ভূমধ্যসাগর পেরোতে অসংখ্য তরুণ যেভাবে জীবন বাজি রাখছে
১৩ জুলাই ২০২৩, ০২:২৪ পিএম | আপডেট: ১৩ জুলাই ২০২৩, ০২:২৪ পিএম
লাল-সাদা রঙের উদ্ধার জাহাজটি নিয়মিত ভূমধ্যসাগরে বিশাল এলাকা চষে বেড়ায়। জাহাজটি থেকে সেদিন হঠাৎ দূরে চোখে পড়লো বাতাসে ফোলানো নীল রংয়ের একটি রাবারের নৌকা। ভেতরে গাদাগাদি করে মানুষ, তাদের মাথাগুলো ঢেউয়ে ওঠানামা করছে। জাহাজে উপস্থিত ত্রাণ সংস্থা এসওএস মেডিটেরানির কর্মীরা দ্রুত মাথায় হেলমেট এবং লাইফ জ্যাকেট পরে ফেললো। কয়েকটি স্পিড বোটে উঠে তারা ঐ রাবারের নৌকাটির দিকে ছুটে গেল। তারপর এক এক করে নৌকার অভিবাসীদের স্পিডবোটে তুলে জাহাজে ওঠালো।
তাদের অধিকাংশই কিশোর-তরুণ। সিংহভাগই গাম্বিয়া থেকে আসা। ত্রিপলির কাছে লিবিয়ার উপকূলীয় শহর কাসটেলভার্দে শহর থেকে ১৫ ঘণ্টা আগে নৌকায় রওয়ানা দিয়ে ৫৪ নটিক্যাল মাইল এগিয়েছে। সবাই ক্লান্ত, অবসন্ন। তাদের কজন জানায় উদ্ধারের কিছুক্ষণ আগে নৌকার ভেতর বড় ধরনের মারামারি লেগে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। কেউ কেউ চাইছিল কপালে যাই ঘটে এগিয়ে যেতে হবে, বাকিরা চাইছিল এ-দফায় ফিরে গিয়ে আবার চেষ্টা করতে। ধস্তাধস্তির মধ্যে একজনের মোবাইল ফোন সাগরে পড়ে যায়।
তাদের একজনের গায়ে ছিল ম্যানচেস্টার সিটি ফুটবল ক্লাবের হালকা নীল টি-শার্ট। অনেকের হাতে আইফোন। কারো কারো হাতে পানির বোতল, প্যাকেট খাবার। নৌকার যাত্রীদের অনেকেই সাঁতার জানে না। তাদের সাথে রয়েছে গাড়ির টায়ারের ভেতরের ফোলানো অংশ, যাতে নৌকা যদি ডোবে, সেগুলো ধরে যেন ভেসে থাকা যায়। উদ্ধারকাজ চলার সময় তাদের মধ্যে আতংক ছড়িয়ে পড়ে কারণ দূরে হঠাৎ চোখে পড়ে লিবিয়ার উপকূল-রক্ষী বাহিনীর একটি জাহাজ। এদের অনেককেই এর আগে লিবিয়ার কোস্ট গার্ডের হাতে ধরা পড়ে ফিরে যেতে হয়েছে। আফ্রিকা থেকে সাগর-পথে অবৈধ অভিবাসন ঠেকাতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন লিবিয়ার কোস্ট গার্ডকে জাহাজ, টাকা-পয়সা এবং প্রশিক্ষণ দিয়েছে।
উদ্ধারের জন্য যাওয়া স্পিড বোটে উঠে বেশ ক'জন তরুণের মুখে হাসি ফুটে ওঠে। একজন সেলফি তুলে ফেললো। তাদের একজন পরে আমাকে বলেছে একজন উদ্ধারকারীর হাত ধরার পর তার মনে হয়েছিল, “আমি ইউরোপে ঢুকে গেছি।” স্পিডবোটে করে এই অভিবাসী দলটিকে ওসান কিং নামের উদ্ধার জাহাজে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রথমে তাদের মেডিকেল পরীক্ষা হয়, তারপর নতুন একসেট জামা-কাপড় দেওয়া হয়। সেইসাথে দেওয়া হয় প্ল্যাস্টিকের একটি ব্যাগ যার ভেতর ছির টুথব্রাশ, টুথপেস্টের মতো জিনিস। এরপর উদ্ধার জাহাজটি ইটালির কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করলে তাদেরকে দেরি না করে দ্রুত বারি বন্দরে যাওয়ার কথা বলা হয়। বারি বন্দরে পৌঁছুতে প্রায় তিনদিন লাগে।
ঝুঁকি জেনেই নৌকায় ওঠা
