মাটির গহনা

Daily Inqilab আহমেদ উল্লাহ্

০৯ মার্চ ২০২৩, ০৯:০৭ পিএম | আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ১০:৪৪ পিএম

বেশ জমে ওঠেছে মেলা!
পাঁচ বছরের মেয়েটিকে সামনে রেখে আনমনে সোহাগী দাঁড়িয়ে আছে গাছের ছায়ায়! কাপড়ের আঁচল টেনে টেনে মেয়েটি বিরক্ত করছে মেলায় নিয়ে যেতে; সেদিকে খেয়াল নেই সোহাগীর, নিঃশ্চুপ দাঁড়িয়ে কত কী ভাবছে!
ছোট্টবেলায় কতোবার এসেছিল এই মেলায়, হিসেব নেই! কখনো বাবার হাত ধরে, কখনোবা পাড়ার ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে দলবেঁধে।
দোকানে দোকানে ঘুরে ঘুরে দাম কষাকষি করে কত পন্য-সামগ্রী ক্রয় করেছে, আনন্দচিত্তে সন্দেশ খেয়েছে, মনের মতো পুতুল কিনেছে, বেলুন কিনেছে, কাচের রঙিন চুড়ি কিনেছে, কত ঘটনা-ই না ঘটেছে শ্রীমদ্দির বটতলায়...
বৈশাখের এমনই এক মেলার দিনে ¯œান করতে নদীতীরে এসে ঠায় দাঁড়িয়ে ছিল সোহাগী।
পূর্বপাড়ার সাজন এসে ওর পাশে দাঁড়িয়ে বলেছিল, কী গো সোহাগী, এইখানে খাঁড়াইয়্যা আছো ক্যান, মেলায় যাইবা না?
মুখ ফিরিয়ে তাকায় সোহাগী, মুন্সি বাড়ির মাইয়ারা মেলায় গেলে মান থাকে না।
মুচকি হেসে সামনে এসে দাঁড়িয়ে সাজন, এইডা আবার কও কী! গেরামের হগ্গলেই তো মেলায় যায়, কারোই মান যাইতে দ্যহি নাই।
বাজানে কইছ্যেÑ আমি বড় হইয়্যা গেছি। যুবতী মাইয়্যারা মেলায় গেলে লোকে মন্দ কয়।
কী যে কও, তোমারে মেলায় না দেখলে, আমার মনটা কেমন কেমন করে! হেই ছোট্টবেলা থেইক্যা তোমারে লইয়্যা মেলায় ঘুইর‌্যা বেড়াইতাম, হেইডা কি আর মন থেইক্যা যায়!
আগে কও, মেলা থেইক্যা আমারে কী কিইন্যা দিবা?
তুমি যা চাইবা, তা-ই দিমু। আমি জানি তুমি কী কিনতে বেশি পছন্দ করো।
কী?
মাটির পুতুল, গয়না, কাচের চুড়ি।
হেই কতা তোমার এহনো মনে আছে?
মইর‌্যা গেলেও ভুলমু না। চল, তাড়াতাড়ি চল... বেলা ভাটি পইড়্যা যাইত্যাছে!
দুজনে অবাধে ঘুরে বেড়ায় দোকানে দোকানে। কাঁচের চুঁড়ি কিনে সাজন নিজেই সোহাগীর হাতে পরিয়ে দিয়ে বিক্রেতার উদ্দেশ্য সাজন বলে, এই বেটা, ভালা গহনা দেখা। দোকানে ভালা পুতুল আছে তো?
দোকানদার তার দিকে তাকায়, আছে মানে! এই দ্যহেন ভালা, সুন্দর গহনাই আছে; পছন্দ কইর‌্যা নেন।
মাটির গহনা পছন্দ হচ্ছে না দেখে, দোকনিকে ধমকে ওঠে সাজন, অ্যাই বেটা, কী গহনা বিক্রি করছ, পছন্দ হয় না ক্যান? সুন্দর কইর‌্যা বানাইবার পারস না?
আমার মতন সুন্দর মাল কেউ বানাইতে পারে না, খুঁইজ্যা দ্যহেন। পছন্দ না হইলে নিজে বানাইয়্যা নিলেই পারেন।
রেগে তিড়বিড়িয়ে ওঠে সাজন, চুপ কর বেটা..! তরে আমি দ্যহাইয়্যা দ্যমু মাটির গহনা ক্যামনে বানাইতে হয়, বুঝলি?
