বুদ্ধগয়া দখল করে রেখেছে হিন্দুরা, মুক্ত করতে বিক্ষোভ বৌদ্ধদের

Daily Inqilab অনলাইন ডেস্ক

২৬ মার্চ ২০২৫, ০৭:২৭ পিএম | আপডেট: ২৬ মার্চ ২০২৫, ০৭:৩৩ পিএম

 

বৌদ্ধদের পবিত্রতম স্থান বুদ্ধগয়া। প্রতিবছর সেখানে তীর্থযাত্রায় যান বৌদ্ধরা। তবে এবার তারা কেবল তীর্থযাত্রার জন্য বুদ্ধগয়াতে আসেননি। তাদের এবারের সমাবেশ সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলিতে ভারত জুড়ে ছড়িয়ে পড়া বিক্ষোভের অংশ, যা তাদের অন্যতম পবিত্র মন্দির, বৌদ্ধধর্মের মহাবিহারের নিয়ন্ত্রণ বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের কাছে হস্তান্তরের দাবিতে শুরু হয়েছে।

 

বৌদ্ধদের বিশ্বাস অনুযায়ী বুদ্ধগয়াতে গৌতম বুদ্ধ নিজে জ্ঞানার্জন করেছিলেন। গত ১২ ফেব্রুয়ারি থেকে অল ইন্ডিয়া বৌদ্ধ ফোরামের (এআইবিএফ) নেতৃত্বে বিহারের বুদ্ধগয়ায় অনির্দিষ্টকাল অনশন চালিয়ে যাচ্ছেন বৌদ্ধরা। বৌদ্ধ সন্ন্যাসী এবং অন্য বিক্ষোভকারীরা মহাবোধি মহাবিহার গেটের বাইরে বসে নীরবে নিজেদের অধিকারের জন্য প্রতিবাদ করে চলেছেন। সম্প্রতি, বিহার পুলিশ মধ্যরাতে ২৫ জন বৌদ্ধ সন্ন্যাসীকে আটকও করেছে। এই সন্ন্যাসীদের বেশিরভাগই অনশনরত ছিলেন। বিশ্বজুড়ে ধীরে ধীরে ব্যাপক ক্ষোভ জমা হচ্ছে মানুষের মধ্যে এই ঘটনার প্রেক্ষিতে। কিন্তু বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা কেন অনশনে বসেছেন, কীই বা দাবি তাদের? কেন একমাস পরেও তাদের দাবিতে কর্ণপাত করছে না মোদি সরকার?

 

এআইবিএফ-এর সভাপতি জাম্বু লামা বলছেন, ‘আমরা আসলে শান্তিপ্রিয় মানুষ, কিন্তু এখন আমরা রাস্তায় নেমে এই ধরনা দিতে বাধ্য হচ্ছি!’ কেন? মহাবোধি মহাবিহার কমপ্লেক্স, যার বাইরে বৌদ্ধ ভিক্ষুক ও বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা প্রতিবাদ করছেন, সেখানেই বোধিবৃক্ষ রয়েছে। ঐতিহাসিক বা ধর্মীয় স্মৃতিস্তম্ভ তো বটেই, এই জায়গাটি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে সবচেয়ে সম্মানিত স্থানও। ইতিহাস বলছে, অতীতে এই স্থানটি ঘন ঘন আক্রমণের শিকার হয়েছে। বৌদ্ধধর্মের ক্রমেই প্রসার ও প্রচার হতে থাকায় বিশেষ করে ব্রাহ্মণ ও উচ্চবর্ণের শাসকরা এই জায়গাটি আক্রমণ করেছে। বোধিবৃক্ষকে ধ্বংস করার একাধিক প্রচেষ্টা হয়েছিল। মহাবোধি কমপ্লেক্সের ভিতরে বর্তমান বোধিবৃক্ষটি চতুর্থ প্রজন্মের গাছ।

 

বর্তমানে বৌদ্ধরা অনশনে বসেছেন মহাবোধি মুক্তি আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে। এই আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য ‘বুদ্ধগয়া মন্দির আইন ১৯৪৯’ বাতিল করা, বৌদ্ধ ধর্মের পবিত্রতা রক্ষা করা এবং মহাবোধি মহাবিহারের পবিত্র প্রাঙ্গণ যেন শুধুমাত্র বৌদ্ধদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় তা নিশ্চিত করা। হঠাৎ এই দাবিগুলি কেন উঠছে তা বুঝতে গেলে কিছুটা পিছনে হাঁটতেই হবে। এই আইনের প্রয়োজনীয়তা ও বিশদ জানা সর্বাগ্রে প্রয়োজন।

 

বুদ্ধগয়া মন্দির আইন কী?

