আইসিসি’র পরোয়ানাকে স্বাগত জানিয়েছে ইইউসহ বিভিন্ন দেশ

যেসব দেশে গেলে গ্রেফতার হতে পারেন নেতানিয়াহু

Daily Inqilab ইনকিলাব ডেস্ক

২৩ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০২ এএম | আপডেট: ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০২ এএম

যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং তার সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে শেষমেশ গ্রেপ্তারি পরোয়ানাই জারি করলেন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি)। এই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এক অভূতপূর্ব চাপ তৈরি করেছে। তবে প্রশ্ন হলো, কোন দেশ এই পরোয়ানা কার্যকর করবে এবং আদৌ তারা গ্রেফতার হবেন কি?

আইসিসি-এর সদস্য রাষ্ট্রগুলোর ওপর আইনগত বাধ্যবাধকতা রয়েছে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা কার্যকর করার। যদি নেতানিয়াহু বা গ্যালান্ট এই দেশগুলোর যেকোনো একটির ভূখণ্ডে প্রবেশ করেন, তবে তাদের গ্রেফতার করা আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক। বর্তমানে ১২৩টি দেশ আইসিসির সদস্য, যার মধ্যে বেশিরভাগই ইউরোপ, আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকায় অবস্থিত। বিশেষ করে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের বেশিরভাগ দেশ আইসিসির সক্রিয় সমর্থক। ফ্রান্স, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস এবং যুক্তরাজ্যের মতো দেশগুলো আইসিসির আইন মেনে চলার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আফ্রিকান ইউনিয়নের অনেক দেশ আইসিসির সদস্য, তবে অতীতে কিছু দেশ আইসিসির বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ এনেছে। ফলে, তাদের ভূমিকা দ্বিধাগ্রস্ত হতে পারে।

যদিও আইসিসির সদস্য দেশগুলোর ওপর গ্রেপ্তারি পরোয়ানা কার্যকর করার আইনগত বাধ্যবাধকতা রয়েছে, রাজনৈতিক বাস্তবতা ভিন্ন। নেতানিয়াহু এবং গ্যালান্টের গ্রেপ্তার ইসরাইলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষ করে, যুক্তরাষ্ট্র এবং কিছু পশ্চিমা দেশ, যারা ইসরাইলের ঘনিষ্ঠ মিত্র, তারা এই পরোয়ানা কার্যকর করার সম্ভাবনা কম। যুক্তরাষ্ট্র আইসিসির সদস্য নয় এবং তাদের এই আদালতের কোনো আইনি বাধ্যবাধকতা নেই। পাশাপাশি, যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে ইসরাইলের প্রধান সমর্থক। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইতোমধ্যেই আইসিসির এই সিদ্ধান্তকে ‘অন্যায়’ বলে অভিহিত করেছেন এবং নেতানিয়াহুর পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশগুলোও এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে দ্বিধাগ্রস্ত হতে পারে।

ইসরাইল আইসিসির সদস্য নয় এবং তারা এই আদালতের বৈধতাকে সরাসরি অস্বীকার করে আসছে। ইসরাইলি সরকার এই গ্রেপ্তারি পরোয়ানাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং ভিত্তিহীন বলে উল্লেখ করেছে। তারা জানিয়েছে, এই পরোয়ানা তাদের কূটনৈতিক নীতিতে কোনো প্রভাব ফেলবে না। আইসিসি নিজস্ব কোনো পুলিশ বাহিনী না থাকায় এই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা কার্যকর করার ক্ষমতা সদস্য রাষ্ট্রগুলোর ওপর নির্ভরশীল। যদি নেতানিয়াহু বা গ্যালান্ট কোনো আইসিসি সদস্য রাষ্ট্রে ভ্রমণ করেন, তবে তাদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব। তবে অতীতে দেখা গেছে, আইসিসির অনেক গ্রেপ্তারি পরোয়ানা শুধুমাত্র প্রতীকী পদক্ষেপ হিসেবেই রয়ে গেছে। উদাহরণস্বরূপ, সুদানের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বাশিরের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হলেও তিনি বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করেছেন এবং তাকে গ্রেপ্তার করা হয়নি।

