ঢাকা   বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারি ২০২৫ | ৯ মাঘ ১৪৩১

ইতিহাসের বাঁক পরিবর্তন

Daily Inqilab মুনশী আবদুল মাননান

০১ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০২ এএম | আপডেট: ০১ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০২ এএম

প্রত্যেক জাতির ইতিহাসে এমন কিছু সন-তারিখ আছে, যে সব সন-তারিখে মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল। আমাদের জাতির ইতিহাসেও ওই ধরনের কিছু সন-তারিখ আছে। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ, ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর। এসব ঐতিহাসিক সন-তারিখের সঙ্গে আরো একটি সন-তারিখ যুক্ত হয়েছে। সেটি হলো, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট। আমরা জানি, ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট উপমহাদেশ বিভক্ত হয়ে স্বাধীন-সার্বভৌম পাকিস্তানের অভ্যুদয় ঘটে। পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ হিসেবে পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করে। উপমহাদেশের স্বাধীনতাহরণের সূত্রপাত হয়েছিল বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের মধ্য দিয়ে। ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রতিবেশী হিন্দু সম্প্রদায়ের উচ্চশ্রেণি ও নবাবের আত্মীয়-স্বজনের ষড়যন্ত্রে বা সহযোগিতায় ক্ষমতা দখল করে। এরপর আস্তে আস্তে ভারতের অন্যান্য অংশ ইংরেজ কোম্পানির করতলগত হয়। নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয় হয় পলাশীর যুদ্ধে ১৭৫৭ সালের ২৩ মার্চ। তখনই পূর্ণ শাসনভার নেয়নি কোম্পানি। মীর জাফর আলী খানকে নবাব বানিয়ে স্বাধীন নবাবীশাসন অব্যাহত আছে, এমন একটি ধারণা দেয়ার চেষ্টা করা হয়। তবে অচিরেই সবকিছু খোলাসা হয়ে যায়। দেশ পরাধীন হয়ে গেছে। ক্ষমতা ও শাসন এখন ইংরেজ কোম্পানির, এটি জানার পরপরই পরাধীনতা থেকে স্বাধীনতায় উত্তরণের জন্য সংগ্রাম শুরু হয়। রাজ্য ও শাসন হারানো মুসলিমরাই প্রথম সংগ্রামের সূচনা করে। প্রায় এক শ’ বছর সশস্ত্র যুদ্ধ ও প্রায় এক শ’ বছর নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন চালিয়ে যায় মুসলমানরা। এরপর ১৯৪৭ সালে ভারত যখন বিভক্ত ও স্বাধীন হয়, তখন মুসলমানদের স্বতন্ত্র হোমল্যান্ড হিসেবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার অতি ক্ষুদ্র অংশ পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন রাষ্ট্রের একাংশের মর্যাদা পায়, যার শাসন ক্ষমতার অধিকার লাভ করে মুসলমানরা। পরাধীনতা থেকে এভাবে স্বাধীনতায় ফিরে আসা একটি বড় রকমের জাতীয় মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনা।

দুই.

অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, ১৯০ বছর পরাধীন থাকার পর এ দেশের মানুষ যে স্বাধীনতা অর্জন করে, সেই স্বাধীনতা উপভোগ করা থেকে তারা বঞ্চনার শিকার হয়। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক ইত্যাদি ক্ষেত্রে দাবিয়ে রাখার বা বঞ্চিত করার নীতি অবলম্বন করে। পাকিস্তানের ২৩ বছরের প্রথম ৯ বছরে কোনো সংবিধান ছিল না। ১৯৫৬ সালে একটি সংবিধান প্রণীত হয়, যা সামরিক শাসক আইয়ুব খান বাতিল করেন। ১৯৬২ সালে তিনি একটি সংবিধান প্রণয়ন করেন, যা আরেক সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান বাতিল করেন। দেশে কোনো গণতন্ত্র ছিল না। মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর ছিল হস্তক্ষেপ। ২৩ বছর একটি জাতীয় নির্বাচন করাও সম্ভব হয়নি। সঙ্গতকারণেই পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ দুঃশাসন, বঞ্চনা, বৈষম্য, গণতন্ত্রহীনতার জন্য ছিল ক্ষুব্ধ ও প্রতিবাদমুখর। তারা লাগাতার আন্দোলন করতে করতে ১৯৭০ সালে এসে পায় জাতীয় একটি নির্বাচন। এই নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার পরিবর্তন, গণতন্ত্রে উত্তরণ, বৈষম্য ও বঞ্চনা অবসানের স্বপ্ন নিয়ে তারা ভোট দেয়। পূর্ব পাকিস্তান ও সমগ্র পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। ফলাফল অনুযায়ী, তারই পূর্ব পাকিস্তান ও সমগ্র পাকিস্তানে সরকার গঠনের কথা। কিন্তু পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা প্রদানে তালবাহানা শুরু করে এবং ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক হামলা ও গণহত্যা আরম্ভ করে। ওইদিনই কার্যত পাকিস্তান শেষ হয়ে যায়। প্রতিরোধ যুদ্ধের সূচনা হয় পরপরই। মেজর জিয়াউর রহমান আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। মুক্তির এ যুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় আসে ওই বছরই ডিসেম্বরে। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। পূর্ব পাকিস্তান থেকে স্বাধীন বাংলাদেশ এটি জাতির জীবনে সবচেয়ে বড় ঘটনা।

তিন.

কারো অজানা নয়, ভারত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা করেছিল। প্রায় এক কোটি লোককে আশ্রয় দিয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং দিয়েছিল। অস্ত্র দিয়েছিল। ভারতীয় সশস্ত্রবাহিনী মিত্র বাহিনীর অংশ হিসেবে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। ভারত যে কেবল বিপন্ন মানবতার কারণে, স্বাধীনতার প্রতি অনুরাগের কারণে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা করেছিল, এমন নয়। তার ছিল আলাদা অ্যাজেন্ডা। আমাদের ছিল পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা অর্জন। আর ভারতের ছিল চিরশত্রু পাকিস্তানকে ভাঙা। বিভক্ত ও দুর্বল পাকিস্তান ভারতের জন্য সুবিধাজনক। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে সেটিই হয়েছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ হওয়ায় পশ্চিমবঙ্গসহ সাত রাজ্যের নিরাপত্তাঝুঁকির অবসান হয়েছিল। এ জন্য বিপুল সামরিক ব্যয় কমেছিল। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমনের পথ প্রশস্ত হয়েছিল। ভারতীয় মানসে এমন ধারণা তৈরি হওয়াও অস্বাভাবিক নয় যে, বাংলাদেশ মুক্ত হলে ভারতের সঙ্গে মিশে যাবে। যদি বা নাও যায়, বাংলাদেশ একটি অনুগত রাষ্ট্র হিসেবে পরিগণিত হবে। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশকে কৌশলে কবজা করতে ভারত কম চেষ্টা করেনি। শুরুতে ভারতের সৈন্য তো ছিলই। একদল সিভিল সার্ভিস কর্মকর্তাও ভারত থেকে এসেছিলেন। কিন্তু এদেশের মানুষ ভারতীয় সৈন্যের অবস্থান এবং ভারতীয় কর্মকর্তাদের সিভিল প্রশাসন দখলÑ কোনোটিই বরদাশত করেনি। অল্পকালের মধ্যেই তাদের বিদায় করেছিল। এটি ছিল ভারতের জন্য একটি বড় ধাক্কা। পরবর্তীতে ভারতের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের কেউ কেউ বলেছেন, বাংলাদেশ থেকে সৈন্য প্রত্যাহার তাদের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল। ভারত বাংলাদেশের দখল ছাড়তে চায়নি। বাস্তবতা তাকে ছাড়তে বাধ্য করেছিল। শুরু থেকেই দখল শুরু করেছিল ভারত। মুক্তিযুদ্ধের বিজয়, যা একান্তই আমাদের, তা দখল করে নিয়েছিল। পাকিস্তান বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছিল ভারতীয় বাহিনীর কাছে, মুক্তিবাহিনীর কাছে নয়। ভারত একে ‘হাজার সালকে বদলা’ বলে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ভারত, পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ হিসেবে মনে করতো, এখনো করে। এবারের ১৬ ডিসেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যে বাণী দিয়েছেন, তাতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ হিসেবে দেখিয়েছে, বাংলাদেশের নাম পর্যন্ত নেই।

