মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির বঙ্গজয়-৩
০৯ জুন ২০২৩, ১২:০০ এএম | আপডেট: ২৫ জুন ২০২৩, ০৮:১৬ পিএম
মিনহাজুস সিরাজ দুই ব্যক্তির কাছ থেকে ঘটনাটি শোনেন। তারা হলেন ফারগানা রাজ্যের দুই বিজ্ঞ ভাই; নিজাম উদ্দীন ও শামসামুদ্দীন। তারা বিন বখতিয়ারের প্রশাসনে নিযুক্ত ছিলেন। ঘটনার প্রায় ৪০ বছর পরে (৬৬১ হিজরিতে) লাখনৌতিতে তাদের সাথে মিনহাজুস সিরাজের দেখা হয়। সেখানে তারা তাকে ঘটনাটি শুনান। ঘটনা বর্ণনায় তারা কিছু ভুল করেন। যেমন দুর্গের অধিবাসীদের তারা ন্যাড়ামাথার ব্রাহ্মণ বলে আখ্যা দেন। আসলে তারা ছিলেন বৌদ্ধ। হিন্দুদের বিদ্যালয়কে বিহার বলে অভিহিত করেন, আসলে বিহার হলো বৌদ্ধদের উপাসনালয় ও বিদ্যালয়। মিনহাজ এই ঘটনা বর্ণনা করেন এই ভুলসহ।
মিনহাজের বিবরণে আমরা পাচ্ছি ‘কিলআয়ে বিহারে’র উল্লেখ, যেখানে বিন বখতিয়ার অভিযান পরিচালনা করেন।
কিলআ বা কিল্লায়ে বিহার মানে বিহারের সেনানিবাস। এই কথাটার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কেউ কেউ লিখেছেন সেটা মূলত ছিল ওদন্তপুরী মঠ। বিন বখতিয়ার ওদন্তপুরীকে শত্রæদের সেনাশিবির মনে করেন। এর মানে ওদন্তপুরী মঠে বিন বখতিয়ার অভিযান করেছেন, এটা মিনহাজ বলেননি। তিনি বলেছেন বিহারের কেল্লা বা দুর্গে অভিযানের কথা। একে ব্যাখ্যাকাররা ধরে নিচ্ছেন ওদন্তপুরী মঠ। যেহেতু মিনহাজ তবকাতের আগের খÐে উদন্দপুর জয়ের কথা বলেছেন এবং ১৬০৮ সালে ঐতিহাসিক লামা তারানাথ (১৫৭৫-১৬৩৪) তার ঐরংঃড়ৎু ড়ভ ইঁফফযরংস রহ ওহফরধ (এুধ-মধৎ-পযড়ং-নুঁহ গ্রন্থে স্পষ্ট করেন যে, অভিযানের কবলে পড়া বিহারটি হলো ওদন্তপুরী। কালিকারঞ্জন কানোনগো (১৮৯৫-১৯৭২) রমেশচন্দ্র মজুমদার (১৮৮৮-১৯৮০) আবদুল করীম (১৯২৮-২০০৭) মোহর আলী (১৯২৯-২০০৭), রিচার্ড ম্যাক্সওয়েল ইটনসহ ঐতিহাসিকরা একেই কবুল করেছেন।
মুহম্মদ বিন বখতিয়ার এই বিহারকে সেনানিবাস মনে করেছিলেন ভুলবশত। কিন্তু কেন তিনি একে সেনানিবাস ভাবলেন? বস্তুত ওদন্তপুরী মঠকে সেনাশিবির মনে করার কারণ ছিল। লামা তারানাথ দিয়েছেন এর ব্যাখ্যা। তার মতে, খুব সম্ভবত দুর্গের প্রাচীর দেখে এবং সৈন্যের উপস্থিতির খবর শুনে বিন বখতিয়ার একে সেনানিবাস ভেবেছিলেন। তিনি দেখিয়েছেন তখনকার বৌদ্ধ মঠগুলো সেনাশিবিরের আদলে বানানো হতো। এর প্রমাণ আমরা দেখব ওদন্তপুরীসহ অন্যান্য বিহারের ধ্বংসাবশেষেও। আমরা যদি শালবন বিহার লক্ষ করি, এর প্রমাণ পাব। এ বিহারে আছে কেন্দ্রীয় এক মÐপ, যার চারদিকে ক্রুশ আকারে চারটি শাখা। ১৮৭ বর্গমিটার আয়তনের মধ্যে আছে ১৫৫টি কক্ষ। এতে মূল প্রবেশপথ মাত্র একটি। উত্তর দিকের ঠিক মধ্যবর্তী অংশে যার অবস্থান। প্রবেশপথের সামনের অংশ ২২.