চীনা অর্থনীতির বিপুল উত্থানে অনেক সমীকরণ বদলে গেছে

Daily Inqilab ইনকিলাব ডেস্ক :

০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:১৮ এএম | আপডেট: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:১৮ এএম

দীর্ঘ সময় ধরে বিশ্বের অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করছে আমেরিকা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই বিশ্ব অর্থনীতির শেষ কথা- এ আধিপত্য বজায় রয়েছে অর্ধ শতকেরও বেশি সময় ধরে। গত কয়েক দশকে চীনা অর্থনীতিরও বিপুল উত্থান হয়েছে। গত শতকের শেষ দশক থেকেই চীনের অর্থনীতির বহর বাড়ছে। এর জেরে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও অনেক সমীকরণ বদলে গিয়েছে। চীনের এই বৃদ্ধির হার দেখে বিভিন্ন সময় অনেক বিশেষজ্ঞই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই মার্কিন অর্থনীতিকে ছাপিয়ে যাবে চীন। গত দশকেও চীনের বৃদ্ধির হার যা ছিল, তাতে মনে হত আমেরিকাকে ছাপিয়ে যাওয়া কেবল সময়ের অপেক্ষা। বিষয়টি নিয়ে গত এক দশকের বেশি সময় ধরে চীন ও আমেরিকার প্রতিদ্বন্দ্বিতা কম হয়নি। অনেক বিশেষজ্ঞই চীন-আমেরিকার বাণিজ্যযুদ্ধে ঠান্ডা যুদ্ধের ছায়াও দেখতে পান। এ সবের মধ্যেই কোভিড মহামারি সব হিসাবে উল্টেপাল্টে দিয়েছে। মহামারি বিশ্ব অর্থনীতিকেই বড় ধাক্কা দিয়েছে। এর জেরে আমেরিকা এবং চীনেরও ক্ষতি কম হয়নি। সেই পরিস্থিতি কাটিয়ে দুই দেশ ইতিমধ্যেই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু গত এক দশকের তুলনায় বর্তমানে চীনের অর্থনৈতিক বৃদ্ধি যেন অনেকটাই কম। সেই ‘গ্রোথ মিরাকেল’ যেন উধাও। এই পরিস্থিতিতেই বিভিন্ন অর্থনৈতিক বিশ্লেষক সংস্থা জানাচ্ছে, আমেরিকার অর্থনীতিকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়া এখনই চীনের পক্ষে সম্ভব নয়। কেউ কেউ মনে করছেন, ২০৪০ সালেও ওয়াশিংটনকে পিছনে ফেলতে পারবে না বেইজিং! কিন্তু কী হল চীনের? কেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে লড়াইয়ে পিছিয়ে পড়ল ড্রাগনের দেশ?২০০৮ সালে প্রথম সারির মার্কিন সংবাদমাধ্যমের এক প্রতিবেদনে লেখা হয়েছিল, “সারা বিশ্বে আমেরিকার আধিপত্যে শেষ হতে চলেছে। নতুন শক্তিরা উঠে আসছে। চীন, ভারত এবং রাশিয়া এই স্থান নিতে পারে।” চীন আমেরিকার অর্থনীতিকে পিছনে ফেলবে এ নিয়ে আশাও কম ছিল না। এর পরবর্তী সময়কালে অর্থনীতির পাশাপাশি ভূ-রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও নিজের প্রভাবের বিস্তার ঘটিয়েছে। আর্থিক শক্তির সঙ্গে ভূ-রাজনৈতিক ক্ষমতা বিস্তারের বড় যোগ রয়েছে। সে দিকেও ধীরে ধীরে এগিয়েছে ‘বিশ্বের ফাস্টেস্ট গ্রোয়িং