গিয়াসুদ্দীন বলবন : স্থিতিস্থাপক সুলতান-২
২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০৪ এএম
ইলতুতমিশের উত্তরসূরিদের অযোগ্যতার কারণে দিল্লির আশেপাশের অঞ্চলগুলিতে মেও বিদ্রোহীরা শক্তিশালী হয়ে ওঠে। তাদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পায়। রাতে তারা শহরে গিয়ে দেয়াল ভেঙ্গে ঘরে ঘরে ঢুকে পড়তো এবং মানুষকে জর্জরিত করতো। মেওদের ভয়ে দিল্লির মানুষের ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছিল। তারা দিল্লির আশেপাশের সরাইখানাগুলোতেও লুটপাট করতো।
দিনদিন মেও বিদ্রোহীদের সংখ্যা যেমন বেড়ে চলছিল, তেমনি বাড়ছিলো দিল্লির নিকটবর্তী জঙ্গল। ঘনবৃক্ষ, বেয়াড়া ঝোপঝাড়। এসব জায়গা ছিলো ডাকাতদের আশ্রয়। দুই নদী তীরবর্তী দুষ্কৃতকারীরা নির্বিঘেœ এ পথে ডাকাতি করতো। চারদিক থেকে (দিল্লি আসার) রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। ব্যবসায়ীদের যাতায়াত অসম্ভব হয়ে পড়ে। ভীতি ও আতঙ্কে নগরীর পশ্চিম ফটক বন্ধ করে দেওয়া হয়। আসরের পরে সেগুলো বন্ধ করে দেওয়া হতো। এরপর কেউ কবর যিয়ারত বা সুলতানি (শামসি) পুকুরের পারে ঘুরে বেড়ানোর সাহসও করতো না। এমনকি আসরের নামাযের আগেও পুকুর থেকে পানি আনতে যাওয়া দাস-দাসীদের উপর আক্রমণ করতো দস্যুরা। তাদের কাপড় খুলে ফেলতো, উলঙ্গ করে দিত।
বলবন এই নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন। মেওদের দমনে এবং দিল্লির আশেপাশের জঙ্গল নিয়ন্ত্রণে পুরো বছর কাটিয়ে দেন। বহু দুর্ধর্ষ মেওকে হত্যা করতে সক্ষম হয় তার বাহিনী। তিনি গোপালগীরে একটি দুর্গ নির্মাণ করেন এবং সেখানে অনেক থানা (সামরিক চৌকি) স্থাপন করে আফগানদের হাতে তুলে দেন। এসব অঞ্চলকে (যা থানার খরচ পূরণ করতে দেওয়া হয়েছিল) কর থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল।
এ যুদ্ধে সুলতানের একজন প্রিয় গোলাম ও সহচর ইয়াক লাখী মেওদের হাতে নিহত হন। সুলতানের তরবারি আল্লাহ তাআলার অনেক বান্দাকে রক্ষা করে। মেওদের হুমকি এবং অত্যাচার থেকে যাদের রক্ষার কেউ ছিলো না। সুলতানের প্রতিরোধের ফলে সে সময় থেকে আজ পর্যন্ত দিল্লি মেওদের নৈরাজ্য থেকে থেকে সুরক্ষিত আছে।’
মেওদের দমনের পর সুলতান দু’ নদী তীরবর্তী এলাকার দিকে দৃষ্টি দেন। দু’নদীর শহর (কসবা) এবং এর আশেপাশের অঞ্চলগুলি উপযুক্ত সামন্তদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছিল। তারা ছিলো খুব সম্পদশালী। নৌপথে তারা ধ্বংসের বন্যা বইয়ে দিতো। বলবন আদেশ জারি করেন, বিদ্রোহীরা শান্তিকে গ্রহণ করুক। নতুবা তাদের আস্তানাগুলোকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করা হবে। তাদের পুরুষদের হত্যা করা হবে এবং তাদের নারী ও শিশুদের দাস হিসেবে গ্রহণ করা হবে। লুটের মাল বাজেয়াপ্ত করা হবে এবং আশ্রয়ের জঙ্গল পুরোপুরি পরিষ্কার করা হবে। বিদ্রোহীরা আনুগত্য স্বীকার না করায় কয়েকজন আমির বিশাল বাহিনী নিয়ে এ অভিযানের জন্য প্রস্তুত ছিল। তারা নেতৃস্থানীয় দস্যুদের নাস্তানাবুদ করে দেয়। বন পরিষ্কার করে এবং দুষ্কৃতিকারীদের কঠোরভাবে দমন করে। সেখানকার প্রজারা আনুগত্য মেনে নেয়, বাধ্য আচরণ করে এবং গ্রামগুলো রক্ষা পায়।
