শহীদ জিয়ার বিএনপির সাথে কি আজকের বিএনপির মিল আছে?
১৯ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০৬ এএম | আপডেট: ১৯ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০৬ এএম
আজ ১৯ জানুয়ারি শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ৮৯তম জন্মবার্ষিকী। এই উপলক্ষে বিএনপি ব্যাপক কর্মসূচি দিয়েছে। জিয়াউর রহমান মুক্তিযোদ্ধা সেক্টর কমান্ডার ছিলেন, স্বাধীনতার ঘোষক ছিলেন, স্বাধীন বাংলাদেশের সেনাপ্রধান ছিলেন এবং সবশেষে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। কিন্তু তার সব পরিচয়কে ছাপিয়ে গেছে একটি বিশেষ পরিচয়। সেটি হলো তিনি কোটি কোটি বাংলাদেশিকে জাতিসত্ত্বার সঠিক পরিচয় দিয়েছিলেন। বাংলাদেশ নামক ভূখ-টির কোটি কোটি মানুষকে দিয়েছিলেন তাদের রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় দিকদর্শন। আর সেটি প্রতিফলিত হয়েছিল জিয়ার প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল, সংক্ষেপে বিএনপির আদর্শিক গন্তব্যের ঠিকানা দিয়ে। আজ যখন বিএনপি তাদের প্রতিষ্ঠাতা শহীদ জিয়ার ৮৯তম জন্মবার্ষিকী পালন করছে তখন একটি প্রশ্ন সকলের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। সেটি হলো, আজ মানুষ বিএনপির যে আদর্শিক ও রাজনৈতিক চেহারা দেখছে সেটি কি তাদের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের আদর্শিক ও রাজনৈতিক চেহারার সাথে মিল খায়?
বিগত ৫৪ বছরে বাংলাদেশে অনেক রাষ্ট্রনায়ক এসেছেন এবং অনেক রাষ্ট্রনায়ক পরপারে চলে গেছেন। কিন্তু শহীদ জিয়ার মৃত্যুতে তার জানাযায় মানুষের যে ঢল নেমেছিল তেমন ঢল বিগত ৫৪ বছরে আর কোনো নেতার জানাযায় হয়নি। ১ লাখ ২ লাখ নয়, ৩০ লাখ মানুষ সেই জানাযায় শরিক হয়েছিল। কেন শহীদ জিয়ার প্রতি কোটি কোটি বাংলাদেশির এমন হৃদয় উজাড় করা ভালবাসা? কারণটি হলো, জিয়া ছিলেন কোটি কোটি বাংলাদেশির আশা-আকাক্সক্ষার মূর্তপ্রতীক। তার কণ্ঠে বাঙময় হয়েছিল এদেশের মানুষের ব্যাথা বেদনা, আনন্দ হাসি। জিয়ার অবিস্মরণীয় কয়েকটি কাজের তালিকা নি¤েœ দিচ্ছি।
(১) শেখ মুজিব সংবিধানে আল্লাহ খোদার নাম রাখেননি। কিন্তু শহীদ জিয়া সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম’ সংযোজন করেন।
(২) শেখ মুজিব সংবিধানে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে জাতিসত্ত্বা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেন। এখানে ছিল একটি বিরাট ফ্যালাসি। পশ্চিমবঙ্গের কোটি কোটি মানুষও তো বাঙালি। এছাড়া সারাবিশে^ বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের প্রায় দেড় কোটি মানুষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ জাতিসত্ত্বা হিসেবে ভারতীয়। এছাড়া বাংলাদেশে পাহাড়ীরা এবং গারো, সাওতাল ও চাকমাসহ অনেকে নৃতাত্ত্বিকভাবে বাঙালি নয়। শেখ মুজিবের জাতীয়তাবাদের এই শুভঙ্করের ফাঁক, এই স্ববিরোধিতা দূর করেছিলেন শহীদ জিয়া সংবিধানে ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’ অন্তর্ভুক্ত করে।
