মেরুকরণই হাতিয়ার মোদির! ভারতে ধর্মের কার্ড খেলার ট্র্যাডিশন চলছেই
১৭ মে ২০২৪, ১১:৫৫ এএম | আপডেট: ১৭ মে ২০২৪, ১১:৫৫ এএম
নির্বাচনী প্রচারে ভারতের প্রধানমন্ত্রী যেভাবে মেরুকরণকে হাতিয়ার করছেন, তা অভাবনীয়। ভোটে নগ্নভাবে ধর্মের কার্ড খেলার জন্য বম্বে হাইকোর্ট একদা বাল ঠাকরে ও তার চিকিৎসক রমেশ প্রভুর বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নিয়েছিল। কিন্তু তা থেকে শিক্ষা কতটা নিয়েছে রাজনীতির জগৎ?
ব্যক্তিগত চিকিৎসক রমেশ প্রভুর হয়ে ভোট চাইতে গিয়ে হিন্দু-মুসলমান বিভাজন করার চেষ্টা করেছিলেন প্রয়াত শিবসেনা প্রধান বাল ঠাকরে। এই অভিযোগে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ছয় বছরের জন্য ভোটাধিকার হারিয়েছিলেন তিনি। ঠাকরেকে এই ধরনের বিভাজনমূলক প্রচারে বাধা না দেয়ায় প্রভুও ছয় বছরের জন্য ভোটাধিকার এবং ভোটে প্রার্থী হওয়ার অধিকার হারান। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাম্প্রতিক ভোটপ্রচারের উল্লেখ করে ইতিমধ্যেই বালাসাহেবের পুত্র উদ্ধব ঠাকরে প্রশ্ন তুলেছেন, কেন নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে একইরকম শাস্তির ব্যবস্থা করবে না নির্বাচন কমিশন?
১৯৮৭ সালে মহারাষ্ট্রের একটি উপনির্বাচনে ডা. রমেশ প্রভু প্রার্থী হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন বাল ঠাকরের ব্যক্তিগত চিকিৎসক। প্রভুর প্রচারে ঠাকরে নগ্নভাবে হিন্দুত্বের কার্ড খেলেছিলেন। যদিও ওই কেন্দ্রে কোনও মুসলিম প্রার্থী ছিলেন না, তবুও ঠাকরে মন্তব্য করেছিলেন, প্রভুর পরাজয় হলে হিন্দুদের বিপদ হবে। ঠাকরের বিভাজনমূলক মন্তব্যের বিরুদ্ধে বম্বে হাই কোর্টে মামলা করেছিলেন কংগ্রেস প্রার্থী প্রভাকর কুন্তে। বম্বে হাই কোর্ট প্রভুর নির্বাচন বাতিল করেছিল এবং ঠাকরের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়েছিল। মামলা সুপ্রিম কোর্টে গড়ায়। ১৯৯৫ সালে একটি ঐতিহাসিক নির্দেশে সুপ্রিম কোর্ট বম্বে হাই কোর্টের রায়কে বহাল রাখে।
সুপ্রিম কোর্টের বেঞ্চ জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের উল্লেখ করে রায়ে বলেছিল, ‘একটি রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতার এই ধরনের ভাষণে আমরা আমাদের উদ্বেগ প্রকাশ না করে থাকতে পারি না। নির্বাচনী প্রচারে একদল লোককে বোঝানোর জন্য ব্যবহৃত ভাষায় সংযমের অভাব এবং তাতে ব্যবহার করা অবমাননাকর শব্দ সত্যিই নিন্দনীয়। এই রায় শুধুমাত্র নির্বাচনী প্রচারে শালীনতা এবং নৈতিকতা বজায় রাখার জন্যই নয়, আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ হিসাবে গড়ে ওঠা মূল্যবোধ রক্ষার জন্য এবং একটি ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্যও অপরিহার্য। বর্তমান মামলায় উল্লিখিত আপত্তিকর ভাষণগুলি আমাদের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে লালিত মূল্যবোধগুলিকে পরিত্যাগ করেছে এবং এসব ভাষণে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিকে ধ্বংস করার প্রবণতা রয়েছে। আমরা প্রবল আশা নিয়ে বলছি যে আমাদের পর্যবেক্ষণ ভবিষ্যতের নির্বাচনী প্রচারে কিছুটা প্রভাব ফেলবে। সবাই সতর্ক হবে।’ (সূত্র: ‘দ্য ওয়্যার’)