ইকোনমি’ চীন। ‘দ্য বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিটিয়েটিভ’-এর মতো পদক্ষেপও করেছে তারা। কিন্তু তাতেও কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে এখনও পৌঁছতে পারেনি বেইজিং। এর প্রধান কারণ চীনের অর্থনৈতিক বৃদ্ধি এক দশক আগের থেকে অনেকটাই ঝিমিয়ে পড়েছে। ২০০১-০২ সালের পর থেকেই চীনের বার্ষিক জিডিপি ছিল ৯ শতাংশের বেশি। ২০০৮-০৯ এ তা ১৪ শতাংশও ছাড়িয়ে গিয়েছিল। কোভিডের আগের সময়েই তা কমে ৮-৭ শতাংশ নেমেছে। মহামারিতে এক ধাক্কায় তা অনেকটা কমেছিল। কিন্তু এখন তা বাড়লেও অতীতের মতো ৮ শতাংশ ছাড়াতে পারেনি। ২০২৩ সালে আমেরিকার বার্ষিক জিডিপি ছিল ৬.৩ শতাংশ। সেখানে চীনের মাত্র ৪.৬ শতাংশ। যা প্রত্যাশার থেকে অনেকটা কম। আমেরিকার থেকে চীনের পিছিয়ে পড়ার কারণ হিসাবে বেশ কিছু বিষয় তুলে ধরেছেন বিশেষজ্ঞরা। চার দশক আগেও চীন যে অর্থনৈতিকভাবে খুব শক্তিশালী ছিল এমন নয়। তখন চীন অর্থনীতির বিকাশের জন্য ‘ওপেন ডোর’ নীতি নেয়। এর জেরে চীনের বিভিন্ন এলাকায় অর্থনৈতিক জোন তৈরির কাজ শুরু হয়। বৈদেশিক বিনিয়োগের রাস্তাও প্রশস্ত হয় চীনে। এর পর চীন অর্থনীতির বৃদ্ধির জন্য একাধিক সংস্কারের পথে হেঁটেছে। বিভিন্ন সংস্থায় রাষ্ট্রের মালিকানা, লিগাল সিস্টেম, কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক নিয়ে একাধিক পদক্ষেপ করেছে বেইজিং। এর পর থেকেই বিশ্বের উৎপাদন শিল্পের ঠিকানা হয়ে উঠেছে চীন। ‘বিশ্বের কারখানা’ হিসাবেও ডাকা হয় এশিয়ার এই দেশকে।বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সংস্থা কারখানা তৈরি করেছে চীনে। এবং চীনে উৎপাদিত পণ্য ছড়িয়ে পড়েছে গোটা বিশ্বে। এ ভাবেই দিনে দিনে বেড়েছে চীনের অর্থনীতি। ২০০৭ সালে চীনের জিডিপি-র ৩২ শতাংশ এসেছিল রফতানি থেকে। এ ভাবে যতই বেড়েছে চীনের অর্থনীতির বহর, ততই রাষ্ট্রের আগলও শক্তিশালী হয়েছে। বিভিন্ন সংস্থায় রাষ্ট্রের মালিকানা ১০-১৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ৫০-৬০ শতাংশে পৌঁছেছে। আবার রাষ্ট্রের সম্পূর্ণ মালিকানাধীন সংস্থার সংখ্যা কমেছে। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির হস্তক্ষেপ বৃদ্ধি, মুক্ত অর্থনীতির পরিসরকে অনেকটাই খাটো করেছে বলে মত বিশেষজ্ঞদের। চীনের উৎপাদন শিল্পে জোয়ার আসা এবং অর্থনীতির বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সেখানে নগরায়ন প্রবণতাও বেড়েছিল। এর জেরে ফুলেফেঁপে উঠেছিল চীনের আবাসনক্ষেত্র বা রিয়েল এস্টেট ব্যবসা। কিন্তু গত কয়েক বছরে চীনের আবাসনক্ষেত্র দারুণ ধাক্কা খেয়েছে। যার প্রভাব পড়েছে চীনা অর্থনীতিতে। এর পাশাপাশি সময়ের সঙ্গে