(৩) শেখ মুজিব সংবিধানে সর্বপ্রকার ইসলামী রাজনীতি নিষিদ্ধ করেন। সেই সুবাদে সবগুলি ইসলামী রাজনৈতিক দল এবং মুসলিম লীগ নিষিদ্ধ হয়। অথচ, নাস্তিক্যবাদি সমাজতন্ত্রী ও কমিউনিস্ট রাজনীতি অ্যালাও করা হয়। শহীদ জিয়া শেখ মুজিবের এই চরম ধর্মবিরোধী সাংবিধানিক প্রভিশন অপসারণ করে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি অ্যালাও করেন। ফলে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলসমূহ পুনরুজ্জীবিত হয়।
(৪) শেখ মুজিব সংবিধানে ‘জয় হিন্দ’ শ্লোগানের আদলে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় শ্লোগান করেন ‘জয় বাংলা’। শেখ মুজিবের পতনের পরবর্তী সরকার জয় বাংলার পরিবর্তে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’কে রাষ্ট্রীয় শ্লোগান করেন। শহীদ জিয়া এই বাংলাদেশ জিন্দাবাদ শ্লোগান চালু রাখেন।
(৫) ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুজিবনগর সরকারের স্বাধীনতার প্রোক্লামেশনÑ কোথাও ধর্মনিরপেক্ষতার উল্লেখ ছিল না। কিন্তু শেখ মুজিব সংবিধানে কারো কোনো দাবি না থাকা সত্ত্বেও ধর্মনিরপেক্ষতা অন্তর্ভুক্ত করেন। প্রেসিডেন্ট জিয়া ধর্মনিরপেক্ষতা সরিয়ে এদেশের ৯২ শতাংশ মানুষের আবেগ ও অনুভূতিকে সম্মান দিয়ে সংবিধানের প্রস্তাবনার আগে ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা ও বিশ^াস’ যুক্ত করেন।
(৬) শেখ মুজিব তার সারা জীবনের রাজনীতিতে কোনোদিন সমাজতন্ত্রের কথা বলেননি। অথচ, ৭২ এর সংবিধানে মনি সিং ও মোজাফ্ফর আহমদ এবং সোভিয়েট ইউনিয়নকে খুশি করার জন্য তিনি সংবিধানে সমাজতন্ত্র অন্তর্ভুক্ত করেন। শহীদ জিয়া জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়ে সমাজতন্ত্রের পরিবর্তে ‘সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার’ সংবিধানে সন্নিবেশিত করেন।
(৭) শেখ মুজিব ভারতের সাথে ২৫ বছরের গোলামী চুক্তি করেন। তার পররাষ্ট্রনীতি ছিল ইন্দো-সেন্ট্রিক বা ভারত কেন্দ্রিক। কিন্তু শহীদ জিয়া সেটি পরিবর্তন করে সংবিধানের ২৫(২) অনুচ্ছেদ সংযোজন করে লেখেন, ‘রাষ্ট্র ইসলামী সংহতির ভিত্তিতে মুসলিম দেশসমূহের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক সংহত, সংরক্ষণ ও জোরদার’ করিতে সচেষ্ট হইবে।
॥ দুই ॥
ওপরে যেসব পয়েন্ট উল্লেখ করা হলো, সেগুলোই ছিল বিএনপির আসল চেহারা এবং আদর্শিক গন্তব্যস্থল। বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষ এই সব পয়েন্টে তাদের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিচ্ছবি দেখেছিল এবং তাই তারা লাখে লাখে বিএনপির পতাকাতলে জমায়েত হয়েছিল। কিন্তু আজ, বিশেষ করে ২০১৮ সালের অব্যবহিত পূর্ব থেকে ২০২৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত বিএনপির যে চেহারা দেখা যাচ্ছে সেই চেহারার সাথে কি শহীদ জিয়ার বিএনপির চেহারার কোনো মিল আছে? গত বছরে চট্টগ্রামের এক বিশাল জনসভায় সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পুত্র হুম্মাম কাদের চৌধুরী বক্তৃতা শেষে শ্লোগান ধরেন, ‘নারায়ে তাকবির/আল্লাহু আকবার’। সাথে সাথে লক্ষ লক্ষ শ্রোতা গগনবিদারি কণ্ঠে সেই শ্লোগান ধ্বনিত ও প্রতিধ্বনিত করেন। কিন্তু সকলকে অবাক করে দিয়ে মঞ্চে আসেন ঘোষক। তিনি বলেন, ‘নারায়ে তাকবির/আল্লাহু আকবার’ বিএনপির শ্লোগান নয়। এটি হুম্মাম কাদেরের ব্যক্তিগত শ্লোগান।