জাহাজের ডেকে অভিবাসীদের থাকা এবং চিকিৎসার জন্য ঘরের মতো বেশ কটি অস্থায়ী কাঠামো তৈরি করা হয়েছে। সেগুলোতে তাদের কয়েকজনের সাথে আমার কথা হয়। তাদের অনেকেই বেশ ইংরেজি বলতে পারে। তাদের যে নাম ব্যবহার করা হয়েছে সেগুলো ছদ্মনাম। এই অভিবাসীরা আমাদের কাছে স্বীকার করেছে যে এই যাত্রায় চরম ঝুঁকির কথা তারা জানতো। তাদের অনেকেই এর আগেও একাধিকবার ইউরোপ আসার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। অনেকে মরতে মরতে বেঁচে গেছে। লিবিয়ার উপকূল বাহিনী বা জেলে নৌকা তাদেরকে উদ্ধার করে তীরে নিয়ে গেছে।
“আমি এ নিয়ে সাতবার চেষ্টা করেছি,” ১৭ বছরের এক তরুণ বললো। আমি যাদের সাথে কথা বললাম তাদের প্রত্যেকেরই পরিচিতি এবং বন্ধু-বান্ধবদের কেউ না কেউ ইউরোপে আসতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছে। ক'দিন আগে গ্রিসের উপকূলের কাছে নৌকা ডুবে প্রায় ৭৫০ জনের মৃত্যুর খবরও তারা সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে জেনেছে। তারাও লিবিয়ার উপকূল থেকেই রওয়ানা হয়েছিল। একজন বললো ঐ ঘটনায় সে তার সংকল্প থেকে সরেনি। “সবার মনোভাব এমন যে - হয় ইউরোপ পৌঁছুবে, না হয় সাগরে ডুবে মরবে,” ঐ তরুণ বলে, “বিকল্প এই দুটোই।“ তার দৃঢ় বিশ্বাস, গ্রিসে ডুবে যাওয়া অভিবাসীরাও এই মনোভাব নিয়েই নৌকায় উঠেছিল। এসওএস মেডিটেরানি এই রাবারের বোটটির সন্ধান পায় ‘অ্যালার্ম ফোন’ নামে একটি জরুরি হেল্প-লাইনের মাধ্যমে যারা সাগরে দুর্গত অভিবাসী নৌকার খবর দেয়। ইউরোপীয় সীমান্ত এজেন্সি ফ্রনটেক্সও খবর দিয়েছিল।
এই অভিবাসীদের ৮০ শতাংশেরই বয়স ১৮ বছরের কম। তাদের সাথে কোনো অভিভাবক নেই। এদের অনেকেই লিবিয়া থেকে নৌকায় ওঠার কয়েক বছর আগেই পরিবার, দেশ ছেড়েছে। অনেকে বলেছে তাদের বাবা অথবা মা নেই, অথবা দু'জনের কেউই বেঁচে নেই। পরিবারের সন্তান হিসাবে প্রিয়জনদের দেখভাল করার জন্য ইউরোপে গিয়ে আয়ের তাড়না থেকে নিজের গ্রাম-শহর ছেড়ে এসেছে। এই দলটির অধিকাংশই গাম্বিয়া থেকে আসা, যে দেশটি লিবিয়ার ২,০০০ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে। গাম্বিয়া বিশ্বের অন্যতম একটি দরিদ্র দেশ। জাতিসংঘের হিসাবে, জনসংখ্যার অনুপাতে আফ্রিকার মধ্যে এই দেশটি থেকে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সবচেয়ে বেশি অভিবাসন হয়েছে। ২০১৫ সাল থেকে ২০২০ সালের মধ্যে গাম্বিয়া থেকে ৩২,০০০ মানুষ অবৈধভাবে ইউরোপে ঢুকেছে। ২০২০ থেকে ২০২২ পর্যন্তও এই প্রবণতা একই রকম ছিল।