৬ মিটার প্রশস্ত, আর এর উভয় পাশে আছে বাইরের দিকে মুখ করা দুই প্রহরী ঘর। প্রবেশের পথে কড়া নিরাপত্তা। গোটা বিহারের দেয়ালগুলো আকারে অস্বাভাবিক রকমের সুদৃঢ় ও বিশাল। বিহারের সব দেয়াল বিশালায়তন ও ইট নির্মিত। পেছনের দেয়াল সবচেয়ে পুরু ও প্রশস্ত। এই দেয়াল দুর্ভেদ্য, সুউচ্চ ও পাঁচ মিটার পুরু। গোটা কাঠামোটাই সুনিশ্চিতভাবে এক দুর্গের চিত্র হাজির করে। সেকালের সেনানিবাসগুলো যতটা সুরক্ষিত ও দুর্ভেদ্য হতো, এই মঠ ঠিক তেমনই।
দিনাজপুরের সীতাকোট বৌদ্ধবিহারে একই চিত্র লক্ষ করব। সেখানে বিহারের চারদিকে আছে শক্তিশালী নিরাপত্তা প্রাচীর। প্রাচীরের চার দিকে আছে পরিখা। বিহারের উত্তর দিকে ঠিক মাঝামাঝিতে ছিল প্রধান ফটক। এর দক্ষিণ দিকে একটি মন্দির ছিল। এর গঠন, নিরাপত্তা ব্যবস্থা, চার দিকের পরিবেশ একে একটি দুর্গ হিসেবেই উপস্থাপন করে। ওদন্তপুরী ছিল এসবের তুলনায় অধিকমাত্রায় দুর্গবৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। এখানে যাতায়াত ব্যবস্থা ছিল দুর্গম, দুর্গের চার দিক ছিল নিরাপত্তা ব্যবস্থায় আচ্ছাদিত। এর বাইরের প্রাচীর ছিল একেবারে সেনানিবাসের আদলে গড়া, দুর্গফটকে ছিল শক্ত প্রহরার ব্যবস্থা। কোনো কোনো গবেষক দাবি করেছেন, সেন রাজাদের গুপ্তচররা তুর্কি বাহিনীকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে ওদন্তপুরীতে আক্রমণ করতে প্ররোচিত করে, যেহেতু বিহারের পাল রাজারা ছিল তাদের প্রতিপক্ষ। এর মাধ্যমে বিন বখতিয়ারকে সেখানকার সীমানায় জটিল সঙ্ঘাতে ফেলে আটকে রাখার ইচ্ছে ছিল তাদের। বিন বখতিয়ার ওদন্তপুরীর বাহ্যিক অবস্থা লক্ষ করে তাদের প্রচারে আস্থা রাখেন, একে সেনানিবাস হিসেবে বিশ্বাস করেন।
ড. সুশীলা মÐল তার বিখ্যাত ঐরংঃড়ৎু ড়ভ ইবহমধষ: ঞযব সরফফষব ধমব, ১২০০-১৫২৬ গ্রন্থে দেখিয়েছেন ওদন্তপুরী ছিল দুর্গম, সুরক্ষিত, শিখরস্থিত আশ্রম। এখানে স্বয়ং বিহারের রাজা গোবিন্দপাল নিজের সৈন্যদের নিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করেন। ফলে বিহার জয়ের জন্য বিন বখতিয়ার রাজধানীর পরে এখানে আক্রমণ করেন। ফলে সৈন্যদের পাশাপাশি বৌদ্ধভিক্ষুরাও অস্ত্র ধারণ করেন। যুদ্ধে তারা পরাজিত হন এবং গোবিন্দ পাল দেব নিহত হন।
