গোলান মালভূমি কী, ইসরায়েল সেখানে কী করছে?

Daily Inqilab অনলাইন ডেস্ক

১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:১১ এএম | আপডেট: ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:১১ এএম

সিরিয়া ও ইসরায়েলের মাঝখানে বাফার জোন (সংঘাতমুক্ত বিশেষ অঞ্চল) বলা হতো গোলান মালভূমিকে। কিন্তু দামেস্কে প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের পতনের পর ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী গোলানসহ আরও কয়েকটি এলাকা দখল করে নিয়েছে।

 

ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্স (আইডিএফকে) বাফার জোনে প্রবেশ করার এবং কমান্ডিং পজিশনে অবস্থান নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।

 

বাশার আল আসাদের পতনের পর ইসরায়েলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সাময়িকভাবে এই পদক্ষেপ নেওয়া হলো বলে জানিয়েছেন তিনি। তবে আরব দেশগুলো এর নিন্দা জানিয়েছে।

 

গোলান হলো সিরিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত প্রায় ১৮০০ বর্গকিলোমিটার (প্রায় ১০০০ বর্গমাইল) আয়তনের এক পাথুরে মালভূমি। এলাকাটি ইসরায়েলের উত্তর-পূর্বাঞ্চল স্পর্শ করেছে। গোলান বর্তমানে ইসরায়েলি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আছে।

 

১৯৬৭ সালে ছয় দিনের যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত লড়াইয়ের সময় গোলান মালভূমিজুড়ে ইসরায়েলের ওপর হামলা চালায় সিরিয়া। কিন্তু ইসরায়েল পাল্টা প্রতিরোধ নেয় এবং গোলানের ১২০০ বর্গকিলোমিটার (৪৬০ বর্গমাইল) এলাকা দখল করে নেয়।

 

১৯৭৩ সালে মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধের (যা ইয়োম কাপুর নামেও পরিচিত) সিরিয়া গোলানের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়।

১৯৭৪ সালে দুই দেশই অস্ত্রবিরতিতে সই করে। চুক্তির শর্ত মেনে দুই পক্ষকেই মালভূমির ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি লম্বালম্বি এলাকা ছেড়ে নিজ নিজ বাহিনীকে সরিয়ে নিতে হয়। এই এলাকাটি পরিচিত 'এরিয়া অব সেপারেশন' নামে। এরপর সেখানে জাতিসংঘ নিয়োজিত 'ডিজএনগেজমেন্ট অবজারভার ফোর্স' মোতায়েন করা হয় অস্ত্রবিরতির বিষয়টিতে নজর রাখার জন্য।

১৯৮১ সালে ইসরায়েল গোলান মালভূমিতে নিজের নিয়ন্ত্রণে এলাকার বাড়ায় এবং নতুন দখল করা ভূমিতে বসতি স্থাপনও শুরু করে।

এই এলাকায় ইসরায়েলের সার্বভৌমত্বে কখনও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মেলেনি। তবে কয়েক দশক পুরনো মার্কিন নীতি ভঙ্গ করে ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই দখলদারিত্বে স্বীকৃতি দেন।

সিরিয়া বরাবরই বলে এসেছে, ইসরায়েল গোলান মালভূমি থেকে পুরোপুরি সেনাপ্রত্যাহার না করা পর্যন্ত তারা আর কোনো শান্তি চুক্তিতে সই করবে না।

বাফার জোন উপেক্ষা করে এরিয়া অব সেপারেশনের কোনো কোনো পয়েন্ট পর্যন্ত বসতি সম্প্রসারণ করায় গত নভেম্বরে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে সিরিয়া ও জাতিসংঘ।

গোলান মালভূমি দখলে থাকার সময় ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত সিরিয়ার উত্তরঞ্চলে নিয়মিত কামানের গোলা নিক্ষেপ করতো ইসরায়েল। এছাড়া সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক গোলান থেকে মাত্র ৬০ কিলোমিটার উত্তরে, ফলে ইসরায়েলের জন্য সেখানে নজর রাখাও অনেক সহজ। সিরিয়ান সামরিক বাহিনীর নড়াচড়াও চোখে পড়ে সেখান থেকে।

এই মালভূমি সিরিয়ার হামলা থেকেও ইসরায়েলকে এক ধরনের প্রতিরক্ষা দেয়, ১৯৭৩ সালের যুদ্ধেও তারা এর সুবিধাটা পায়।

এছাড়া শুষ্ক ওই অঞ্চলে গোলান মালভূমি হচ্ছে পানির উৎস। মালভূমি বেয়ে নামা বৃষ্টির পানি যায় জর্ডান নদীতে, যেই পানি আশপাশের জমির উর্বরতা ধরে রাখে।

