ভারতের সভ্যতায় মুসলমানদের অবদান

গিয়াসউদ্দীন তুঘলক : দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাষ্ট্রনায়ক-১

Daily Inqilab মুসা আল হাফিজ

১০ নভেম্বর ২০২৩, ১২:৩৫ এএম | আপডেট: ১০ নভেম্বর ২০২৩, ১২:৩৫ এএম

উপমহাদেশের ইতিহাসে তুঘলক শাসনামল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গিয়াসুদ্দীন তুঘলক এই রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম সুলতান। তার প্রকৃত নাম গাজী মালিক। ১২৮১ খ্রিস্টাব্দে দিল্লীর নিকটবর্তী কোটলা শহরে তার জন্ম। তুর্কি পিতা ও পাঞ্জাবের জাট বংশীয় মায়ের সন্তান ছিলেন তিনি। দিল্লীতে তিনি বেড়ে উঠেন উন্নত সুবিধা ও শিক্ষা-প্রশিক্ষণে। কর্মজীবন শুরু করেন আলাউদ্দীন খিলজির অধীনে, তারই সেনাবাহিনীতে। দক্ষ সমরবিদ ছিলেন তিনি। রণাঙ্গণে তার পারদর্শিতা ছিলো অসাধারণ। মোঙ্গলদের মোকাবেলায় বীরত্ব প্রদর্শন করেন তিনি। ভারতের সীমান্ত রক্ষায় অসামান্য কৃতিত্বের ফলে লাভ করেন গাজী উপাধি। আলাউদ্দিন খিলজির পরে তার উত্তরসূরি মোবারক খিলজির অধীনেও গিয়াসউদ্দীন দক্ষতার প্রমাণ পেশ করেন।
আভ্যন্তরীণ সঙ্কট নিরসনে তার ভূমিকা ছিলো ব্যাপক। ১৩১৬ সালে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করেন আমির খসরু খান। তিনি ছিলেন আলাউদ্দীন খিলজির সাবেক ক্রীতদাস। দিল্লী সালতানাতের ইতিহাসে এটি ছিল একটি উত্তাল সময়। গিয়াসউদ্দীন প্রথমে খসরুর সেনাবাহিনীতে চাকরি করলেও অচিরেই তার বিরুদ্ধে দাঁড়ান। তাকে সিংহাসনচ্যুত করতে নেতৃত্ব দেন তিনি। অমাত্যবর্গের উপর তার প্রভাব ছিলো প্রতিষ্ঠিত। খসরু খানের শাসনামলে দিল্লী সালতানাতের চারদিকে যে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়েছিলো, তার প্রতিবিধানের যোগ্য লোক হিসেবে তিনিই বিবেচিত হন। দরবারের অভিজাতরা ১৩২০ খ্রিস্টাব্দে তাকে সুলতানরূপে সিংহাসনে বসান। তিনি গিয়াসউদ্দীন তুঘলক নাম ধারণ করেন। শুরু হয় তুঘলক বংশের শাসন। ১৩২৫ সালে মৃত্যু অবধি জারি ছিলো তার শাসনকাল। পাঁচ বছরের শাসনামলকে তিনি রাজনৈতিক, প্রশাসনিক এবং সাংস্কৃতিক উন্নয়নের কালখ-ে পরিণত করেন। তার অবদান সালতানাতের ইতিহাসে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলেছিল।
খিলজি রাজবংশের শেষ দিকের বছরগুলি অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, অর্থনৈতিক সমস্যা এবং বিদ্রোহে জর্জরিত ছিলো। গিয়াসউদ্দীন শৃঙ্খলা, ঐক্য ও শান্তি নিশ্চিত করেন। সূচিত করেন উন্নয়ন ও অগ্রগতির নতুন কর্মধারা।