তিন দশক আগে সুপ্রিম কোর্টের করা এই পর্যবেক্ষণ যে ভারতের রাজনৈতিক নেতারা বিস্মৃত হয়েছেন, তা এবারের নির্বাচনী প্রচারে বোঝাই যাচ্ছে। প্রথম দফার ভোটের পর মোদি তার প্রচারে যেভাবে মেরুকরণের হাতিয়ার প্রয়োগ করছেন, তা অভাবনীয়। উত্তর ২৪ পরগনা, হাওড়া ও হুগলিতে একই দিনে অল্প সময়ের ব্যবধানে চারটি সভায় মোদি প্রকাশ্যে হিন্দু-মুসলমান বিভাজনের রাজনীতি করেছেন বলে অভিযোগ। খোদ প্রধানমন্ত্রীর মুখে এই ধরনের ভাষা অনেককেই বিস্মিত করেছে। কংগ্রেসের ইস্তাহারে কোথাও বলা নেই যে এসসি, এসটি ও ওবিসিদের শিক্ষা এবং সরকারি চাকরিতে সংরক্ষণ তুলে দিয়ে ধর্মের ভিত্তিতে সংরক্ষণ চালু করা হবে। অথচ, ১৯৯৫ সালে করা কর্নাটক সরকারের একটি সিদ্ধান্তকে তুলে এনে মোদি সভায় বলেছেন, কংগ্রেস ওবিসিদের সংরক্ষণ মুসলিমদের দিয়ে দেবে। এক তৃণমূল বিধায়কের করা একটি বিতর্কিত ভাষণকে সামনে এনে তিনি সভায় এ রাজ্যের হিন্দুদের অবস্থা নিয়ে মন্তব্য করেছেন। যা স্তম্ভিত করেছে সবাইকে।
সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণকে সামনে রেখে নির্বাচন কমিশন কেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে এসব বিভাজন সৃষ্টিকারী প্রচারের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিচ্ছে না, সেই প্রশ্ন খুব জোরালোভাবে উঠতে শুরু করেছে। প্রধানমন্ত্রী দ্বিতীয় দফার ভোটের আগে যখন প্রচারে বলেছিলেন কংগ্রেস বড়লোকদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে মুসলিমদের মধ্যে বণ্টন করে দেবে, তখন তার বিরুদ্ধে ঘৃণাভাষণের অভিযোগ এনে নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ জানায় সিপিএম। ওই অভিযোগের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন সামান্য ভর্ৎসনার রাস্তাতেও যায়নি। কমিশনের পক্ষ থেকে একটি শোকজের চিঠি পাঠানো হয়েছিল শুধুমাত্র বিজেপি সভাপতির কাছে।
প্রশ্ন উঠেছে, কমিশন যদি এতটাই নিষ্ক্রিয় থাকে, তাহলে আদর্শ আচরণবিধি রাখার প্রয়োজনটা কোথায় রয়েছে? প্রথম দফার ভোটের ১১ দিন পর কেন ভোটদানের হার প্রকাশ করা হল? এই প্রশ্ন তোলায় কমিশন কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গের বিরুদ্ধে কড়া চিঠি দিয়েছে। কমিশন অভিযোগ তুলেছে, খাড়গে এসব প্রশ্ন তুলে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন নিয়ে সংশয় তৈরি করছেন। অথচ, কমিশন এই জবাব দিতে পারেনি, কেন ভোট শেষ হওয়ার পর ১১ দিন লাগল চূড়ান্ত ভোটের হার জানাতে? কেন্দ্রওয়াড়ি ভোটদানের হারও কমিশন প্রকাশ করতে পারেনি। এ নিয়ে বিরোধীরা প্রশ্ন তুললে, কমিশনের পক্ষ থেকে সাফাই দেয়া হয়েছে, রাজনৈতিক