যাই হোক, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশকে পদানত করার, বিপদগ্রস্ত ও বিপন্ন করার কোনো কিছুই বাদ দেয়নি ভারত। ২৫ সালা গোলামি চুক্তি, ফারাক্কা সমঝোতা ইত্যাদির কথা উল্লেখ করা যায়। এর আগে তো সোনাদানা, অস্ত্রপাতি ইত্যাদি লুট করে নিয়ে যেতেও দ্বিধা করেনি ভারতীয়রা। বাংলাদেশের রাষ্ট্রনীতি, পররাষ্ট্রনীতি, প্রতিরক্ষানীতি, রাজনীতি ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করার জোর চেষ্টা হয়েছে। এ দেশের মানুষ এসব মেনে নিতে পারেনি। যুদ্ধের পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে খুন, সন্ত্রাস, দখল ও লুটপাটের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করে ওই দল ও দলীয় সরকার। জনগণের রাজনৈতিক অধিকার, গণতন্ত্র, নির্বাচন, সংবাদপত্র ও মত প্রকাশের স্বাধীনতাÑ সব কিছু লোপাট হয়ে যায়। বাকশাল প্রতিষ্ঠিত হলে মানুষের শ্বাসরুদ্ধ হওয়ার অবস্থা হয়। এই প্রেক্ষাপটে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট আকস্মিকভাবে ঘটে যায় এক অভ্যুত্থান, যাতে প্রায় সপরিবারে নিহত হন শেখ মুজিবুর রহমান। আওয়ামী লীগেরই একাংশ খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে ক্ষমতা লাভ করে। ওই বছরই ৩ নভেম্বর একটি সামরিক অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়, যা ওই সরকারকে সরিয়ে দেয়। ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানকারীরা ভারতপন্থী বা ভারতের অনুগত, তখনই এটি চাউর হয়ে যায়। ৭ নভেম্বর ঘটে পাল্টা অভ্যুত্থান, যা সিপাহি-জনতার বিপ্লব হিসেবে ইতিহাসে প্রসিদ্ধি পেয়েছে। সিপাহি-জনতার বিপ্লব ভারতীয় আধিপত্যবাদ ও সম্প্রসারণবাদের বিরুদ্ধে ছিল এক শক্ত চপেটাঘাত। বলা হয়, সিপাহি-জনতার বিপ্লবের মধ্য দিয়ে দেশের স্বাধীনতা পূর্ণতা লাভ করে। একে অনেকে দ্বিতীয় স্বাধীনতাও বলে।

চার.