ভূমধ্যসাগরের কেন্দ্রাঞ্চল ইউরোপে অবৈধ অভিবাসনের প্রধান রুট। ফ্রনটেক্স জানিয়েছে এ বছরের প্রথম পাঁচ মাসে নৌকা দিয়ে ইউরোপে পাড়ি দেওয়া লোকের সংখ্যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে দাঁড়ায় ৫০,৩১৮। এই সংখ্যা ২০১৭ সালের পর সবচেয়ে বেশি। এসব অভিবাসীর সবাই যে আফ্রিকার নাগরিক তা নয়। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়া, ইরান এবং আফগানিস্তান থেকেও বহু মানুষ লিবিয়া হয়ে এই রুটে ইউরোপে আসার চেষ্টা করে। আফ্রিকা থেকে বিভিন্ন পথে এরা লিবিয়ায় পৌঁছে। মানব পাচারকারীদের পয়সা দিয়ে অনেক সময় কয়েকটি দেশ পার হতে হয় তাদের।
১৮ বছরের সুমা জানায় প্রতিবেশী দেশ মালির এক দালালের সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে গাম্বিয়া থেকে তার যাত্রা শুরু। তার মাধ্যমেই আলজেরিয়া এবং লিবিয়া হয়ে ইউরোপে যাওয়ার পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়। পথিমধ্যে, সে বলে, পাচারকারীদের হাতে তাকে মারধর খেতে হয়েছে, তাকে বেঁধে রাখা হয়েছে, ঠিকমত খাবার দেওয়া হয়নি। যাদের সাথে সে লিবিয়ায় আসে, তাদের কেউই এই নৌকায় ছিল না। তার এসব কথা বিবিসির পক্ষে নিরপেক্ষভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি, তবে সবার কাহিনী কম-বেশি একইরকম।
তীরে পৌঁছুনোর আগে এই অভিবাসী কিশোর তরুণরা জাহাজের ডেকেই ফুটবল খেলেছে, তাস খেলেছে, লাউডস্পিকারে সঙ্গীতের তালে নাচানাচি করেছে। নিজেদের আনা কাপড়চোপড় সাবান দিয়ে ধুয়ে জাহাজের ওপরই শুকালো তারা। লিবিয়ায় তাদের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তারা জানায়, নৌকায় ওঠার আগের বেশ কিছুদিন তারা পাচারকারীদের ব্যবস্থাপনায় বিভিন্ন ক্যাম্পে ছিল। নৌকায় ওঠার জন্য একেক জনকে ৩,৫০০ লিবিয়ান দিনার (৫৭০ পাউন্ড) দিতে হয়েছে।
সুমার সৎ বাবা তাকে কিছু টাকা দিয়েছিল। অন্যরা জানায় পরিবার ধার-দেনা করে পয়সা জুগিয়েছে। কয়েকজন দাবি করে তারা পাচারকারীদের জন্য কাজ করে কিছু পয়সা পেয়েছে। “অমার ভাগ্য ভালো যে আমাকে কোনো টাকা দিতে হয়নি,” একজন বলে, “আমি সবকিছু জোগাড়যন্ত্র করতে মানুষটিকে (পাচারকারী) সাহায্য করেছি।“ অনেকে বলে আগে লিবিয়ার কোস্ট-গার্ডের হাতে আটক হয়ে তাদেরকে কয়েকমাস বন্দীশিবিরে থাকতে হয়েছে যেখানে তাদের ওপর অত্যাচার হয়েছে।
নৌকায় ওঠার জন্য হাতে যথেষ্ট টাকা হলেই তারা পাচারকারীদের সাথে যোগাযোগ করে। মসুমার কথায়, লোকগুলোকে বিশ্বাস করা কঠিন। “অধিকাংশ সময় তারা যা বলে আর যা করে তার মধ্যে বিরাট ফারাক।“ সে জানায় তাকে বলা হয়েছিল নৌকায় ৫৫ থেকে ৬০ জন মানুষ থাকবে। পরে সে দেখে রাবারের তৈরি ভেলার মতো বোটে ৮০ থেকে ৯০ জন। “আমরা সবকিছু ঈশ্বরের হাতে ছেড়ে দিই। সবাই জানে যত লোকই হোক, ঐ নৌকাতেই তাদের উঠতে হবে।“
আডমা নামে এক তরুণ বলে সে একবার এমন একটি নৌকায় উঠেছিল যেটিতে ১২৫ জন যাত্রী ছিল। কিছুদূর গিয়ে সেটি ডুবে গিয়েছিল। ৯৪ জন প্রাণে বেঁচেছিল যদের একজন সে। “আমি দেখেছি আমারই বন্ধুরা ডুবে মরছে। আমি তাদের কাউকে কাউকে সাহায্য করেছি, কিন্তু সবাইকে পারিনি, আমি তাকিয়ে দেখেছি তারা ডুবে যাচ্ছে।“ নৌকা যত ইটালির উপকূলের কাছ আসছিল এই তরুণদের চোখ নতুন জীবনের আশায় যেন চকচক করছিল। তবে সুমা বলে দেশের কথা, বাড়ির কথা মনে হচ্ছে তার, কিন্তু ধার করা এত টাকা খরচ করার পর বাড়িতে ফেরা “খুবই লজ্জার” হতো।