বারানি লিখেছেন, ‘দু’ নদী এলাকার অভিযান শেষ করে বলবন অযোধ্যার সড়ক নিরাপদ করার জন্য দুই বার শহরের বাইরে আসেন। তিনি কাম্পিল ও পাতিয়ালা এলাকায় এসে এ অঞ্চলে পাঁচ বা ছয় মাস অবস্থান করেন।
তিনি হঠাৎ আক্রমণ করে দস্যু ও বিদ্রোহীদের পরাজিত করতেন। এভাবে নানা অঞ্চলে যাতায়াতের পথ পরিষ্কার হয়ে গেল। কাফেলা ও ব্যবসায়ীরা নিশ্চিন্তে যাতায়াত করতে পারতো। এসব অঞ্চল থেকে প্রচুর গণিমত দিল্লিতে জড়ো হয়। এখানে দাস ও গবাদি পশু সহজলভ্য হয়ে যায়।
কাম্পিল পাতিয়ালা এবং ভোজপুরের যাতায়াতপথে দস্যুদের বিশাল ও বিস্তৃত ঘাঁটি ছিল। সেখানে মজবুত দুর্গ এবং সুউচ্চ ও প্রশস্ত মসজিদ নির্মিত হয়। তিন এলাকার তিনটি দুর্গই আফগানদের হাতে অর্পণ করা হয় এবং দুর্গ সংলগ্ন আবাদি জমির ওপর থেকে কর তুলে নেয়া হয়। কেননা এসব আফগান মুসলমানদের কারণে ওই অঞ্চলের শহর ও জনপদগুলো এতটাই স্থিতিশীল হয়ে উঠেছিল যে, রাজপথে ডাকাতি ও লুটপাট সম্পূর্ণরূপে রোধ করা সম্ভব হয়েছিল।’ বারানি আরো লিখেছেন, ‘সে সময় থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত তিন শতাব্দী পেরিয়ে গেছে, এখনো পথগুলো নিরাপদ। কারণ দুর্গ নির্মাণ এবং সেনাছাউনি বা থানাগুলোকে শক্তিশালী করায় টেকসই নিরাপত্তা লাভ করেছে ভারতের জনগণ। তারপর থেকে ছিনতাই ও ডাকাতি সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়।’
এ অভিযানের সময় জালালী দুর্গও নির্মিত হয়। ডাকাতদের ঘাঁটিগুলো দখল করে সামরিক ফাঁড়িতে পরিণত করা হয়েছিল। জালালী দুর্গের জমিও করমুক্ত করা হয়েছিল। এর আগে সেখানে ডাকাতদের আস্তানা ছিল, এখন তা মুসলমান এবং পথের নিরাপত্তা প্রহরীদের আবাসস্থল।
সুলতান যখন এসব অভিযানে ব্যস্ত ছিলেন, তখন বারবার তার কানে এ সংবাদ এসে পৌঁছচ্ছিল যে, কাঠিরে বিদ্রোহীদের সংখ্যা বেড়েই চলছে। তারা প্রজাদের গ্রামে লুটপাট চালাতো। তারা বাদায়ুন ও আমরুহার লোকদের উপর নিষ্ঠুরতা চালাতো। এসব অপরাধ তারা প্রকাশ্যে করতো। তারা এতটাই শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল যে, বাদায়ুন ও আমরুহার শাসকদেরও পরোয়া করতো না। তাদের শক্তি ও ক্ষমতার কারণে আশপাশের প্রাদেশিক শাসনকর্তাগণ আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন। কেউই তাদের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার সাহস করেননি। বলবন বুঝতে পারলেন, কাঠিরের এ দস্যুদের দমন করতে হলে তার সেনাবাহিনীকে মার্চ করতে হবে। কাম্পিল ও পাতিয়ালা থেকে তিনি দিল্লিতে ফিরে এলেন এবং কেন্দ্রীয় বাহিনীকে প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দিলেন। তিনি ঘোষণা করলেন, আমি পার্বত্য অঞ্চলে শিকার করতে যাব। কিন্তু সেনাবাহিনী প্রস্তুত হলে তিনি কাঠিরের দিকে অগ্রসর হন এবং তিন দিন দুই রাতে সেখানে পৌঁছান। কোনো কোনো ঐতিহাসিক লিখেছেন, সম্ভবত সেখানকার বিদ্রোহী অঞ্চলের সব পুরুষকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন বলবন। কিন্তু এটা অবিশ্বাস্য। কারণ সুলতান গ্রামবাসীদের ডাকাতদের হাত থেকে রক্ষা করতে গিয়েছিলেন। বেসামরিক মানুষের সুরক্ষাই ছিলো তার অগ্রাধিকার। যারা ডাকাতদের দ্বারা প্রথমত জর্জরিত হচ্ছিলো, তারা ছিলো সেই এলাকার সাধারণ মানুষ। বলবন তাদের আশ্বস্ত করতে যান। এ এলাকায় কয়েকদিন থাকলেন। নৈরাজ্যপূর্ণ এলাকাগুলো দুষ্টদের রক্তে রঞ্জিত হল। প্রতিটি আস্তানার সামনে লাশের স্তূপ জমে গেল। সে সময় থেকে জালালুদ্দিনের শাসনামলের শেষ সময় পর্যন্ত কাঠিরের আর কেউ দস্যুতা, খুন-রাহাজানি ও বিদ্রোহ করার দুঃসাহস দেখায়নি। এরপর বলবন পাহাড়ী অঞ্চলের পাদদেশে (লবণ রেঞ্জ) চলে গেলেন এবং সেখানকার বিদ্রোহীদের দমন করা জরুরি ছিলো। এসব সামরিক অভিযানে বিপুল পরিমাণ ঘোড়া অর্জিত হয়। দিল্লির বাজারে ঘোড়ার দাম পড়ে যায়। এভাবে কয়েক বছরের মধ্যেই সুলতান সব বিদ্রোহ দমন করেন। তিনি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় শান্তি ও সম্প্রীতির পরিবেশ সৃষ্টি করেন এবং সমস্ত বিদ্রোহীদের বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য করেন।
বিভাগ : বিশেষ প্রতিবেদন
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
প্রবাসীদের যে জন্য সুখবর দিলো মালয়েশিয়া
জাবি শিক্ষার্থী মৃত্যুর ঘটনায় মামলা, তদন্ত কমিটি গঠন, ফটকে তালা, মশাল মিছিল
মাদকের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে থাকবে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল
"নতুন সিনেমা নিয়ে ফিরছেন গ্লোবাল তারকা অ্যাঞ্জেলিনা জোলি"
ড. ইউনূসকে নিয়ে খালেদা জিয়ার পুরোনো যে বক্তব্য ভাইরাল
নতুন নির্বাচন কমিশনের প্রতি ইসলামী আন্দোলনের শুভ কামনা
আলোচনায় ফ্যাসিস্ট হাসিনার ‘টুস করে ফেলে দেয়ার’ হুমকি
দীর্ঘ ১৫ বছর সাংবাদিকরা বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করতে পারেনি: খোকন
'ইউটিউব ট্রেন্ডিংয়ে রয়েছে অভিনেতা তারিক আনাম খানের নাটক'
বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার আহ্বান
ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর বোর্ড অব গভর্নর সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সম্বর্ধনা
সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সংবর্ধনা
লালমোহনে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত যুবদল নেতা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু
চকরিয়ার বিএনপি নেতা আবু তাহের চৌধুরীর মৃত্যুতে সালাহউদ্দিন আহমদ ও হাসিনা আহমদের শোক
উইন্ডিজের বিপক্ষে মাঠে নামছে বাংলাদেশ
বেইজিং সংস্কৃতি ও পর্যটন ব্যুরো ও আটাবের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত
প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানের সাক্ষাৎ
দেশের বাজারে ফের বাড়ল সোনার দাম
সবচেয়ে কম মূল্যে বাংলাদেশকে বিদ্যুৎ দিচ্ছে নেপাল: নেপাল রাষ্ট্রদূত
আগামী নির্বাচন নিয়ে দিল্লি ভয়ংকর পরিকল্পনা করছে: যুক্তরাষ্ট্র জাগপা