সিপাহি-জনতার বিপ্লবীরা স্বাধীনতার ঘোষক জেনারেল জিয়াউর রহমানকে তাদের নেতা মেনে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেন। জাতির আরো একটি কঠিন সময়ে জিয়াউর রহমান দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি প্রথমবারের মতো বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। আধিপত্যবাদী-সম্প্রসারণবাদী ভারতের কব্জা থেকে দেশ মুক্ত করেন। অর্থনীতি পুনর্গঠিত ও শক্তিশালী করেন। পররাষ্ট্রনীতিতে জাতীয় স্বার্থ যোগ করেন। আন্তর্জাতিক আঙ্গনে তিনি বিপুল প্রশংসা ও খ্যাতি অর্জন করেন। তবে তিনি খুব বেশি দিন ক্ষমতায় থাকতে পারেননি। ১৯৮১ সালের ৩০ মে একদল বিপথগামী সেনা সদস্যের হাতে তিনি মর্মান্তিকভাবে শহীদ হন। তার এই হত্যাকা-ের পেছনে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র ছিল বলে মনে করা হয়। এরপর বিচারপতি আব্দুস সাত্তার প্রেসিডেন্ট হন। নির্বাচিত এই প্রেসিডেন্টকে হটিয়ে দিয়ে ক্ষমতা দখল করেন সেনাপ্রধান এইচএম এরশাদ। এরশাদ প্রায় ১০ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। তার স্বৈরশাসনের অবসান ঘটে নব্বই সালের গণঅভ্যুত্থানে। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসে। প্রধানমন্ত্রী হন বেগম খালেদা জিয়া। বেগম জিয়াই প্রেসিডেন্টশাসিত ব্যবস্থা থেকে মন্ত্রিপরিষদশাসিত ব্যবস্থায় পরিবর্তন করেন। ১৯৯৬ সালে আরেকটি নির্বাচন হয়, যা ১৬ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন বলে পরিচিত। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য এ নির্বাচন অপরিহার্য ছিল। নির্বাচনে বিএনপিই বিজয়ী হয়। প্রধানমন্ত্রী হন বেগম খালেদা জিয়া। পরে সংসদ ভেঙে দেয়া হয়। ওই ১৯৯৬ সালের জুনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে বিজয়ী হয় আওয়ামী লীগ। প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী হন বেগম খালেদা জিয়া। এর পরের নির্বাচনে বিএনপি অধিক সংখ্যক আসনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে, সরকারের সহযোগী হয় জামায়াতে ইসলামী। এর পরের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় সেনাশাসিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা। সেই থেকে শেখ হাসিনা ২০২৪ সালে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। এই সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল এবং ২০১৪, ১৯১৮ ও ২০২৪ সালে দলীয় সরকারের অধীনে একতরফা বিনাভোটের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়। প্রধানমন্ত্রী থাকেন শেখ হাসিনা। তিনি তার একটানা সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে দেশে চরম ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। অনেকে তার শাসনকে মাফিয়া শাসন বলেও অভিহিত করেন।

পাঁচ.

শেখ হাসিনা নিকৃষ্টতম স্বৈরাচার হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন। তিনি দেশে একটি মাফিয়াতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তার স্বৈরশাসনে এমন কোনো অপকর্ম, অনাচার ও অপরাধ নেই যা সংঘটিত হয়নি। তিনি অবৈধভাবে ক্ষমতায় থাকার জন্য দেশকে ভারতের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। ভারতের দাসী হিসেবে জাতীয় স্বার্থ উপেক্ষা করে ভারত যা চেয়েছে, তার সব কিছুই দিয়ে দিয়েছেন। তিনি নিজেই এক সময় বলেছিলেন, ভারতকে যা দিয়েছেন ভারত তা সারা জীবন মনে রাখবে। তিনি দেশকে বিরাজনীতিকরণ করেছেন। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর অপরিসীম জুলুম-নির্যাতন করে মাঠ, এমনকি ঘরছাড়া করেছেন। বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের হত্যা ও গুম করেছেন। আয়নাঘর বানিয়েছেন। হামলা-মামলা দিয়ে নাজেহাল করেছেন। নির্বাচনকে নির্বাসনে পাঠিয়েছেন। গণমতের ভিত্তিতে ক্ষমতার পরিবর্তন অসম্ভবপর করেছেন।

রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক প্রথা-প্রতিষ্ঠান যেমনÑ সংসদ, প্রশাসন, বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, পুলিশ বাহিনী, মিডিয়া-সংবাদপত্র, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, পররাষ্ট্রনীতি, সমাজ-সংস্কৃতি ইত্যাদি ধ্বংস করেছেন। তিনি দেশে এমন এক চোরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছেন, যার কেন্দ্রে ছিলেন তিনি নিজে ও তার পরিবার। তার আত্মীয়-স্বজন, দলের লোকজন, এক শ্রেণির বশংবদ ব্যবসায়ী এই চোরতন্ত্রের অংশীদার ছিল। তারা সব মিলে সাড়ে ১৫ বছরে ২৯ লাখ কোটি টাকা লুট ও পাচার করেছেন।

