আলাউদ্দীন খিলজি : যুগনায়ক-২

Daily Inqilab মুসা আল হাফিজ

২১ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০১ এএম | আপডেট: ২১ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০১ এএম

আলাউদ্দীন খিলজির জন্ম সম্ভবত ১২৬৬-৬৭ খ্রিস্টাব্দে। কেউ বলেন, তার জন্ম হয়েছে বাংলার বীরভূমে, কেউ বলেন দিল্লীতে। যদিও কারো দাবি, আফগানে জন্ম হয় তার। কিন্তু জালালুদ্দীন খিলজির পরিবার অনেক আগেই আফগান ত্যাগ করে ভারতে আসে। গিয়াসুদ্দীন বলবন ও মুইজুদ্দীন কায়কোবাদের শাসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এই পরিবার। আলাউদ্দীন খিলজি ছিলেন জালালুদ্দীন খিলজির ভাতিজা। বলবন ক্ষমতাসীন হন ১২৬৬ সালে, এ বছর কিংবা এর পরের বছর আলাউদ্দীন খিলজির জন্ম। তার পরিবার তখন ভারতে বসবাস করছে। ভারতে জন্মগ্রহণকারী খিলজিকে বিদেশি বলাটা তাই ইতিহাসে পাত্তা পায়নি মোটেও। আলাউদ্দীন খিলজির বাল্যনাম ছিলো আলি ঘুরশাস্প। তরুণ বয়সে অসাধারণ যুদ্ধনৈপুণ্য অর্জন করেন তিনি, শেখেন রাজনীতি, প্রশাসন ও ভারততত্ত্বের জ্ঞান। জালালুদ্দীন খিলজির প্রশাসনে ‘আমীর-ই-তুজুক’ নামে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ লাভ করেন। জালালুদ্দীনের প্রশাসন বহু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি ছিলো। গিয়াসুদ্দীন বলবনের ভাতিজা মালিক চজু বা ছজ্জুর বিদ্রোহ ছিলো অন্যতম সমস্যা। আলাউদ্দীন এ বিদ্রোহ দমন করেন ১২৯১ সালে। সফল সেনা অভিযানের ফলে তিনি লাভ করেন নানা পুরস্কার। এলাহাবাদের কারা ও মানিকপুরের জায়গীর দেওয়া হয় তাকে। মালিক চজুর বহু অনুসারীকে নিজের দলে ভেড়াতে সক্ষম হন আলাউদ্দীন। তাদের মধ্যে ছিলো উচ্চাকাক্সক্ষা ও ক্ষমতার নেশা। আলাউদ্দীনকে আশ্রয় করে সেই উচ্চাকাঙ্খা এবার নতুন করে ডালপালা মেলতে থাকে। আরো ক্ষমতাবান হবার প্ররোচনা তারা দেয় আলাউদ্দীনকে। নিজের উপর প্রবল আত্মবিশ্বাসী যুবক এতে সাড়া দেন। স্বাধীন ক্ষমতা লাভের ইচ্ছা তার মধ্যে জেগে উঠে। অনুচর ও সহযোগী বাড়াতে থাকেন। প্রভাবশালীদের নিজের দলে ভেড়াতে থাকেন। নিজের খ্যাতি বৃদ্ধি করেন বিভিন্ন অভিযানের মাধ্যমে। এতে জয়ী হয়ে লাভ করেন বহু সম্পদ, সোনাদানা, ভূমি ও দুর্গ। ১২৯২ সালে ভিলসা নগরে যুদ্ধ, দেবগিরির যাদব রাজ্যের পরাজয়, ১২৯৫ সালে ৮ হাজার অশ্বারোহী নিয়ে দাক্ষিণাত্য অভিযান, বাধ্য হয়ে আলাউদ্দীনের সাথে যাদবরাজা রামচন্দ্রের সন্ধি এবং বিপুল রতœপ্রদান ইত্যাদি ঘটনা আলাউদ্দীনকে শাসক হবার সক্ষম ব্যক্তিত্ব হিসেবে তুলে ধরে। কারণ, শাসক না হয়েই তিনি দাক্ষিণাত্যকে দিল্লী সালতানাতের অংশে পরিণত করবার চেষ্টায় সাফল্যের সূত্রপাত করেন। তার আগে দিল্লীর কোনো সুলতান বিন্ধ্য পর্বতের দক্ষিণে সাম্রাজ্য বিস্তার করতে পারেননি। আলাউদ্দীনের এই সাফল্য বিপুল অনুসারী, যোদ্ধাদল ও ধনরতেœর সমাহার ঘটালো। তার ছোট ভাই উলুঘ খাঁ ছিলেন জালালুদ্দীনের প্রশাসনের আমাত্য। অন্যান্য প্রভাবশালী জালালুদ্দীনকে উচ্চাভিলাষী আলাউদ্দীনের ব্যাপারে সতর্ক করলেও উলুঘ খাঁ আশ্বস্ত করতেন সব সময়। তিনি চাইতেন জালালুদ্দীনের সাথে সংঘাত এড়িয়েই আলাউদ্দীন হোন পরবর্তী শাসক। বিজয়ী আলাউদ্দীনকে অভিনন্দিত করার জন্য উলুঘ খাঁর পরামর্শে জালালুদ্দীন এগিয়ে যান কারা অঞ্চলের দিকে। তিনি