যেভাবে বিজেপিকেই অস্বস্তিতে ফেলেছেন মোদীর নিযুক্ত সাবেক গভর্নর
১৮ এপ্রিল ২০২৩, ০৭:৫৩ এএম | আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ০১:১৭ পিএম

ভারত শাসিত জম্মু ও কাশ্মীর যখন সে দেশের পৃথক একটি রাজ্য ছিল, সেই রাজ্যের শেষ গভর্নর সত্যপাল মালিক এখন অবসরের পর বেশ কিছু বিতর্কিত মন্তব্য করে নরেন্দ্র মোদী সরকারের জন্য প্রবল অস্বস্তি ডেকে এনেছেন।
‘দ্য ওয়্যারে’র সাংবাদিক করণ থাপারকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মি মালিক দাবি করেছেন, কাশ্মীরের পুলওয়ামাতে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে যে জঙ্গী হামলায় অন্তত ৪০জন সিআরপিএফ জওয়ান নিহত হন তার জন্য প্রশাসনের নিরাপত্তা গাফিলতিই দায়ী ছিল। কিন্তু সে বিষয়ে রাজ্যের তৎকালীন গভর্নর হিসেবে তিনি যখন প্রধানমন্ত্রী মোদীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তখন তাকে চুপ থাকতে বলা হয় বলে মি মালিক সাক্ষাৎকারে দাবি করেছেন।
এমন কী ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালও তাকে এ বিষয়ে কোনও কথা বলতে নিষেধ করেছিলেন বলে মি মালিক জানান। ভিন্ন একটি প্রসঙ্গে তিনি আরও দাবি করেন দুর্নীতির মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী মোদী ‘আদৌ সিরিয়াস নন’। সত্যপাল মালিকের এই সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হওয়ার পরই ভারতের রাজনৈতিক মহলে রীতিমতো হইচই পড়ে গেছে। কংগ্রেস, আম আদমি পার্টি, তৃণমূল বা সিপিআই-য়ের মতো বিরোধী দলগুলো একযোগে এই ‘নিষ্ক্রিয়তা’ ও ‘দুর্নীতিতে প্রশ্রয়ে’র অভিযোগ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কৈফিয়ত দাবি করতে শুরু করেছে।
এদিকে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও সত্যপাল মালিকের বক্তব্যকে লুফে নিয়ে বলেছে, এর মাধ্যমে পুলওয়ামার জঙ্গী হামলা নিয়ে তাদের বক্তব্যই আরও প্রতিষ্ঠিত হল। অবশ্য পুলওয়ামার হামলা পাকিস্তান থেকে আনা আরডিএক্স ব্যবহার করেই ঘটানো বলে সত্যপাল মালিক ওই সাক্ষাৎকারে মন্তব্য করেছিলেন, সে প্রসঙ্গে রবিবার রাতে জারি করা পাকিস্তান সরকারের বিবৃতিতে কিছু বলা হয়নি। তবে সব মিলিয়ে রাজনৈতিক জীবনের শেষ প্রান্তে এসে সত্যপাল মালিক যে রীতিমতো একটা হইচই ফেলে দিয়েছেন, তাতে কোনও সংশয় নেই।
মেঘালয়ের রাজ্যপাল পদ থেকে অবসর নিয়ে গত বছরের অক্টোবর মাসে উত্তরপ্রদেশের বাগপতের কাছে নিজের গ্রামে ফিরে এসেছেন সত্যপাল মালিক। এরপর গত কয়েক মাসে তিনি কয়েকটি আঞ্চলিক ও হিন্দি চ্যানেলে এমন কিছু সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, যেগুলোকে বিজেপি সরকারের জন্য মোটেই প্রশংসাসূচক বলা যায় না। তবে করণ থাপারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি পুলওয়ামার হামলার জন্য সরাসরি অঙুল তুলেছেন সরকারের গাফিলতিকেই।
মালিক বলেছেন, সিআরপিএফ জওয়ানদের জম্মু থেকে শ্রীনগরে নিয়ে যাওয়ার জন্য বাহিনীর পক্ষ থেকে পাঁচটি এয়ারক্র্যাফট চাওয়া হয়েছিল, কারণ সড়কপথে বিরাট কনভয় নিয়ে সেনাদের ওভাবে নিয়ে যাওয়াটা খুবই ঝুঁকির। কিন্তু দিল্লিতে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও তদানীন্তন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং সে অনুরোধ রক্ষা করেননি এবং সেনাদের বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছিলেন বলে সত্যপাল মালিক মন্তব্য করেন।
পুলওয়ামায় হামলার পর এই বিষয়ে প্রথম টেলিফোন কলেই যখন তিনি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে কথা বলেন, তখন তাকে মুখ বন্ধ রাখতে বলা হয় বলে মি মালিক দাবি করেছেন। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালও তাঁকে একই নির্দেশ দেন। এমন কী, পুলওয়ামার হামলা নিয়ে মুখ খুললে তাকে বয়কট করারও হুমকি দেওয়া হয় বলে সত্যপাল মালিক জানান।
গোয়ায় রাজ্যপাল থাকাকালীন তিনি সেখানকার বিজেপি সরকারের কথিত দুর্নীতি নিয়েও প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। কিন্তু সত্যপাল মালিকের বক্তব্য অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী তাকে না কি সরাসরি জানিয়ে দেন ‘আপনার তথ্য সঠিক নয়’। ফলে দুর্নীতির মোকাবিলার প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী মোদী মুখে যা-ই বলুন, আসলে তিনি ‘মোটেও সিরিয়াস নন’ বলেও মন্তব্য করেছেন সাবেক এই রাজ্যপাল।
প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের জয়রাম রমেশ, পবন খেড়া ও সুপ্রিয়া শ্রীনাতের মতো সিনিয়র নেতানেত্রীরা শনিবারই যৌথ সাংবাদিক সম্মেলন করে এই সাক্ষাৎকারে তোলা অভিযোগগুলোর ব্যাপারে সরকারের কৈফিয়ত তলব করেছেন। জয়রাম রমেশ বলেন, “এই সরকারের নীতিই হল মিনিমাম গভর্নেন্স ও ম্যাক্সিমাম সাইলেন্স!”