কয়েকটি গহনা এবং পুতুল হাতে নিয়ে হেঁটে হেঁটে মুচকি হেসে সোহাগী বলল, মাটির গয়না আমার খুব পছন্দের।
নদীতে ¯œানরত কে একজন সাজনকে ডেকে বলে, সাজন, মেলায় গেছিলা নাহি?
আচমকা তাদের কথায় চির ধরে। নদীর পারে চলে এসেছে দেখে সাজন বলল, সোহাগী, আমি এহন যাই।
এক দুপুরে সোহাগীকে নিয়ে বিলে শাপলা কুড়াতে এসেছিল সাজন; ঠিক সেসময় কোত্থেকে কালী ভূঁইয়া জাল পাততে আসে বিলে। এমন নির্জন বিলে তাদের দেখে, কালী ভূঁইয়া ডেকে বলে, কী সাজন, মাইয়াপোলা লইয়া এইখ্যানে কী করতাছো?
কালী ভূইয়ার দিকে তাকিয়ে সাজন, এই আর কী..! শাপলা তুলতে আইছিলাম।
আর কোনো কথা না-বলে বৈঠা হাতে তুলে নেয় সাজন। ধীরবেগে চাপ দিয়ে বাড়ির দিকে ছুট লাগায়...
দুজনার ভালোবাসা বছর দুয়েক অতিবাহিত হয়। প্রেমের তৃণ পরিণত হয় তরুতে! ঘটনাক্রমে একথা গ্রামময় ছড়িয়ে পড়ে। মেয়ের প্রেমের কথা লোকের মুখে প্রচার হতে দেখে, মেয়েকে বিয়ে দেবার জন্য ব্যস্ত হয়ে ওঠে সোহাগীর বাবা রমজান আলী ।
দেখে-শোনে মেয়ের বিয়ে ঠিক করে বিজয়নগর গ্রামে। কথা-বার্তা পাকা হয়ে গেছে শোনে, সোহাগীর মনে প্রিয়জন হারানোর আগুন জ্বলে ওঠে! না পারে কাউকে বলতে, না পারে সইতে!
তার বিমর্ষ চেহারা দেখে, তাকে ডেকে বাবা বলেছিলেন, মা, তর কী হইছে? তর চাঁনমুখ এমন আন্ধার হইল ক্যামনে? আমারে খুইল্যা ক’তো দ্যহি!
বাবার চোখে চোখ রেখে অশ্রুভেজা কণ্ঠে সোহাগী বলেছিল, আমি কইল্যেই তো আপনি রাইগ্যা ওঠবেন।
ঈষৎ হাসি দিয়ে ওঠে রমজান আলী, তর সুখের লাইগ্যাই আমি এতকিছু করি! তুই ডরাইস না, ক, কী কইত্যে চাস?
সাময়িক নীরবতার পর আমতা আমতা করে সোহগী বলল, বাজান, আমারে বিজয়নগর বিয়া দিয়ো না।
চমকে ওঠে রমজান আলী, ক্যান? এমন ভালা সমন্ধ আমরা আর কই পামু। ছেলে দেহাশুনায় যেমন রাজপুত! লেহাপড়া আছে, আই.এ পাশ। হুনছি চাকরিও হইব। জমি-জিরাতেরও কমতি নাই। বড়ই সুখের সংসার। তুই রানীর মতন থাকবি মা।
না বাজান, মনে সুখ না থাকলে বিষয়-সম্পত্তিতে সুখ হয় না; আমারে পুবপাড়ার সাজনের লগে বিয়া দিলে, আমি সুখে থাকমু।
রেগে ওঠে রমজান আলী, সাজন! ওই হারামজাদার কতা মুখে আনবি না; আমার মান-ইজ্জত শেষ কইর‌্যা দিছে। এমন কুলাঙ্গার বেটার লগে বিয়া দিলে, তোর সুখ হইব না। ঠিকমতো ভাত-ই মিলবে না তোর..
সাজনরে, তুমি চিনো না বাজান! আমারে খুবই আদর করে, মহব্বত করে। আমার জন্য জীবন দিতে চায়। আমারে তার লগেই বিয়ার বন্দোবস্ত করো..
এই কথা আর কইছ না মা। তার না আছে লেহাপড়া, না আছে বিষয়-সম্পত্তির জোর। কী আছে তার? চার ভাইয়ের দুই শতক বাড়ি। এক শতক জমিও তো নাই। বাপে সারাদিন দোকানে চা বেইঁচ্যা দিনের খাওনও যোগাড় করতে পারে না। এমন সংসারে আমি তরে কিছুতেই বিয়া দ্যমু না। আমার মান-ইজ্জত আছে।
