হ্যাকারদের লড়াই বদলে দিচ্ছে ইউক্রেন যুদ্ধ
১৭ এপ্রিল ২০২৩, ০৮:৩১ এএম | আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ১০:৪৩ পিএম
রাশিয়া ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরু করার সাথে সাথেই দ্বিতীয় আরেকটি যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। যাকে বলা যায়, এক অদৃশ্য যুদ্ধ। সে যুদ্ধ চলছে সাইবারস্পেসে। কিন্তু কারা এই যুদ্ধ করছে?
দেখতে বিবিসির সংবাদদাতা জো টাইডি গিয়েছিলেন ইউক্রেনে। সেখানে গিয়ে তিনি দেখেন, কীভাবে এ যুদ্ধ সামরিক সাইবার তৎপরতা আর হ্যাকারদের কর্মকান্ডের এতদিন যে পার্থক্য ছিল তা ঝাপসা করে দিয়েছে।
তিনি বলেন, ওলেক্সান্দর থাকেন মধ্য ইউক্রেনে। আমি যখন তার এক-বেডরুমের ফ্ল্যাটে গেলাম। দেখতে পেলাম, সাধারণতঃ হ্যাকারদের ঘর যেমন হয়ে থাকে, এটাও ঠিক তেমনিই। আরাম-আয়েশ বা বিলাসিতার কোনো উপাদান সেখানে নেই। তেমন কোনো আসবাবপত্র নেই, এমনকি একটা টিভিও নেই। শুধু আছে বেডরুমের এক কোণে একটা শক্তিশালী কম্পিউটার, আরেক কোণায় একটা জোরালো মিউজিক সিস্টেম।
এখান থেকেই ওলেক্সান্দর শত শত রুশ ওয়েবসাইট সাময়িকভাবে অকার্যকর করে দেবার কাজে ভুমিকা রেখে চলেছেন। এর ফলে কয়েক ডজন ব্যাংকের সেবা বিঘ্নিত হয়েছে, রুশ ওয়েবসাইটে জুড়ে দেয়া হয়েছে ইউক্রেন-সমর্থক বার্তা ।
ওলেক্সান্দর হচ্ছেন ‘আইটি আর্মি অব ইউক্রেন’ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী হ্যাকার নেটওয়ার্কের একজন প্রধান হ্যাকার। তাদের যে টেলিগ্রাম গ্রুপ আছে তার সদস্য সংখ্যা প্রায় দু’লাখ। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি এ কাজ করছেন। তার লক্ষ্য রাশিয়ার ভেতরে যত বেশি সম্ভব বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা ।
আমরা যখন তার সাথে দেখা করতে গেছি তখনো তিনি ব্যস্ত। তার সর্বশেষ টার্গেট একটি রুশ ব্যাংকিং ওয়েবসাইটের ইন্টারনেট সংযোগ বিকল করে দেবার লক্ষ্যে এক জটিল সফটওয়্যার পরিচালনার কাজে।
ওলেক্সান্দর স্বীকার করলেন, তার সবচেয়ে প্রিয় হ্যাকের আইডিয়া তিনি পেয়েছিলেন একজন অজ্ঞাতনামা রুশের দেয়া তথ্য থেকে।
ওলেক্সান্দর বলেন,‘রাশিয়া থেকে একজন আমাকে বললো চেস্টনি জনাক নামে একটি প্রতিষ্ঠানের কথা। ওরা বললো, এটা হচ্ছে রাশিয়ার একমাত্র পণ্য যাচাই করার সিস্টেম। কাজেই সব রকমের পণ্যকেই কারখানায় তৈরি হওয়া থেকে বিক্রি হওয়া পর্যন্ত ওই কারখানার দেয়া বারকোড এবং বিশেষ একটি নম্বর স্ক্যান করার জন্য দিতে হয়।’
তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয় এর অর্থনৈতিক ক্ষতি ছিল বেশ উচ্চমাত্রার। ব্যাপারটা সত্যি বিস্ময়কর। এ হ্যাকিংয়ের ফলে বাস্তবে কতটা ক্ষতি হয়েছিল তা পরিমাপ করা কঠিন। তবুও এপ্রিল মাসে চেস্টনি জনাক তাদের অফিশিয়াল টেলিগ্রাম ফিডে এই ডিডিওএস আক্রমণ সম্পর্কে নিয়মিত আপডেট দিচ্ছিল। ব্যবসায়ীদের দেয়া হচ্ছিল নানা রকম পরামর্শ। সহায়তার জন্য খোলা হয়েছিল একটি হেল্প লাইন ‘
শেষ পর্যন্ত রুশ শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় খাবারের লেবেলিং-সংক্রান্ত কিছু নিয়মকানুন শিথিল করে। যাতে যেসমস্ত খাদ্যপণ্য তাড়াতাড়ি নষ্ট হয়ে যায় সেগুলো বিক্রি করা সম্ভব হয়।
নিজেদের সৈনিক বলেই মনে করেন হ্যাকাররা
সম্প্রতি ইউক্রেনে রুশ অভিযানের এক বছর পুরো হবার সময়টায়, ওলেক্সান্দর ওয়ান ফিস্ট নামে একটি হ্যাকার দলের সাথে যোগ দেন। তাদের লক্ষ্য ছিল রুশ রেডিও স্টেশনগুলো হাইজ্যাক করা। সেখান থেকে ভুয়া বিমান হামলার সাইরেনের শব্দ প্রচার করা। যাতে রুশ নাগরিকদের আত্মরক্ষার জন্য জরুরি আশ্রয়ে যেতে সচেতন করা হয়।
ওলেক্সান্দর বলেন, ‘আমরা নিজেদেরকে সামরিক বাহিনীর মতোই মনে করি। যখন আমার দেশ রাইফেল হাতে তুলে নিতে বলবে তার জন্য আমি তৈরি। কিন্তু এখন আমি রাশিয়ায় হ্যাকিং চালিয়ে সহায়তা করছি।’
অনেক বিশেষজ্ঞই পূর্বাভাস দিয়েছিলেন যে এই ‘হ্যাকটিভিস্টরা’ ইউক্রেন যুদ্ধে হয়তো একটা ভূমিকা পালন করতে পারে। কিন্তু যে মাত্রায় এ কার্যক্রম চলছে তা অনেককেই বিস্মিত করেছে। উভয় পক্ষ থেকেই হ্যাকার বাহিনী বেরিয়ে এসেছে।
যেসব গ্রুপ অপরাধমূলক আক্রমণ চালাচ্ছে তাদের সাথে সামরিক কর্মকর্তাদের নজিরবিহীন যোগাযোগের খবরো বেরিয়ে আসছে। এর ফলে রাষ্ট্রীয় অনুমোদনপ্রাপ্ত সাইবার আক্রমণ এবং এডহক স্বেচ্ছাসেবীদের হ্য্যাকিং। এদের মধ্যে ভেদরেখা মুছে যাচ্ছে। এর পরিণাম হতে পারে সুদূরপ্রসারী।
কিয়েভে অবস্থিত ইউক্রেনের সাইবার প্রতিরক্ষা হেডকোয়ার্টারটি আমরা দেখতে যাই। সেখানে কর্মকর্তারা বিবিসিকে বলেন, তাদের কাছে এমন তথ্যপ্রমাণ রয়েছে যে রুশ হ্যাকারদের চক্র কিলনেট। যাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে প্রায় এক লাখ সদস্য আছে। তারা সরাসরি রুশ সাইবার সামরিক বাহিনীর সাথে মিলে কাজ করছে।
রাষ্ট্রীয় স্পেশাল কমিউনিকেশন বিভাগের ডেপুটি চেয়ারম্যান ভিক্তর ঝোরা। বলছেন, ‘কিলনেট বা সাইবার আর্মি অব রাশিয়ার মতো গ্রুপগুলো ডিডিওএস আক্রমণ দিয়ে শুরু করেছিল। তবে এখন তারা আরো প্রতিভাবান ও দক্ষ লোকজনকে নিয়োগ করেছে। তারা এখন আরো উচ্চস্তরের সাইবার আক্রমণ চালাতে সক্ষম, এবং রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর কনসালট্যান্টরাও তাদের সাথে আছে। তাদের কমান্ডাররা এই সবগুলো গ্রুপ এবং তাদের কার্যক্রমকে এক জায়গায় নিয়ে আসছে। যা হলো ইউক্রেন ও তার মিত্রদের বিরুদ্ধে সাইবার স্পেসে রুশ আক্রমণের উৎস।’
