ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহার

নাব্যতা হারিয়ে দখলদারদের কবলে পড়ে মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাচ্ছে একের পর এক নদী

Daily Inqilab হালিম আনসারী, রংপুর থেকে

০৪ এপ্রিল ২০২৫, ০৭:২৮ পিএম | আপডেট: ০৪ এপ্রিল ২০২৫, ০৭:২৮ পিএম

ভারত উজানে বাঁধ দিয়ে শুষ্ক মৌসুমে একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করায় মারাত্মক নাব্যতা সংকটে পড়েছে রংপুর অঞ্চলের প্রায় সকল নদ-নদী। নাব্যতা হারিয়ে দখলদারদের কবলে পড়ে ইতিমধ্যে মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাচ্ছে এ অঞ্চলের শতাধিক নদ-নদী। পানির অভাব ও অবৈধ দখলদারদের কারণে ইতিমধ্যে অনেক নদ-নদী মরা খালে পরিণত হয়েছে। অনেকগুলোই অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলেছে। স্বাধীনতা-পরবর্তী ৮০’র দশকেও এসব নদীতে ছিল উত্তাল যৌবন। কিন্তু এখন সেই যৌবনে ভাটা পড়ায় অনেক নদ-নদী হারিয়ে যেতে বসেছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে এ অঞ্চলের পরিবেশ, প্রকৃতি ও কৃষিতে।

 

 

তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, দেশের উত্তর জনপদের প্রাচীনতম অঞ্চল বৃহত্তর রংপুরের রংপুর, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী জেলায় অসংখ্য নদ-নদী রয়েছে। এর মধ্যে গাইবান্ধায় আলাই, ইছামতি, করতোয়া, কাটাখালি, কালপানি, গাংনাই, ঘাঘট, তিস্তা, নলেয়া, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, মরা, মরুয়াদহ, মাইলা, মানাস, মাশানকুড়া, বাঙালি, লেঙগা, শাখা তিস্তা, হলহলি নদীগুলোর অস্তিত্ব সংকটের মধ্যে পড়েছে।

 

 

কুড়িগ্রামে অন্তাই, কালজানি, কালো, কুরসা, কোটেশ্বর, খলিশাকুড়ি, গঙ্গাধর, গদাধর, গিরাই, গোদ্ধার, ঘড়িয়ালডাঙা, ঘাগুয়া, চান্দাখোল, জালশিরা, জিঞ্জিরাম, তিস্তা, তোর্সা, দুধকুমার, ধরলা, নওজল, নাগদহ, ফুলকুমার, ব্রহ্মপুত্র, সোনাভরি, হাড়িয়ার ডারা নদীগুলো শুকিয়ে গেছে।

 

 

নীলফামারীতে আউলিয়াখান, করতোয়া, কলমদার, কুমলাল, খড় খড়িয়া, খলিসাডিঙি, চারা, চারালকাঠা, চিকলি, তিস্তা, দেওনাই, ধাইজান, ধুম, নাউতারা, বামনডাঙা, বুড়ি খোড়া, যমুনেশ্বরী, শালকি নদীগুলো নাব্যতা হারিয়ে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। লালমনিরহাটে গিদারী, চতরা, তিস্তা, ধরলা, ভেটেশ্বর, রতনাই, সাকোয়া, সানিয়াজান, সিঙ্গিমারী নদীগুলো হারিয়ে যেতে বসেছে।

 

 

রংপুরে আখিরা, ইছামতি, করতোয়া, কাঠগড়ি, খোকসাঘাঘট, ঘাঘট, তিস্তা, নলশীসা, যমুনেশ্বরী, শাখা চিকলি, সোনামতি নদীগুলোও নাব্যতা সংকটে পড়েছে। এই অঞ্চলের প্রায় সব নদীই বর্তমানে মৃতপ্রায়। ৯০’র দশকেও এসব নদীর বুকে পালতোলা নৌকা চলত। অথচ মাত্র ২০-২৫ বছরে পানির অভাবে এসব নদী অস্তিত্ব হারাতে বসেছে। বর্তমানে এসব নদীর বুকে চাষাবাদ হচ্ছে। সর্বকালের সর্বনিম্ন পানি প্রবাহ এখন তিস্তা নদীতে।