একথা বলেই তিনি অন্যদিকে চলে গেলেন। সোহাগী যথাস্থানে বসেই নিঃশব্দে কেঁদেছে..
কোনো এক রাতে সবাইকে ঘুমিয়ে পড়তে দেখে, সোহাগী ঘর থেকে একা বেরোয়ৃ
সাজনদের বাড়িতে গিয়ে দরজার পাশে দাড়িয়ে ফিস্ফিস শব্দে ‘সাজন.. ও সাজন’ বলে ডাকতে থাকে...
প্রতিত্তুর নেই! মশার কামড়ে গোহাল থেকে গবাদি পশুর দাপাদাপিতে আৎকে ওঠে সোহাগী!
হঠাৎ ঘুমন্ত মানুষের কর্কশ কাশীর ধ্বনিতে কেঁপে ওঠে সোহাগী। ধীরে ধীরে দুয়ার থেকে নিজেকে আড়াল করে রাখে! কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর, পূর্বের পথে বাড়িতে ফিরে আসে...
বিয়ের দুদিন আগে বেলা ডুবুডুবু অবস্থায় হঠাৎ কোত্থেকে সাজন গিয়ে হাজির হয় সোহাগীদের বাড়ি।
উন্মত্ত পাগলের মতো সোহাগীর হাত ধরে সাজন বলেছিল, সোহাগী, তুমি, আমারে ছাইড়্যা যাইয়্যো না! তুমি চইল্যা গেলে আমি পাগল হইয়্যা যামু। তুমি চল, তোমারে আইজই আমার সংসারে লইয়্যা যামু। দুনিয়ার কোনো শক্তি আমারে দমাইতে পারব না। চলো..
সোহাগী নির্বাক দাঁড়িয়ে কাঁদছে! হাত ধরে টেনে টেনে সাজন বলতে থাকে, ‘চল, খাঁড়াইয়্যা রইলা ক্যান?
মেয়ের তা ধরে টেনে ঘর থেকে বের করে নিয়ে যেতে দেখে, সোহাগীর মা অন্দর থেকে বেরিয়ে এসে চিৎকার করতে থাকে, তোমরা কে, কই আছো.. তাড়াতাড়ি আসো, আমার সোহাগীরে ধইর‌্যা লইয়্যা যাইতাছে..
ওর চিৎকারে বাড়ির সকলে উঠোনে এসে জড়ো হয়..
সোহাগীর হাত ধরে সাজনকে টানাটানি করতে দেখে, বাড়ির ছেলেরা এসেই তাকে মারধর শুরু করেÑ চড়-থাপ্পর, কিল-ঘুষি ...
লোকের মারের চোটে উঠোনে আছড়ে পড়ে সাজন। আর এমনি সোহাগীর হাত থেকে তার হাত ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল। সোহাগীর মা মেয়েকে টেনে অন্দরে নিয়ে যায়। রমজান আলী বাড়ি এসে এমন ঘৃণ্য ঘটনা শুনে সাজনকে আরও নির্দয়ভাবে বেধড়ক পেটাতে থাকে..
অবশেষে গ্রামের লোকজন ডেকে সালিশ বসিয়ে বেত্রাঘাত করে সাজনকে ছেড়ে দেয়। এরপর বিয়ে হয় সোহাগীর, অশ্রুজলে ভেসে স্বামীর বাড়িতে চলে যায় সোহাগী। সেখানকার পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে শুরু করে ধীরে ধীরে।
দুয়েক বছরের সংসার জীবনের পর স্বামীর চাকুরি হওয়ায়, স্বামীর সঙ্গে শহরে চলে যায় সোহাগী। বহুদিন পর বাপের বাড়িতে এসে মেলায় গিয়ে হাজির হয় সোহাগী। পাশে ওর মেয়েটি কাপড়ের আঁচল ধরে জোরে টেনে মেলায় নিয়ে যাবার জন্য উৎপীড়ন শুরু করলে, সম্বিৎ ফিরে পেল সোহাগী। এতক্ষণ মন্ত্র-তাড়িত হয়ে জাবর কেটেছে শৈশবের ফেলে-আসা দুঃখ বিজড়িত দিনগুলো।
অবশেষে স্থান ত্যাগ করে মেয়েটির হাত ধরে মেলায় পা বাড়ায়..
অগণিত মানুষের কোলাহল সেই আগের মতোই আছে!(অসমাপ্তি)