১. প্রশাসনিক সংস্কার ও উন্নয়ন: উচ্চাভিলাষী প্রশাসনিক সংস্কারের একটি সিরিজ কর্মসূচি গ্রহণ করেন তিনি। সাম্রাজ্যের শাসনব্যবস্থার উন্নতির প্রশ্নে তিনি গভীরভাবে উদ্বিগ্ন ছিলেন এবং তার সংস্কারগুলি সালতানাতকে বিভিন্ন সমস্যা থেকে পরিত্রাণ দিয়েছিলো। নমুনা হিসেবে কয়েকটি সংস্কারের প্রতি দৃষ্টি দেওয়া যেতে পারে।
রাজস্ব সংস্কার: রাজস্ব প্রশাসন ব্যবস্থাপনায় তার অবদান ছিল অনন্য। খিলজি রাজবংশের শেষ দিকে সালতানাত আর্থিক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল। গিয়াসউদ্দীন ‘জাবত’ নামে একটি নতুন রাজস্ব ব্যবস্থা চালু করেন। এই ব্যবস্থার অধীনে ভূমি রাজস্ব স্থির করা হয়েছিল এবং নগদ অর্থে রাজস্ব সংগ্রহ করা হয়, যা রাষ্ট্রকে আয়ের আরও স্থিতিশীল ক্ষেত্র প্রদান করে। জমির মানের উপর ভিত্তি করে রাজস্বের হার স্থির করা হয়েছিল এবং এই ব্যবস্থা রাজস্ব সংগ্রহে আরও সামঞ্জস্য নিশ্চিত করে। রাষ্ট্র ও জনগণের জন্য তা উপাদেয় বিবেচিত হয়। তা রাজস্ব ব্যবস্থাকে দেয় সেই দক্ষতা, যা থেকে উপকৃত হয়েছে পরবর্তী ভারত।
কৃষি সংস্কার: গিয়াসউদ্দীন কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতেও মনোযোগী ছিলেন। এর জন্যও অগ্রসর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তিনি খাল খনন এবং অন্যান্য সেচ কাজকে উৎসাহিত করেন, যা কৃষিফলন বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অনাবাদী ভূমি আবাদ, সবুজায়ন ও পানিব্যবস্থাপনায় ছিলো তার দৃষ্টি। এর ফলে শুধু অর্থনীতি চাঙ্গা হয়, তা নয়, বরং দুর্ভিক্ষের ঝুঁকি হ্রাস পায় এবং অধিকতরো প্রজাকল্যাণী খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত হয়।
২. নতুন রাজধানী স্থাপন: গিয়াসউদ্দীন তুঘলক নগরব্যবস্থাপনায়ও অগ্রসর ছিলেন। নিরাপত্তা, ভূমি, পরিবেশ, প্রতিবেশ ও আবহাওয়া বিবেচনা করে তিনি তুঘলকাবাদ শহর প্রতিষ্ঠা করেন। একে নতুন রাজধানী হিসেবে সম্প্রসারিত করেন। তিনি তুঘলকাবাদের কাছে আদিলাবাদ নামে একটি দুর্গশহরও প্রতিষ্ঠা করেন। এই শহরগুলির নির্মাণ করেছিলেন একটি সংগঠিত এবং দক্ষ প্রশাসনের আকাক্সক্ষা থেকে, যা তার সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটায়।
৩. অবকাঠামো উন্নয়ন: গিয়াসউদ্দীন তুঘলক শিল্প ও স্থাপত্যের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনি বেশ কয়েকটি অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করেছিলেন, যা ভারত উপমহাদেশে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলেছিল।

