খাজা নিজাম উদ্দীন আওলিয়া (রহ.)-১

ভারতের সভ্যতায় মুসলমানদের অবদান

Daily Inqilab ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন

০৯ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০৩ এএম | আপডেট: ০৯ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০৩ এএম

শায়খ খাজা সাইয়েদ মুহম্মদ নিজাম উদ্দীন আওলিয়া (১২৩৮-১৩২৫) উপমহাদেশে চিশতিয়া তরিকার অন্যতম মহান সুফি সাধক। সুলতানুল মাশায়েখ ও মাহবুবে ইলাহি নামে তিনি পরিচিতি লাভ করেন। তাঁর সিলসিলা ফরিদ উদ্দীন গঞ্জেশকর (রহ.), কুতুব উদ্দীন বখতিয়ার কাকী (রহ.) হয়ে খাজা মইনুদ্দীন চিশতি (রহ.)-এর সাথে মিলিত হয়। নিজাম উদ্দীন আওলিয়া, তাঁর পূর্বসূরীদের ন্যায়, প্রেম বা ইশককে আল্লাহ প্রাপ্তির পন্থা হিসেবে বর্ণনা করেন। তাঁর মতে, আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা মানবতার প্রতি ভালোবাসার জন্ম দেয়। ইতিহাসবিদ জিয়াউদ্দিন বারানী দাবি করেন, দিল্লিবাসীর উপর তাঁর প্রভাব এমন ছিলো যে, পার্থিব ব্যাপারে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তিত হয়। মানুষ আধ্যাত্মিকতা এবং ইবাদতের প্রতি মনোযোগী এবং দুনিয়াবী চিন্তা থেকে পৃথক হয়ে পড়ে।

তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিলো উদার। ধর্ম, বর্ণ, ভাষা নির্বিশেষে সব মানুষকে তিনি ভালোবাসতেন এবং তাদের সেবা প্রদানকে পুণ্য কাজ মনে করতেন। জমি-জায়গা ও অতিরিক্ত ধন-সম্পদ সঞ্চয় করা তিনি পছন্দ করতেন না। একদা এক আমীর একনিষ্ঠ ভক্তি ও শ্রদ্ধা প্রকাশ করে ফলের বাগান, অনেক জায়গা-জমি ও অন্যান্য আসবাবপত্রের দলিল-দস্তাবিজ হযরত খাজা নিজাম উদ্দীন (রহ.)-এর খেদমতে পাঠিয়েছিলেন। হযরত খাজা (রহ.) তা কবুল করেননি, বরং মুচকি হেসে বললেন, ‘যদি আমি এটাকে কবুল করি তবে এরপর লোকে বলাবলি শুরু করবে যে, শায়খ বাগান ভ্রমণে গেছেন এবং নিজ জায়গা-জমি ও ক্ষেত-খামার দেখতে গেছেন। এসব কাজের সাথে আমার কী সম্পর্ক? আমাদের কোনো শায়খ ও বুযুর্গ কেউ জায়গা-জমি কবুল করেননি’ (ফাওয়ায়েদুল ফুয়াদ, পৃ. ৯৯)।