রাশিয়ার সাইবার আক্রমণের ঝুঁকি
এই যোগাযোগের প্রমাণ পাওয়া গেলে তা রাশিয়ার জন্য সমস্যার কারণ হতে পারে। গত বছর ফেব্রুয়ারির অভিযানের পর থেকে রাশিয়ার সাইবার আক্রমণের লক্ষ্য মোটামুটি ইউক্রেনীয় লক্ষ্যবস্তুর মধ্যেই সীমিত ছিল। যেসব টার্গেট যুদ্ধের সাথে সম্পর্কিত।
কিন্তু কিলনেট আহ্বান জানিয়েছে যে ইউক্রেন ও তার মিত্র দেশগুলোয় হাসপাতালের ওয়েবসাইটের ওপরো আক্রমণে চালানোর জন্য। তারা এরকম আক্রমণ পরিচালনাও করেছে, যা সাময়িকভাবে হলেও বিঘ্ন সৃষ্টি করেছে।
সাইবার যুদ্ধের জন্য এখনো কোন জেনেভা কনভেনশন নেই। কিন্তু আন্তর্জাতিক রেড ক্রস কমিটি যুক্তি দিয়েছে যে ওই কনভেনশনের বিদ্যমান বিধানগুলো এ ক্ষেত্রে প্রযুক্ত হতে পারে।
সেক্ষেত্রে উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে হাসপাতালকে লক্ষ্য করে চালানো সাইবার আক্রমণ কনভেনশনের লঙ্ঘন হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। তা ছাড়া যেহেতু নেটোভুক্ত দেশে এসব আক্রমণ চালানো হচ্ছে। তাই এর ফলে গুরুতর কোন ক্ষতি হলে জোটবদ্ধভাবে পাল্টা জবাব দেবার পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।
'কিলনেট'-এর নেতা 'কিলমিল্ক'
এ ব্যাপারে মন্তব্য চাইলে বিবিসির অনুরোধে রুশ সরকার সাড়া দেয়নি। তাই আমরা সরাসরি কিলনেটের নেতা। যিনি নিজেকে ‘কিলমিল্ক’ নামে পরিচয় দেন। তার সাথেই যোগাযোগ করেছিলাম।
কিলমিল্ক মুখোমুখি সাক্ষাতকার দিতে রাজী হননি। কিন্তু কয়েক সপ্তাহ ধরে তাকে টেলিগ্রামে মেসেজ দেবার পর তিনি ভিডিওতে আমাদের প্রশ্নের জবাব পাঠান এবং তার পরই সংযোগ কেটে দেন।
কিলমিল্ক বলেন, ‘আমরা কিলনেটকে প্রতিদিন ১২ ঘন্টা করে সময় দেই। আমরা এমন কাউকে দেখিনি যার সাথে রুশ হ্যাকারদের তুলনা হতে পারে। নির্বোধ আর অপদার্থ ইউক্রেনীয়ান হ্যাকাররা আমাদের মোকাবিলা করে সফল হতে পারবে না।’
কিলমিল্ক দাবি করেন তার গ্রুপ রাশিয়ার বিশেষ সংস্থার প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। তিনি আরো বলেন, তিনি একটি কারখানায় চাকরি করেন এবং একজন ‘সহজ সরল’ লোক ।
তিনি জানান , তিনি ইউক্রেন যুদ্ধের আগেই একটি অপরাধমূলক ভাড়াটে ডিডিওএস ব্যবসা শুরু করেন। কিন্তু যুদ্ধ শুরু হবার পর তিনি তার হ্যাকিং কার্যক্রমকে ইউক্রেন ও তার মিত্রদের মধ্যে বিঘ্ন সৃষ্টির জন্য উৎসর্গ করেন।’
রোমান - স্বেচ্ছাসেবী হ্যাকার থেকে সামরিক কর্মী