বিভাগ : সাহিত্য


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

কালিয়াকৈরে বিয়ের ৪দিন পর স্বামীর আত্মহত্যা

কালিয়াকৈরে বিয়ের ৪দিন পর স্বামীর আত্মহত্যা

নাশকতার মামলায় গয়েশ্বর-রিজভীসহ বিএনপির ১৭৩ নেতাকর্মীকে অব্যাহতি

নাশকতার মামলায় গয়েশ্বর-রিজভীসহ বিএনপির ১৭৩ নেতাকর্মীকে অব্যাহতি

দীর্ঘ সাড়ে ৭ বছর পর মায়ের বুকে ছেলে

দীর্ঘ সাড়ে ৭ বছর পর মায়ের বুকে ছেলে

ঘোড়াঘাটে সেনাবাহিনীর শীতবস্ত্র বিতরণ

ঘোড়াঘাটে সেনাবাহিনীর শীতবস্ত্র বিতরণ

ঢাকা জেলা উত্তর ছাত্রদলের সভাপতি তমিজ, সম্পাদক মাহফুজ

ঢাকা জেলা উত্তর ছাত্রদলের সভাপতি তমিজ, সম্পাদক মাহফুজ

নাজিরপুরে বাজার উন্নয়ন কাজ না করেই বিল তুলে নিয়েছে ঠিকাদার অংশু

নাজিরপুরে বাজার উন্নয়ন কাজ না করেই বিল তুলে নিয়েছে ঠিকাদার অংশু

বেনাপোল ইমিগ্রেশন চেকপোস্টে নেই কোনো কার্যকরী ব্যবস্থা, আতঙ্কিত স্থানীয়রা

বেনাপোল ইমিগ্রেশন চেকপোস্টে নেই কোনো কার্যকরী ব্যবস্থা, আতঙ্কিত স্থানীয়রা

শহীদ আবু সাঈদের কবরে তিন উপাচার্যের শ্রদ্ধা নিবেদন

শহীদ আবু সাঈদের কবরে তিন উপাচার্যের শ্রদ্ধা নিবেদন

রামগড়ে হত-দরিদ্রদের জন্য বিনামূল্যে  চক্ষু চিকিৎসা ক্যাম্প উদ্বোধন

রামগড়ে হত-দরিদ্রদের জন্য বিনামূল্যে  চক্ষু চিকিৎসা ক্যাম্প উদ্বোধন

লন্ডনে খালেদা জিয়াকে স্বাগত জানালেন তারেক রহমান

লন্ডনে খালেদা জিয়াকে স্বাগত জানালেন তারেক রহমান

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তিন নবজাতক জন্ম দিলেন এক গৃহবধূ

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তিন নবজাতক জন্ম দিলেন এক গৃহবধূ

একনেকে অনুমোদন পেল ৪ হাজার কোটি টাকার ১০ প্রকল্প

একনেকে অনুমোদন পেল ৪ হাজার কোটি টাকার ১০ প্রকল্প

নরসিংদীতে জুলাই ঘোষণাপত্র বিতরণ করছেন সারজিস আলম

নরসিংদীতে জুলাই ঘোষণাপত্র বিতরণ করছেন সারজিস আলম

বিডিআর জওয়ানদের মুক্তির দাবিতে যমুনা অভিমুখে পদযাত্রা, পুলিশের বাধা

বিডিআর জওয়ানদের মুক্তির দাবিতে যমুনা অভিমুখে পদযাত্রা, পুলিশের বাধা

ব্রাহ্মণপাড়ায় ডায়রিয়ার প্রকোপ শীত বাড়ছে মৌসুমি রোগবালাই

ব্রাহ্মণপাড়ায় ডায়রিয়ার প্রকোপ শীত বাড়ছে মৌসুমি রোগবালাই

এ বছর থেকেই এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বদলি শুরু : শিক্ষা উপদেষ্টা

এ বছর থেকেই এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বদলি শুরু : শিক্ষা উপদেষ্টা

স্কুলে না থেকেও বেতন নিচ্ছেন নিয়মিত

স্কুলে না থেকেও বেতন নিচ্ছেন নিয়মিত

সুপ্রিম কোর্ট বার সভাপতি মাহবুব উদ্দিন খোকনের সঙ্গে ফজল আনসারীর সাক্ষাৎ

সুপ্রিম কোর্ট বার সভাপতি মাহবুব উদ্দিন খোকনের সঙ্গে ফজল আনসারীর সাক্ষাৎ

কম্বলডা পায়া শান্তিতে ঘুমামু

কম্বলডা পায়া শান্তিতে ঘুমামু

ঈশ্বরগঞ্জে পুলিশের বিশেষ অভিযানে গ্রেফতার ১১

ঈশ্বরগঞ্জে পুলিশের বিশেষ অভিযানে গ্রেফতার ১১