একথা ঠিক যে শহীদ জিয়া তার মন্ত্রিসভায় এবং দলে শাহ আজিজুর রহমান, আব্দুল আলিম, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী প্রমুখকে অন্তর্ভুক্ত করেন। এই অন্তর্ভুক্তির বিরুদ্ধে আওয়ামী ও ভারতীয় ঘরানা শহীদ জিয়ার বিরুদ্ধে নানান অপপ্রচার চালায়। কিন্তু শহীদ জিয়া এসব অপপ্রচার গায়ে মাখেননি। বরং তিনি তার রাজনৈতিক কৌশল এবং আদর্শিক বলিষ্ঠতা দিয়ে আওয়ামী-ভারতীয় উন্মাদ প্রচারণাকে ভোঁতা করে দেন। ফলে ইসলামী ও মুসলিম ভাবদর্শে বিশ^াসী লক্ষ লক্ষ মানুষ জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপির ছায়াতলে আশ্রয় নেন।
বর্তমান বিএনপি ২০১৮ সালে শেখ মুজিবের ঘনিষ্ঠ সহচর কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে। এই ঐক্যফ্রন্ট থেকে নির্বাচিত হন সুলতান মোহাম্মদ মনসুর ও খন্দকার আব্দুল মুক্তাদির। নির্বাচিত হয়েই তারা পল্টি খান এবং আওয়ামী সরকারের ধামা ধরেন।
॥ তিন ॥
শহীদ জিয়া এবং বেগম জিয়ার বিএনপির সাথে আজকের বিএনপির আদর্শগত বিচ্যুতি এখন প্রকট। আজকের বিএনপির সিনিয়র নেতা মির্জা আব্বাস শেখ মুজিবের ৭২ এর সংবিধান রক্ষার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। শেখ হাসিনার প্রেসিডেন্ট সাহাবুদ্দিন চুপ্পুকে গদিতে রেখে দিলো বিএনপি। আওয়ামী লীগকে বিএনপি বলে ফ্যাসিবাদী স্বৈরাচার। ফ্যাসিবাদ কি কোনোদিন গণতন্ত্রের সাথে যায়? সেজন্যই তো গণতান্ত্রিক জার্মানি ফ্যাসিবাদ তথা নাৎসিবাদী পার্টিকে বিগত ৭৮ বছর ধরে নিষিদ্ধ রেখেছে। একই অবস্থা ইতালিতেও। অথচ, বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদের চেয়েও নিকৃষ্ট এবং নাৎসিবাদের চেয়েও ভয়ঙ্কর আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার তীব্র বিরোধিতা করেছেন বিএনপির মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। শেখ মুজিবের মূর্তি অপসারণ এবং অফিস-আদালত থেকে তার ছবি নামিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দেশের প্রায় সব মানুষের প্রশংসায় ধন্য হয়েছে। কিন্তু বিএনপি শেখ মুজিবের ছবি নামানোতে ভয়ঙ্কর রুষ্ট।
আজ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিরুদ্ধে কথা বলে বিএনপি। আর বৈষম্যবিরোধীরা বলে, বিএনপির উচিত হাজার হাজার মানুষের লাশ এবং আহত ২৬ হাজার মানুষের বেদনার্ত আর্তনাদের কথা মাথায় রাখা। কিন্তু সেখানে বিএনপি দেখছে শুধুই নির্বাচন। গত ১৭ জানুয়ারি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত ইসলামী আন্দোলনের যুব ফ্রন্টের কনভেনশনে চরমোনাইয়ের পীর সাহেব সৈয়দ রেজাউল করীম