যে কোনো শান্তি চুক্তির জন্য সিরিয়ার মূল শর্ত হলো, ইসরায়েলকে ১৯৬৭ সালের আগের সীমান্তে ফিরে যেতে হবে। ইসরায়েল এটা মানলে গ্যালিলি সাগরের (মিঠা পানির হ্রদ) নিয়ন্ত্রণ পাবে। আরবদের মধ্যে এই হ্রদ লেক তিবেরিয়াস এবং ইসরায়েলিদের মধ্যে লেক কিনেরেত নামেও পরিচিত। কিন্তু এর নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দিলে বিশুদ্ধ পানির উৎস ইসরায়েলের হাতছাড়া হয়ে যাবে। বরং ইসরায়েলের দাবি, গোলানের ওপর দিয়ে পূর্ব দিকে তার সীমানা আরো সম্প্রসারিত হওয়া উচিত।

ইসরায়েলের জনমতও এই অঞ্চলের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার পক্ষে।

গোলান মালভূমিতে বসবাস করে কারা?
১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ইসরায়েল গোলান মালভূমি দখল করার পর অনেক সিরিয়ানকে ওই এলাকা ছেড়ে চলে যেতে হয়। এখন সেখানে ৩০টিরও বেশি ইসরায়েলি বসতি আছে। এসব বসতিতে ২০ হাজারের মতো লোক বসবাস করে।

আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী এসব বসতি বেআইনি, যদিও ইসরায়েল এটা মানতে নারাজ।

ইসরায়েলি বসতিগুলোর আশপাশ দিয়ে আরও বসবাস করছে অন্তত ২০ হাজার সিরিয় নাগরিক, যারা প্রধানত দ্রুজ সম্প্রদায়ের।

সিরিয়া বারবারই দাবি করছে এই এলাকাটির মালিক তারা এবং মালিকানা পুনরুদ্ধার করা হবে। তবে ইসরায়েলের দাবি, এই মালভূমি তাদের নিরাপত্তার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং এটা চিরকালই তাদের দখলে থাকবে।

ইসরায়েল এখন গোলান মালভূমিতে কী করছে?
প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের পতনের পর সিরিয়ার সেনারা গোলান মালভূমিতে তাদের চৌকিগুলো ছেড়ে যেতে শুরু করে। ঠিক তখনই বাফার জোন অতিক্রম করে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী।

ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলছেন, তার বাহিনী এখানে সাময়িকভাবে প্রতিরক্ষামূলক অবস্থানে থাকবে।

'সাময়িক' এই ব্যবস্থা কতদিন থাকবে তার কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, "সিরিয়ার নতুন ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে যতক্ষণ না শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপিত হয়। তবে এটা না হলে ইসরায়েল রাষ্ট্র ও এর সীমানা রক্ষার জন্য যা যা করা দরকার আমরা তার সবটাই করবো।"

সিরিয়ান সংবাদ মাধ্যমগুলো বলছে, ইসরায়েলি বাহিনী দামেস্কের ২৫ কিলোমিটারের মধ্যে চলে এসেছে, যদিও এটা স্বীকার করেনি ইসরায়েল।

সিরিয়ায় ইরায়েলের সাম্প্রতিক এসব কর্মকাণ্ডের নিন্দা জানিয়েছে আরব দেশগুলো। মিসরের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এটাকে "সিরিয়ান ভূখণ্ডের ওপর দখলদারিত্ব এবং ১৯৭৪ সালে স্বাক্ষরিত লড়াই থেকে সরে আসার চুক্তির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।"

লন্ডনের এসওএএস ইউনিভার্সিটির শিক্ষক গিলবার্ট অ্যাচকার বলেন, "সিরিয়ার দিক থেকে যাতে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার মতো কোনো ঘটনা না ঘটে সেটা ফেরানোর চেষ্টা করছে বলে দাবি করেছে ইসরায়েল। এর মধ্যে দিয়ে অন্য যে কোনো পক্ষকে সীমান্তের কাছে আসতে বাধা দিচ্ছে তারা।"

তবে অনেক বিশেষজ্ঞ ইসরায়েলের এই পদক্ষেপ নিয়ে সন্দিহান।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে লন্ডনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান চ্যাথাম হাউজের প্রফেসর ইয়োসি ম্যঅকেলবার্গ বলেন, "সিরিয়া তো বলেনি তারা বিদ্যমান চুক্তি মানবে না। ইসরায়েল প্রতিরক্ষার কথা বলে আগ বাড়িয়ে এসব পদক্ষেপ নিয়েছে, অথচ যুদ্ধের কোনো উসকানি নেই।"

লন্ডনভিত্তিক আরেক গবেষণা প্রতিষ্ঠান রয়াল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের ডক্টর এইচ এ হেলিয়ার বলেন, সিরিয়ার বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো গোলানের দখল ফিরে পেতে অচিরেই হামলা চালাবে এমন কোনো সম্ভাবনা নেই।