শেখ হাসিনা দাবি করেন দেশটি তার বাবার। কারণ, এ দেশ স্বাধীন করেছিলেন তার বাবা। সেই সূত্রে তিনিও দেশের মালিক। তিনি যেহেতু মালিক সুতরাং যাচ্ছেতাই করার অধিকার তার ষোলোআনা। তিনি তাই করেছেন। দেশের মানুষকে তার ভৃত্য বা প্রজা মনে করেছেন। তাদের মানবিক, সাংবিধানিক ও আইনি অধিকার বে-তোয়াক্কা করেছেন। এই বিভীষিকাময় পরিবেশ-পরিস্থিতি পরিবর্তনে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো চেষ্টা করেও বারবার ব্যর্থ হয়েছে। দেশ ও জাতির ওপর চেপে বসা এই জগদ্দল পাথর সরানো সম্ভব হবে, এটি কেউ ধারণা করতে পারেনি। মজলুম মানুষ এ পাথর সরানোর ভার দিয়েছে আল্লাহতায়ালার ওপর। আল্লাহ তাদের প্রার্থনা শুনেছেন। যা ছিল অনড়, অটল, আল্লাহর ইচ্ছায় সেই পাথর ছাত্র-জনতা এক ঝটকায় দূরে নিক্ষিপ্ত করেছে। এ জন্য তাদের বিপুল রক্ত ও অঙ্গদান করতে হয়েছে। ৫ আগস্টের অভাবিত ও অভূতপূর্ব এক গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচার হাসিনা পালিয়ে গেছেন ভারতে। দেশ এখন স্বৈরশাসন মুক্ত। জনসমর্থিত অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায়। জুলাইয়ের শুরুতে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছিল ছাত্ররা। সেই ন্যায়সঙ্গত আন্দোলন স্বৈর সরকার উপেক্ষা ও অবহেলা করেছিল। হাসিনা স্বয়ং আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকারের সন্তান’ বলে গালি-গালাজ করেছিলেন। এটি ছিল অগ্নিতে ঘৃত নিক্ষেপের মতো। দলে দলে ছাত্ররা প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে এসেছিল। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে তাদের আন্দোলন দ্রুত সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। তাদের ওপর পাল্টা আক্রমণও নেমে আসে। পুলিশ ও ছাত্রলীগের ক্যাডার বাহিনী হামলা, হত্যা, নির্যাতন ইত্যাদির তা-ব সৃষ্টি করে। আন্দোলনকারীরাও সব কিছু উপেক্ষা করে আন্দোলনে লেগে থাকে এবং ঘোষণা করে এক দফা, অর্থাৎ শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও সরকারের বিদায় মরণ কামড় দেয় স্বৈরাচার। নির্বিচারে গণহত্যা শুরু করে। এতে বিক্ষুব্ধ হয়ে সারা দেশের সব শ্রেণিপেশার ও বয়সের মানুষ এক দফার সমর্থনে রাস্তায় নেমে আসে। ছাত্রদের আন্দোলন শেষ পর্যন্ত পরিণত হয় গণঅভ্যুত্থানে। ছাত্র-জনতার এই অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারের পতন ও দুঃশাসনের অবসান ঘটে।