 


বিভাগ : বিশেষ প্রতিবেদন


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

নাব্যতা হারিয়ে দখলদারদের কবলে পড়ে মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাচ্ছে একের পর এক নদী
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-১২
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-১১
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-১০
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-৯
আরও
X

আরও পড়ুন

সৌদি রাষ্ট্রদূতকে হেয় করাই মূল উদ্দেশ্য মেঘনার?

সৌদি রাষ্ট্রদূতকে হেয় করাই মূল উদ্দেশ্য মেঘনার?

২৯ এপ্রিল প্রথম হজ ফ্লাইট, হজযাত্রীদের সুবিধায় সরকারের যত উদ্যোগ

২৯ এপ্রিল প্রথম হজ ফ্লাইট, হজযাত্রীদের সুবিধায় সরকারের যত উদ্যোগ

৪ মাসের সন্তান বিক্রি করে পায়ের নূপুর মোবাইল কিনলেন মা! উদ্ধার করল পুলিশ

৪ মাসের সন্তান বিক্রি করে পায়ের নূপুর মোবাইল কিনলেন মা! উদ্ধার করল পুলিশ

কওমি সনদ বাস্তবায়নের দায়িত্ব শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের : ধর্ম উপদেষ্টা

কওমি সনদ বাস্তবায়নের দায়িত্ব শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের : ধর্ম উপদেষ্টা

অত্যাচারীরা কখনও শাসক বা নেতা হতে পারে না: সাবেক সাংসদ নিজাম

অত্যাচারীরা কখনও শাসক বা নেতা হতে পারে না: সাবেক সাংসদ নিজাম

চুয়াডাঙ্গার দর্শনা জয়নগর আন্তর্জাতিক ইমিগ্রেশন চেকপোস্টে শয়নকক্ষে পুলিশ কনস্টবলের ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার

চুয়াডাঙ্গার দর্শনা জয়নগর আন্তর্জাতিক ইমিগ্রেশন চেকপোস্টে শয়নকক্ষে পুলিশ কনস্টবলের ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার

খনিজ সম্পদ নিয়ে সই হলো কিয়েভ-ওয়াশিংটন সমঝোতা স্মারক

খনিজ সম্পদ নিয়ে সই হলো কিয়েভ-ওয়াশিংটন সমঝোতা স্মারক

বিমান ছিনতাই করতে গিয়ে যাত্রীর গুলিতে মার্কিন নাগরিক নিহত

বিমান ছিনতাই করতে গিয়ে যাত্রীর গুলিতে মার্কিন নাগরিক নিহত

দুবাইতে স্বর্ণের দামে সর্বকালের সব রেকর্ড ভঙ্গ, নেপথ্যে শেয়ারবাজারে ধ্বস

দুবাইতে স্বর্ণের দামে সর্বকালের সব রেকর্ড ভঙ্গ, নেপথ্যে শেয়ারবাজারে ধ্বস

গাজায় ইসরাইলি হামলায় একই পরিবারের ১৩ জন নিহত

গাজায় ইসরাইলি হামলায় একই পরিবারের ১৩ জন নিহত

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংস্থার ও বিচার কার্যক্রম শেষ করে ঘোষিত সময়ের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন দিতে হবে

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংস্থার ও বিচার কার্যক্রম শেষ করে ঘোষিত সময়ের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন দিতে হবে

বিরলে বাড়ী থেকে অপহরণ করে এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা

বিরলে বাড়ী থেকে অপহরণ করে এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা

সাভার ও আশুলিয়ার পোশাক শ্রমিকদের ভরসা ব্যয়বহুল বেসরকারি হাসপাতাল

সাভার ও আশুলিয়ার পোশাক শ্রমিকদের ভরসা ব্যয়বহুল বেসরকারি হাসপাতাল

মুর্শিদাবাদে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা নিয়ে বাংলাদেশকে জড়ানোর চেষ্টা, আসিফ নজরুলের তীব্র প্রতিবাদ

মুর্শিদাবাদে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা নিয়ে বাংলাদেশকে জড়ানোর চেষ্টা, আসিফ নজরুলের তীব্র প্রতিবাদ

ফরিদপুরে প্রেমের ফাঁদে ভুয়া মেজর আটক!

ফরিদপুরে প্রেমের ফাঁদে ভুয়া মেজর আটক!

তেল ছাড়াই আমের আচার! সুগার, ব্লাড প্রেশার থাকলেও খেতে পারবেন

তেল ছাড়াই আমের আচার! সুগার, ব্লাড প্রেশার থাকলেও খেতে পারবেন

দুর্ঘটনায় উড়ে গেল বাসের ছাদ, ১০ কিমি চালিয়ে গেলেন বেপরোয়া চালক

দুর্ঘটনায় উড়ে গেল বাসের ছাদ, ১০ কিমি চালিয়ে গেলেন বেপরোয়া চালক

মাগুরার আছিয়াকে নিয়ে হৃদয়বিদারক গান গাইলেন বাপ্পা

মাগুরার আছিয়াকে নিয়ে হৃদয়বিদারক গান গাইলেন বাপ্পা

কুড়িগ্রামে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহ সভাপতি দুর্জয় গ্রেফতার

কুড়িগ্রামে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহ সভাপতি দুর্জয় গ্রেফতার

সালথায় কৃষককে হাতুড়িপেটা

সালথায় কৃষককে হাতুড়িপেটা