ঢাকা   বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪ | ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

আলাউদ্দীন খিলজি : যুগনায়ক-৫

Daily Inqilab মুসা আল হাফিজ

০৩ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০৫ এএম | আপডেট: ০৩ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০৫ এএম

আলাউদ্দীন এবার দৃষ্টি দেন মালবের দিকে। মালবরাজা অনেক যুদ্ধ করেও অবশেষে আত্মসমর্পণ করেন। তারপর একে একে মধ্যপ্রদেশের মাণ্ডু, উজ্জয়িনি, চান্দেরি দিল্লী সালতানাতের অধীনে এলো। উত্তর ভারত একত্রিত হলো দিল্লীকেন্দ্রিক সাম্রাজ্যে।
এরপর সুলতান মোনোযোগ দিলেন দক্ষিণ ভারতের দিকে। দিল্লী থেকে এর ভৌগোলিক অবস্থানগত দূরত্ব ছিলো একটা সমস্যা। দাক্ষিণাত্য সহস্র বছর ধরে আলাদা ছিলো ভারতের মূল ভূমি থেকে। পৃথক ছিলো সংস্কৃতিতে, পৃথক ছিলো ভৌগোলিক-ভাষিক বিচারেও। দক্ষিণ কখনো দাক্ষিণ্য দেয়নি ভারতকে। সেই দাক্ষিণ্যকে জয় করলেন আলাউদ্দীন খিলজি। তিনি একে জয় করলেন এবং নিয়মতান্ত্রিক শাসন কায়েম করলেন। দাক্ষিণাত্যে তখন বিন্ধ্য পর্বতের দক্ষিণ-পশ্চিমে ছিলো দেবগিরি রাজ্য, বিন্ধ্য পর্বতের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ছিলো তেলেঙ্গনা বা বরঙ্গল রাজ্য। কৃষ্ণা নদীর দক্ষিণে ছিল দ্বারসমুদ্র রাজ্য। আর একেবারে দক্ষিণে ছিল পান্ড্যরাজ্য।

আলাউদ্দীনের ক্রীতদাস ও সেনাপতি মালিক কাফুর দুর্গম ও দুর্বোধ্য দাক্ষিণাত্য জয়ের দায়িত্ব পেলেন। তিনি বিস্ময়করভাবে সম্পন্ন করেন দেবগিরি জয়। এই জয়ে ভূমিকা রেখেছিলো সামরিক সক্ষমতা ও কৌশল এবং কূটনীতি। ১৩০৬-৭ খ্রিস্টাব্দে দেবগিরির রামচন্দ্রদেবকে পরাস্ত করেন মালিক কাফুর। রাণী দেবলাদেবীকে বন্দি করে সম্মানের সাথে আনা হয় দিল্লীতে। আলাউদ্দিনের পুত্র খিজির খানের সঙ্গে তার বিবাহ হয়। রামচন্দ্রদেব আশ্বস্ত হন এবং দিল্লীতে এসে বশ্যতা স্বীকার করেন। আলাউদ্দীন তাকে দেন রায়-রায়ান উপাধি। এরপর তিনি হয়ে উঠেন দাক্ষিণাত্যে দিল্লী সাম্রাজ্যের প্রধান সহযোগী।