আলাউদ্দীনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এরপর দুর্বৃত্তের হাতে নিহত হন জালালুদ্দীন। অনেকের দাবি, তিনি প্রকৃতপক্ষে বিশ্বাসঘাতকতা ও প্রতারণার শিকার হন। বিশ্বাসঘাতকতা করেন আলাউদ্দীন। তিনি পরিকল্পিতভাবে হত্যার আয়োজন করে রেখেছিলেন। তবে সমসাময়িক ঐতিহাসিকদের অনেকেই এ হত্যার সাথে আলাউদ্দীনের সম্পৃক্ততা খোঁজে পাননি। কোনো কোনো বিবরণ দাবি করে, নিহত সুলতানের মস্তক একটি বর্শাফলকে বিদ্ধ করে শাসনাধীন অঞ্চলে প্রদর্শন করা হয়। কিন্তু এর ন্যায্যতা কতটুকু?
নিজের চাচা হত্যা কোনো কালে তার শাসক হিসেবে মহতি ইমেজ তৈরি করতো না। চাচার সাথে দৃশ্যত কোনো দ্বন্দ্ব ছিলো না। হত্যার পরে তার কাটা মস্তক প্রদর্শনের মাধ্যমে আলাউদ্দীন কী অর্জন করতে চাইবেন? অনেকেই বলবেন, এর দ্বারা নিজের প্রতাপ দেখানো ও প্রতিপক্ষকে ভীত করাই হতে পারে উদ্দেশ্য। কিন্তু নতুন করে আলাউদ্দীনের শক্তিপ্রদর্শন ও ভীতি তৈরির কি কোনো দরকার ছিলো? ছিলো না আদৌ। কারণ, ইতোমধ্যে তিনি আপন শক্তি প্রদর্শন করেছেন বহুবিজয়ে, ভীতি তৈরিও করেছেন প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে। এ পর্যায়ে তার দরকার ছিলো নিজের মহত্ব ও ন্যায্যতার স্বীকৃতি আদায় করা। কারণ, এবার জনগণকে আস্থায় নিতে হবে শাসন পরিচালনার জন্য। সেই মহত্ব ও ন্যায্যতার প্রমাণ যেখানে পেশ করা জরুরি, সেখানে কেন তিনি কাটা মস্তক প্রদর্শন করে প্রতারণা, নিষ্ঠুরতা ও অবিচারের নমুনা উপস্থাপন করবেন? যা খুব দ্রুতই ক্ষোভ, ঘৃণা ও বিভেদ তৈরি করে মানুষের মধ্যে! বস্তুত কাটা মস্তক প্রদর্শনের গল্প আকর্ষণীয় কল্পনা, যা কিছু অতিরঞ্জনপূর্ণ ভাষ্যের উপর সওয়ার হয়েছে। এটা সত্য যে ৭৬ বছর বয়সী জালালুদ্দীনের ক্ষমতার অবসান চাইছিলেন আলাউদ্দীন এবং তার নিহত হওয়ার সাথে সাথে সিংহাসনের দাবিদার হন তিনি। এই হত্যার সরাসরি উপকারভোগী ছিলেন তিনি, এতে সন্দেহ নেই। অনেকে তাই মনে করতে পারেন, জালালউদ্দীনের হত্যার সঙ্গে তার কোনো না কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে। তবে এ ধারণার পক্ষে কোনো বিশ্বাসযোগ্য তথ্য নেই।
জালালুদ্দীনের মৃত্যুর পরে ক্ষমতার দাবিদার হন দুইজন। জালালুদ্দীনের পুত্র আরকালী খান ও আলাউদ্দীন খিলজি। আলাউদ্দীন সেনাবাহিনীকে নিজের আওতায় নিতে সক্ষম হন, আমিরদের অধিকাংশই তার পাশে দাঁড়ান। আরকালী খান তাকে প্রতিরোধে ব্যর্থ হন, পরাজিত হন। ১২৯৬ খ্রিস্টাব্দে দিল্লীর সিংহাসনে বসেন আলাউদ্দীন খিলজি।
শাসক হয়েই তিনি সেই সব আমিরের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেন, যারা পদ ও অর্থলোভে তাকে সহযোগিতা করেছিলো। তিনি এই লোভের ফলাফল জানতেন। অতি আপন হলেও লোভী ব্যক্তিটি শেষ অবধি আঘাত করবে, এটা ছিলো তার গভীর বিশ্বাস।
যে পথ ধরে তিনি ক্ষমতায় আসেন, সে পথে এগিয়ে চলেন আরো। দিগি¦জয় ও সাম্রাজ্যবিস্তারকে প্রাধান্য দেন তিনি। তার স্বপ্ন ছিলো আপন কালের আলেকজান্ডার হওয়ার। বিশ্বজয় করতে পারেননি তিনি। কিন্তু বৃহত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে আপন সাম্রাজ্য ঠিকই প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। কাজটি মোটেও সহজ ছিলো না। কারণ, তার চারধারে ছিলো অগণিত সমস্যা। সবচেয়ে গুরুত্বর হুমকি হিসেবে গর্জাতে গর্জাতে এগিয়ে আসছিলো মোঙ্গল ঘূর্ণিঝড়!