শায়েখ নিজাম উদ্দীন আওলিয়া (রহ.) উত্তর প্রদেশের (দিল্লীর পূর্বে) বদায়ুনে জন্মগ্রহণ করেন। পাঁচ বছর বয়সে তার পিতা সাইয়েদ আবদুল্লাহ বিন আহমদ আল-হোসাইনী বদায়ুনীর মৃত্যুর পর তিনি তাঁর মা বিবি জুলায়খার সাথে দিল্লি চলে আসেন। তিনি সমসাময়িক আলিমদের কাছে তাফসির, হাদিস, ফিকহ ও আরবি সাহিত্য অধ্যয়ন করেন। মুঘল সম্রাট আকবরের উজির আবুল ফজল রচিত আইন-ই-আকবরি-তে খাজা নিজাম উদ্দীন (রহ.)-এর জীবনী উল্লেখ রয়েছে (অরহ-র-অশনধৎর, নু অনঁ’ষ-ঋধুষ রনহ গঁনধৎধশ. ঊহমষরংয ঃৎ. নু ঐবরহৎরপয ইষড়পযসধহহ ধহফ ঈড়ষড়হবষ ঐবহৎু ঝঁষষরাধহ ঔধৎৎবঃঃ, ১৮৭৩–১৯০৭. ঞযব অংরধঃরপ ঝড়পরবঃু ড়ভ ইবহমধষ, ঈধষপঁঃঃধ, ঠড়ষঁসব ওওও, ঝধরহঃং ড়ভ ওহফরধ. (অষিরুপ্স-র-ঐরহফ), ঢ়ধমব ৩৬৫.)। বিশ বছর বয়সে, নিজাম উদ্দীন আজোধানে (বর্তমানে পাকিস্তানের পাকপাত্তান শরীফ) যান এবং সুফি সাধক ফরিদ উদ্দীন গঞ্জেশকরের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন, যিনি বাবা ফরিদ নামে অধিক পরিচিত। বাবা ফরিদ বর্তমান থাকা অবস্থায় তিনি প্রতি বছর রমজান মাস অতিবাহিত করতে আজোধানে যেতেন। তৃতীয়বার আজোধান সফরে গেলে বাবা ফরিদ তাকে তার উত্তরসূরি বা খলিফা মনোনীত করেন। এর কিছুদিন পরে, যখন নিজাম উদ্দীন দিল্লিতে ফিরে আসেন, তিনি খবর পান যে, বাবা ফরিদ মৃত্যুবরণ করেছেন। দিল্লিতে নির্মিত তাঁর খানকা ছিলো আধ্যাত্মিক স্থান, যেখানে সর্বস্তরের মানুষের সেবা করা হয়। তিনি সেখানে ভক্তদের আধ্যাত্মিক শিক্ষা প্রদান করতেন। খুব অল্পদিনের মধ্যেই খানকাটি গরিব-ধনীসহ সকল প্রকারের মানুষের ভিড়ে লোকারণ্য হয়ে পড়ে।

শায়খ নিজাম উদ্দীন আওলিয়ার খানাকায় প্রতিদিন হাজার হাজার মুসলিম, হিন্দু, খ্রিস্টান এবং বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী পরিদর্শনে আসে। সেখানে আগতদের জন্য খোলা ছিল উন্মুক্ত লঙ্গরখানা। সুলতানুল মাশায়েখের দরবারে জনতার ঢল পূর্বযুগ থেকেই ছিলো। সাক্ষাতপ্রার্থীরা নগদ অর্থ, বস্ত্রখণ্ড ও বিভিন্ন হাদিয়া-তোহফা তাঁকে দিতেন, যা উপস্থিত জনগণের মাঝে তিনি বিতরণ করে দিতেন। প্রতি জুমাবার খানাকা ও ভাণ্ডারে মজুদ দ্রব্যসামগ্রী দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে দান করা ছিলো তাঁর নিয়মিত আমল (সিয়ারুল আওলিয়া, পৃ. ১২৬-১৩০)। হজরত খাজা নাসির উদ্দীন চেরাগে দেহলী (রহ.) বলেন, বিজয় অভিযানের অবস্থা ও নমুনা এমন ছিলো যে, ধন-দৌলতের সমুদ্র দরজার সামনে ঢেউ খেলত। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্তই নয়; বরং এশা পর্যন্ত লোকজনের আসার বিরতি থাকতো না। কিন্তু আনয়নকারীর চেয়ে গ্রহণকারীর সংখ্যা ছিলো অনেক বেশি (খাজা নাসির উদ্দীন চেরাগে দেহলী (রহ.)-এর মালফুজাত, সিরাজুল মাজালিস, [খায়রুল মাজালিসের অনুবাদ, পৃ.২০২]।


বিভাগ : বিশেষ প্রতিবেদন


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

নাব্যতা হারিয়ে দখলদারদের কবলে পড়ে মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাচ্ছে একের পর এক নদী
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-১২
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-১১
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-১০
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-৯
আরও
X

আরও পড়ুন

সৌদি রাষ্ট্রদূতকে হেয় করাই মূল উদ্দেশ্য মেঘনার?

সৌদি রাষ্ট্রদূতকে হেয় করাই মূল উদ্দেশ্য মেঘনার?

