হার মানতে নারাজ মণিপুরে বিবস্ত্র করে হেনস্থার শিকার দুই নারী
০৯ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০৬ এএম | আপডেট: ০৯ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০৬ এএম
ঠিক ছয় মাস জাতিগত সহিংসতায় দীর্ণ মণিপুরে দুইজন নারীকে বিবস্ত্র করে ঘুরিয়ে গণধর্ষণ করা হয়। ওই ঘটনার ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর, এই প্রথম তারা কোনও সাংবাদিকের মুখোমুখি হয়ে নিজেদের কথা জানালেন।
ভাইরাল ভিডিওতে যে কুকি-জোমি সম্প্রদায়ের দুই নারী গ্লোরি আর মার্সিকে দেখা গিয়েছিল, তারা যেন আজ অদৃশ্যই হয়ে যেতে চান। কিন্তু তাদের কণ্ঠস্বর দৃঢ়। এই প্রথম তারা রাজি হয়েছেন কোনও সাংবাদিকের সঙ্গে দেখা করতে, যাতে নিজেদের কষ্ট আর ন্যায়বিচারের জন্য লড়াইয়ের কথা তারা সারা বিশ্বের কাছে বলতে পারেন। সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ওই ভিডিওটা দেখা খুবই পীড়াদায়ক। প্রায় এক-মিনিট লম্বা ওই ভিডিওতে দেখা যায়, মেইতেই পুরুষরা দুজন বিবস্ত্র নারীকে ঘিরে রেখেছে, ধাক্কা দিচ্ছে, জোর করে গোপনাঙ্গ স্পর্শ করছে এবং মাঠে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, যেখানে তাদের গণধর্ষণ করা হয়েছে বলে ওই দুই নারী অভিযোগ করেছেন।
ঘটনার কথা বলতে গিয়ে গ্লোরির গলা ধরে আসে। তিনি বলেন, ‘আমার সঙ্গে পশুর মতো আচরণ করা হয়েছিল। ওই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার পর বেঁচে থাকা এমনিই কঠিন ছিল। দুইমাস পরে যখন ঘটনার ভিডিও ভাইরাল হল, তখন বাঁচার ইচ্ছেটাও চলে যেতে লাগল।’ মার্সির কথায়, ‘আপনি তো জানেন ভারতীয় সমাজ কেমন, এরকম একটা ঘটনার পরে নারীদের কোন নজরে দেখা হয়। এখন আমি আমার সম্প্রদায়ের লোকদের সঙ্গেও চোখ মেলাতে পারি না। আমার ইজ্জত চলে গেছে। আমি আর কখনও আগের মতো হতে পারব না।’
ওই ভাইরাল ভিডিওটি এই নারীর যন্ত্রণা বহুগুণ বাড়িয়ে দিলেও, সেটি এমন একটি প্রমাণ সামনে এনেছে, যা মেইতেই আর কুকি-জোমি সম্প্রদায়ের মধ্যে কয়েক মাস ধরে চলা জাতিগত সহিংসতার দিকে সবার মনোযোগ আকর্ষণ করে। ভিডিওটি প্রকাশ্যে আসার পর ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয় এবং পুলিশ- প্রশাসনের পক্ষ থেকে ব্যবস্থাও নেওয়া হয়। যার ফলে বেশ কয়েকজন কুকি নারী সাহস করে এগিয়ে এসে পুলিশের কাছে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ দায়ের করেন। কিন্তু ওই ভিডিওটার ওপরে পুরো বিশ্বের নজর পড়ায় গ্লোরি-মার্সি যেন আরও কুঁকড়ে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন।
হামলার আগে গ্লোরি যে কলেজের ছাত্রী ছিলেন, সেখানে মেইতেই এবং কুকি দুই সম্প্রদায়ের ছাত্রছাত্রীরাই পড়তেন। মার্সির দিন কাটত তার দুই সন্তানের দেখাশোনা করে, তাদের লেখাপড়া করানো এবং গির্জায় গিয়ে। কিন্তু ওই ঘটনার পর এখন এই দুই নারীকে গ্রাম ছেড়ে অন্য শহরে লুকিয়ে থাকতে হচ্ছে। ভয় আর লজ্জায় তারা এখন কোনও এক শুভাকাঙ্ক্ষীর বাড়ির চার দেয়ালের মধ্যে আবদ্ধ।