বিভাগ : বিশেষ প্রতিবেদন


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

নাব্যতা হারিয়ে দখলদারদের কবলে পড়ে মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাচ্ছে একের পর এক নদী
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-১২
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-১১
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-১০
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-৯
আরও
X

আরও পড়ুন

সৌদি রাষ্ট্রদূতকে হেয় করাই মূল উদ্দেশ্য মেঘনার?

সৌদি রাষ্ট্রদূতকে হেয় করাই মূল উদ্দেশ্য মেঘনার?

২৯ এপ্রিল প্রথম হজ ফ্লাইট, হজযাত্রীদের সুবিধায় সরকারের যত উদ্যোগ

২৯ এপ্রিল প্রথম হজ ফ্লাইট, হজযাত্রীদের সুবিধায় সরকারের যত উদ্যোগ

৪ মাসের সন্তান বিক্রি করে পায়ের নূপুর মোবাইল কিনলেন মা! উদ্ধার করল পুলিশ

৪ মাসের সন্তান বিক্রি করে পায়ের নূপুর মোবাইল কিনলেন মা! উদ্ধার করল পুলিশ

কওমি সনদ বাস্তবায়নের দায়িত্ব শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের : ধর্ম উপদেষ্টা

কওমি সনদ বাস্তবায়নের দায়িত্ব শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের : ধর্ম উপদেষ্টা

