মানুষ মারা ‘কসাইখানা’, প্রকাশ্যে এল সেদনায়া কারাগারের ভয়াবহ চিত্র

Daily Inqilab ইনকিলাব ডেস্ক

১১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৬:৫২ পিএম | আপডেট: ১১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৬:৫৩ পিএম

বাংলাদেশের কথিত আয়নাঘরের মতোই সিরিয়ায় সন্ধান পাওয়া গিয়েছে ‘মানব কসাইখানা’র। সিরিয়ায় সরকার পতনের পরেই খুলে দেয়া হয়েছে কুখ্যাত কারাগার সেদনায়ার ফটক! ছাড়া পেয়েছেন বছরের পর বছর ধরে বন্দি হয়ে থাকা কয়েদিরা। কী এই সেদনায়া? কী চলত সেই ‘বধ্যভূমি’র চার দেওয়ালের আড়ালে?

 

বাশার আল-আসাদের সবচেয়ে কুখ্যাত কারাগার থেকে পাওয়া ফুটেজগুলো প্রকাশ করেছে যে, সিরিয়ার স্বৈরশাসক হাজার হাজার বেসামরিক নাগরিককে আটক ও নির্যাতনের জন্য ভূগর্ভস্থ কক্ষ এবং শরীরের হাড় ভাঙার জন্য লোহার প্রেস ব্যবহার করেছিল। সিরিয়ার উদ্ধারকারী দলগুলো সোমবারও সেদনায়া কারাগারের ভূগর্ভস্থ গোলকধাঁধায় আটকে পড়া বন্দীদের কাছে পৌঁছানোর জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছিল।

 

কারাগারে পৌঁছানো প্রথম বেসামরিক ব্যক্তি এবং বিদ্রোহীদের তোলা ক্ষণস্থায়ী ভিডিও ক্লিপ - যা স্থানীয়ভাবে ‘মানব কসাইখানা’ নামে পরিচিত - আসাদ সরকারের জিজ্ঞাসাবাদ এবং আটকের ভয়াবহতা দেখাতে শুরু করে, যেখানে গণ ফাঁসি, নির্যাতন এবং যৌন নির্যাতনের কথা বলা হয়। একটি ফুটেজে একটি বড় লোহার প্রেস দেখা যায় যা হাড় ভাঙ্গা এবং বন্দীদের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল বলে মনে করা হয়, যখন অজানা নির্যাতনের পদ্ধতির জন্য ব্যবহৃত রক্তমাখা দড়ি মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখা যায়।

 

অন্যান্য বন্দীরা মুক্তির জন্য গ্রীলের ভেতর থেকে তাদের হাত-পা বের করে চিৎকার করছিল। হাঁটতে না পেরে এক ব্যক্তিকে তার ভাঙা শরীরকে কারাগারের মেঝেতে টেনে নিয়ে যেতে দেখা যায়। শেষ কয়েদিদের বাঁচানোর চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে কারণ সিসিটিভিতে দেখানো হয়েছে যে অনেক বন্দী মাটির নিচে ১০০ ফুট গভীর অন্ধকূপে আটকে আছে এবং ভারী ইলেকট্রনিক দরজার পিছনে তালাবদ্ধ রয়েছে।

 

সিরিয়ার সিভিল ডিফেন্স গ্রুপ - হোয়াইট হেলমেট নামে পরিচিত - বলেছে যে তারা বাকি বন্দীদের মুক্তি দিতে পাঁচটি ‘বিশেষায়িত জরুরী দল’ মোতায়েন করেছে, যার মধ্যে রয়েছে ‘প্রাচীর ভাঙার বিশেষজ্ঞ, লোহার দরজা খোলার ক্রু, প্রশিক্ষিত কুকুর ইউনিট এবং চিকিৎসা সেবা দানকারী’।

 

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের একটি প্রতিবেদন থেকে জানা গিয়েছে, ২০১১ সাল থেকে একের পর এক গুম-খুন এবং অমানবিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে সিরিয়ার এই কারাগারে। ইংল্যান্ডের সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইট্‌স-এর ২০২১ সালের একটি রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে, সিরিয়ার জেলগুলিতে এক লাখেরও বেশি বন্দির মৃত্যুদণ্ড কিংবা হেফাজতে মৃত্যু হয়েছে, যার মধ্যে ৩০,০০০-রও বেশি বন্দি সেদনায়ার!