 

 

ভারত উজানে ব্যারেজ নির্মাণের মাধ্যমে একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করায় বাংলাদেশের ১১২ মাইল দীর্ঘ তিস্তা নদী শুকিয়ে গেছে। বর্ষাকালে ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করা করতোয়া নদীও পানির অভাবে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। রংপুরের পীরগাছার আলাইকুড়ি নদী পরিণত হয়েছে মরা খালে। কালের আবর্তনে মরে যাচ্ছে গঙ্গাচড়ার ঘাঘট নদী। বদরগঞ্জ উপজেলার মরা নদী দখলদারদের কবলে পড়ে পুরোপুরি অস্তিত্ব হারিয়েছে।

 

 

নদীগুলো শুকিয়ে যাওয়ায় শত শত মৎস্যজীবী বেকার হয়ে পড়েছেন। নদী বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব নদী খনন করা হলে কৃষি ও মৎস্য খাত উপকৃত হবে। ঘাঘট নদীর উৎপত্তি নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলার কুড়িপাড়া গ্রামে। এটি রংপুর সদর হয়ে গাইবান্ধার সাদুল্ল্যাপুরে যমুনায় মিলিত হয়েছে। কিন্তু পানির অভাবে শুকিয়ে গিয়ে দখলদারদের কব্জায় চলে গেছে। একসময় যে নদীতে পালতোলা নৌকা চলত, এখন সেখানে চাষাবাদ হচ্ছে।

 

 

১৭৭৬ সালের রেনেল মানচিত্রে তিস্তার একটি শাখা পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি থেকে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশের নীলফামারী জেলার ডোমারে প্রবেশ করে। এরপর এটি করতোয়ার সঙ্গে মিলিত হয়। ১৭৮৭ সালের ভূমিকম্প ও ভয়াবহ বন্যায় তিস্তা নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়। পরবর্তীতে এই শাখা নদীটি সংকীর্ণ হতে হতে এখন প্রায় বিলুপ্ত।

 

 

এমন পরিস্থিতিতে হারিয়ে যাওয়া নদী উদ্ধার ও দখলমুক্তকরণে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) উদ্যোগ নিয়েছে। তারা বদরগঞ্জের হারিয়ে যাওয়া মরা তিস্তা নদী খনন করে নতুন করে প্রাণ ফিরিয়েছে। বরেন্দ্র কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ১৩.৫০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের মরা তিস্তা ও ৩.২৬ কিলোমিটারের ঘিরনই নদী খননের পর নতুন প্রাণ ফিরে পেয়েছে।

 

 

নদী বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, খরার প্রভাব দূর করতে হারিয়ে যাওয়া নদীগুলো উদ্ধার ও খননের মাধ্যমে পানি প্রবাহ ফিরিয়ে আনা জরুরি। মরা তিস্তা খনন একটি সফল দৃষ্টান্ত হতে পারে। দেশের প্রতিটি নদীকে বাঁচাতে সরকারের পক্ষ থেকে জোরালো পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। বিশেষ করে উত্তরের জীবনরেখা তিস্তা নদীকে ঘিরে প্রস্তাবিত মহাপরিকল্পনা দ্রুত বাস্তবায়ন করা উচিত।

 

বিভাগ : বিশেষ প্রতিবেদন


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-১২
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-১১
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-১০
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-৯
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-৮
আরও
X

আরও পড়ুন

পিএসএলে এক বছর নিষিদ্ধ বশ

পিএসএলে এক বছর নিষিদ্ধ বশ

কোচিং না করায় এসএসসি পরীক্ষার হলে ছাত্রীর সঙ্গে যে কাণ্ড করলেন শিক্ষকদ্বয়!

কোচিং না করায় এসএসসি পরীক্ষার হলে ছাত্রীর সঙ্গে যে কাণ্ড করলেন শিক্ষকদ্বয়!

