ভারতের সভ্যতায় মুসলমানদের অবদান

খাজা নিজাম উদ্দীন আওলিয়া (রহ.)-৩

Daily Inqilab ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন

১৬ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০২ এএম | আপডেট: ১৬ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০২ এএম

হযরত খাজা নিজাম উদ্দীন আওলিয়া (রহ.)-এর জীবনে মহামূল্যবান সম্পদ, যা তাঁকে তাঁর সমসাময়িক মনীষীবৃন্দের মধ্যে ভিন্ন মর্যাদা দান করেছে। শুধু স্বীয় জামানারই নয়, বরং ইসলামী ইতিহাসের বিভিন্ন যুগেও তা সাধারণ স্বীকৃতি ও চিরন্তন স্থায়িত্ব লাভ করেছে। তাঁকে জনপ্রিয়তার বিশিষ্ট পুরস্কার দ্বারা পুরস্কৃত করেছে, তা ছিল তাওহীদ ও ইখলাস। সেই বিশেষ অবস্থা ও স্বাদ, যার মধ্যে মুহব্বত (ঐশী-প্রেম) ও রিযায়ে ইলাহী (আল্লাহর সন্তুষ্টি) ব্যতীত অন্য কোনো বস্তুই আর কাম্য ও লক্ষ্য থাকে না। মুহব্বত ও ইয়াকীনের প্রেমাগ্নি সর্বপ্রকারের কণ্টকময় প্রতিবন্ধকতাকে জ্বালিয়ে দিয়েছিল। দুনিয়া-প্রীতি, জৌলুস-প্রীতি এবং এ ধরনের সকল প্রেমের কামনা-বাসনার মূল উৎপাটিত হয়ে গিয়েছিল (সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী, হযরত খাজা নিজাম উদ্দীন আওলিয়া (রহ.), অনুবাদ আবু সাঈদ ওমর আলী, ১৯৯৯ খ্রি., পৃ. ৮৮-৮৯)।

তিনি উপযুক্ত শিষ্য রেখে গেছেন, যারা চিশতীয়া তরিকার মাধ্যমে নতুন সভ্যতা নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁরা জনগণের হৃদয়ে উচ্চাসনে আসীন ছিলেন। হযরত আমির খসরু ছিলেন তার পীর বা মুর্শিদের সবচেয়ে প্রিয় শিষ্য, তাঁর মুখপাত্র ও প্রধান খলিফা। তিনি তাঁর পীরের জন্য নিজের বিপুল ধনরাশি ও রাজকীয় সম্মানের সর্বস্ব ত্যাগ করেন। তিনি তাঁর মুর্শিদের এতটাই প্রিয় ছিলেন যে, একদা নিজাম উদ্দীন আওলিয়া বলেছিলেন, ‘যদি শরিয়ত আমাকে অনুমতি দিত তাহলে আমি খসরুকে আমার সাথে একই কবরে সমাহিত করতে বলতাম’ (ঐরংঃড়ৎরপধষ ঝঃঁফরবং লড়ঁৎহধষ ঘড় ১২, ২০১১, ঢ় ১২৫.) তিনি আরো বলেন, কেউ যদি আমার সমাধিস্থল যিয়ারত করতে আসে; তাহলে সে যেন প্রথমে আমির খসরুর সমাধি আগে যিয়ারত করে আসে (ঙসবৎ ঞধৎরহ রহ ঝড়সব ঈযরংযঃর ঝঁভরং ড়ভ ঃযব ১৩-১৪ঃয প)। পীরের পরলোক গমনের ছয় মাস পর তিনিও ইন্তেকাল করেন। তাঁকে তার পীরের পায়ের কাছে সমাধিস্থ করা হয়। তাঁর মাজার নয়াদিল্লির নিজাম উদ্দীন দরগাহে অবস্থিত।

নাসির উদ্দীন চিরাগ দেহলভী ছিলেন নিজাম উদ্দীন আওলিয়া (রহ.)-এর আধ্যাত্মিক উত্তরসূরি। তিনি ভারতের চিশতিয়া তরিকার পাঁচজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির মধ্যে পঞ্চম বলে বিবেচিত হন। অন্যরা হলেন মইনুদ্দীন চিশতী, কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকী, ফরিদ উদ্দীন গঞ্জেশকর, নিজাম উদ্দীন আওলিয়া (রহ.)।
আখি সিরাজ আয়নায়ে হিন্দ। খাজা নিজাম উদ্দীন আওলিয়া তাঁকে আয়নায়ে হিন্দ (ভারতের আয়না) উপাধি দিয়েছিলেন এবং দীর্ঘদিন তার সাথে বসবাস করেছিলেন। তিনি নিজাম উদ্দীন আওলিয়ার প্রথম দিকের শিষ্যদের মধ্যে একজন ছিলেন, যিনি তাকে বাংলায় পাঠিয়েছিলেন দাওয়াতের কাজে। তাঁর মাজার পশ্চিমবঙ্গের মালদা শহরের পীরানা পীর দরগাহে অবস্থিত।