সম্ভাব্য গ্রেপ্তারকারী দেশ:
১. ইউরোপীয় দেশগুলো: ফ্রান্স, জার্মানি, স্পেন এবং নেদারল্যান্ডসের মতো দেশ আইসিসির প্রতি তাদের প্রতিশ্রুতি বজায় রাখতে পারে এবং নেতানিয়াহুকে গ্রেপ্তার করার উদ্যোগ নিতে পারে।
২. আফ্রিকান দেশগুলো: দক্ষিণ আফ্রিকা এবং কেনিয়ার মতো দেশ, যারা পূর্বে আইসিসিকে সমর্থন করেছে, তারা এই পরোয়ানা কার্যকর করতে পারে। তবে আফ্রিকার কিছু দেশ অতীতে আইসিসির বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তুলেছে।
৩. লাতিন আমেরিকা: ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনার মতো দেশ, যারা মানবাধিকার ইস্যুতে শক্ত অবস্থান নেয়, তারা এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে পারে।
নেতানিয়াহু এবং গ্যালান্টের বিরুদ্ধে জারি করা আইসিসির এই পরোয়ানা আন্তর্জাতিক অপরাধের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের একটি বড় পদক্ষেপ। তবে, এই পরোয়ানার কার্যকারিতা তাদের গ্রেপ্তার পর্যন্ত পৌঁছাতে পারবে কিনা, তা অনেকটাই নির্ভর করবে রাজনৈতিক সমীকরণের ওপর।
এদিকে, নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের গ্রেফতারি পরোয়ানা জারিকে স্বাগত জানিয়েছে বিশ্বের বিভিন দেশ। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পাশাপাশি পরোয়ানাকে স্বাগত জানিয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। ইইউ বলছে, তাদের ২৭টি দেশই আইসিসির আইন মানতে বাধ্য। ইতালির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তাদের দেশে নেতানিয়াহু প্রবেশ করলে তাকে গ্রেফতার করা হবে। নেদারল্যান্ড জানায়, তারা আইসিসির আইন মানতে বাধ্য। একই সুরে বেলজিয়ামের পক্ষ থেকে বলা হয়, ইউরোপের দেশগুলোর উচিত ইসরাইলের সঙ্গে বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করা। এছাড়াও, যত চুক্তি আছে সব বাতিল করার আহ্বান জানায় দেশটি।

এর পাশাপাশি, গণহত্যার জন্য ইসরাইলের সব কর্মকর্তাকে জবাবদিহি করার আহ্বান জানায় তুরস্ক। একইসঙ্গে আইসিসির আইনকে সম্মান জানিয়েছে যুক্তরাজ্য। মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইরাক সব স্বাধীন দেশকে আইসিসির রায় মেনে নেয়ার আহ্বান জানিয়েছে। তবে বাইডেন প্রশাসনের পক্ষ থেকে নাকচ করে দেয়া হয়েছে এই রায়। যুক্তরাষ্ট্রের দাবি, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করার পর আইসিসির আর কোনো কিছু করার নেই। এছাড়া ইসরাইলের সাবেক প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট বলেছেন, তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে ‘বিপজ্জনক নজির’ স্থাপন করেছে আইসিসি। অন্যদিকে ইসরাইলি পররাষ্ট্র মন্ত্রী গিডিয়ন সার বলেন, যেসব দেশ এই আইন মানবে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সব দেশের রাষ্ট্রদূতকে নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি।

উল্লেখ্য, গাজায় যুদ্ধাপরাধ ও মানবতা বিরোধী অপরাধের জন্য জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে চলতি বছরের ২০ মে ইসরাইলি নেতাদের পাশাপাশি হামাস নেতাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করতে আইসিসির কাছে আবেদন জানানে এর প্রধান প্রসিকিউটর করিম খান। এরপর পরোয়ানা জারিতে বিলম্ব হওয়ায় বারবার তাগিদ দিয়েছেন তিনি। প্রায় ছয় মাস পর বহুলকাক্সিক্ষত ইসরাইলি দুই নেতার বিরুদ্ধে সেই গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হলো। গত বছরের ৭ অক্টোবর ইসরাইলে আকস্মিক হামলা চালায় ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী হামাস। হামাসের ওই হামলার অজুহাতে অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় সামরিক আগ্রাসনের নির্দেশ দেন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট। সেই থেকে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চলছে ইসরাইলি আগ্রাসন। যদিও চলতি মাসের শুরুর দিকে ইয়োভ গ্যালান্টকে বরখাস্ত করেন নেতানিয়াহু। সূত্র : আল-জাজিরা, রয়টার্স।