২৯ এপ্রিল প্রথম হজ ফ্লাইট, হজযাত্রীদের সুবিধায় সরকারের যত উদ্যোগ

২৯ এপ্রিল প্রথম হজ ফ্লাইট, হজযাত্রীদের সুবিধায় সরকারের যত উদ্যোগ

৪ মাসের সন্তান বিক্রি করে পায়ের নূপুর মোবাইল কিনলেন মা! উদ্ধার করল পুলিশ

৪ মাসের সন্তান বিক্রি করে পায়ের নূপুর মোবাইল কিনলেন মা! উদ্ধার করল পুলিশ

কওমি সনদ বাস্তবায়নের দায়িত্ব শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের : ধর্ম উপদেষ্টা

কওমি সনদ বাস্তবায়নের দায়িত্ব শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের : ধর্ম উপদেষ্টা

অত্যাচারীরা কখনও শাসক বা নেতা হতে পারে না: সাবেক সাংসদ নিজাম

অত্যাচারীরা কখনও শাসক বা নেতা হতে পারে না: সাবেক সাংসদ নিজাম

চুয়াডাঙ্গার দর্শনা জয়নগর আন্তর্জাতিক ইমিগ্রেশন চেকপোস্টে শয়নকক্ষে পুলিশ কনস্টবলের ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার

চুয়াডাঙ্গার দর্শনা জয়নগর আন্তর্জাতিক ইমিগ্রেশন চেকপোস্টে শয়নকক্ষে পুলিশ কনস্টবলের ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার

খনিজ সম্পদ নিয়ে সই হলো কিয়েভ-ওয়াশিংটন সমঝোতা স্মারক

খনিজ সম্পদ নিয়ে সই হলো কিয়েভ-ওয়াশিংটন সমঝোতা স্মারক

বিমান ছিনতাই করতে গিয়ে যাত্রীর গুলিতে মার্কিন নাগরিক নিহত

বিমান ছিনতাই করতে গিয়ে যাত্রীর গুলিতে মার্কিন নাগরিক নিহত

দুবাইতে স্বর্ণের দামে সর্বকালের সব রেকর্ড ভঙ্গ, নেপথ্যে শেয়ারবাজারে ধ্বস

দুবাইতে স্বর্ণের দামে সর্বকালের সব রেকর্ড ভঙ্গ, নেপথ্যে শেয়ারবাজারে ধ্বস

গাজায় ইসরাইলি হামলায় একই পরিবারের ১৩ জন নিহত

গাজায় ইসরাইলি হামলায় একই পরিবারের ১৩ জন নিহত

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংস্থার ও বিচার কার্যক্রম শেষ করে ঘোষিত সময়ের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন দিতে হবে

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংস্থার ও বিচার কার্যক্রম শেষ করে ঘোষিত সময়ের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন দিতে হবে

বিরলে বাড়ী থেকে অপহরণ করে এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা

বিরলে বাড়ী থেকে অপহরণ করে এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা

সাভার ও আশুলিয়ার পোশাক শ্রমিকদের ভরসা ব্যয়বহুল বেসরকারি হাসপাতাল

সাভার ও আশুলিয়ার পোশাক শ্রমিকদের ভরসা ব্যয়বহুল বেসরকারি হাসপাতাল

মুর্শিদাবাদে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা নিয়ে বাংলাদেশকে জড়ানোর চেষ্টা, আসিফ নজরুলের তীব্র প্রতিবাদ

মুর্শিদাবাদে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা নিয়ে বাংলাদেশকে জড়ানোর চেষ্টা, আসিফ নজরুলের তীব্র প্রতিবাদ

ফরিদপুরে প্রেমের ফাঁদে ভুয়া মেজর আটক!

ফরিদপুরে প্রেমের ফাঁদে ভুয়া মেজর আটক!

তেল ছাড়াই আমের আচার! সুগার, ব্লাড প্রেশার থাকলেও খেতে পারবেন

তেল ছাড়াই আমের আচার! সুগার, ব্লাড প্রেশার থাকলেও খেতে পারবেন

দুর্ঘটনায় উড়ে গেল বাসের ছাদ, ১০ কিমি চালিয়ে গেলেন বেপরোয়া চালক

দুর্ঘটনায় উড়ে গেল বাসের ছাদ, ১০ কিমি চালিয়ে গেলেন বেপরোয়া চালক

মাগুরার আছিয়াকে নিয়ে হৃদয়বিদারক গান গাইলেন বাপ্পা

মাগুরার আছিয়াকে নিয়ে হৃদয়বিদারক গান গাইলেন বাপ্পা

কুড়িগ্রামে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহ সভাপতি দুর্জয় গ্রেফতার

কুড়িগ্রামে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহ সভাপতি দুর্জয় গ্রেফতার

সালথায় কৃষককে হাতুড়িপেটা

সালথায় কৃষককে হাতুড়িপেটা