 

বৌদ্ধদের কাছে বুদ্ধগয়া হচ্ছে সবচেয়ে পবিত্র বৌদ্ধ স্থান। সারা বছর হাজার হাজার আন্তর্জাতিক দর্শনার্থী এবং তীর্থযাত্রীর ভিড় জমান এখানে। ১৯৪৯ সালের বুদ্ধগয়া মন্দির আইনে মহাবোধি মহাবিহার উপর অ-বৌদ্ধদের নিয়ন্ত্রণ এবং এক্তিয়ারের অনুমতি দেয়া হয়। এই আইনের পরে গঠিত হয় বুদ্ধগয়া মন্দির পরিচালনা কমিটি যেখানে হিন্দু ও বৌদ্ধ দুই ধরনের সদস্যকেই অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এখানে উল্লেখ্য, হিন্দু সদস্যদের অধিকাংশই ছিলেন উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ। কমিটির নয়জন সদস্যের মধ্যে মাত্র চারজন ছিলেন বৌদ্ধ, চারজন ছিলেন হিন্দু। আর খোদ চেয়ারম্যান ছিলেন গয়ার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, তিনিও হিন্দু।

 

এআইবিএফ-এর সভাপতি জাম্বু লামা বলেছেন, ‘আগে এই আইনে এমন একটি ধারা ছিল যাতে বলা হয়েছিল যে ম্যাজিস্ট্রেট সবসময়ই হিন্দু হওয়া উচিত। তবে পরে, ২০১২ সালে, সেই ধারাটি সরানো হয়েছিল। তারপরও, বুদ্ধগয়া মন্দির পরিচালনা কমিটিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যই থাকেন অ-বৌদ্ধ এবং বাকি চারজন বৌদ্ধ ক্ষমতাহীন, শুধুমাত্র দেখানোর জন্য তাদের কমিটিতে রাখা হয়।’

 

এআইবিএফ-এর দাবি, এই কমিটি আসলে ব্রাহ্মণ্য প্রভাবের অধীনস্থ। কমিটির উচিত ছিল বুদ্ধের শিক্ষাকে আরও ব্যাপকভাবে প্রচার করা এবং সহজলভ্য করার জন্য প্রচেষ্টা করা। উল্টে মহাবিহারে অ-বৌদ্ধ অনুশীলন এবং আচার-অনুষ্ঠানের চর্চা বাড়ানো হয়েছে, এই স্থানের পবিত্রতাকে অসম্মান করা হয়েছে এবং বৌদ্ধ বিশ্বাসকে লঙ্ঘন করা হয়েছে বলেই অভিযোগ জাম্বু লামাদের।

 

তাদের অভিযোগ, বর্তমানে যে আচারগুলির অনুশীলন হয় তার বেশিরভাগই বুদ্ধের নিজস্ব শিক্ষার বিরোধী - যেমন বিতর্কিত শিব লিঙ্গের চিহ্ন স্থাপন করা, হিন্দু আচার-অনুষ্ঠান করা, হিন্দু দেবতাদের মতো বুদ্ধের মূর্তির পুজো করা, সিল্কের পোশাক এবং উজ্জ্বল সাজে সজ্জিত বুদ্ধকে একজন শিক্ষকের পরিবর্তে অবতার হিসাবে মূর্তি করে পুজো করা।

 

জাম্বু লামা বলেছেন, ‘কমিটির সদস্যরা সবাইকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন যে মহাবোধি প্রাঙ্গণের ভিতরে শিব লিঙ্গ সবসময়ই ছিল, কিন্তু তা সত্য নয়! ৩০ বছর আগেও এমন কোনও চিত্র ছিল না। ১৯৯৬ সালে জাপানের একজন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী সুরাই সাসাই এসেছিলেন এবং তিনিই প্রথম মহাবোধি মহাবিহারের ধীরে ধীরে ব্রাহ্মণ্যকরণের কথা তুলে ধরেছিলেন।’

 