পরিকাঠামোগত যে পরিবর্তন দরকার ছিল, তার অনেক কিছুই হয়নি চীনে। অর্থনৈতিক বৃদ্ধির প্রাথমিক পরিচালন শক্তি হিসাবে পুঁজি বিনিয়োগের থেকে ব্যক্তিগত ভোক্তাজগতের উপর অধিকতর গুরুত্ব দেওয়ার বহুকথিত পরিবর্তনের বিষয়টি শেষ পর্যন্ত ঘটেনি। যা ধাক্কা দিয়েছে চীনের অর্থনৈতিক বৃদ্ধিতে। কোনও দেশকে অর্থনীতিতে সবথেকে শক্তিশালী হতে চাইলে প্রযুক্তির উদ্ভাবনেও এগিয়ে থাকা আবশ্যক। কিন্তু এ ব্যাপারে আমেরিকাকে কখনই টেক্কা দিতে পারেনি চীন। নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন এবং গবেষণায় চীনের থেকে অনেক এগিয়ে রয়েছে আমেরিকা। বিশ্ব ব্যাঙ্কের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টির নিরিখে আমেরিকার থেকে কয়েক যোজন পিছিয়ে চীন। এমনকি জাপানও এ ব্যাপারে চীনের থেকে এগিয়ে। এমনকি বিভিন্ন পেটেন্ট এবং পুরষ্কারের নিরিখেও পিছিয়ে রয়েছে চীন। এর পাশাপাশি চীনের বিরুদ্ধে প্রযুক্তি চুরির অভিযোগও উঠেছে বিভিন্ন সময়ে। তাই কোনও প্রযুক্তির উপর ভিত্তি করে পণ্য উৎপাদন। সেই পণ্য বিশ্বের বাজারে পৌঁছে দেয়া এবং তার গতি নিয়ন্ত্রণ করার পর্যায়ে চীন ততটা সফল হয়নি। বরং বাইরের বিভিন্ন দেশ থেকে যন্ত্রাংশ এসে, চীনে অ্যাসেম্বল হয়েছে। এবং পণ্য বাইরে রফতানি হয়েছে। প্রযুক্তির উদ্ভাবনে আমেরিকাকে টেক্কা দিতে না পারাও চীনেও পিছিয়ে পড়ার অন্যতম কারণ বলে মত বিশেষজ্ঞদের। এ বিষয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমন কল্যাণ লাহিড়ী বলেছেন, “বিভিন্ন প্রযুক্তির উদ্ভাবনী, পেটেন্টের বিষয়ে আমেরিকা অনেক এগিয়ে। এ ব্যাপারে চীনও অনেকাংশে আমেরিকার উপর নির্ভরশীল। প্রযুক্তি আমেরিকার হাতে যেহেতু বেশি, চীন এ ব্যাপারে আমেরিকার সঙ্গে তেমন পেরে ওঠে না। বাজারকেন্দ্রিক প্রযুক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতেই বেশি। এর সঙ্গে সিলিকন প্রযুক্তি অর্থাৎ চিপ তৈরি নিয়ে যে লড়াইটা হচ্ছে, সেখানে চীন এগিয়ে থাকলেও কিছু সমস্যা তৈরি হচ্ছে। চীনে থাকা সংস্থা পরিচালনা, পণ্য নিয়ে যাওয়া, নিরাপত্তা সংক্রান্ত জটিলতা তৈরি হচ্ছে।”অর্থনৈতিক শক্তি বৃদ্ধির সঙ্গে ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের সম্পর্ক অনেকটাই অবিচ্ছেদ্য। বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি আমেরিকা বিশ্বের ভূ-রাজনীতিতে নিজের প্রভাব বজায় রেখেছে। যদিও সেই প্রভাব আগের তুলনায় কমেছে, কিন্তু এখনও এ ব্যাপারে আমেরিকাই এগিয়ে। যদিও চীন আর্থিক বৃদ্ধিকে কাজে নিজের মিলিটারির ক্ষমতা আগের থেকে অনেক বাড়িয়েছে। কিন্তু মিলিটারি যন্ত্রাংশ তৈরির ক্ষমতাতেও চীন আমেরিকার থেকে অনেক পিছিয়ে। রয়টার্স।