দলের এজেন্টদের ভোট শেষ হওয়ার পর ১৭সি সার্টিফিকেট দেয়া হয়। সেখান থেকেই তো হিসাব পাওয়া সম্ভব কোন বুথে কত ভোট পড়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক দলের দেয়া হিসাবের উপর কেন সাধারণ মানুষকে নির্ভর করতে হবে? স্বচ্ছ ও অবাধ নির্বাচনের উপর জনগণের আস্থা তৈরির দায়িত্ব তো কমিশনের। ভোট সুষ্ঠুভাবে হচ্ছে না, জনগণের মধ্যে এই ধরনের বিশ্বাস তৈরি হয়ে গেলে নির্বাচনী ব্যবস্থার উপরই নিস্পৃহতা জন্মাবে। যার জেরে ক্ষতিগ্রস্ত হবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই।
গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে কমিশনের নিরপেক্ষ অবস্থান জরুরি। এবারের ভোটের গোড়া থেকেই কমিশনের নিরপেক্ষতা রক্ষার প্রশ্নটি সামনে এলেও পরিস্থিতির কোনও পরিবর্তন হয়নি। যেভাবে কমিশনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ঘৃণাভাষণ চলছে, তা অবশ্যই ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক কাঠামোটিকে রক্ষার ক্ষেত্রে বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। সুপ্রিম কোর্টের আশা ছিল, বাল ঠাকরের মতো নেতার ছ’বছরের জন্য ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া সব রাজনৈতিক নেতাকে শিক্ষা দেবে। শীর্ষ আদালতের সেই আশা যে দুরাশাই, তা বার বার প্রমাণিত হয়ে চলেছে।
বিভাগ : আন্তর্জাতিক
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
দাবানলে আবাসন হারালেন হলিউড হিলের যেসব তারকারা
শীতার্তদের মাঝে উঞ্চতা ছড়ালো ইবি 'তারুণ্য'
আমরা খেলাধুলার ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকি- অধ্যক্ষ এখলাস উদ্দিন খান
হাসিনার উৎখাতে যুক্তরাষ্ট্রের হাত নেই এটা ভারতও বিশ্বাস করে : জ্যাক সুলিভান
আশুলিয়ায় চাঁদা না দেয়ায় চা দোকানীকে গুলি, গ্রেপ্তার ৩
সরাইলে পলিথিন উৎপাদনকারিকে কারাদণ্ড
হাজীগঞ্জে অর্ধলক্ষাধিক জনসমাগমের উপস্থিতিতে জামায়াতের কর্মী সম্মেলন
ফরিদপুরের ঐতিহ্য খেজুরের রস ও গুড় হারিয়ে যাচ্ছে
রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই ৪ আগস্ট পরবর্তী হামলা হয়েছে: প্রেস উইং
নগরকান্দায় কবরস্থানের জায়গা নিয়ে দুইপক্ষের সংঘর্ষে আহত ১৫
কুয়েট ভর্তি পরীক্ষায় উপস্থিতির হার ৯২ দশমিক ৩৯ শতাংশ
লক্ষ্মীপুরে পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেল ২ জনের, আহত ৯
বিএনপির সাথে জামায়াতের দূরত্ব নয়, বরং সু-সম্পর্ক রয়েছে: ডা. তাহের
দাউদকান্দিতে সাদপন্থীদের নিষিদ্ধের দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ
সুন্দরবন জুড়ে ফের দস্যু আতঙ্ক
আবারও ভারতীয় রুপির দরপতন
রাজবাড়ীর পদ্মায় বরশিতে ধরা পড়লো ১৬ কেজির বোয়াল মাছ
রাজবাড়ী ডিবেট এসোসিয়েশনের দ্বি-বার্ষিক কমিটি গঠন
প্রথমবারের মতো মক্কার বাইরে পবিত্র কাবার সম্পূর্ণ কিসওয়া প্রদর্শন
মেশিন দিয়ে পানি ছিটিয়ে ধুলো নিয়ন্ত্রণ করছে ভোলা পৌরসভা