মার্সি গির্জা বা স্কুলে যান না। এক আত্মীয় তার সন্তানদের নিয়ে যায় আর নিয়ে আসে। তিনি বলেন, ‘রাতে বহু কষ্টে ঘুম আসে আর দুঃস্বপ্ন দেখি। ঘর থেকে বের হতে পারি না। মানুষের সঙ্গে দেখা করতে ভয় পাই, লজ্জাও লাগে।’ ওই ঘটনার পর দুজনেই কুঁকড়ে গিয়েছেন। কাউন্সেলিং সাহায্য করলেও, ঘৃণা এবং ক্রোধ জমে আছে তাদের মনে। এখন গ্লোরি তার মেইতেই বন্ধু বা সহপাঠীদের সঙ্গে পড়া তো দূরস্থান, ওই সম্প্রদায়ের কারও মুখও দেখতে চান না। তিনি বলেন, ‘আমি আর কখনও আমার গ্রামে ফিরে যাব না। আমার বাড়ি ওখানে, আমি বেড়েও উঠেছি সেখানে। কিন্তু ওখানে থাকার অর্থ আশেপাশের গ্রামের মেইতেই লোকদের সঙ্গে মেলামেশা করা, যেটা অসম্ভব।’
মার্সিও একই কথা বিশ্বাস করেন। ‘আমি তো ভাষাটাই শুনতে চাই না’, তিনি রাগ করে টেবিলের ওপরে সজোর হাতটা রেখে বললেন। মে মাসে মণিপুরে শুরু হওয়া জাতিগত সহিংসতায় যে গ্রামগুলি প্রথম আক্রান্ত হয়েছিল, তার মধ্যে গ্লোরি আর মার্সির গ্রামও ছিল। ওই সংঘর্ষে গ্লোরি তার বাবা এবং ভাইকেও হারিয়েছেন। ‘আমি তাদের আমার চোখের সামনে মরতে দেখেছি,’ মৃদুস্বরে তিনি বলেন। গ্লোরি বলেন, প্রাণ বাঁচাতে বাবা আর ভাইয়ের দেহ মাঠে ফেলে রেখেই দৌড়তে হয়েছিল। তিনি সেখানে আর ফিরতে পারবেন না।
সহিংস আক্রমণের ঘটনার পর মেইতেই এবং কুকি সম্প্রদায় একে অন্যের এলাকায় পা রাখতে পারেন না। মণিপুর দুটি অংশে বিভক্ত। মাঝখানে পুলিশ, সেনাবাহিনী এবং উভয় সম্প্রদায়ের স্বেচ্ছাসেবকদের তৈরি চেক-পয়েন্ট। বাবা আর ভাইকে হারানোর প্রসঙ্গে গ্লোরি বলেন, ‘আমি তো এটাও জানি না ওদের দেহ কোথায় রাখা হয়েছে। নিজে গিয়ে যে খোঁজ নেব, সেটাও সম্ভব নয়। সরকারের উচিৎ ওদের দেহ আমাদের কাছে ফিরিয়ে দেয়া।’
বেদনা আর গ্লানি
হামলার সময় মার্সির স্বামী পার্শ্ববর্তী মেইতেই গ্রামের প্রধানের সঙ্গে বৈঠক করছিলেন, যেখানে শান্তি বজায় রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু গ্রামের প্রধান চলে যাওয়ার পরেই জনতা আক্রমণ করে, বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং স্থানীয় গির্জাও পুড়িয়ে দেয়। তিনি বলেছেন, ‘আমি স্থানীয় পুলিশকে ফোন করেছিলাম কিন্তু তারা বলেন যে থানাতেও হামলা হয়ে গেছে, তাই তারা এখানে এসে সাহায্য করতে পারবেন না। আমি রাস্তায় একটি পুলিশ ভ্যান দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি, কিন্তু সেখান থেকে কেউ বের হননি।’
মার্সির স্বামীর জানিয়েছেন, উত্তেজিত জনতা যখন নারীদের নিশানা করতে শুরু করে, তখন তিনি একা পড়ে যান। তিনি বলেন, ‘আমি কিছুই করতে পারিনি এটা ভেবে খুব কষ্ট আর গ্লানি হয়। আমি আমার স্ত্রী বা গ্রামবাসীদের কাউকেই বাঁচাতে পারিনি। এসব ভেবে খুব খারাপ লাগে। মনে হয়, নিজেকে শেষ করে ফেলি।’ পুলিশ বিবিসিকে জানিয়েছে, ওই ঘটনায়, ভারপ্রাপ্ত অফিসার-সহ মোট পাঁচজন পুলিশ কর্মীকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে এবং তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে।