জাম্বু আরও বলছেন, ‘ইতিহাসের তথ্য বলছে, চীনা পরিব্রাজক এবং পণ্ডিত হিউয়েন সাং ৬২৯ খ্রিস্টাব্দে ভারতে এসেছিলেন, তার তখনকার লেখাগুলিতে তিনি উল্লেখ করেছিলেন যে মহাবোধি কমপ্লেক্সের অভ্যন্তরে অবলোকিতেশ্বরের একটি পাথরের মূর্তি ছাড়া অন্য কোনও ধর্মের চিহ্ন ছিল না।’

 

বুদ্ধগয়া মন্দির আইন, ১৯৪৯-এর বাস্তবায়ন ভারতীয় সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৫, ২৬, ২৯ এবং ৩০ ধারাকেও লঙ্ঘন করে। সংবিধানের এই ধারাগুলিতে ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং সংখ্যালঘু অধিকারের নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছিল। ভারতে সংখ্যালঘু হওয়া সত্ত্বেও বৌদ্ধরা নিজেদের পবিত্র স্থান পরিচালনা করা থেকেই বঞ্চিত।

 

আসলে শুধু আইনি নিয়ন্ত্রণ নয়, জড়িয়ে থাকে আর্থিক নিয়ন্ত্রণও। জাম্বু লামার কথায়, দার্শনিক বা আধ্যাত্মিক কিছুর বিষয় নয় এটা, একেবারেই টাকাপয়সার বিষয়। তার কথায়, দানপাত্রে যে এত এত টাকা আসে তা সব দখলে নেয়া হয়। এই টাকার না অডিট আছে, না কোনও নিরাপত্তা! টাকাপয়সা জড়িত না থাকলে কমিটির হিন্দু সদস্যরা অনেকদিন আগেই সব ছেড়ে চলে যেতেন।

 

ফলে নিজেদের দাবির সমর্থনে ৩০,০০০-এরও বেশি সই এবং বিশ্বব্যাপী ৫০০-রও বেশি বৌদ্ধ সংগঠনের সমর্থন সহ, এআইবিএফ ইতিমধ্যেই বিহার সরকারের কাছে একটি স্মারকলিপি জমা দিয়েছে বুদ্ধগয়া মন্দির আইন ১৯৪৯ বাতিলের দাবিতে, কিন্তু এখনও উল্লেখযোগ্য কিছুই হয়নি৷ মূলধারার মিডিয়াতেও এই আন্দোলনের কথা উঠে আসেনি তেমন।

 

এআইবিএফ বুদ্ধগয়ার পবিত্র ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে বুদ্ধগয়া মহাবোধি মহাবিহার চৈত্য ট্রাস্ট গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে। এই ট্রাস্টটি সম্পূর্ণভাবে বৌদ্ধদের দ্বারা পরিচালিত হবে। প্রশাসন, নিরাপত্তা এবং ধর্মের পবিত্রতা বজায় রাখার জন্য শুধুমাত্র বৌদ্ধ কর্মীদেরই নিয়োগ করা হবে। নতুন ট্রাস্ট শুধুমাত্র বুদ্ধের শিক্ষার প্রতি নিবেদিত কেন্দ্র তৈরি করবে, যার মধ্যে ভিক্ষুকদের প্রশিক্ষণ, সম্প্রদায় কল্যাণ পরিষেবা, ধর্ম শিক্ষা এবং ধ্যান কর্মসূচি অন্তর্ভুক্ত থাকবে। কিন্তু একমাস ধরে চলা অনশন নিয়ে সরকার তো দূর অস্ত, স্থানীয় কর্তৃপক্ষও ভ্রূক্ষেপ করেনি। ভারতে বিভিন্ন ধর্মের অস্তিত্ব অস্বীকার করে, শুধুমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মই সমস্ত মর্যাদা ছিনিয়ে নেয়ার প্রচেষ্টায় কি সরকারি মদতও নেই, উঠছে প্রশ্ন। সূত্র: আল-জাজিরা।


বিভাগ : আন্তর্জাতিক


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

আনুষ্ঠানিক বন্ধ ইউএসএআইডি
৯৫ বছরে এমন ভূমিকম্প দেখেনি থাইল্যান্ড
রাজতন্ত্রের দাবিতে নেপালে বিক্ষোভ সংঘর্ষ, সাংবাদিকসহ নিহত ২
ফিলিস্তিনপন্থি প্রতিবাদে ৩০০ শিক্ষার্থীর ভিসা বাতিল
ডিয়েগো গার্সিয়া দ্বীপকে কাজে লাগাতে পারে পেন্টাগন
আরও
X

আরও পড়ুন

এমবাপের জোড়া গোলে রিয়াল মাদ্রিদের জয়

এমবাপের জোড়া গোলে রিয়াল মাদ্রিদের জয়

দোষী প্রমাণিত হলে কি শাস্তি হতে পারে আনচেলত্তির?

