ভারতের নির্বাচনে প্রভাব সৃষ্টিকারী মুসলিমবিরোধী ৪ দাবি : সত্যিটা কী?

Daily Inqilab আল জাজিরা

২৭ মে ২০২৪, ১২:০১ এএম | আপডেট: ২৭ মে ২০২৪, ১২:০১ এএম

এপ্রিলে শুরু হওয়া ভারতের সাত পর্যায়ের জাতীয় নির্বাচন ৪ জুন ফলাফলের সাথে সমাপ্ত হতে যাচ্ছে। এবারের নির্বাচনে ভোটারদের কাছে দেশটির ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব¡ এবং মুদ্রাস্ফীতি সর্বাধিক গুরুত্ব পেয়েছে। ভারতের কংগ্রেস দলের নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোটের লাগাতার সমালোচনার মুখে জনসাধারণের দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং তার ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) তাদের দশক-দীর্ঘ শাসন ধরে রাখার জন্য সর্বাত্মক কৌশল হিসেবে মুসলিমবিরোধী ঘৃণাত্মক প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে।
ভারতের চলমান নির্বাচনের মধ্যে দেশটির নির্বাচন কমিশন বিজেপি দলের প্রধানকে প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্য সম্পর্কে সতর্কবার্তা পাঠিয়েছে, কারণ ভারতের নির্বাচনী আইন ভোট সংগ্রহের জন্য ধর্মের প্রকাশ্য ব্যবহারের অনুমতি দেয় না। আল-জাজিরা ভারতের বৃহত্তম ধর্মীয় সংখ্যালঘু ২০ কোটি মুসলমানের বিরুদ্ধে বিজেপির চারটি দাবির সত্যতা পরীক্ষা করেছে, যা নিচে তুলে ধরা হল।
১. যাদের বেশি সন্তান রয়েছে : ২১ এপ্রিল ভারতের রাজস্থানে একটি নির্বাচনী সমাবেশে মোদি দাবি করেন, ‘যখন তারা শেষবার ক্ষমতায় ছিল, কংগ্রেস বলেছিল যে, দেশের সম্পদের ওপর মুসলমানদের প্রথম অধিকার রয়েছে। সেটার মানে কী? তার মানে হল, যদি তারা ক্ষমতায় আসে, তারা সব সম্পদ আদায় করে নেবে এবং তারা কাকে দেবে? যাদের সন্তান বেশি রয়েছে, অনুপ্রবেশকারীদের কাছে।’
২০০২ সালে ভারতের গুজরাটে সহিংস মুসলিমবিরোধী দাঙ্গার পর রাজ্যটির তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী মোদি ক্ষতিগ্রস্ত মুসলিমদের জন্য ত্রাণ শিবিরগুলোকে সমর্থন করতে তার সরকারের ব্যর্থতার বিষয়ে সমালোচনার সম্মুখীন হন, যেগুলোর বেশিরভাগই অলাভজনক এবং মুসলিম গোষ্ঠীদের হাতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সেই সময়ে একটি প্রচার সমাবেশে মোদি বলেছিলেন যে, এ ধরনের ত্রাণ শিবির শিশু উৎপাদন কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে। ভারতের হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠরা তাদের মুসলিমবিরোধী ষড়যন্ত্র তত্ত্বের কেন্দ্রবিন্দুতে রাখা মুসলিম জনসংখ্যা বিস্ফোরণের ধারণাটি ‘জনসংখ্যা জিহাদ’ হিসাবে উল্লেখ করে। নরেন্দ্র মোদির অর্থনৈতিক উপদেষ্টা কমিটি ৭ মে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যেখানে দাবি করা হয়েছে যে, ১৯৫০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে ভারতে হিন্দুদের জনসংখ্যা ৭.৮ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে এবং মুসলিমদের জনসংখ্যা ৪৩.২ শতাংশ বেড়েছে। বিজেপি নেতারা এ প্রেক্ষিতে দাবি করেন যে, বিরোধী দল ক্ষমতায় এলে দেশে হিন্দুরা বিপদে পড়বে।