পুলওয়ামা-সহ প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যুতে সরকার বিরোধী ও সমালোচকদের মুখ বন্ধ করে দেওয়ার নীতি নিয়ে চলছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। পবন খেড়া বলেন, কাশ্মীরের বিশেষ স্বীকৃতি বাতিল বা সংবিধানের ৩৭০ ধারা বিলুপ্ত করার মতো স্পর্শকাতর সময় সেখানে গভর্নরের পদে দায়িত্বে ছিলেন সত্যপাল মালিক। “এটা ধরেই নেওয়া যায় যে তিনি প্রধানমন্ত্রী মোদীর আস্থাভাজন ছিলেন। ফলে এখন তিনি যে কথাগুলো বলছেন সেটা তো উপেক্ষা করা সম্ভব নয়”, মন্তব্য করেন মি খেড়া।
পুলওয়ামাতে হামলার পর চার বছরেরও বেশি কেটে গেলেও ওই ঘটনার তদন্ত কেন শেষ হল না, কিংবা অজিত দোভাল বা রাজনাথ সিংয়ের জবাবদিহিতা কেন নিশ্চিত করা গেল না – সে প্রশ্নও তোলা হয় কংগ্রেসের পক্ষ থেকে। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী ও আম আদমি পার্টির নেতা অরবিন্দ কেজরিওয়াল মনে করিয়ে দেন, ‘বিজেপির নিজেদের লোক’ই (সত্যপাল মালিক) এখন বলছেন যে বিভিন্ন রাজ্যে দলের মুখ্যমন্ত্রীরা দুর্নীতিগ্রস্ত ... “তারা টাকা তুলছেন এবং একটা অংশ নিজেদের কাছে রেখে বাকিটা ওপরতলায় পাঠিয়ে দিচ্ছেন।”
বামপন্থী দল সিপিআইয়ের সাধারণ সম্পাদক ডি রাজা আবার বলেছেন, “এই মারাত্মক অভিযোগগুলো আসছে খোদ ঘোড়ার মুখ থেকে – যা মোদীর নেতৃত্বে জাতীয় নিরাপত্তা ও দুর্নীতির বেহাল দশা তুলে ধরছে।” সত্যপাল মালিক যে সব অভিযোগ তুলেছেন, সেগুলো নিয়ে নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু তদন্তেরও দাবি জানিয়েছেন রাজা। উত্তরপ্রদেশে পুলিশি হেফাজতে মাফিয়া তথা সাবেক রাজনীতিক আতিক আহমেদের হত্যাকান্ডের প্রসঙ্গ টেনে তৃণমূলের এমপি মহুয়া মৈত্র টুইট করেছেন, “সত্যপাল মালিকের সাক্ষাৎকার থেকে নজর ঘোরানোর জন্যই যদি আতিক আহমেদকে খুন করা হয়ে থাকে তাতে আমি এতটুকুও অবাক হব না।”
কেন বিক্ষুব্ধ সত্যপাল?
সত্যপাল মালিক ভারতের সবচেয়ে প্রবীণ ও সিনিয়র রাজনীতিবিদদের একজন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী চরণ সিংয়ের সঙ্গে রাজনৈতিক যাত্রা শুরু করে লোকদল, কংগ্রেস, জনতা দল ইত্যাদি নানা ঘাটের জল খেয়ে তিনি ২০০৪ সালে বিজেপিতে যোগ দেন। পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের এই জাঠ নেতার রাজনৈতিক জার্নি পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময়ের। ১৯৭৪ সালেই তিনি উত্তরপ্রদেশ বিধানসভার সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।
পরে ১৯৮০ থেকে ১৯৮৯ পর্যন্ত তিনি কংগ্রেসের হয়ে রাজ্যসভার এমপি ছিলেন। পরে বোফর্স কেলেঙ্কারির পর কংগ্রেস ছেড়ে ভি পি সিংয়ের জনতা দলে যোগ দেন এবং ‘৮৯র লোকসভা নির্বাচনে আলিগড় থেকে জিতে আসেন। ২০০৪ সালে বিজেপিতে যোগ দেওয়ার বেশ কয়েক বছর পর তিনি দলের জাতীয় সহ-সভাপতিও হয়েছিলেন। ২০১৪তে নরেন্দ্র মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পর তাকে জমি অধিগ্রহণ বিল পর্যালোচনার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কমিটিরও দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।
২০১৭তে সরকার তাকে বিহারের রাজ্যপাল করে পাঠায়। পরের পাঁচ বছরে তিনি একে একে জ্ম্মু ও কাশ্মীর, গোয়া ও মেঘালয়ে গভর্নরের ভূমিকায় ছিলেন – মাঝে কিছুদিন ওড়িশার রাজ্যপাল হিসেবেও দায়িত্ব সামলেছেন। কিন্তু কোনও রাজ্যেই তিনি পুরো মেয়াদ শেষ করতে পারেননি – কোনও না কোনও বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে তাঁকে বারবার বদলি হতে হয়েছে।
সত্যপাল মালিকের ক্ষোভের আসল কারণ নিয়ে স্পষ্ট ধারণা না-থাকলেও বিজেপির কোনও কোনও নেতা মনে করছেন, এই ‘হেনস্থা’র বদলা নিতেই তিনি নরেন্দ্র মোদী সরকারকে পাল্টা বিব্রত করতে চাইছেন। বস্তুত মেঘালয়ের রাজ্যপাল পদে থাকাকালীনও সত্যপাল মালিক হরিয়ানাতে রীতিমতো জনসভা করে মোদী সরকারের কৃষি নীতির তীব্র সমালোচনা করেছিলেন এবং কৃষক আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়েছিলেন। অবসরের পর নিজের জায়গায় ফিরে এসে বিজেপির নয় – বরং একজন ‘জাঠ কৃষক নেতা’ হিসেবেও তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন বলে কোনও কোনও পর্যবেক্ষক মনে করছেন।
উত্তরপ্রদেশে বিজেপির প্রতিপক্ষ সমাজবাদী পার্টি বা রাষ্ট্রীয় লোকদলের ‘মেন্টর’ হিসেবে কাজ করতেও তাঁর আপত্তি নেই, সত্যপাল মালিক সম্প্রতি একাধিক সাক্ষাৎকারে সে কথা স্পষ্ট করে দিয়েছেন। এক যুগেরও বেশি সময় বিজেপির সঙ্গে থাকলেও ওই দলের প্রতি তিনি যে এখন ক্ষুব্ধ সত্যপাল মালিক তা গোপন করছেন না – আর তারই জেরে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হচ্ছে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকারকে। সূত্র: বিবিসি।
বিভাগ : আন্তর্জাতিক
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন

সল্ট-কোহলির ঝড়ে অন্যরকম শুরু বেঙ্গালুরুর

চ্যাম্পিয়ন বিকেএসপি

‘বিদেশি’ আনছে ভারতও!

কর্ণফুলীতে বন্যহাতির আক্রমণে শিশুর মৃত্যু

কিশোরগঞ্জে স্কুল ম্যানেজিং কমিটি নিয়ে সংঘর্ষে ছাত্রদল নেতা নিহত

ঝিনাইদহে জমে উঠেছে ঈদের বাজার ক্রেতাদের ঝোঁক দেশি পোশাকে

সুশীল বিপ্লবীরা আ.লীগের পুনর্বাসন করতে চায় : রাশেদ খান

ধানমন্ডিতে নিষিদ্ধ হিজবুত তাহরীরের ৭ সদস্য রিমান্ডে

সুষ্ঠু নির্বাচন হলে ৯০% ভোট পেয়ে বিএনপি জয়লাভ করবে : কায়কোবাদ

আপন চাচাতো ভাইয়ের বিরুদ্ধে ৪ বছরের বোনকে ধর্ষণের অভিযোগ

আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত জনগণই নেবে : মাহমুদুর রহমান মান্না

টিভিতে দেখুন

অমর একুশে হল ছাত্রদলের ইফতার মাহফিল অনুষ্ঠিত

বিশ্বকাপে এক পা আর্জেন্টিনার

মোবাইল ফোন কেড়ে নেয়ায় হাফেজ ছেলের উপর্যুপরি ছুরিকাঘাতে নামাজরত অবস্থায় বাবা নিহত

‘‘রাম্বল ইন দ্য জাঙ্গল’ কিংবদন্তি জর্জ ফোরম্যান আর নেই

বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণে ঐক্যবদ্ধভাবে ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে হবে : নাসিরউদ্দীন পাটোয়ারী

৬ এপ্রিল ক্যাম্পে ফিরছেন সাবিনারা

আর্জেন্টিনা ম্যাচে ‘বেকার’ আলিসনও

ইউট্যাবের ইফতার মাহফিলে খালেদা জিয়ার সুস্থতার কামনা