বিভাগ : আন্তর্জাতিক


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

মাদুরোকে গ্রেপ্তারে ২৫ মিলিয়ন ডলার পুরস্কার ঘোষণা যুক্তরাষ্ট্রের

মাদুরোকে গ্রেপ্তারে ২৫ মিলিয়ন ডলার পুরস্কার ঘোষণা যুক্তরাষ্ট্রের

যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত উভয়েই একটি স্থিতিশীল বাংলাদেশ দেখতে চায় :বিদায়ী মার্কিন রাষ্ট্রদূত

যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত উভয়েই একটি স্থিতিশীল বাংলাদেশ দেখতে চায় :বিদায়ী মার্কিন রাষ্ট্রদূত

অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্যে ইরানে অস্থিরতা বাড়ছে

অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্যে ইরানে অস্থিরতা বাড়ছে

দ্রুত নির্বাচন হলে সৃষ্ট সংকট দূর হবে : মির্জা ফখরুল

দ্রুত নির্বাচন হলে সৃষ্ট সংকট দূর হবে : মির্জা ফখরুল

গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসনে নিহত আরও ২১

গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসনে নিহত আরও ২১

নিষেধাজ্ঞার কারণে যুক্তরাষ্ট্রে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি পাবে

নিষেধাজ্ঞার কারণে যুক্তরাষ্ট্রে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি পাবে

অভিশংসিত প্রেসিডেন্ট বাসভবনকে ‘দুর্গে’ পরিণত করেছেন

অভিশংসিত প্রেসিডেন্ট বাসভবনকে ‘দুর্গে’ পরিণত করেছেন

ভারতের সঙ্গে করা জনস্বার্থবিরোধী চুক্তি বাতিলের দাবি আনু মুহাম্মদের

ভারতের সঙ্গে করা জনস্বার্থবিরোধী চুক্তি বাতিলের দাবি আনু মুহাম্মদের

পাকিস্তানিদের জন্য ভিসার শর্ত শিথিল করল বাংলাদেশ

পাকিস্তানিদের জন্য ভিসার শর্ত শিথিল করল বাংলাদেশ

মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধানদের ঐক্যবদ্ধ কার্যকরী ভূমিকা সময়ের অপরিহার্য দাবি

মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধানদের ঐক্যবদ্ধ কার্যকরী ভূমিকা সময়ের অপরিহার্য দাবি

রাজনীতি হওয়া উচিত জনমানুষের কল্যাণে -বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আসলাম চৌধুরী

রাজনীতি হওয়া উচিত জনমানুষের কল্যাণে -বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আসলাম চৌধুরী

বিএনপির সাথে জামায়াতের দূরত্ব নয় বরং সুসম্পর্ক রয়েছে -চাঁদপুরে ডা. তাহের

বিএনপির সাথে জামায়াতের দূরত্ব নয় বরং সুসম্পর্ক রয়েছে -চাঁদপুরে ডা. তাহের

আদমদীঘিতে খালেদা জিয়ার রোগ মুক্তি কামনায় দোয়া

আদমদীঘিতে খালেদা জিয়ার রোগ মুক্তি কামনায় দোয়া

ছাত্রাবাস থেকে রুয়েট শিক্ষার্থীর লাশ উদ্ধার

ছাত্রাবাস থেকে রুয়েট শিক্ষার্থীর লাশ উদ্ধার

দেশীয় চোলাই মদের ট্রানজিট বোয়ালখালী

দেশীয় চোলাই মদের ট্রানজিট বোয়ালখালী

সোনারগাঁওয়ে বিনামূল্যে চক্ষু শিবির

সোনারগাঁওয়ে বিনামূল্যে চক্ষু শিবির

রূপগঞ্জ অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সভা, সংবর্ধনা ও বার্ষিক মিলনমেলা অনুষ্ঠিত

রূপগঞ্জ অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সভা, সংবর্ধনা ও বার্ষিক মিলনমেলা অনুষ্ঠিত

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কর্মীরাও ফ্যাসিস্ট সরকারের নিপীড়নের শিকার : অধ্যাপক মুজিবুর রহমান

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কর্মীরাও ফ্যাসিস্ট সরকারের নিপীড়নের শিকার : অধ্যাপক মুজিবুর রহমান

সাম্প্রদায়িক হামলার অভিযোগে ১১৫টি মামলা, ১০০ জন গ্রেফতার

সাম্প্রদায়িক হামলার অভিযোগে ১১৫টি মামলা, ১০০ জন গ্রেফতার

উন্মুক্ত মঞ্চে তরুণদের উচ্ছ্বাস

উন্মুক্ত মঞ্চে তরুণদের উচ্ছ্বাস