তবে, প্রকৃত সত্য হল, হিন্দুদের তুলনায় মুসলমানদের জন্মহার বেশি হলেও ব্যবধানটি ক্রমশ কমছে। ভারতের জাতীয় পারিবারিক স্বাস্থ্য জরিপ বলছে, ১৯৯২ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে হিন্দুদের ১.৩৬ শতাংশ হ্রাসের তুলনায় মুসলিমদের প্রজনন হার ২.০৫ শতাংশ কমেছে।
২. কংগ্রেস মঙ্গলসূত্র ছিনিয়ে নিয়ে তাদের ভোট ব্যাংককে দেবে : ২৩ এপ্রিলের নির্বাচনী সমাবেশে মোদি সতর্ক করেন যে, কংগ্রেস হিন্দুদের বিয়ের চিহ্ন মঙ্গলসূত্রগুলো ছিনিয়ে নেবে (অর্থাৎ হিন্দু বিয়ের সুযোগ কেড়ে নিয়ে মুসলিমদের সাথে বিয়ে সমর্থন করে তাদের দল ভারি করবে) এবং তাদের ভোট ব্যাংককে দেবে।
৩. কংগ্রেস সংরক্ষিত সুবিধা কেড়ে নেবে : নরেন্দ্র মোদি ও বিজেপি তাদের বিরোধী দলগুলোর বিরুদ্ধে নিম্নবর্ণের হিন্দুদের জন্য ইতিবাচক পদক্ষেপগুলোর সুবিধা কেড়ে নিয়ে মুসলমানদের হাতে তুলে দেওয়ার অভিযোগ করছে। বাস্তবতা হল, চাকরি এবং শিক্ষায় ভারতীয় সরকারের ইতিবাচক কর্মসূচির সংরক্ষিত কোটা সুবিধা শুধুমাত্র বর্ণ শ্রেণী এবং আর্থ-সামাজিক মানদণ্ডের ওপর ভিত্তি করে দেয়া হয়, ধর্মের ভিত্তিতে নয়। পিউ রিসার্চ সেন্টারের ২০২১ সালের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, ধর্ম নির্বিশেষে প্রায় সব ভারতীয়ই বর্ণের ভিত্তিতে পরিচিত। প্রায় ৪৩ শতাংশ মুসলিম ‘অন্যান্য/সবথেকে পশ্চাদপদ’ বর্ণ শ্রেণীর অংশ হিসাবে চিহ্নিত।
শিক্ষা থেকে স্বাস্থ্য থেকে আয়ের স্তর পর্যন্ত মুসলিমরা ভারতে অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে অনগ্রসর ধর্মীয় গোষ্ঠী। বিজেপি সরকারের সর্বশেষ তথ্য থেকে জানা যায়, ভারতের জনসংখ্যার ১৪ শতাংশ হওয়ার পরেও দেশটির মুসলিমরা উচ্চ শিক্ষায় নথিভুক্ত শিক্ষার্থীদের মাত্র ৪.৬ শতাংশের প্রতিনিধিত্ব করে। ২০২৩ সালের জুনে হিন্দুস্তান টাইম্স মোদি সরকারের অল ইন্ডিয়া ডেট অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট সার্ভে (এআইডিআইএস) এবং পর্যায়ক্রমিক শ্রমবাহিনী সমীক্ষা (পিএলএফএস) বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছিল যে, মুসলমানরা ভারতের সবচেয়ে দরিদ্র ধর্মীয় গোষ্ঠী।
৪. লাভ জিহাদ : বিজেপি দাবি করে যে, ভারতের মুসলিম পুরুষরা ইচ্ছাকৃতভাবে হিন্দু মহিলাদেরকে ইসলামে ধর্মান্তরিত করার জন্য ভালোবাসার নামে প্রলুব্ধ করে থাকে। ২০০০ সাল থেকে এই তত্ত্বটি দেশজুড়ে বিজেপি সরকারগুলো দ্বারা বিস্তার লাভ করে আসছে। এ পর্যন্ত বেশ কয়েকটি রাজ্য ধর্মান্তরবিরোধী আইন প্রবর্তন করেছে এবং মুসলিম পুরুষ ও আন্তঃধর্মীয় দম্পতিদের ওপর পুলিশি দমন-পীড়ন জোরদার করেছে।
গত বছর মুক্তি পাওয়া মোদির প্রচারিত ‘কেরালা স্টোরি’ নামক একটি বলিউড চলচ্চিত্রেও ‘লাভ জিহাদ’-এর অভিযোগ আনা হয়। ছবিটিতে দেখানো হয়েছে, দক্ষিণ কেরালা রাজ্যের মেয়েরা আইএসআইএল (আইএসআইএস) সন্ত্রাসী গোষ্ঠীতে নিয়োগ পাওয়ার জন্য ইসলাম গ্রহণ করছে। এতে আরো দাবি করা হয়েছে, আইএসআইএল-এ যোগ দিতে যেয়ে রাজ্যটি থেকে ৩২ হাজার নারী নিখোঁজ হয়ে গেছে।
জর্জটাউন বিশ^বিদ্যালয়ের গবেষণা প্রকল্প ‘ব্রিজ’ এটিকে বাস্তবতার পর্র্যালোচনায় ব্যাপকভাবে ভুয়া বলে অভিহিত করেছে। কেরালা স্টোরির দাবিগুলোকে সত্যতা পরীক্ষাকারী গোষ্ঠীগুলো এবং কেরালার স্থানীয় সম্প্রদায়গুলো চ্যালেঞ্জ করার পর চলচ্চিত্র নির্মাতারা স্বীকার করেন যে, ছবিতে ব্যবহৃত পরিসংখ্যানগুলো অপ্রমাণিত।


