ঢাকা   শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৬ আশ্বিন ১৪৩১

গৌরনদীর দই, একবার খাইলেও আর একবার খাই

Daily Inqilab মো. বদরুজ্জামান খান সবুজ, গৌরনদী (বরিশাল) থেকে

২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০৬ এএম | আপডেট: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০৬ এএম

ঐতিহ্যগত কারণে সুদীর্ঘকাল ধরে বিশেষ রসনার জায়গা দখল করে আছে বরিশালের গৌরনদীর দই ও মিষ্টি। আঞ্চলিক ও দেশের গণ্ডী পেরিয়ে এর সুনাম দেশের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে। ঐতিহ্যবাহী এ দই যারা একবার চোখে দেখেছেন তাদের কাছে এ প্রবচনের মর্মার্থ ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। তবে গৌরনদীর দইয়ের মজা কি মাজেজা যারা জানেন না, ওপরের প্রবাদের সত্যতা যাচাইয়ে তাদের এর স্বাদ গ্রহণের বিকল্প নেই। বিশেষ করে ভোজন বিলাসীদের ভোজন-রসনার ঘোষকলা পূর্ণ করতে বরিশালের গৌরনদীর দইয়ের জুড়ি মেলা ভার। নানা প্রতিকূলতা পাড়ি দিয়ে ঐতিহ্য রক্ষা করে দই ও মিষ্টি তৈরির এ পেশা টিকিয়ে রেখেছেন গৌরনদীর কয়েকজন মিষ্টি ব্যবসায়ী। বংশ পরম্পরায় তারা উৎপাদন করে চলেছেন জিভে জল এনে দেয়া দই। তবে পরিচিতি ও চাহিদা বৃদ্ধির কারণে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী অধিক মুনাফার লোভে গুণগত মান নষ্ট করে কৃত্রিমভাবে দই উৎপাদন করছেন। যা গৌরনদীর দইয়ের মান সম্পর্কে বিভিন্ন নেতিবাচকতা তৈরি করছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সকাল থেকে রাত অব্দি গৌরনদী ও টরকী বাজারে মণকে-মণ গরুর দুধের বিকিকিনি চলে। অনেকটা ওই দুধ দিয়েই তৈরি হয় এখানার দই ও মিষ্টি। সাত-সকাল থেকে শুরু করে সারাদিন ঝিমুনি ধরা এ বাজারের কয়েকটি মিষ্টির দোকান থেকেই প্রতিদিন গোটা দক্ষিণাঞ্চল ও দেশের বিভিন্ন স্থানে যাচ্ছে শত শত হাঁড়ি দই। সুদীর্ঘকাল থেকে পারিবারিক পেশার অংশ হিসেবে এখানে দই উৎপাদন করে আসছে কয়েকটি পরিবার। তারাই দক্ষতা ও নিপূণতা দিয়ে ধরে রেখেছেন গৌরনদীর দইয়ের ঐতিহ্য ও স্বাদ। এদের মধ্যে রয়েছেন গৌরনদীর নিতাই মিষ্টান্ন ভান্ডারের স্বত্ত্বাধিকারী শচীন্দ্র নাথ ওরফে শচীন ঘোষ, শ্রী দুর্গা মিষ্টান্ন ভান্ডারের গৌরাঙ্গ দাস, শ্রী গুরু মিষ্টান্ন ভান্ডারের সুশীল ঘোষ ও টরকী বন্দরের শ্রী গুরু মিষ্টান্ন ভান্ডারের বাদল ঘোষ। গৌরনদীর দইয়ের অন্যতম কুশীলবরা জানান, বংশ পরম্পরায় হাজারো প্রতিকূলতার মধ্যেও তারা এ পেশা ধরে রেখেছেন। মূলত ঐতিহ্যের কথা চিন্তা করেই অন্যান্যরা মেশিনে দই উৎপাদন করলেও তারা এখনও সনাতন পদ্ধতিতেই দই উৎপাদন করছেন। ফলে উৎপাদন খরচ বেশি হচ্ছে তার। প্রতিদিন দই উৎপাদনের জন্য তার প্রায় ৪৫ মণ গরুর দুধের প্রয়োজন হয়। এর থেকে ১৫ মণের মতো দই উৎপাদিত হয়। সেই সঙ্গে তৈরি করেন বাহারি নকশা ও স্বাদের মিষ্টি। দুধ সংগ্রহ থেকে শুরু করে দই উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ পর্যন্ত অন্তত দৈনিক ৬৫ জন লোক কাজ করেন তার এখানে। এদের কারো দৈনিক, কারো কারো মাসিক ভিত্তিতে মজুরি দেয়া হয়।
দই উৎপাদনের প্রক্রিয়া সম্পর্কে তারা জানান, প্রথমে সংগ্রহকৃত গরুর দুধ বড় কড়াইতে নিয়ে ভালোভাবে মাটির চুলাতে রেখে জাল দেওয়া হয়। এরপর তা ঠাণ্ডা করা হয়। কড়াইয়ের ভেতর থেকে বাঁশের চাক দিয়ে নির্দিষ্ট পরিমাণে মাখন তুলে ফেলা হয়। এরপর কড়াইয়ে দুধের যে অংশ থাকে তার সঙ্গে চিনি মিশিয়ে আবারো ভালোভাবে গরম করা হয়। এবার মিশ্রণের রং কিছুটা লালচে আকার ধারণ করলে তা নামিয়ে ফেলা হয়। এরপর ওই মিশ্রণ মাটিতে সাজিয়ে রাখা বিভিন্ন আকৃতির (১ কেজি থেকে ৬ কেজি) মাটির হাঁড়িতে ঢালা হয়। এভাবে দই পাতা হয়। এ প্রক্রিয়াকে বলা হয় চাণক। এভাবে হাঁড়িতে পেতে রাখা দই এভাবে চারপাশে কচুরিপানা দিয়ে তার ওপর ২৪ থেকে ৩০ ঘণ্টা রাখার পর তা অকেটা জমাট ও কিছুটা শক্ত হয়ে আসে। এরপর শুরু হয় তা বিক্রি ও বাজারজাতকরণের কাজ। এই দই আবহাওয়া ও তাপমাত্রা ভেদে ৬ থেকে ১০ দিন পর্যন্ত ভালো থাকে।
তাদের সাথে কথা বলে আরও জানা যায়, প্রতি কেজি দই ১৫০ টাকা দরে বিক্রি করেন তারা। এছাড়া চাহিদা অনুযায়ী নিজস্ব পরিবহনে করে দূর-দূরান্তে পাঠানো হয় এই দই।
স্থানীয় দই উৎপাদকরা জানান, ১৯৭৪ সালে ঘোষদের জন্য রেশম পদ্ধতি বন্ধ হয়ে যায়। এরপর থেকে সরকারি-বেসরকারি কোনো সহযোগিতা পাচ্ছেন না তারা। ফলে বর্তমানে নানা কারণে উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। দুধের চড়া দাম, ঘর ভাড়া, বিদ্যুত বিল, জ্বালানি, কর্মচারীদের বেতনসহ নানা কারণে ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় এ ব্যবসায় টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। তাই সহজ শর্তে ঋণ বিতরণ, দুধের বাজার, ডেইরি ফার্ম স্থাপন এখন জরুরি হয়ে পড়েছে তাদের জন্য। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে ও ছোট-খাটো দোকানে কৃত্রিমভাবে দই উৎপাদন বন্ধ করা গেলে তারা এ পেশার বিস্তারসহ সার্বিক উন্নতি নিশ্চিত করতে পারেন। এ জন্য সংশ্লিষ্টদের সুদৃষ্টি কামনা করেন তারা।