গাজায় যুদ্ধ থামাতে ইসরায়েলি সেনা-শিক্ষাবিদদের পিটিশনে স্বাক্ষর

গাজায় যুদ্ধ থামাতে ইসরায়েলি সেনা-শিক্ষাবিদদের পিটিশনে স্বাক্ষর

স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিয়েছে ১৪৭ দেশ

স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিয়েছে ১৪৭ দেশ

ইসরায়েলের পণ্য রাষ্ট্রীয়ভাবে নিষিদ্ধের দাবি

ইসরায়েলের পণ্য রাষ্ট্রীয়ভাবে নিষিদ্ধের দাবি

তানজানিয়ার বিরোধী নেতার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ

তানজানিয়ার বিরোধী নেতার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ

মেঘনা আলমকে ‘নিরাপত্তা হেফাজতে’ নেওয়া হলো কেন, জানালো ডিএমপি

মেঘনা আলমকে ‘নিরাপত্তা হেফাজতে’ নেওয়া হলো কেন, জানালো ডিএমপি

নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের দুই নারী এক শিশুর খন্ড বিখন্ড মরদেহ উদ্ধার

নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের দুই নারী এক শিশুর খন্ড বিখন্ড মরদেহ উদ্ধার

গুরুদাসপুরে ধর্ষণে ব্যর্থ হয়ে নারীকে এলোপাথাড়ি কুপিয়ে জখম

গুরুদাসপুরে ধর্ষণে ব্যর্থ হয়ে নারীকে এলোপাথাড়ি কুপিয়ে জখম

স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে বিক্ষোভে উত্তাল বায়তুল মোকাররম

স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে বিক্ষোভে উত্তাল বায়তুল মোকাররম

দৈনিক ইনকিলাবের সিংগাইর প্রতিনিধি রকিব বিশ্বাসের মায়ের মৃত্যু

দৈনিক ইনকিলাবের সিংগাইর প্রতিনিধি রকিব বিশ্বাসের মায়ের মৃত্যু

বরগুনায় জলবায়ু ন্যায়বিচার দাবিতে তরুণদের ২২ সংগঠনের ধর্মঘট

বরগুনায় জলবায়ু ন্যায়বিচার দাবিতে তরুণদের ২২ সংগঠনের ধর্মঘট

রাষ্ট্রপ্রধানদের দেখলে কেন সেলফি তুলতে ঝাঁপিয়ে পড়তেন হাসিনা?

রাষ্ট্রপ্রধানদের দেখলে কেন সেলফি তুলতে ঝাঁপিয়ে পড়তেন হাসিনা?

চাল ব্যবসায়ী রশিদের বাড়িতে গুলির ঘটনায় গ্রেপ্তার ১

চাল ব্যবসায়ী রশিদের বাড়িতে গুলির ঘটনায় গ্রেপ্তার ১

শ্রীনগরে ফিলিস্তিনের স্বাধিনতার পক্ষে গণমানববন্ধন

শ্রীনগরে ফিলিস্তিনের স্বাধিনতার পক্ষে গণমানববন্ধন

ফুলপুরে নিচের মাটি সরে গিয়ে ঝুলে আছে সেতু, ঝুঁকি নিয়ে পারাপার

ফুলপুরে নিচের মাটি সরে গিয়ে ঝুলে আছে সেতু, ঝুঁকি নিয়ে পারাপার

যশোর-অভয়নগরে গাছ কাটার সময় গাছের নিচে চাপা পড়ে এক ব্যক্তির মৃত্যু

যশোর-অভয়নগরে গাছ কাটার সময় গাছের নিচে চাপা পড়ে এক ব্যক্তির মৃত্যু

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অন্তর্বর্তীকালীন পারমাণবিক চুক্তির ভাবনায় ইরান

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অন্তর্বর্তীকালীন পারমাণবিক চুক্তির ভাবনায় ইরান

ফিলিস্তিন স্বীকৃতি ইস্যুতে ম্যাক্রোঁকে এড়িয়ে গেল যুক্তরাষ্ট্র

ফিলিস্তিন স্বীকৃতি ইস্যুতে ম্যাক্রোঁকে এড়িয়ে গেল যুক্তরাষ্ট্র

গোয়ালন্দে পদ্মা নদীতে বিষ দিয়ে অবাধে মাছ শিকার

গোয়ালন্দে পদ্মা নদীতে বিষ দিয়ে অবাধে মাছ শিকার