এর মানে পরিস্থিতি এখানে অভিযানকে অনিবার্য করে তুলেছিল। পরাজিত রাজা রাজধানী থেকে পালিয়ে এখানে আশ্রয় নিয়েছেন জেনে বিন বখতিয়ার দুর্গের দিকে এগিয়ে আসেন। দুর্গরক্ষীরা তাকে ফটক খুলে দেয়নি। ফলে যুদ্ধ হয়। তখনকার অভিযানসমূহের নিয়মই ছিল এমন। তবকাতের অনুবাদক আবুল কালাম জাকারিয়ার (১৯১৮-২০১৬) মতে, এখানে যে যুদ্ধ হয়ে থাকবে, তা সম্ভবত একপক্ষীয় ছিল না, এখানে প্রচÐ প্রতিরোধ হয়েছিল, এমন সম্ভাবনা রয়েছে। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ও (১৮৮৫-১৯৩০) দিয়েছেন ওদন্তপুরীর প্রতিরোধের বিবরণ। তার মতে, বিন বখতিয়ারের বিরুদ্ধে এখানে বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং সেনারা সমন্বিতভাবে প্রতিরোধ করে। বিহার রাজার সেনারা এখানে এসে থাকবে চারদিক থেকে কোণঠাসা হবার ফলে। এখানে এসে তারা আশ্রয় নিয়ে থাকবে। (চলবে)
বিভাগ : বিশেষ প্রতিবেদন
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
রামু সেনানিবাসে সশস্ত্র বাহিনী দিবস পালিত
এক সপ্তাহে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ল ৬ কোটি ১০ লাখ ডলার
প্রবাসীদের যে জন্য সুখবর দিলো মালয়েশিয়া
জাবি শিক্ষার্থী মৃত্যুর ঘটনায় মামলা, তদন্ত কমিটি গঠন, ফটকে তালা, মশাল মিছিল
মাদকের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে থাকবে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল
"নতুন সিনেমা নিয়ে ফিরছেন গ্লোবাল তারকা অ্যাঞ্জেলিনা জোলি"
ড. ইউনূসকে নিয়ে খালেদা জিয়ার পুরোনো যে বক্তব্য ভাইরাল
নতুন নির্বাচন কমিশনের প্রতি ইসলামী আন্দোলনের শুভ কামনা
আলোচনায় ফ্যাসিস্ট হাসিনার ‘টুস করে ফেলে দেয়ার’ হুমকি
দীর্ঘ ১৫ বছর সাংবাদিকরা বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করতে পারেনি: খোকন
'ইউটিউব ট্রেন্ডিংয়ে রয়েছে অভিনেতা তারিক আনাম খানের নাটক'
বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার আহ্বান
ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর বোর্ড অব গভর্নর সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সম্বর্ধনা
সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সংবর্ধনা
লালমোহনে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত যুবদল নেতা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু
চকরিয়ার বিএনপি নেতা আবু তাহের চৌধুরীর মৃত্যুতে সালাহউদ্দিন আহমদ ও হাসিনা আহমদের শোক
উইন্ডিজের বিপক্ষে মাঠে নামছে বাংলাদেশ
বেইজিং সংস্কৃতি ও পর্যটন ব্যুরো ও আটাবের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত
প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানের সাক্ষাৎ
দেশের বাজারে ফের বাড়ল সোনার দাম