রেডক্রসের কর্মকর্তা সারা ম্যানচিনেলি – যিনি ঐ জাহাজে ছিলেন- আমাকে বলেন কোন কোন পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে তারা এখানে এসেছে তা শুনে-বুঝে, যাচাই করে তারপর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে কে এদেশে থাকার অনুমতি পাবে আর কে পাবে না। ইটালিতে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার প্রতিনিধি চিয়ারা কার্দোলেতি বলেন, অভিবাসীদের আসার সংখ্যা যেভাবে “নাটকীয়ভাবে বেড়েছে” তাতে তাদের রাখার জায়গার সংকুলান কঠিন হয়ে পড়েছে। ওদিকে, আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়ার বাসে ওঠার আগে সুমা বিদায় জানাতে পেছনে ফিরে একবার আমাদের দিকে হাত নাড়ালো। সূত্র: বিবিসি।
বিভাগ : আন্তর্জাতিক
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
যমুনার ভাঙনের মুখে আলোকদিয়াবাসীর বসতবাড়ি ও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা
কুষ্টিয়া চিনিকলসহ দেশের ৬ চিনিকল চালু হওয়ায় ভারতের দম্ভ খতম!
নোবিপ্রবির সঙ্গে নেদারল্যান্ডের ইউট্রিচ বিশ্ববিদ্যালয়ের চুক্তি স্বাক্ষর
৯ দফা দাবীতে নওগাঁয় পুলিশ সুপারের কার্যালরে সামনে শিক্ষার্থীদের অবস্থান
এলজিইডির এক প্রকল্পে ৪০ কোটি ডলার ঋণ দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক
আবাসিক হোটেলের নামে মাদকের আড্ডা
নোয়াখালীতে মসজিদের ইমাম ও খতিবকে বিদায়ী সংবর্ধনা
খুলনাকে বিদায় করে ফাইনালে মেট্রো
কালিয়াকৈরে চাঁদাবাজের হামলায় চাঁদাবাজ কালামের মৃত্যু
বিরল উপজেলা শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের দ্বি-বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত
সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত- ১
কামালপুর সড়কের ব্রিজ ভেঙ্গে মরণফাঁদ চরম দুর্ভোগে পথচারীরা
মেয়েদের ক্রিকেটে যুক্ত হলো যেসব সুযোগ-সুবিধা
বাড়ছে শীতের প্রকোপ, সাধারণের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় করণীয়
জকিগঞ্জে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে হামলার অভিযোগে যুবলীগ নেতা গ্রেফতার
খালিশপুরে শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন দ্বি-বার্ষিক সম্মেলন
যুব এশিয়া কাপজয়ীরা পাচ্ছেন আর্থিক পুরস্কার
আদমদিঘীতে বিএনপি কার্যালয় উদ্বোধন
রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ নিয়ে যা জানালেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা
গোপালগঞ্জে বিএনপির বহিস্কৃত ও আ. লীগ কর্মীদের নিয়ে বিএনপির ২ জেলা কার্যালয়