বোরহান উদ্দীন গরীব ছিলেন নিজাম উদ্দীন আওলিয়া (রহ.) প্রথম দিকের শিষ্যদের মধ্যে একজন এবং তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মুর্শিদ বা পীরের সাথে বসবাস করেন। শায়খ নিজাম উদ্দীন আওলিয়ার মৃত্যুর পর তিনি দাক্ষিণাত্যে চলে যান এবং সেখানে তিনি যে স্থানে থাকতেন তা বিখ্যাত হয়ে ওঠে। মহারাষ্ট্রের খুলদাবাদে তার মাজার অবস্থিত।

জীবনের শেষ দিকে শামস নিজাম উদ্দীন আউলিয়া আহার বিহার ছেড়ে দেন। চল্লিশ দিন পর্যন্ত এভাবেই তিনি খানাপিনা থেকে বিরত থাকেন, এক দানাও তিনি গ্রহণ করেননি। এর পর তিনি কথাও খুব কম বলেছেন। ওফাতের দিন বুধবার পর্যন্ত এরূপ অবস্থায় কাটে। ১৮ রবিউছছানী, ৭২৫ হিজরী বেলা উঠার পর যুহুদ, ইবাদত, হাকীকত ও মা’রিফত এবং হেদায়াত ও সত্যের উজ্জ্বল এই আলোকবর্তিকা অস্তমিত হয়ে যায়। জানাযার নামাযে ইমামতি করেন শায়খুল ইসলাম বাহাউদ্দীন যাকারিয়া মুলতানীর দৌহিত্র শায়খুল ইসলাম রুকনউদ্দীন। জানাযার পর শায়খুল ইসলাম রুকনউদ্দীন বলেন, ‘এখন আমি বুঝতে পারলাম যে, আমাকে চার বছর পর্যন্ত দিল্লিতে এজন্যই রাখা হয়েছিল যেন আমি এই জানাযার ইমামতি দ্বারা সৌভাগ্য হাসিল করি।’ সারাটা জীবন একাকীত্বের মাঝে কেটেছিল বিধায় তাঁর কোনো সন্তান-সন্ততি ছিল না। রূহানী সিলসিলা সমগ্র ভারতবর্ষে পরিব্যাপ্ত এবং এখনও অব্যাহত (সিয়ারুল আওলিয়া, পৃ. ১৫২-৫৪)।

সুলতানুল মাশায়েখ হযরত শায়খ নিজাম উদ্দীন (রহ.) চিশতীয়া সিলসিলার প্রথম বুযুর্গ যাঁর প্রভাব-বলয় ও প্রতিপত্তি নিজের জীবদ্দশায়ই সমগ্র ভারতবর্ষে পরিব্যাপ্ত হয়ে পড়ে এবং যিনি ভারতবর্ষের ইসলামী সমাজজীবনকেও বিশেষভাবে প্রভাবান্বিত করেন। রাষ্ট্রীয় জীবন থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ ও দরিদ্রের পর্ণ কুটির পর্যন্ত সর্বত্রই তিনি নিজেকে শ্রদ্ধাশীল করে তোলেন (সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী, হযরত খাজা নিজাম উদ্দীন আওলিয়া (রহ.), অনুবাদ আবু সাঈদ ওমর আলী, ১৯৯৯ খ্রি., পৃ. ৪২)। ভারতের সভ্যতা ও সংস্কৃতি নির্মাণে তাঁর অবদান ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। দিল্লিতে অবস্থিত তাঁর খানাকা এখনো প্রতিদিন সর্বস্তরের মানুষের মিলন মেলায় পরিণত হয়। (সমাপ্ত)


বিভাগ : বিশেষ প্রতিবেদন


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

নাব্যতা হারিয়ে দখলদারদের কবলে পড়ে মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাচ্ছে একের পর এক নদী
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-১২
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-১১
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-১০
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-৯
আরও
X

আরও পড়ুন

বিশ্বনাথে অপপ্রচারকারীদের ২৪ ঘন্টার আল্টিমেটাল তিন সাংবাদিক সংগঠনের

বিশ্বনাথে অপপ্রচারকারীদের ২৪ ঘন্টার আল্টিমেটাল তিন সাংবাদিক সংগঠনের

মেঘনা সেতুতে ট্রাক উল্টে ৮ কিলোমিটার সড়কে তীব্র যানজট

মেঘনা সেতুতে ট্রাক উল্টে ৮ কিলোমিটার সড়কে তীব্র যানজট

নিজেকে বরিশালের মেয়র দাবী করে নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে মুফতি সৈয়দ মোহাম্মাদ ফয়জুল করীম