গণঅভ্যুত্থানকারীরা স্বৈরাচারের বিদায় ও পতনকে নতুন বাংলাদেশের অভ্যুদয় হিসেবে অভিহিত করেছে। দেশ মাফিয়া শাসন ও ভারতের হেজিমনি থেকে মুক্ত ও স্বাধীন হয়েছে বলে ঘোষণা দিয়েছে। এখন চলছে নতুন বাংলাদেশ গঠনের সংগ্রাম, যেখানে ছাত্র-জনতা, রাজনৈতিক দলসহ সবাই একাত্ম। যেকোনো বিপ্লব বা পরিবর্তনের পর প্রতিবিপ্লব বা পাল্টা পরিবর্তনের আশঙ্কা থাকে। ইতিহাসে প্রতিবিপ্লবের বহু নজির আছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান ব্যর্থ করে দেয়ার জন্যও চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র চলছে। পতিত স্বৈরাচার ও তার প্রভু ভারতের মোদি সরকার একের পর এক চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। সমগ্র বাংলাদেশ একট্টা হয়ে এসব চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দিচ্ছে। অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা ও নাশকতার অপচেষ্টাও চলছে। এদিকে সবাইকে সতর্ক ও সাবধান থাকতে হবে।

জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে দেশ এক নব অধ্যায়ে প্রবেশ করেছে। জনমনে নতুন স্বপ্ন ও প্রত্যাশা জাগ্রত হয়েছে। স্বাধীনতা-স্বার্বভৌমত্ব হুমকিমুক্ত হবে, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি ত্বরান্বিত হবে, শোষণ-বৈষম্য, নিরসিত হবে। গণতন্ত্র, সুশাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে, দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তাচার বন্ধ হবেÑ এগুলো মানুষের অবিকল্প আকাক্সক্ষা। এসব আকাক্সক্ষা পূরণ করতে হলে রাষ্ট্রাচার সংস্কার এবং তার পুনর্বিন্যাস ও পুনর্গঠন অত্যাবশ্যক। যেহেতু পতিত স্বৈরাচার সব কিছু ভেঙে-চুরে মিছমার করে দিয়ে গেছে, তাই সংস্কার ছাড়া সামনে অগ্রসর হওয়ার উপায় নেই। সরকার কিছু কিছু ক্ষেত্রে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। কমিশন গঠন করেছে। রাজনৈতিক দলগুলো সরকারের সংস্কার-উদ্যোগকে সমর্থন ও সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে। সংস্কারের পাশাপাশি গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তন ও নির্বাচন অত্যন্ত জরুরি। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, সংস্কারের সঙ্গে নির্বাচনের প্রস্তুতিও চলতে থাকবে। যে সম্ভাবনা জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থান আমাদের সামনে উপস্থিত করেছে, তা কাজে লাগাতে হলে জাতীয় ঐক্য অটুট রাখতে হবে। ধৈর্য-সহিষ্ণুতা প্রদর্শন করতে হবে। বুদ্ধিমত্তা, বিচক্ষণতা ও দূরদৃষ্টির পরিচয় দিতে হবে। কোনো কারণ বা অজুহাতেই এই পরিবর্তন-সম্ভাবনাকে হাতছাড়া করা যাবে না। দেশ নতুন দিকে মোড় নিয়েছে। এ যাত্রা চূড়ান্ত গন্তব্যে নিয়ে যেতে হবে।


বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

জুলাই গণঅভ্যুত্থান ও জিয়ার বাংলাদেশ
শহীদ জিয়ার বিএনপির সাথে কি আজকের বিএনপির মিল আছে?
জিয়াউর রহমানের রাজনীতি
ফিরে দেখা রাজশাহী ২০২৪
বিচারবিভাগ ওলটপালটের বছর
আরও

