারকি বাড়ানো যেতে পারে।

এ ব্যাপারে বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক প্রফেসর মো. হাদিউজ্জামান বলেন, ঢাকা শহরে মোটরসাইকেল চালানো আর মহাসড়কে চালানোর মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। গণপরিবহনের বিকল্প হিসেবে দূরের যাত্রায় এ মোটরসাইকেল ব্যবহারের ফলে দুর্ঘটনা বেড়েছে।

পূর্বাঞ্চলীয় হাইওয়ে পুলিশ সুপার খায়রুল আলম বলেন, ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকার পরও অনেকে মোটরসাইকেল কিনছেন। দুই-তিন বছর বাইক চালিয়ে এরপর লাইসেন্স করেন। এছাড়া তরুণ বাইকাররা সিগন্যাল মানেন না। প্রযুক্তির ঘাটতি থাকায় মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। ওভার স্পিডে মোটরসাইকেল চালিয়ে চলে যায়, তাই তাদের ধরা সম্ভব হয় না। যথাযথ হেলমেট না পরা মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মৃত্যুর একটি কারণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, হেলমেটের ব্যবহার করে না, আবার অনেকে হেলমেট ব্যবহার করলেও ফুল ফেস হেলমেট ব্যবহার করে না। কিন্তু মোটরসাইকেলের জন্য নির্ধারিত ফুলফেস হেলমেট ব্যবহার করতে হবে। তিনি বলেন, আমাদের কাছে এমনো তথ্য আছে, এসএসসি পরীক্ষা শেষ করে বাবার কাছ থেকে মোটরসাইকেলের চাবি নিয়ে রাস্তায় নেমে গেছেন। অনেকে তিনজন যাত্রী বহন করেন। এছাড়া লং ড্রাইভে ক্লান্ত অবস্থায় বাইক চালানো দুর্ঘটনার একটি বড় কারণ। উচ্চ সিসির গাড়ির সংখ্যা দেশে বেড়ে গেছে। এর ফলে অনেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। মোটরসাইকেল চালকরা মহাসড়কে ওভারটেক করার বিধান মানেন না বলেও জানান এ পুলিশ কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ওভারটেক করতে হলে ডান দিক দিয়ে ওভারটেক করতে হবে। মোটরসাইকেল চালকরা ওভারটেক করার ক্ষেত্রে ডান-বাম মানেন না। মোটরসাইকেল ছোট গাড়ি হওয়ার পরেও বড় গাড়ির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ওভারটেকিং ও রেসিং করে। এসব সমস্যা থেকে উত্তরণের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, গণপরিবহনের সংখ্যা বাড়াতে হবে। ২০টি ছোট গাড়ি বিক্রি না করে, একটি বড় গাড়ি বিক্রি করতে হবে, যাতে বেশি মানুষ চলাচল করতে পারে। ট্রাফিক আইন জেনে সেটি মানতে হবে। সর্বোপরি মানুষ সচেতন না হলে মৃত্যু কমানো সম্ভব না।

সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা গবেষকরা বলছে, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা রোধে ব্যক্তি সচেতনতাই মুখ্য। মনে রাখতে হবে, মোটরসাইকেল বেপরোয়া গতিতে চালানোর ফলে চালক কেবল নিজেকেই ঝুঁকিতে ফেলছেন না, একই সঙ্গে পথযাত্রীদেরও ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। জীবনের নিরাপত্তা সবার আগে। তাই মোটরসাইকেল চালানোর সময় সতর্ক থাকতে হবে। পাশাপাশি প্রশাসনকেও মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা রোধে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। ট্রাফিক আইন যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে। একই সঙ্গে প্রতিটি মোটরসাইকেল যেন নিবন্ধিত হয়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। লাইসেন্সবিহীন চালকদের আইনের আওতায় আনতে হবে। ১৮ বছরের নিচে কেউ যাতে ড্রাইভিং লাইসেন্স না পায়, সেদিকেও লক্ষ রাখতে হবে।


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

অর্থনৈতিক অপরাধে জড়িতদের বিচারে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে
হাইকোর্টের ৪৮টি বেঞ্চ গঠন, রোববার থেকে চলবে বিচারকাজ
‘বৈঠকে আমরা সন্তুষ্ট নই, দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলন চলমান থাকবে’
১ মে থেকে ডিম-মুরগি উৎপাদনকারী সব খামার বন্ধ ঘোষণা
ভারতের ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করতে লিগ্যাল নোটিশ
আরও
X