দোষী প্রমাণিত হলে কি শাস্তি হতে পারে আনচেলত্তির?

আনুষ্ঠানিক বন্ধ ইউএসএআইডি

আনুষ্ঠানিক বন্ধ ইউএসএআইডি

৯৫ বছরে এমন ভূমিকম্প দেখেনি থাইল্যান্ড

৯৫ বছরে এমন ভূমিকম্প দেখেনি থাইল্যান্ড

রাজতন্ত্রের দাবিতে নেপালে বিক্ষোভ সংঘর্ষ, সাংবাদিকসহ নিহত ২

রাজতন্ত্রের দাবিতে নেপালে বিক্ষোভ সংঘর্ষ, সাংবাদিকসহ নিহত ২

ফিলিস্তিনপন্থি প্রতিবাদে ৩০০ শিক্ষার্থীর ভিসা বাতিল

ফিলিস্তিনপন্থি প্রতিবাদে ৩০০ শিক্ষার্থীর ভিসা বাতিল

নালিতাবাড়ীতে ৯৫ ড্রেজার ধ্বংস কারাদণ্ড ৩ জন কে

নালিতাবাড়ীতে ৯৫ ড্রেজার ধ্বংস কারাদণ্ড ৩ জন কে

ডিয়েগো গার্সিয়া দ্বীপকে কাজে লাগাতে পারে পেন্টাগন

ডিয়েগো গার্সিয়া দ্বীপকে কাজে লাগাতে পারে পেন্টাগন

‘রাষ্ট্র সংস্কার প্রক্রিয়ায় বাধাদানকারীদের জাতি ক্ষমা করবে না’

‘রাষ্ট্র সংস্কার প্রক্রিয়ায় বাধাদানকারীদের জাতি ক্ষমা করবে না’

নাটক প্রেম ভাই

নাটক প্রেম ভাই

নাটক লাস্ট উইশ

নাটক লাস্ট উইশ

ঈদে সায়েরা রেজার নতুন গান

ঈদে সায়েরা রেজার নতুন গান

ঈদ উপলক্ষে মুক্তি পেয়েছে অপার্থিবের প্রথম অ্যালবাম আবছা নীল কণা

ঈদ উপলক্ষে মুক্তি পেয়েছে অপার্থিবের প্রথম অ্যালবাম আবছা নীল কণা

নগরকৃষকদের নিয়ে কৃষকের ঈদ আনন্দ

নগরকৃষকদের নিয়ে কৃষকের ঈদ আনন্দ

হানিফ সংকেতের ঈদের নাটক ‘ঘরের কথা ঘরেই থাক’

হানিফ সংকেতের ঈদের নাটক ‘ঘরের কথা ঘরেই থাক’

মিয়ানমারে ভূমিকম্পে মৃতের সংখ্যা ১৬০০ ছাড়াল

মিয়ানমারে ভূমিকম্পে মৃতের সংখ্যা ১৬০০ ছাড়াল

ভূমিকম্প বিধ্বস্ত থাইল্যান্ডের রাস্তায় সন্তানের জন্ম দিলেন তরুণী

ভূমিকম্প বিধ্বস্ত থাইল্যান্ডের রাস্তায় সন্তানের জন্ম দিলেন তরুণী

তালেবানের ঘাঁটিতে ড্রোন হামলা পাকিস্তান সেনার, নিহত ১১

তালেবানের ঘাঁটিতে ড্রোন হামলা পাকিস্তান সেনার, নিহত ১১

বিক্রি হয়ে গেল এক্স, দাম উঠল ৩,৩০০ কোটি ডলার, কিনল কে?

বিক্রি হয়ে গেল এক্স, দাম উঠল ৩,৩০০ কোটি ডলার, কিনল কে?

চপলকে নিয়ে এ কেমন নাটক এনএসসির?

চপলকে নিয়ে এ কেমন নাটক এনএসসির?