মার্সির স্বামী বলছেন, হামলার দুই সপ্তাহ পরেই তিনি পুলিশের কাছে অভিযোগ করেছিলেন, তবে ভিডিওটি প্রকাশিত না হওয়া পর্যন্ত কোনও পদক্ষেপ নেয়া হয় নি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ওই ভিডিও প্রকাশ্যে আসার পরে মণিপুরের জাতিগত সহিংসতার প্রসঙ্গে প্রথম বক্তব্য রাখেন। ওই ঘটনায় মণিপুর পুলিশ সাতজনকে গ্রেফতার করেছে। সুপ্রিম কোর্ট তদন্তভার সিবিআইয়ের হাতে তুলে দিয়েছে। ইতিমধ্যে সাতজনের বিরুদ্ধে গণধর্ষণ ও হত্যার মামলা দায়ের করা হয়েছে।
গ্লোরি, মার্সি এবং তার স্বামী বলছেন, ভিডিওটি সামনে আসার পর বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পাঠানো মানুষের মেসেজ তাদের সাহস যুগিয়েছে। মার্সির স্বামীর কথায়, ‘ভিডিও ছাড়া কেউ সত্যিটা বিশ্বাস করত না, আমাদের কষ্টটা বুঝত না।’ মার্সির এখনও দুঃস্বপ্ন দেখেন। ভবিষ্যতের কথা ভাবতে ভয় পান। তিনি তার সন্তানদের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘সন্তানদের উত্তরাধিকারে দেওয়ার মতো কিছুই অবশিষ্ট নেই, এটা ভেবে দুশ্চিন্তা হয়।’
আক্রমণে তাদের পুরো গ্রাম ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। তারা এখন তাদের সম্প্রদায়ের সহায়তায় নতুন করে জীবন শুরু করছেন। গ্লোরি ব্যাখ্যা করেছেন যে, ওই অঞ্চলে দুই ভিন্ন সম্প্রদায়ের জন্য পৃথক প্রশাসনই হতে পারে ‘নিরাপদে এবং শান্তিপূর্ণভাবে বেঁচে থাকার’ একমাত্র উপায়। এ বিতর্কিত দাবিটি কুকি সম্প্রদায় একাধিকবার উত্থাপন করেছে এবং মেইতেই সম্প্রদায় তার বিরোধিতা করেছে। দুই পক্ষেরই নিজস্ব যুক্তি আছে। কিন্তু রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিং এই বিভাজনের বিরোধী।
গ্লোরি আর মার্সি স্থানীয় প্রশাসনকে বিশ্বাস করেন না এবং কুকি সম্প্রদায়ের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের অভিযোগও করেছেন। গ্লোরি বলেন, ‘মণিপুর সরকার আমার জন্য কিছুই করেনি। আমি মুখ্যমন্ত্রীকে বিশ্বাস করি না। তার শাসনামলে আমাদের সঙ্গে এই সব ঘটেছে।’ দুজনেই অভিযোগ করেছেন যে মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিং জাতিগত সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্থ কুকি-জোমি পরিবারগুলোর সঙ্গে কথা বলেননি বা দেখা করেননি।
বিরোধী দলগুলি বারবার মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেছে, তবে রাজ্য সরকার বৈষম্যের সমস্ত অভিযোগকে ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিয়েছে। এ অভিযোগের বিষয়গুলি উত্থাপন করা হলে মুখ্যমন্ত্রী বিবিসির সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি। তবে সম্প্রতি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস সংবাদপত্রকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে সিং বলেছিলেন যে, তিনি মেইতেই সম্প্রদায়ের পরিবারগুলির সঙ্গেও দেখা করতে যাননি এবং ‘আমার মনে বা কাজে কোনও পক্ষপাতিত্ব নেই’। সুপ্রিম কোর্ট রাজ্য সরকারকে সহিংসতায় নিহতদের চিহ্নিত করে মৃতদেহ পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করতে বলেছে।
