আমাদের প্রাচীন পত্রিকা
৩০ মার্চ ২০২৩, ০৯:১৪ পিএম | আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ০৪:১৮ এএম
বাংলা ভাষার প্রথম পত্রিকা হলো দিগদর্শন (১৮১৭)। এই দিগদর্শন পত্রিকাটি ছিল একটি মাসিক পত্রিকা। শ্রীরামপুর মিশন থেকে জনক্লার্ক এবং মার্শম্যানের যৌথ সম্পাদনায় প্রকাশিত দিগদর্শন পত্রিকার মাধ্যমে শুরু হয় বাংলা পত্রিকার পথচলা। সাহিত্যের গতিপ্রকৃতি, ঝোঁকবদল ও বিভিন্ন সাহিত্য আন্দোলনের রেখাপাত ঘটেছে এই পত্রিকায়। এছাড়াও মানুষের ধর্ম, সমাজ, পরিবার, অর্থনীতি, রাজনীতি ও আশা-আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটেছে বিভিন্ন রচনায়-কবিতায়-প্রবন্ধে-আখ্যানে। ১৮১৮ সালের ১৪ই মে হরচন্দ্র রায় এবং গঙ্গাকিশোর ভাট্টাচার্য সম্পাদনা করেন বাঙ্গাল গেজেটি। একই সময়ে শ্রীরামপুর মিশন থেকে মার্শম্যান সম্পাদনা করেন সমাচার দর্পণ (২৩শে মে ১৮১৮)। খ্রিষ্ট ধর্মের মহিমা প্রচার করাই ছিল সমাচার দর্পণ নামের সাপ্তাহিকটির মূখ্য উদ্দেশ্য। বাঙ্গাল গেজেটি পত্রিকাটি বাংলা ভাষায় বাঙালিদের সাংবাদিকতার দ্বার উন্মোচন করে দেয়। এটিই ছিল বাঙালিদের সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে প্রথম উদ্যোগ। তবে পত্রিকাটির কোনো নমুনা পাওয়া যায়নি।
রাজা রামমোহন রায়ের উদ্যোগে এবং তারাচাঁদ দত্ত ও ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় সম্বাদকৌমুদী (১৮২১ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর)। ব্রাহ্ম সমাজের এই মুখপত্রে ধর্ম, রাস্ট্র, বিজ্ঞান, ঐশ্বরিকতা, উল্লেখযোগ্য চিঠিপত্র ও দেশ-বিদেশের খবরাখবর প্রভৃতি প্রকাশিত হতো। একই সময়ে রামমোহন রায় প্রকাশ করেন ্র ব্রাহ্মণ সেবধি ্র (১৮২১)। এই পত্রিকায় তাঁর ধর্ম ও দর্শন সংক্রান্ত অনেক রচনা প্রকাশ পায়। ১৮২২ সালের মার্চ মাসে ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রকাশ করেন ্র সমাচার চন্দ্রিকা ্র। এটি গোঁড়া হিন্দুদের মুখপত্র হিসেবে কাজ করে। এই পত্রিকায় রামমোহন রায়ের সতীদাহ প্রথা নিবারণের চেষ্টার বিরোধিতাও করা হয়।
নীলরতœ হালদারের সম্পাদনায় ১৮২৯ সালে প্রকাশিত হয় বঙ্গদূত পত্রিকা। এই সংবাদ সাপ্তাহিকটির পৃষ্ঠপোষকতা ও পরিচালনার দায়িত্বে বিভিন্ন সময়ে ছিলেন রামমোহন রায়, দ্বারকানাথ ঠাকুর প্রমূখ। সেসময়কার রাজনীতি ও অর্থনীতি সংশ্লিষ্ট বহু রচনা প্রকাশিত হয় এই পত্রিকায়। কবি ঈশ্বর গুপ্তের সম্পাদনায় ১৮৩১ সালে প্রকাশিত হয় সংবাদ প্রভাকর পত্রিকা। ১৮৩২ সালের মাঝামাঝি সময়ে পত্রিকাটির প্রকাশ বন্ধ হয়ে যায় এবং ১৮৩৬ সালে পুনরায় প্রকাশ হতে থাকে। পত্রিকাটি প্রথমে সাপ্তাহিক হিসেবে প্রকাশ হয়। পরে একদিন পরপর প্রকাশিত হয়ে ১৮৩৯ সাল থেকে দৈনিক হিসেবে প্রকাশ হতে থাকে। ভারতীয় (বাংলা) ভাষায় প্রকাশিত এটিই প্রথম দৈনিক পত্রিকা। বাংলা সাহিত্যের অনেক কালজয়ী উপন্যাসের পেছনেও এই পত্রিকার অসামান্য অবদান রয়েছে। প্রথিতযশা বহু সাহিত্যিকের আত্মপ্রকাশও ঘটেছে এই পত্রিকার পাতায়, যেমন– দীনবন্ধু মিত্র, রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। এছাড়াও ভারতচন্দ্র রায়, রামপ্রসাদ সেন, রামনিধি গুপ্তের মতো প্রখ্যাত প্রাচীন কবিদের জীবনী, বহু কবিগানের স্রষ্টা ও গায়কদের জীবনী প্রকাশ এবং সাহিত্যের পর্যালোচনা করা হতো এই