 

অ্যামনেস্টির প্রতিবেদন থেকেই জানা গিয়েছে, সেদনায়ার চৌহদ্দির মধ্যে রয়েছে দু’টি পৃথক জেল। একটি লাল এবং একটি সাদা রঙের ভবন। লাল রঙের ভবনে রাখা হত সাধারণ নাগরিকদের। আর সাদা রঙের ভবনে থাকতেন সামরিক ও রাজনৈতিক বন্দিরা। আল-কাবুনের মিলিটারি ফিল্ড কোর্টে নামমাত্র বিচারের পর ফাঁসির সাজা শোনানো হত লাল ভবনের বন্দিদের। ‘বিচারপ্রক্রিয়া’ শেষ হয়ে যেত মাত্র এক থেকে তিন মিনিটের মধ্যেই। যে দিন এক এক জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হত, সেই দিনটিকে ‘পার্টি’ বলে অভিহিত করতেন কারারক্ষীরা। কখনও কখনও আবার ‘গণফাঁসি’-রও আয়োজন করা হত। তালিকায় নাম থাকা মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের এক এক করে নিয়ে আসা হত লাল ভবনের বেসমেন্টের একটি গোপন কক্ষে। সেখানে দু’তিন ঘণ্টা ধরে চলত অকথ্য অত্যাচার, মারধর। তার পর গভীর রাতে চোখ বেঁধে বন্দিদের নিয়ে যাওয়া হত সাদা ভবনের একটি নির্দিষ্ট কক্ষে। সেখানেই একসঙ্গে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেয়া হত তাদের।

 

প্রতি সপ্তাহে এক কিংবা দু’বার এই ‘পার্টি’ হত। প্রতি ‘পার্টি’-র রাতে ফাঁসি হত ২০ থেকে ৫০ জন কয়েদির। তবে এই ‘পার্টি’-র বিষয়ে ঘুণাক্ষরেও জানতে পারতেন না বন্দিদের কেউ। ফাঁসির মাত্র মিনিটখানেক আগে তাদের জানানো হত, মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে তাদের! এমনকি, লাল ভবনের কারারক্ষীরাও জানতে পারতেন না, গভীর রাতে সাদা ভবনে নিয়ে যাওয়ার পর বন্দিদের সঙ্গে কী হয়। ফাঁসির পর মৃতদেহগুলি ট্রাকে করে নিয়ে যাওয়া হত তিশরিন হাসপাতালে। সেখানে নামপরিচয় নথিভুক্তকরণের পর গণকবর দেয়া হত লাশগুলোকে। অ্যামনেস্টির দাবি, ২০১১ সাল থেকে ২০১৫ পর্যন্ত প্রায় ১৩ হাজার বন্দিকে বিনা বিচারে এ ভাবেই মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে সেদনায়ায়।

 

সেদনায়ায় বন্দিদের উপর অত্যাচারের ইতিহাসও কম নয়। বন্দিদের নির্বিচারে মারধরের পাশাপাশি চলত যৌন নির্যাতনও। কখনও কখনও এক বন্দিকে দিয়ে আর এক বন্দিকে ধর্ষণ করানো হত। এর পাশাপাশি, পর্যাপ্ত খাবার, পানি, ওষুধ— কিছুই জুটত না। অত্যাচারের সময় মুখ বেঁধে রাখা হত বন্দিদের। অকথ্য অত্যাচারের ফলে কোনও কোনও বন্দি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলতেন। রোববারই সেদনায়া থেকে মুক্তি পাওয়া এক বন্দির ভিডিও প্রকাশ্যে এসেছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, সেদনায়ার বাইরে রাস্তার ধারে গায়ে কম্বল মুড়ি দিয়ে বসে রয়েছেন শীর্ণ এক যুবক। কথাবার্তা অসংলগ্ন। অত্যাচারের চোটে ভুলেছেন নাম-ঠিকানাও। ভিডিওটি প্রকাশ্যে আসার পরেই ফের এক দফা চর্চা শুরু হয়ে গিয়েছে সিরিয়ার কুখ্যাত এই জেল নিয়ে। সূত্র: দ্য টেলিগ্রাফ।