রামচন্দ্রের সহায়তায় ১৩০৯ খ্রিস্টাব্দে মালিক কাফুর তেলেঙ্গানা আক্রমণ করেন। রাজা প্রতাপরুদ্রদেব কাফুরকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পণে বাধ্য হন। মালিক কাফুরের শর্ত মেনে তিনি দিল্লীর অধীনতা কবুল করেন। কৃষ্ণা নদী পার হয়ে ১৩১০ খ্রিস্টাব্দে কাফুরের নেতৃত্বে সুলতানি বাহিনী দ্বারসমুদ্র রাজ্য আক্রমণ করে। রাজা তৃতীয় বীরবল্লাল যুদ্ধ করে পরাজিত হন। বিপুল ধনরত্ন দিয়ে দিল্লীর বশ্যতা কবুল করে নেন। ১৩১১ খ্রিস্টাব্দে পান্ড্য রাজ্যের রাজধানী মাদুরা জয় করেন কাফুর। এভাবে পুরো দাক্ষিণাত্য আসে দিল্লীর কব্জায়। আলাউদ্দীন উত্তর ভারতকে সরাসরি শাসন করলেও দাক্ষিণাত্যের রাজ্যগুলোকে বানান করদ রাজ্য। তাদের থাকতে দেন তাদের মতো করে। ফলে রাজারা ছিলেন খুশি, সন্তুষ্ট। দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া তারা আলাউদ্দীনকে সহায়তা করেন বরাবর। ‘তারিক-ই-আলাই’ জানাচ্ছে, দক্ষিণের রাজারা নিয়মিত জিজিয়া আর খাজনা আদায় করতেন। আর বিনিময়ে সুলতানের তরফে নিজ নিজ সিংহাসন অধিকারে রাখার সুযোগ পেতেন।
আলাউদ্দীন খিলজি আপন প্রশাসনে স্থানীয়দের দেন বিশেষ অবস্থান। সাধারণ মানুষের জন্য উঠে আসার পথকে তিনি করেন প্রশস্ত। এটা একই সাথে হিন্দু-মুসলিম অভিজাতদের ক্ষোভের কারণ হয়েছিলো। তার বিভিন্ন সংস্কার সুবিধাবাদী শ্রেণীর জন্য সুখকর ছিলো না। বিশেষত রাজপুতরা ছিলো তার প্রতি খাপ্পা। আবার গঙ্গা-যমুনার মধ্যবর্তী দোয়াব অঞ্চলের বহু সুফির নিষ্কর জমির অধিকার তিনি কেড়ে নেন। সেই সুফিদের উত্তরাধিকারী মালিক জায়সী কবিতার মধ্যে আলাউদ্দীনের চরিত্র ভিন্নভাবে চিত্রিত করেন। গোটা সাম্রাজ্যের কোথায় কী হচ্ছে, সব কিছু তাকে রিপোর্ট করতেন প্রশাসকরা। তথ্য সংগ্রহের জন্য তার ছিলো নিজস্ব ব্যবস্থা। সাম্রাজ্য জুড়ে তিনি অসংখ্য গুপ্তচর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দিয়েছিলেন। এরা সর্বত্র সুলতানের চোখ-কান হিসাবে কাজ করত। রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য থেকে শুরু করে অতি তুচ্ছ তথ্যও মুহূর্তেই সুলতানের কাছে পৌঁছে যেত। তিনি বাজার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। গম, বার্লি, চাল, চিনি, ডাল, লবণ, গুড়, ঘিসহ সব ধরনের খাদ্যপণ্য, বস্ত্র, দাস-দাসী, পশু এবং অন্যান্য দ্রব্যের বাজারদর বেঁধে দেন। দ্রব্যের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে চাহিদা অনুযায়ী, বাজারদর পর্যবেক্ষণ করতে হবে যথাযথভাবে, পরিস্থিতি অনুযায়ী মানুষের কল্যাণে সবচেয়ে ভালো ব্যবস্থাটি গ্রহণ করতে হবে। এজন্য প্রতিষ্ঠা করা হয় সরকারি আলাদা দপ্তর। এসব দপ্তর বাজার পরিস্থিতির সকল তথ্য সংরক্ষণ করতো। এমনকি ব্যবসায়ীদের নাম ও তথ্য তাদের তালিকায় থাকতো। বাজার নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকা দুজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার ছিলো বিশেষ ক্ষমতা। নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বাজারমূল্য বেশি হলে বিক্রেতাদের কঠোর শাস্তি প্রদান করা হতো। ওজনে কম দিয়ে কোনো ব্যবসায়ী ধরা পড়লে যতটুকু ওজন কম দেওয়া হয়েছে, ঠিক ততটুকু মাংস তার শরীর থেকে কেটে নেওয়ার গল্পও তখন প্রচলিত হয়। সব রকমের অপকর্মের শাস্তি ছিলো কঠিন, কঠোর। আলাউদ্দীনের সাম্রাজ্যে অপরাধের সংখ্যা কমে গিয়েছিলো। আমীর-উমরাহদের ঘুষ ও দুর্নীতির মাত্রা কমে গিয়েছিলো বিশেষভাবে।


বিভাগ : বিশেষ প্রতিবেদন


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-২
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-১
ব্রিটিশ সরকারের তত্বাবধানে বাহদুর শাহ জাফর ও তাঁর বংশধরদের অবস্থা !
তারেক রহমানের রাষ্ট্র চিন্তা
মুজাদ্দিদে আলফেসানী (রহ.) দ্বীন ও মিল্লাতের নবায়ন-৬
আরও