 


বিভাগ : আন্তর্জাতিক


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সাকিবের বোলিং নিষিদ্ধ

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সাকিবের বোলিং নিষিদ্ধ

এই সরকার বিপ্লবের চেতনাকে পুরোপুরি ধারণ করতে পারেনি: মাহমুদুর রহমান

এই সরকার বিপ্লবের চেতনাকে পুরোপুরি ধারণ করতে পারেনি: মাহমুদুর রহমান

শার্শা থানা প্রেসক্লাবের উদ্যোগে সাংবাদিকদের মিলন মেলা

শার্শা থানা প্রেসক্লাবের উদ্যোগে সাংবাদিকদের মিলন মেলা

মুখ্য সংগঠক হান্নান মাসউদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা!

মুখ্য সংগঠক হান্নান মাসউদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা!

সোনারগাঁওয়ে শীতবস্ত্র বিতরণ ও ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প অনুষ্ঠিত

সোনারগাঁওয়ে শীতবস্ত্র বিতরণ ও ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প অনুষ্ঠিত

রাষ্ট্র সংস্কারে ১৫ দফা প্রস্তাবনা: পৃথক শরীয়া আদালত প্রতিষ্ঠার দাবি

রাষ্ট্র সংস্কারে ১৫ দফা প্রস্তাবনা: পৃথক শরীয়া আদালত প্রতিষ্ঠার দাবি

কলম্বিয়ায় বিমান বিধ্বস্ত হয়ে নিহত ১০

কলম্বিয়ায় বিমান বিধ্বস্ত হয়ে নিহত ১০

দেশের সংগ্রামের ইতিহাস-সংস্কৃতি বিশ্বে তুলে ধরার আহ্বান উপদেষ্টা নাহিদের

দেশের সংগ্রামের ইতিহাস-সংস্কৃতি বিশ্বে তুলে ধরার আহ্বান উপদেষ্টা নাহিদের

ভারতে চার বাংলাদেশি নাগরিক গ্রেপ্তার

ভারতে চার বাংলাদেশি নাগরিক গ্রেপ্তার

পথশিশুদের নিয়ে বিপিএলের ট্রফি উন্মোচন

পথশিশুদের নিয়ে বিপিএলের ট্রফি উন্মোচন

তামিমকে বিসিবির ধন্যবাদ

তামিমকে বিসিবির ধন্যবাদ

গণহত্যাকারীদের বিচারিক প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে: সারজিস

গণহত্যাকারীদের বিচারিক প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে: সারজিস

দ্বিতীয় চালানে ভারত থেকে এলো ২৭ হাজার টন চাল

দ্বিতীয় চালানে ভারত থেকে এলো ২৭ হাজার টন চাল

গাঁজা সেবনের অভিযোগে নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪ শিক্ষার্থীকে শাস্তি

গাঁজা সেবনের অভিযোগে নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪ শিক্ষার্থীকে শাস্তি

উইন্ডিজ সিরিজে পাকিস্তান দলে ৭ পরিবর্তন, নেই আফ্রিদি

উইন্ডিজ সিরিজে পাকিস্তান দলে ৭ পরিবর্তন, নেই আফ্রিদি

সুইজারল্যান্ডে গ্লোবাল এসএমই সামিট অনুষ্ঠিত হবে আগামী ২৩-২৫ এপ্রিল

সুইজারল্যান্ডে গ্লোবাল এসএমই সামিট অনুষ্ঠিত হবে আগামী ২৩-২৫ এপ্রিল

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে প্রবাসীদের ভূমিকা অপরিসিম : সিলেটে কাইয়ুম চৌধুরী

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে প্রবাসীদের ভূমিকা অপরিসিম : সিলেটে কাইয়ুম চৌধুরী

ডার্ক ওয়েবে গ্রাহকের তথ্য বিক্রির অভিযোগ : সিটি ব্যাংকের ব্যাখ্যা

ডার্ক ওয়েবে গ্রাহকের তথ্য বিক্রির অভিযোগ : সিটি ব্যাংকের ব্যাখ্যা

মার্কেন্টাইল ব্যাংকের ‘বার্ষিক ব্যবসায়িক সম্মেলন-২০২৫’ অনুষ্ঠিত

মার্কেন্টাইল ব্যাংকের ‘বার্ষিক ব্যবসায়িক সম্মেলন-২০২৫’ অনুষ্ঠিত

গফরগাঁওয়ে বন্ধুর ছুরিকাঘাতে বন্ধুর মৃত্যু

গফরগাঁওয়ে বন্ধুর ছুরিকাঘাতে বন্ধুর মৃত্যু