এ বিষয়ে গ্লোরি এখনো তার আশা জিইয়ে রেখেছেন। তিনি ন্যায়বিচারে বিশ্বাসী। গ্লোরি ভবিষ্যতে অন্য কলেজে পড়াশোনা শুরু করে পুলিশ বা সেনাবাহিনীর অফিসার হওয়ার স্বপ্ন পূরণ করতে চান। তিনি বলেন, ‘যদিও এটা সবসময়ই আমার স্বপ্ন ছিল, কিন্তু হামলার পর আমি নিশ্চিত হয়েছি যে, আমাকে বৈষম্যহীনভাবে সব মানুষের জন্য কাজ করতে হবে।’ আমি যে কোনো মূল্যে ন্যায়বিচার চাই। আজ আমি এই জন্যই কথা বলছি যাতে আমার মতো অন্য কোনও নারীকে এ জাতীয় সমস্যার সম্মুখীন না হতে হয়।"
মার্সি আমার (বিবিসি সংবাদদাতার) দিকে তাকিয়ে বলছিলেন, ‘আমরা আদিবাসি নারীরা খুব শক্ত। আমরা হাল ছেড়ে দেব না।’ আমি যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়িয়েছি, ঠিক সেই সময় মার্সি বললেন যে তিনি একটি বার্তা দিতে চান। ‘আমি সব সম্প্রদায়ের মায়েদের বলতে চাই, যাই ঘটুক না কেন, তারা যেন সন্তানদের শেখান- কোনও পরিস্থিতিতেই নারীদের বেইজ্জত না করে।’ সূত্র: বিবিসি।
বিভাগ : আন্তর্জাতিক
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
সউদী আরবকে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগের আহ্বান উপদেষ্টা নাহিদের
গাজায় ইসরাইলি হামলায় নিহত আরও ৩৬
যুক্তরাষ্ট্রে গুরুত্বপূর্ণ খনিজ রফতানিতে চীনের নিষেধাজ্ঞা
বিক্ষোভের মুখে প্রত্যাহার দক্ষিণ কোরিয়ার সামরিক আইন
সিরিয়ার প্রেসিডেন্টকে সতর্ক করে যা বললেন এরদোগান
নভেম্বরে রপ্তানি আয় বেড়েছে ১৫.৬৩ শতাংশ
সৈয়দপুরে পিকআপের ধাক্কায় এক শ্রমিক নিহত
শিক্ষার্থীদের মারধর ও শিক্ষককে লাঞ্ছিত করার প্রতিবাদে শ্রমিকদের সঙ্গে খুবি শিক্ষার্থীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া
বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারতীয় ষড়যন্ত্র বরদাস্ত করা হবে না : বিক্ষোভ মিছিলে খেলাফত আন্দোলন
আগরতলায় সহকারি হাইকমিশনে উগ্রবাদীদের হামলার প্রতিবাদে চাঁদপুরে খেলাফত মজলিস বিক্ষোভ
বগুড়ায় ম্যাজিষ্ট্রেটের সিল-স্বাক্ষর জাল করার অভিযোগে ৩ প্রতারক গ্রেফতার
পিলখানা হত্যা, শাপলা চত্বরে গণহত্যা ও ২৪'র গণহত্যার বিচারের জন্য ছাত্র ঐক্যের প্রয়োজন: শিবির সভাপতি
‘কুটনীতিকদের উপর আক্রমণ করে ভারত নিজেদের অসভ্য জাতি হিসেবে পরিচয় দিয়েছে’
ষড়যন্ত্র রুখতে সরকারের পাশে থাকবে বিএনপি
ভারতীয় গণমাধ্যমে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু ইস্যু নিয়ে ব্যাপক মিথ্যা ও অপতথ্য ছড়ানোয় বিএফইউজে ও ডিইউজের উদ্বেগ
স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য
ইনকিলাব সাংবাদিকের বাসায় দুর্ধর্ষ চুরি
পঞ্চগড়ে বিএনপির আনন্দ মিছিল
অব্যবহৃত মসজিদ বা তার জায়গা সংরক্ষণ করা প্রসঙ্গে?
চা শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করুন