বিএনপির তীব্র সমালোচনা করেছেন। বলেনছেন, ‘অনেকে মনে করছেন, বড় তালগাছ হয়ে গেছেন। আসলে পায়ের নিচে মাটি নেই। চাঁদাবাজ, খুনিদের মানুষ দেখতে চায় না। অতীতে ক্ষমতায় থাকাদের নতুন কিছু দেওয়ার নেই দাবি করেন ইসলামী আন্দোলনের আমির। আওয়ামী লীগকেও নির্বাচনে বিএনপি চায়Ñ ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, যারা হাজারো মায়ের কোল খালি করেছে, তাদের নির্বাচনে আনার আহ্বান কীসের ইঙ্গিত? আওয়ামী লীগকে নিয়ে ক্ষমতা দখল করবেন, ভারতের দোসরদের খুশি করবেন!’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, নাগরিক কমিটি, ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত মজলিশ, জামায়াতে ইসলামী সকলের বিরুদ্ধে কথা বলছে বিএনপি। বিএনপি নেতারা যদি মনে করেন, সেক্যুলার পার্টি হিসেবে তারা বিএনপির ইমেজ গড়ে তুলবেন তাহলে তারা ভুল করছেন। বিএনপিতে এখন প্রাক্তন বামদের প্রভাব বেশি। মির্জা ফখরুল, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী কি নিজেদেরকে ইসলামী আদর্শ থেকে দূরে রেখে, ভারত সম্পর্কে রহস্যপূর্ণ নীরবতা বজায় রেখে ইলেকশনে জিততে পারবেন? যেভাবে রাজনৈতিক মেরুকরণ শুরু হয়েছে, সেগুলো দেখে অনেক কিছু নতুন করে ভাবতে হচ্ছে।
বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
জুলাই বিপ্লবে প্রত্যেকটি খুনের বিচার হতে হবে
চরনিখলা উচ্চ বিদ্যালয়ের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত
বিশ্বনাথে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা সুইট গ্রেফতার
নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে ইসলাম-ই কার্যকর পন্থা শীর্ষক জেলা সম্মেলন অনুষ্ঠিত
নতুন কমিটির উদ্দেশ্যে সাবেক সভাপতি তিন টাকার কমিটি রুখে দেয়া কঠিন কিছু হবে না
মির্জাপুরে আন্তঃজেলা ডাকাত দলের ৬ সদস্য গ্রেপ্তার
উদ্বোধনের ৪দিন পরও সেচ পানি মিলেনি মেঘনা - ধনাগোদা সেচ প্রকল্পের কৃষকের
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮৪ শিক্ষার্থী বহিষ্কার
বিশ্বনাথে সাংবাদিককে খুন-গুমের হুমকি
সুবর্ণচরে অনুমোদনহীন কীটনাশক ও ভেজাল সার খালে ফেলে নষ্ট করলো প্রশাসন
ফেসবুকে ভুয়া তথ্য প্রতিরোধে মেটাকে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান ড. ইউনূসের
ঈশ্বরদীর ৩ অবৈধ ইটভাটায় অভিযান ২ লাখ টাকা জরিমানা আদায়
‘বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে তারুণ্যের উৎসব অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে’
সিংগাইরে অজ্ঞাত বৃদ্ধের লাশের পরিচয় মিলেছে
শাহরাস্তিতে ট্রাক চাপায় মোটরসাইকেল আরোহী নিহত
বেনাপোলে বিজিবি-বিএসএফের পতাকা বৈঠক
শেখ হাসিনা ও ওবায়দুল কাদের সহ ১৬৬ জনের বিরুদ্ধে ফের হত্যা মামলা বগুড়ায়
ছাগলনাইয়ায় ছাত্র শিবিরের প্রকাশনা সামগ্রী প্রদর্শনী ও বিক্রয় উৎসব
ছাগলনাইয়ায় 'মুফতি মাহমুদুর রহমান আল্ খিদমা ফাউন্ডেশন' এর আত্মপ্রকাশ
কচুয়ায় ফুলকপির ভালো ফলনেও লাভের মুখ দেখছে না কৃষকরা