আরও পড়ুন

শেরপুর ভোগাই নদীতে অভিযান, ২০ ড্রেজার মেশিন ধ্বংস ও ১ লাখ টাকা জরিমানা

শেরপুর ভোগাই নদীতে অভিযান, ২০ ড্রেজার মেশিন ধ্বংস ও ১ লাখ টাকা জরিমানা

বিএনপি নেতাদের গোশত ছিনিয়ে নেয়ার হুমকি, ছাত্রদল আহবায়ককে শোকজ

বিএনপি নেতাদের গোশত ছিনিয়ে নেয়ার হুমকি, ছাত্রদল আহবায়ককে শোকজ

অর্থনৈতিক অপরাধে জড়িতদের বিচারে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে

অর্থনৈতিক অপরাধে জড়িতদের বিচারে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে

চিত্রশিল্পী মানবেন্দ্র ঘোষের বাড়ি পূর্ণ-নির্মাণের আশ্বাস দিলেন জেলা প্রশাসক ড. মানোয়ার হোসেন মোল্লা

চিত্রশিল্পী মানবেন্দ্র ঘোষের বাড়ি পূর্ণ-নির্মাণের আশ্বাস দিলেন জেলা প্রশাসক ড. মানোয়ার হোসেন মোল্লা

মোংলায় বজ্রপাতে বিএনপি নেতার মৃত্যু

মোংলায় বজ্রপাতে বিএনপি নেতার মৃত্যু

ব্যাংকের ভেতরেই প্রতারক চক্রের ফাঁদে নারী!

ব্যাংকের ভেতরেই প্রতারক চক্রের ফাঁদে নারী!

শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে একমত চীন ও মালয়েশিয়া

শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে একমত চীন ও মালয়েশিয়া

হাইকোর্টের ৪৮টি বেঞ্চ গঠন, রোববার থেকে চলবে বিচারকাজ

হাইকোর্টের ৪৮টি বেঞ্চ গঠন, রোববার থেকে চলবে বিচারকাজ

কালীগঞ্জে পৌরসভাকে পরিস্কার রাখতে প্লাসটিকের  ডাস্টবিন স্থাপন

কালীগঞ্জে পৌরসভাকে পরিস্কার রাখতে প্লাসটিকের ডাস্টবিন স্থাপন

‘আগামী মাসে দেশে ফিরতে পারেন খালেদা জিয়া’

‘আগামী মাসে দেশে ফিরতে পারেন খালেদা জিয়া’

তামাকের প্যাকেট দেখিয়ে পাকিস্তানী এফ-১৬ যুদ্ধবিমান বিদ্ধস্তের খবর দিলো ভারতীয় মিডিয়া!

তামাকের প্যাকেট দেখিয়ে পাকিস্তানী এফ-১৬ যুদ্ধবিমান বিদ্ধস্তের খবর দিলো ভারতীয় মিডিয়া!

পুলিশ পরিদর্শক মামুন হত্যা : আরাভ খানের যাবজ্জীবন

পুলিশ পরিদর্শক মামুন হত্যা : আরাভ খানের যাবজ্জীবন

সদরপুরে স্বর্ণেরবার দেখিয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণার অভিযোগে এক ব্যক্তি গ্রেফতার

সদরপুরে স্বর্ণেরবার দেখিয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণার অভিযোগে এক ব্যক্তি গ্রেফতার

‘বৈঠকে আমরা সন্তুষ্ট নই, দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলন চলমান থাকবে’

‘বৈঠকে আমরা সন্তুষ্ট নই, দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলন চলমান থাকবে’

সালথায় ডাকাত দলের ৫ সদস্য আটক

সালথায় ডাকাত দলের ৫ সদস্য আটক

নগরীতে পানি সরবরাহ বন্ধের হুমকি

নগরীতে পানি সরবরাহ বন্ধের হুমকি

অবৈধ ভাবে ভারতের অনুপ্রবেশকালে দুই যুবক বকশীগঞ্জ সীমান্ত থেকে আটক !

অবৈধ ভাবে ভারতের অনুপ্রবেশকালে দুই যুবক বকশীগঞ্জ সীমান্ত থেকে আটক !

কর্ণফুলীতে ৫ টাকা বেড়েছে ঘাট ভাড়া; বিপাকে পড়েছেন এই পথে চলাচলকারী যাত্রীরা

কর্ণফুলীতে ৫ টাকা বেড়েছে ঘাট ভাড়া; বিপাকে পড়েছেন এই পথে চলাচলকারী যাত্রীরা

৫০ লাখ ডলারে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসের সুযোগ, বিক্রির প্রক্রিয়া শুরু

৫০ লাখ ডলারে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসের সুযোগ, বিক্রির প্রক্রিয়া শুরু

রাঙ্গাবালীতে দাখিল পরীক্ষায় অনিয়ম, ১৪ শিক্ষার্থী সাসপেন্ড ও ৫ শিক্ষককে জরিমানা

রাঙ্গাবালীতে দাখিল পরীক্ষায় অনিয়ম, ১৪ শিক্ষার্থী সাসপেন্ড ও ৫ শিক্ষককে জরিমানা