বিভাগ : আন্তর্জাতিক


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ২৮২ রানে থামিয়েও দিনশেষে অস্বস্তিতে ইংল্যান্ড

ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ২৮২ রানে থামিয়েও দিনশেষে অস্বস্তিতে ইংল্যান্ড

পদ্মায় নিখোঁজ নৌপুলিশের সন্ধান মেলেনি ৭ দিনেও

পদ্মায় নিখোঁজ নৌপুলিশের সন্ধান মেলেনি ৭ দিনেও

বেতাগী দরবারে ওরশ আজ

বেতাগী দরবারে ওরশ আজ

সন্ধ্যা হলেই দ্বিগুণ ভাড়া ভোগান্তিতে যাত্রীরা

সন্ধ্যা হলেই দ্বিগুণ ভাড়া ভোগান্তিতে যাত্রীরা

কারফিউ শিথিল করায় টাঙ্গাইলে জনজীবনে কর্মচাঞ্চল্য ফিরেছে

কারফিউ শিথিল করায় টাঙ্গাইলে জনজীবনে কর্মচাঞ্চল্য ফিরেছে

নদী ভাঙনে ৪৫৮ পরিবারের আহাজারি

নদী ভাঙনে ৪৫৮ পরিবারের আহাজারি

বিটিভি ভবনে অগ্নিসংযোগের অভিযোগে টুকুসহ বিএনপি জামায়াতের ৬ নেতা কারাগারে প্রেরণ

বিটিভি ভবনে অগ্নিসংযোগের অভিযোগে টুকুসহ বিএনপি জামায়াতের ৬ নেতা কারাগারে প্রেরণ

শনিবার সজীব ওয়াজেদ জয়ের ৫৩তম জন্মবার্ষিকী

শনিবার সজীব ওয়াজেদ জয়ের ৫৩তম জন্মবার্ষিকী

মেট্রোরেল স্টেশনে হামলার ঘটনায় আসামিদের ৫ দিনের রিমান্ড

মেট্রোরেল স্টেশনে হামলার ঘটনায় আসামিদের ৫ দিনের রিমান্ড

গণবিরোধী কারফিউ দিয়ে মানুষের কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দিতে চাইছে : ডা. মনীষা

গণবিরোধী কারফিউ দিয়ে মানুষের কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দিতে চাইছে : ডা. মনীষা

নিহত রুদ্রের নামে শাবির প্রধান ফটকের নামকরণ

নিহত রুদ্রের নামে শাবির প্রধান ফটকের নামকরণ

তিনটি গুলি খেয়ে বিনা চিকিৎসায় আমার ছেলেটা মরে গেছে’

তিনটি গুলি খেয়ে বিনা চিকিৎসায় আমার ছেলেটা মরে গেছে’

মালয়েশিয়া ও প্রবাসী আর্ট মেলায় প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের অংশগ্রহণ

মালয়েশিয়া ও প্রবাসী আর্ট মেলায় প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের অংশগ্রহণ

সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে থাকুন- ইঞ্জিনিয়ার আব্দুস সবুর এমপি

সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে থাকুন- ইঞ্জিনিয়ার আব্দুস সবুর এমপি

কুড়িগ্রামে তিন লাশ দাফন, পরিবারের আহাজারি

কুড়িগ্রামে তিন লাশ দাফন, পরিবারের আহাজারি

কুষ্টিয়ায় বছরে পাটের আবাদ কমেছে ৯০ হাজার বিঘা জমিতে

কুষ্টিয়ায় বছরে পাটের আবাদ কমেছে ৯০ হাজার বিঘা জমিতে

ভাঙন আতংকে যমুনা পাড়ের মানুষ

ভাঙন আতংকে যমুনা পাড়ের মানুষ

দীর্ঘ পানিবদ্ধতায় হাকালুকি হাওর তীরের ৩ উপজেলা

দীর্ঘ পানিবদ্ধতায় হাকালুকি হাওর তীরের ৩ উপজেলা

চুয়াডাঙ্গায় মাদরাসাছাত্র হত্যা মামলায় আসামির যাবজ্জীবন

চুয়াডাঙ্গায় মাদরাসাছাত্র হত্যা মামলায় আসামির যাবজ্জীবন

সাভারে নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী কেউ ছাত্র ছিল না

সাভারে নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী কেউ ছাত্র ছিল না