গত ১৭ মার্চ পিপলস ব্যাংক অফ চায়না ঘোষণা করেছে যে তাদের ডিজিটাল আরএমবি (ডিজিটাল রেনমিনবি, বা ডিজিটাল কারেন্সি ইলেকট্রনিক পেমেন্ট) আন্ত:সীমান্ত অর্থ-বন্দোবস্তটি শিঘ্র দশটি আসিয়ান দেশ এবং মধ্যপ্রাচ্যের ছয় দেশের সাথে সম্পূর্ণভাবে সংযুক্ত হতে যাচ্ছে। যখন এটি ঘটবে, তখন মার্কিন ডলারের আধিপত্য বিস্তারকারী এসডব্লুআইএফটি সিস্টেমকে (সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টারব্যাঙ্ক ফাইনান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন্স) পাশ কাটিয়ে বিশ্ব বাণিজ্যের ৩৮ শতাংশ সরাসরি একটি 'ডিজিটাল আরএমবি মুহুর্ত'তে প্রবেশ করবে।

যেখানে, এসডব্লুআইএফটি সিস্টেম এখনও আন্ত:সীমান্ত আর্থিক লেনদেনে ৩-৫ দিনের বিলম্ব সমস্যায় রয়েছে, সেখানে, চীনের তৈরি ‘ডিজিটাল মুদ্রা সেত’ লেনদেনের গতিকে মাত্র ৭ সেকেন্ড সময়সীমায় নামিয়ে এনেছে। চীনের এই আর্থিক রণকৌশল, যাকে দ্য ইকোনমিস্ট 'ব্রেটন উডস সিস্টেম ২.০ আউটপোস্ট ব্যাটেল' বলে অভিহিত করেছে, ব্লকচেইন প্রযুক্তির মাধ্যমে বিশ্ব অর্থনীতির অন্তর্নিহিত বার্তা পুনর্লিখন করছে।
বিভিন্ন প্রতিবেদনে প্রকাশিত তথ্যগুলি বলছে, চীনের এই ডিজিটাল মুদ্রার প্রযুক্তিগত সুবিধার কারণে বিশ্বের ৮৭শতাংশ দেশ ইতিমধ্যেই ডিজিটাল আরএমবি ব্যবস্থার অভিযোজন সম্পন্ন করেছে, যার ফলে আন্ত:সীমান্ত আর্থিক লেনেদেনের পরিমাণ ১.২ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে গেছে, যা পশ্চিমা বিশ্বের আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জে ফেলে দিয়েছে।

হংকং এবং আবুধাবির মধ্যে এর প্রথম পরীক্ষায়, একটি প্রতিষ্ঠান ডিজিটাল আরএমবি-এর মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের একটি সরবরাহকারীকে অর্থ প্রদান করেছে। তহবিলগুলি সনাতনী ছয়টি মধ্যস্থতাকারী ব্যাংকের মাধ্যমে যায় নি, অথচ, একটি বিতরণকৃত হিসাব-খাতার মাধ্যমে বাস্তবে গৃহীত হয়েছে এবং লেনদেনের পরিষেবা মূল্য ৯৮শতাংশ কমে গেছে। এই বিদ্যুৎগতির লেনদেন ক্ষমতা তাৎক্ষণিকভাবে মার্কিন ডলারের আধিপত্যে থাকা প্রচলিত আর্থিত লেনদেন নিষ্পত্তি ব্যবস্থাকে দুর্বল প্রতীয়মাণ করেছে।