আরও পড়ুন

ডিসেম্বরে বাংলাদেশ ও ভারতের পররাষ্ট্র বৈঠক, হাসিনাকে ফেরানো নিয়ে আলোচনা থাকবে

ডিসেম্বরে বাংলাদেশ ও ভারতের পররাষ্ট্র বৈঠক, হাসিনাকে ফেরানো নিয়ে আলোচনা থাকবে

রামু সেনানিবাসে সশস্ত্র বাহিনী দিবস পালিত

রামু সেনানিবাসে সশস্ত্র বাহিনী দিবস পালিত

এক সপ্তাহে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ল ৬ কোটি ১০ লাখ ডলার

এক সপ্তাহে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ল ৬ কোটি ১০ লাখ ডলার

প্রবাসীদের যে জন্য সুখবর দিলো মালয়েশিয়া

প্রবাসীদের যে জন্য সুখবর দিলো মালয়েশিয়া

জাবি শিক্ষার্থী মৃত্যুর ঘটনায় মামলা, তদন্ত কমিটি গঠন, ফটকে তালা, মশাল মিছিল

জাবি শিক্ষার্থী মৃত্যুর ঘটনায় মামলা, তদন্ত কমিটি গঠন, ফটকে তালা, মশাল মিছিল

মাদকের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে থাকবে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল

মাদকের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে থাকবে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল

"নতুন সিনেমা নিয়ে ফিরছেন গ্লোবাল তারকা অ্যাঞ্জেলিনা জোলি"

"নতুন সিনেমা নিয়ে ফিরছেন গ্লোবাল তারকা অ্যাঞ্জেলিনা জোলি"

ড. ইউনূসকে নিয়ে খালেদা জিয়ার পুরোনো যে বক্তব্য ভাইরাল

ড. ইউনূসকে নিয়ে খালেদা জিয়ার পুরোনো যে বক্তব্য ভাইরাল

নতুন নির্বাচন কমিশনের প্রতি ইসলামী আন্দোলনের শুভ কামনা

নতুন নির্বাচন কমিশনের প্রতি ইসলামী আন্দোলনের শুভ কামনা

আলোচনায় ফ্যাসিস্ট হাসিনার ‘টুস করে ফেলে দেয়ার’ হুমকি

আলোচনায় ফ্যাসিস্ট হাসিনার ‘টুস করে ফেলে দেয়ার’ হুমকি

দীর্ঘ ১৫ বছর সাংবাদিকরা বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করতে পারেনি: খোকন

দীর্ঘ ১৫ বছর সাংবাদিকরা বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করতে পারেনি: খোকন

'ইউটিউব ট্রেন্ডিংয়ে রয়েছে অভিনেতা তারিক আনাম খানের নাটক'

'ইউটিউব ট্রেন্ডিংয়ে রয়েছে অভিনেতা তারিক আনাম খানের নাটক'

বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার আহ্বান

বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার আহ্বান

ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর বোর্ড অব গভর্নর সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সম্বর্ধনা

ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর বোর্ড অব গভর্নর সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সম্বর্ধনা

সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সংবর্ধনা

সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সংবর্ধনা

লালমোহনে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত যুবদল নেতা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু

লালমোহনে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত যুবদল নেতা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু

চকরিয়ার বিএনপি নেতা আবু তাহের চৌধুরীর মৃত্যুতে সালাহউদ্দিন আহমদ ও হাসিনা আহমদের শোক

চকরিয়ার বিএনপি নেতা আবু তাহের চৌধুরীর মৃত্যুতে সালাহউদ্দিন আহমদ ও হাসিনা আহমদের শোক

উইন্ডিজের বিপক্ষে মাঠে নামছে বাংলাদেশ

উইন্ডিজের বিপক্ষে মাঠে নামছে বাংলাদেশ

বেইজিং সংস্কৃতি ও পর্যটন ব্যুরো ও আটাবের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত

বেইজিং সংস্কৃতি ও পর্যটন ব্যুরো ও আটাবের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত

প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানের সাক্ষাৎ

প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানের সাক্ষাৎ