বিভাগ : অভ্যন্তরীণ


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করার আহ্বান উপদেষ্টা নাহিদের

দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করার আহ্বান উপদেষ্টা নাহিদের

মালয়েশিয়া আন্তর্জাতিক হালাল শোকেসের ২০তম আসরে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ

মালয়েশিয়া আন্তর্জাতিক হালাল শোকেসের ২০তম আসরে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জেলা প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত দেশকে অস্থিতিশীল করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে পরাজিত শক্তি

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জেলা প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত দেশকে অস্থিতিশীল করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে পরাজিত শক্তি

শ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন কাল

শ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন কাল

‘মব জাস্টিস’ বন্ধের আহ্বান বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরামের

‘মব জাস্টিস’ বন্ধের আহ্বান বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরামের

সাত দফা দাবিতে মানববন্ধন ও সমাবেশ

সাত দফা দাবিতে মানববন্ধন ও সমাবেশ

নোয়াখালীতে জীবাশ্ম জ্বালানিতে বিনিয়োগ বন্ধের দাবি

নোয়াখালীতে জীবাশ্ম জ্বালানিতে বিনিয়োগ বন্ধের দাবি

স্বর্ণের দাম বেড়ে রেকর্ড ২,৬০৯ ডলার ছাড়িয়েছে

স্বর্ণের দাম বেড়ে রেকর্ড ২,৬০৯ ডলার ছাড়িয়েছে

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ ও বিচার দাবিতে খুলনায় মানববন্ধন

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ ও বিচার দাবিতে খুলনায় মানববন্ধন

গাজায় অব্যাহত ইসরাইলি গণহত্যা ওআইসির নেতারা চেয়ে চেয়ে দেখছেন

গাজায় অব্যাহত ইসরাইলি গণহত্যা ওআইসির নেতারা চেয়ে চেয়ে দেখছেন

চাঁদপুর শহরে সড়ক সংস্কার কাজে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ

চাঁদপুর শহরে সড়ক সংস্কার কাজে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ

সেনা কর্মকর্তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়া প্রসঙ্গে

সেনা কর্মকর্তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়া প্রসঙ্গে

নোয়াখালীতে ৪৪ দিন পর লাশ উত্তোলন

নোয়াখালীতে ৪৪ দিন পর লাশ উত্তোলন

ভারতের দোসর ও হাসিনামিডিয়ার প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা

ভারতের দোসর ও হাসিনামিডিয়ার প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা

আশাশুনিতে হাজরাখালির নেটপাটায় পানিবন্দি ২শ’ পরিবার

আশাশুনিতে হাজরাখালির নেটপাটায় পানিবন্দি ২শ’ পরিবার

জামায়াত ক্ষমতায় গেলে নারীদের অধিকার খর্ব হবে না: সেলিম উদ্দিন

জামায়াত ক্ষমতায় গেলে নারীদের অধিকার খর্ব হবে না: সেলিম উদ্দিন

গাছে গাছে আফ্রিকান জায়ান্ট শামুক

গাছে গাছে আফ্রিকান জায়ান্ট শামুক

ঈশ্বরগঞ্জে মহাসড়কে কাঁচাবাজার

ঈশ্বরগঞ্জে মহাসড়কে কাঁচাবাজার

উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অস্ত্রসহ আরসা সন্ত্রাসী গ্রেফতার

উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অস্ত্রসহ আরসা সন্ত্রাসী গ্রেফতার

৮২ গোল্ডেন গ্লোবস সঞ্চালনায় নিকি গ্লেজার

৮২ গোল্ডেন গ্লোবস সঞ্চালনায় নিকি গ্লেজার