রাজধানী কিয়েভ থেকে গাড়িতে দু’ঘণ্টার পথ ঝিটোমির শহরে থাকেন রোমান। এক বছর আগে যখন কিয়েভ আক্রান্ত হবার মুখে তখন অপরাধমূলক হ্যাকিং যুদ্ধের জন্য সফটওয়্যার তৈরির কাজে সহায়তা করছিলেন তিনি। আইটি স্ট্যান্ড ফর ইউক্রেন নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী গ্রুপের তিনি সহ-প্রতিষ্ঠাতা। গত কয়েক মাসে তাকে ইউক্রেনের সাইবার সামরিক বাহিনীতে আনুষ্ঠানিকভাবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
রোমানের সাথে আমাদের দেখা হয় তার ট্রেনিং হেডকোয়ার্টারের কাছে একটি পার্কে। তিনি একজন স্বেচ্ছাসেবী থেকে সামরিক বাহিনীতে গেছেন তাই তিনি এমনভাবে ব্যাপারটাকে দেখছেন যা অন্য কারো সাথে মেলেনা। তিনি তার বর্তমান ভূমিকা সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু বললেন না। তবে এটুকু বললেন যে তার কাজের একটা অংশ হচ্ছে সাইবার যুদ্ধের ফলে পাওয়া বিপুল পরিমাণ উপাত্ত এবং ফাঁস হওয়া তথ্যের ভেতরে কীভাবে অনুসন্ধান চালানো যায়। তার উপায় বের করা।
বিবিসি বাংলা
বিভাগ : আন্তর্জাতিক
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
আলফাডাঙ্গায় চলছে হালি পেঁয়াজ লাগানোর মহোৎসব, শ্রমিকের অভাবে বাড়ছে চাষির খরচ
শ্রীনগরে পুকুর থেকে ভাসমান বৃদ্ধের লাশ উদ্ধার
কলকাতায় দেশদ্রোহী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকা চিন্ময়ের আইনজীবী এবার জাতিসংঘে যাওয়ার হুমকি দিলেন
রোববার হারিছ চৌধুরীর পুনর্দাফন
চলছে বিক্ষোভ, তারেক রহমানকে স্মারকলিপি, জবির অন্যান্য সংগঠনের প্রতিবাদ
চীনে তৈরি হবে বিশ্বের বৃহত্তম জলবিদ্যুৎ বাঁধ
কোহলির আরও বড় শাস্তি প্রাপ্য ছিল: পন্টিং
বান্দরবানে আগুন দিয়ে ১৭ ঘর পুড়ে দেয়ার সাথে জড়িত দের ছাড় দেয়া হবে না- পার্বত্য উপদেষ্টা
জাহাজ সেভেন মার্ডারের খুনি ধর্মান্তরিত ইরফানের অজানা কাহিনী
খুলনার তাবলীগ মসজিদ এলাকায় সেনাবাহিনীর টহল
দেশে কি চাঁদাবাজি বন্ধ হয়েছে? জামায়াত আমীরের প্রশ্ন
ভারতে ইসকন মন্দিরে চিন্ময়ের আইনজীবীর বৈঠক
নির্বাচনে অংশ নিতে খালেদা জিয়া-তারেক রহমানের আইনগত কোনো বাধা নেই : অ্যাটর্নি জেনারেল
শুরু হয়েছে অনির্দিষ্টকালের নৌ ধর্মঘট, বন্ধ রয়েছে পায়রা বন্দরের পণ্য খালাস কার্যক্রম
'কাঠামোর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলোকে গণতান্ত্রিক উপযোগী করলেই আমরা গণতন্ত্রকে সফল করতে পারব
ইসরাইলের বিমানবন্দরে পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হুতিদের
ভর শীতে ও গারো পাহাড় সীমান্তাঞ্চলের বিলে-ঝিলে দেখা মিলছে না অতিথি পাখির!
এ বছর আর হচ্ছে না বিজিবি-বিএসএফের বৈঠক
দীর্ঘদিন শরীর সুস্থ রাখার উপায়
গফরগাঁওয়ে ভয়াবহ ব্রহ্মপুত্র ট্রেন দুর্ঘটনা: গুরুতর আহত ১