নিজেকে বরিশালের মেয়র দাবী করে নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে মুফতি সৈয়দ মোহাম্মাদ ফয়জুল করীম

ভিসা বাতিল : বিদেশি শিক্ষার্থীদের মামলায় আসামি ট্রাম্পের ৩ কর্মকর্তা

ভিসা বাতিল : বিদেশি শিক্ষার্থীদের মামলায় আসামি ট্রাম্পের ৩ কর্মকর্তা

ইউক্রেনের যুদ্ধ বিরতির জন্য আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ানোর আহ্বান

ইউক্রেনের যুদ্ধ বিরতির জন্য আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ানোর আহ্বান

সৌদি রাষ্ট্রদূতকে হেয় করাই মূল উদ্দেশ্য মেঘনার?

সৌদি রাষ্ট্রদূতকে হেয় করাই মূল উদ্দেশ্য মেঘনার?

২৯ এপ্রিল প্রথম হজ ফ্লাইট, হজযাত্রীদের সুবিধায় সরকারের যত উদ্যোগ

২৯ এপ্রিল প্রথম হজ ফ্লাইট, হজযাত্রীদের সুবিধায় সরকারের যত উদ্যোগ

৪ মাসের সন্তান বিক্রি করে পায়ের নূপুর মোবাইল কিনলেন মা! উদ্ধার করল পুলিশ

৪ মাসের সন্তান বিক্রি করে পায়ের নূপুর মোবাইল কিনলেন মা! উদ্ধার করল পুলিশ

কওমি সনদ বাস্তবায়নের দায়িত্ব শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের : ধর্ম উপদেষ্টা

কওমি সনদ বাস্তবায়নের দায়িত্ব শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের : ধর্ম উপদেষ্টা

অত্যাচারীরা কখনও শাসক বা নেতা হতে পারে না: সাবেক সাংসদ নিজাম

অত্যাচারীরা কখনও শাসক বা নেতা হতে পারে না: সাবেক সাংসদ নিজাম

চুয়াডাঙ্গার দর্শনা জয়নগর আন্তর্জাতিক ইমিগ্রেশন চেকপোস্টে শয়নকক্ষে পুলিশ কনস্টবলের ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার

চুয়াডাঙ্গার দর্শনা জয়নগর আন্তর্জাতিক ইমিগ্রেশন চেকপোস্টে শয়নকক্ষে পুলিশ কনস্টবলের ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার

খনিজ সম্পদ নিয়ে সই হলো কিয়েভ-ওয়াশিংটন সমঝোতা স্মারক

খনিজ সম্পদ নিয়ে সই হলো কিয়েভ-ওয়াশিংটন সমঝোতা স্মারক

বিমান ছিনতাই করতে গিয়ে যাত্রীর গুলিতে মার্কিন নাগরিক নিহত

বিমান ছিনতাই করতে গিয়ে যাত্রীর গুলিতে মার্কিন নাগরিক নিহত

দুবাইতে স্বর্ণের দামে সর্বকালের সব রেকর্ড ভঙ্গ, নেপথ্যে শেয়ারবাজারে ধ্বস

দুবাইতে স্বর্ণের দামে সর্বকালের সব রেকর্ড ভঙ্গ, নেপথ্যে শেয়ারবাজারে ধ্বস

গাজায় ইসরাইলি হামলায় একই পরিবারের ১৩ জন নিহত

গাজায় ইসরাইলি হামলায় একই পরিবারের ১৩ জন নিহত

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংস্থার ও বিচার কার্যক্রম শেষ করে ঘোষিত সময়ের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন দিতে হবে

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংস্থার ও বিচার কার্যক্রম শেষ করে ঘোষিত সময়ের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন দিতে হবে

বিরলে বাড়ী থেকে অপহরণ করে এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা

বিরলে বাড়ী থেকে অপহরণ করে এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা

সাভার ও আশুলিয়ার পোশাক শ্রমিকদের ভরসা ব্যয়বহুল বেসরকারি হাসপাতাল

সাভার ও আশুলিয়ার পোশাক শ্রমিকদের ভরসা ব্যয়বহুল বেসরকারি হাসপাতাল

মুর্শিদাবাদে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা নিয়ে বাংলাদেশকে জড়ানোর চেষ্টা, আসিফ নজরুলের তীব্র প্রতিবাদ

মুর্শিদাবাদে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা নিয়ে বাংলাদেশকে জড়ানোর চেষ্টা, আসিফ নজরুলের তীব্র প্রতিবাদ

ফরিদপুরে প্রেমের ফাঁদে ভুয়া মেজর আটক!

ফরিদপুরে প্রেমের ফাঁদে ভুয়া মেজর আটক!