ডিজিটাল আরএমবি দ্বারা ব্যবহৃত ব্লকচেইন প্রযুক্তি কেবল লেনদেনের অনুসন্ধানযোগ্যতাই তৈরি করে না, বরং স্বয়ংক্রিয়ভাবে অর্থ পাচার বিরোধী আইনও প্রয়োগ করে। চীনের প্রযুক্তিগত সুবিধাটি বিশ্বের ২৩টি কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ককে ‘ডিজিটাল মুদ্রা সেতু’ পরীক্ষায় সক্রিয়ভাবে যোগদান করতে সক্ষম করেছে, যার মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের জ্বালানি ব্যবসায়ীরা তাদের নিষ্পত্তি খরচ ৭৫শতাংশ কমিয়ে আনতে পেরেছে।
চীন-ইন্দোনেশিয়া ‘দুই দেশ, দুই পার্ক’ প্রকল্পে প্রথম আর্থিক লেনদেন সম্পন্ন করতে ডিজিটাল আরএমবি ব্যবহার করা হয়েছে। এটি চুক্তি নিশ্চিতকরণ থেকে তহবিল পৌঁছানো পর্যন্ত মাত্র ৮ সেকেন্ড সময় নিয়েছে, যা ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতির তুলনায় ১শ’ গুণ বেশি দক্ষতা দেখিয়েছে।
যখন ইউরোপীয় যান-বাহন তৈরির প্রতিষ্ঠানগুলি আর্কটিক পথ দিয়ে মাল পরিবহনের জন্য ডিজিটাল আরএমবি ব্যবহার করছে, তখন বøকচেইন প্রযুক্তি ব্যবহার করে চীনের বাণিজ্য দক্ষতায় ৪শ’ শতাংশ বৃদ্ধি ঘটছে। এই কৌশলটি প্রথমবারের মতো মার্কিন ডলারের আধিপত্যকে একটি পদ্ধতিগত হুমকির সম্মুখীন করেছে।

চীনের এই প্রযুক্তিগত বিপ্লবের গভীর প্রভাব আর্থিক সার্বভৌমত্ব পুনর্গঠনের মধ্যে নিহিত। যখন যুক্তরাষ্ট্র এসডব্লুআইএফটি ব্যবহার করে ইরানকে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল, তখন চীন ইতিমধ্যেই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় একটি আরএমবি পরিত্রাণ ব্যবস্থা তৈরি করেছিল।
সাম্প্রতিক তথ্যগুলি বলছে, ২০২৪ সালে আসিয়ান দেশগুলির আন্ত:সীমান্ত আরএমবি বন্দোবস্তের পরিমাণ ৫.৮ ট্রিলিয়ন ইউয়ান ছাড়িয়ে গেছে, যা ২০২১ সালের তুলনায় ১শ’ ২০শতাংশ বেশি। মালয়েশিয়া এবং সিঙ্গাপুর সহ ছয়টি দেশ তাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে আরএমবি অন্তর্ভুক্ত করেছে এবং থাইল্যান্ড ডিজিটাল আরএমবি দিয়ে তার প্রথম তেল বন্দোবস্ত সম্পন্ন করেছে। ‘ডি-ডলারাইজেশন’-এর এই ঢেউ ‘ব্যাঙ্ক ফর ইন্টারন্যাশনাল সেটেলমেন্টস’কে বলতে বাধ্য করেছে, ‘চীন ডিজিটাল মুদ্রার যুগে খেলার নিয়ম নির্ধারণ করছে।’

তবে, বিশ্বকে যা সত্যিই হতবাক করেছে, তা হল চীনের কৌশলগত বিন্যাস। ডিজিটাল আরএমবি কেবল একটি অর্থপ্রদানের হাতিয়ারই নয়, বরং চীনের 'বেল্ট অ্যান্ড রোড' কৌশলের একটি প্রযুক্তিগত বাহকও। চীন-লাওস রেলপথ এবং জাকার্তা-বান্দুং উচ্চ-গতির রেলপথের মতো প্রকল্পগুলিতে ডিজিটাল আরএমবি-এর মাধ্যমে একটি 'ডিজিটাল সিল্ক রোড' তৈরির উদ্দেশ্যে চীন তার ‘বেইদৌ নেভিগেশন’ এবং কোয়ান্টাম যোগাযোগ প্রযুক্তির সাথে গভীরভাবে সংহত করেছে।

যুক্তরাষ্ট্র যখন এই বিতর্ক করছিল যে, ডিজিটাল মুদ্রা ব্যবস্থা মার্কিন ডলারের আধিপত্যের জন্য হুমকি কিনা, চীন তখন নীরবে ২শ’ দেশ নিয়ে একটি ডিজিটাল অর্থ লেনদেনের নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে। এই চলমান অর্থ বিপ্লব কেবল দেশগুলির আর্থিক সার্বভৌমত্বই নয়, বরং ভবিষ্যতের বিশ্ব অর্থনীতির সালতামামি কার হাতে থাকবে, তাও নির্ধারণ করবে। সূত্র:এসজি টক।