অত্যাচারীরা কখনও শাসক বা নেতা হতে পারে না: সাবেক সাংসদ নিজাম

অত্যাচারীরা কখনও শাসক বা নেতা হতে পারে না: সাবেক সাংসদ নিজাম

চুয়াডাঙ্গার দর্শনা জয়নগর আন্তর্জাতিক ইমিগ্রেশন চেকপোস্টে শয়নকক্ষে পুলিশ কনস্টবলের ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার

চুয়াডাঙ্গার দর্শনা জয়নগর আন্তর্জাতিক ইমিগ্রেশন চেকপোস্টে শয়নকক্ষে পুলিশ কনস্টবলের ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার

খনিজ সম্পদ নিয়ে সই হলো কিয়েভ-ওয়াশিংটন সমঝোতা স্মারক

খনিজ সম্পদ নিয়ে সই হলো কিয়েভ-ওয়াশিংটন সমঝোতা স্মারক

বিমান ছিনতাই করতে গিয়ে যাত্রীর গুলিতে মার্কিন নাগরিক নিহত

বিমান ছিনতাই করতে গিয়ে যাত্রীর গুলিতে মার্কিন নাগরিক নিহত

দুবাইতে স্বর্ণের দামে সর্বকালের সব রেকর্ড ভঙ্গ, নেপথ্যে শেয়ারবাজারে ধ্বস

দুবাইতে স্বর্ণের দামে সর্বকালের সব রেকর্ড ভঙ্গ, নেপথ্যে শেয়ারবাজারে ধ্বস

গাজায় ইসরাইলি হামলায় একই পরিবারের ১৩ জন নিহত

গাজায় ইসরাইলি হামলায় একই পরিবারের ১৩ জন নিহত

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংস্থার ও বিচার কার্যক্রম শেষ করে ঘোষিত সময়ের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন দিতে হবে

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংস্থার ও বিচার কার্যক্রম শেষ করে ঘোষিত সময়ের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন দিতে হবে

বিরলে বাড়ী থেকে অপহরণ করে এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা

বিরলে বাড়ী থেকে অপহরণ করে এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা

সাভার ও আশুলিয়ার পোশাক শ্রমিকদের ভরসা ব্যয়বহুল বেসরকারি হাসপাতাল

সাভার ও আশুলিয়ার পোশাক শ্রমিকদের ভরসা ব্যয়বহুল বেসরকারি হাসপাতাল

মুর্শিদাবাদে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা নিয়ে বাংলাদেশকে জড়ানোর চেষ্টা, আসিফ নজরুলের তীব্র প্রতিবাদ

মুর্শিদাবাদে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা নিয়ে বাংলাদেশকে জড়ানোর চেষ্টা, আসিফ নজরুলের তীব্র প্রতিবাদ

ফরিদপুরে প্রেমের ফাঁদে ভুয়া মেজর আটক!

ফরিদপুরে প্রেমের ফাঁদে ভুয়া মেজর আটক!

তেল ছাড়াই আমের আচার! সুগার, ব্লাড প্রেশার থাকলেও খেতে পারবেন

তেল ছাড়াই আমের আচার! সুগার, ব্লাড প্রেশার থাকলেও খেতে পারবেন

দুর্ঘটনায় উড়ে গেল বাসের ছাদ, ১০ কিমি চালিয়ে গেলেন বেপরোয়া চালক

দুর্ঘটনায় উড়ে গেল বাসের ছাদ, ১০ কিমি চালিয়ে গেলেন বেপরোয়া চালক

মাগুরার আছিয়াকে নিয়ে হৃদয়বিদারক গান গাইলেন বাপ্পা

মাগুরার আছিয়াকে নিয়ে হৃদয়বিদারক গান গাইলেন বাপ্পা

কুড়িগ্রামে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহ সভাপতি দুর্জয় গ্রেফতার

কুড়িগ্রামে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহ সভাপতি দুর্জয় গ্রেফতার

সালথায় কৃষককে হাতুড়িপেটা

সালথায় কৃষককে হাতুড়িপেটা