আরও পড়ুন

নতুন কমিটির উদ্দেশ্যে সাবেক সভাপতি তিন টাকার কমিটি রুখে দেয়া কঠিন কিছু হবে না

নতুন কমিটির উদ্দেশ্যে সাবেক সভাপতি তিন টাকার কমিটি রুখে দেয়া কঠিন কিছু হবে না

মির্জাপুরে আন্তঃজেলা ডাকাত দলের ৬ সদস্য গ্রেপ্তার

মির্জাপুরে আন্তঃজেলা ডাকাত দলের ৬ সদস্য গ্রেপ্তার

উদ্বোধনের ৪দিন পরও সেচ পানি মিলেনি মেঘনা - ধনাগোদা সেচ প্রকল্পের কৃষকের

উদ্বোধনের ৪দিন পরও সেচ পানি মিলেনি মেঘনা - ধনাগোদা সেচ প্রকল্পের কৃষকের

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮৪ শিক্ষার্থী বহিষ্কার

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮৪ শিক্ষার্থী বহিষ্কার

বিশ্বনাথে সিনিয়র সাংবাদিককে খুন-গুমের হুমকি

বিশ্বনাথে সিনিয়র সাংবাদিককে খুন-গুমের হুমকি

সুবর্ণচরে অনুমোদনহীন কীটনাশক ও ভেজাল সার খালে ফেলে নষ্ট করলো প্রশাসন

সুবর্ণচরে অনুমোদনহীন কীটনাশক ও ভেজাল সার খালে ফেলে নষ্ট করলো প্রশাসন

ফেসবুকে ভুয়া তথ্য প্রতিরোধে মেটাকে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান ড. ইউনূসের

ফেসবুকে ভুয়া তথ্য প্রতিরোধে মেটাকে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান ড. ইউনূসের

ঈশ্বরদীর ৩ অবৈধ ইটভাটায় অভিযান ২ লাখ টাকা জরিমানা আদায়

ঈশ্বরদীর ৩ অবৈধ ইটভাটায় অভিযান ২ লাখ টাকা জরিমানা আদায়

‘বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে তারুণ্যের উৎসব অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে’

‘বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে তারুণ্যের উৎসব অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে’

সিংগাইরে অজ্ঞাত বৃদ্ধের লাশের পরিচয় মিলেছে

সিংগাইরে অজ্ঞাত বৃদ্ধের লাশের পরিচয় মিলেছে

শাহরাস্তিতে ট্রাক চাপায় মোটরসাইকেল আরোহী নিহত

শাহরাস্তিতে ট্রাক চাপায় মোটরসাইকেল আরোহী নিহত

বেনাপোলে বিজিবি-বিএসএফের পতাকা বৈঠক

বেনাপোলে বিজিবি-বিএসএফের পতাকা বৈঠক

শেখ হাসিনা ও ওবায়দুল কাদের সহ ১৬৬ জনের বিরুদ্ধে ফের হত্যা মামলা বগুড়ায়

শেখ হাসিনা ও ওবায়দুল কাদের সহ ১৬৬ জনের বিরুদ্ধে ফের হত্যা মামলা বগুড়ায়

ছাগলনাইয়ায় ছাত্র শিবিরের প্রকাশনা সামগ্রী প্রদর্শনী ও বিক্রয় উৎসব

ছাগলনাইয়ায় ছাত্র শিবিরের প্রকাশনা সামগ্রী প্রদর্শনী ও বিক্রয় উৎসব

ছাগলনাইয়ায় 'মুফতি মাহমুদুর রহমান আল্ খিদমা ফাউন্ডেশন' এর আত্মপ্রকাশ

ছাগলনাইয়ায় 'মুফতি মাহমুদুর রহমান আল্ খিদমা ফাউন্ডেশন' এর আত্মপ্রকাশ

কচুয়ায় ফুলকপির ভালো ফলনেও লাভের মুখ দেখছে না কৃষকরা

কচুয়ায় ফুলকপির ভালো ফলনেও লাভের মুখ দেখছে না কৃষকরা

নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অর্ধযুগপূর্তি উৎযাপন

নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অর্ধযুগপূর্তি উৎযাপন

পটুয়াখালীতে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে কম্বল বিতরণ

পটুয়াখালীতে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে কম্বল বিতরণ

শিবালয়ে চালকের গলা কেটে অটোরিক্সা ছিনতাই চক্রের ৩ সদস্য আটক

শিবালয়ে চালকের গলা কেটে অটোরিক্সা ছিনতাই চক্রের ৩ সদস্য আটক

প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটিতে ‘পিঠা উৎসব-১৪৩১’ উদযাপন

প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটিতে ‘পিঠা উৎসব-১৪৩১’ উদযাপন