বিভাগ : আন্তর্জাতিক


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

ইসরায়েলি বর্বর হামলায় গাজায় নিহত আরও ৩২,মানবিক সংকট চরমে

ইসরায়েলি বর্বর হামলায় গাজায় নিহত আরও ৩২,মানবিক সংকট চরমে

চাটমোহর পৌর বিএনপির কাউন্সিলে আরশেদ-তাইজুল-সিন্টু নির্বাচিত

চাটমোহর পৌর বিএনপির কাউন্সিলে আরশেদ-তাইজুল-সিন্টু নির্বাচিত

‘একদল খাইছে আরেকদল খাওয়ার জন্য রেডি হয়ে আছে’ কথাটি ছিল ভেরি জেনারেল: আজহারী

‘একদল খাইছে আরেকদল খাওয়ার জন্য রেডি হয়ে আছে’ কথাটি ছিল ভেরি জেনারেল: আজহারী

নোয়াখালীর মাইজদী হর্কাস মার্কেটে ভয়াবহ অগ্নিকান্ড

নোয়াখালীর মাইজদী হর্কাস মার্কেটে ভয়াবহ অগ্নিকান্ড

ছাত্রলীগ কর্মীকে পুলিশে দিল জাবি ছাত্রদল

ছাত্রলীগ কর্মীকে পুলিশে দিল জাবি ছাত্রদল

গরু চুরি করে বিএনপি নেতা ও তার স্ত্রীর ভূরিভোজ, অতঃপর...

গরু চুরি করে বিএনপি নেতা ও তার স্ত্রীর ভূরিভোজ, অতঃপর...

মানসিক ভারসাম্যহীন বোনকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগে ভাই আটক

মানসিক ভারসাম্যহীন বোনকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগে ভাই আটক

থানা থেকে ছিনিয়ে নেওয়া সেই যুবদল নেতা গ্রেফতার

থানা থেকে ছিনিয়ে নেওয়া সেই যুবদল নেতা গ্রেফতার

এফএ কাপে সিটির গোল উৎসব

এফএ কাপে সিটির গোল উৎসব

মাদুরোকে গ্রেপ্তারে ২৫ মিলিয়ন ডলার পুরস্কার ঘোষণা যুক্তরাষ্ট্রের

মাদুরোকে গ্রেপ্তারে ২৫ মিলিয়ন ডলার পুরস্কার ঘোষণা যুক্তরাষ্ট্রের

যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত উভয়েই একটি স্থিতিশীল বাংলাদেশ দেখতে চায় :বিদায়ী মার্কিন রাষ্ট্রদূত

যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত উভয়েই একটি স্থিতিশীল বাংলাদেশ দেখতে চায় :বিদায়ী মার্কিন রাষ্ট্রদূত

অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্যে ইরানে অস্থিরতা বাড়ছে

অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্যে ইরানে অস্থিরতা বাড়ছে

দ্রুত নির্বাচন হলে সৃষ্ট সংকট দূর হবে : মির্জা ফখরুল

দ্রুত নির্বাচন হলে সৃষ্ট সংকট দূর হবে : মির্জা ফখরুল

গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসনে নিহত আরও ২১

গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসনে নিহত আরও ২১

নিষেধাজ্ঞার কারণে যুক্তরাষ্ট্রে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি পাবে

নিষেধাজ্ঞার কারণে যুক্তরাষ্ট্রে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি পাবে

অভিশংসিত প্রেসিডেন্ট বাসভবনকে ‘দুর্গে’ পরিণত করেছেন

অভিশংসিত প্রেসিডেন্ট বাসভবনকে ‘দুর্গে’ পরিণত করেছেন

ভারতের সঙ্গে করা জনস্বার্থবিরোধী চুক্তি বাতিলের দাবি আনু মুহাম্মদের

ভারতের সঙ্গে করা জনস্বার্থবিরোধী চুক্তি বাতিলের দাবি আনু মুহাম্মদের

পাকিস্তানিদের জন্য ভিসার শর্ত শিথিল করল বাংলাদেশ

পাকিস্তানিদের জন্য ভিসার শর্ত শিথিল করল বাংলাদেশ

মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধানদের ঐক্যবদ্ধ কার্যকরী ভূমিকা সময়ের অপরিহার্য দাবি

মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধানদের ঐক্যবদ্ধ কার্যকরী ভূমিকা সময়ের অপরিহার্য দাবি

রাজনীতি হওয়া উচিত জনমানুষের কল্যাণে -বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আসলাম চৌধুরী

রাজনীতি হওয়া উচিত জনমানুষের কল্যাণে -বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আসলাম চৌধুরী