"তারা অভ্যন্তরীণ নানা বিষয় নিয়েই এতটা ব্যস্ত যে নতুন করে ইসরায়েলের সঙ্গে লড়াইয়ে জড়ানোর ভাবনা তাদের আসব না। খারাপ পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে বলে ইসরায়েল যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছে তা মূলত হিতে বিপরীত হতে পারে।"


বিভাগ : আন্তর্জাতিক


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

মাদুরোকে গ্রেপ্তারে ২৫ মিলিয়ন ডলার পুরস্কার ঘোষণা যুক্তরাষ্ট্রের

মাদুরোকে গ্রেপ্তারে ২৫ মিলিয়ন ডলার পুরস্কার ঘোষণা যুক্তরাষ্ট্রের

যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত উভয়েই একটি স্থিতিশীল বাংলাদেশ দেখতে চায় :বিদায়ী মার্কিন রাষ্ট্রদূত

যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত উভয়েই একটি স্থিতিশীল বাংলাদেশ দেখতে চায় :বিদায়ী মার্কিন রাষ্ট্রদূত

অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্যে ইরানে অস্থিরতা বাড়ছে

অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্যে ইরানে অস্থিরতা বাড়ছে

দ্রুত নির্বাচন হলে সৃষ্ট সংকট দূর হবে : মির্জা ফখরুল

দ্রুত নির্বাচন হলে সৃষ্ট সংকট দূর হবে : মির্জা ফখরুল

গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসনে নিহত আরও ২১

গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসনে নিহত আরও ২১

নিষেধাজ্ঞার কারণে যুক্তরাষ্ট্রে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি পাবে

নিষেধাজ্ঞার কারণে যুক্তরাষ্ট্রে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি পাবে

অভিশংসিত প্রেসিডেন্ট বাসভবনকে ‘দুর্গে’ পরিণত করেছেন

অভিশংসিত প্রেসিডেন্ট বাসভবনকে ‘দুর্গে’ পরিণত করেছেন

ভারতের সঙ্গে করা জনস্বার্থবিরোধী চুক্তি বাতিলের দাবি আনু মুহাম্মদের

ভারতের সঙ্গে করা জনস্বার্থবিরোধী চুক্তি বাতিলের দাবি আনু মুহাম্মদের

পাকিস্তানিদের জন্য ভিসার শর্ত শিথিল করল বাংলাদেশ

পাকিস্তানিদের জন্য ভিসার শর্ত শিথিল করল বাংলাদেশ

মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধানদের ঐক্যবদ্ধ কার্যকরী ভূমিকা সময়ের অপরিহার্য দাবি

মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধানদের ঐক্যবদ্ধ কার্যকরী ভূমিকা সময়ের অপরিহার্য দাবি

রাজনীতি হওয়া উচিত জনমানুষের কল্যাণে -বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আসলাম চৌধুরী

রাজনীতি হওয়া উচিত জনমানুষের কল্যাণে -বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আসলাম চৌধুরী

বিএনপির সাথে জামায়াতের দূরত্ব নয় বরং সুসম্পর্ক রয়েছে -চাঁদপুরে ডা. তাহের

বিএনপির সাথে জামায়াতের দূরত্ব নয় বরং সুসম্পর্ক রয়েছে -চাঁদপুরে ডা. তাহের

আদমদীঘিতে খালেদা জিয়ার রোগ মুক্তি কামনায় দোয়া

আদমদীঘিতে খালেদা জিয়ার রোগ মুক্তি কামনায় দোয়া

ছাত্রাবাস থেকে রুয়েট শিক্ষার্থীর লাশ উদ্ধার

ছাত্রাবাস থেকে রুয়েট শিক্ষার্থীর লাশ উদ্ধার

দেশীয় চোলাই মদের ট্রানজিট বোয়ালখালী

দেশীয় চোলাই মদের ট্রানজিট বোয়ালখালী

সোনারগাঁওয়ে বিনামূল্যে চক্ষু শিবির

সোনারগাঁওয়ে বিনামূল্যে চক্ষু শিবির

রূপগঞ্জ অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সভা, সংবর্ধনা ও বার্ষিক মিলনমেলা অনুষ্ঠিত

রূপগঞ্জ অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সভা, সংবর্ধনা ও বার্ষিক মিলনমেলা অনুষ্ঠিত

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কর্মীরাও ফ্যাসিস্ট সরকারের নিপীড়নের শিকার : অধ্যাপক মুজিবুর রহমান

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কর্মীরাও ফ্যাসিস্ট সরকারের নিপীড়নের শিকার : অধ্যাপক মুজিবুর রহমান

সাম্প্রদায়িক হামলার অভিযোগে ১১৫টি মামলা, ১০০ জন গ্রেফতার

সাম্প্রদায়িক হামলার অভিযোগে ১১৫টি মামলা, ১০০ জন গ্রেফতার

উন্মুক্ত মঞ্চে তরুণদের উচ্ছ্বাস

উন্মুক্ত মঞ্চে তরুণদের উচ্ছ্বাস