পত্রিকায়। ১৮৩১ সালে দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ইয়ং বেঙ্গলের মুখপত্র সাপ্তাহিক জ্ঞানান্বেষণ ১৮৩৩ সালের প্রথম থেকে এই পত্রিকার একটি ইংরেজি সংস্করণও প্রকাশ হতে থাকে। প্রগতিবাদী চিন্তাভাবনাকে উৎসাহ প্রদানে এই পত্রিকার অশেষ অবদান রয়েছে। পত্রিকাটিতে বহু যুক্তিনির্ভর ও আধুনিক রচনা প্রকাশ করা হয়, যা সমাজকে আলোড়িত করেছিল। হিন্দু কলেজের প্রখ্যাত শিক্ষক রামচন্দ্র মিত্রের সম্পাদনায় ১৮৩১ সালে জ্ঞানোদয় প্রকাশিত হয়। এটিই জ্ঞানবিজ্ঞান বিষয়ক প্রথম বাংলা পত্রিকা। এ পত্রিকায় পুরাবৃত্ত, জীবনচরিত, প্রাণীবৃত্তান্ত ও বিজ্ঞান বিষয়ক নানা প্রবন্ধ প্রকাশিত হতো। ১৮৩২ সালে প্রকাশিত ্র বিজ্ঞান সেবধি ্র পত্রিকাও জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চায় ভূমিকা রেখেছে। ১৮৩৫ সালে ্র সংবাদ পূর্ণচন্দ্রোদয় ্র প্রকাশিত হলে জ্ঞানচর্চায় এক নতুন মাত্রার সংযোজন ঘটে। ১৮৪০ সালে ্র জ্ঞানান্বেষণ ্র পত্রিকার প্রকাশ বন্ধ হয়ে যায়। এর বছর তিনেক পর ১৮৪৩ সালের ১৬ আগস্ট মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিচালনায় ও অক্ষয়কুমার দত্তের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় “ তত্ত্ববোধিনী ্র পত্রিকা। তত্ত্ববোধিনী সভার এই মুখপত্রটিতে ধর্ম, দর্শন, বিজ্ঞান, সাহিত্য, ভূগোল, ইতিহাস, পুরাতত্ত্ব, রাজনীতি, সমাজনীতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে লেখা সুচিন্তিত রচনা প্রকাশিত হতো। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ক্ষিতিন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমূখ বিখ্যাত ব্যক্তিরা বিভিন্ন সময়ে এই পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। পত্রিকাটি তার বিচিত্র স্বাদের রচনার মাধ্যমে বাঙালি জাতির রুচি, আগ্রহ ও সৃজনশীলতাকে অনন্য উচ্চতায় পোঁছে দিয়েছিল। অনেক বিখ্যাত লেখকের লেখায় সমৃদ্ধ হয়ে প্রকাশিত হতো পত্রিকাটি। লেখক গোষ্ঠীর মধ্যে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অক্ষয়কুমার দত্ত, রাজেন্দ্রলাল মিত্র, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাজনারায়ণ বসু প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বাংলা সাহিত্যে প্রথম সচিত্র মাসিক পত্রিকা বিবিধার্থ সংগ্রহ প্রকাশিত হয় ১৮৫১ সালে। পুরাতত্ত্ববিদ ও ইতিহাসবিদ রাজেন্দ্রলাল মিত্র এটি সম্পাদনা করেন। মধুসূদন দত্তের ্র তিলোত্তমাসম্ভব কাব্যের প্রথম সর্গ প্রকাশ হয় এই পত্রিকায়। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ্র জীবনস্মৃতি গ্রন্থেও এই পত্রিকার কথা লিখে গেছেন। জ্ঞানচর্চার সঙ্গে শিল্পগত উৎকর্ষের চমৎকার সম্মিলন ঘটিয়ে ছিল বিবিধার্থ সংগ্রহ পত্রিকা। পরবর্তীকালে তারই উজ্জ্বলতর প্রকাশ পরিলক্ষিত হয় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত বঙ্গদর্শন পত্রিকায়। বিবিধার্থ সংগ্রহ ্র ও ্র বঙ্গদর্শন পত্রিকা প্রকাশের মধ্যবর্তী পর্যায়ে ১৮৫৮ সালে ্র সোমপ্রকাশ নামক সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এটি সম্পাদনা করেন দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ। বঙ্কিমচন্দ্রের সম্পাদনায় প্রকাশিত বঙ্গদর্শন পত্রিকাতেও বাঙালি মনীষার বিচ্ছুরণ ঘটেছে। এই পত্রিকার লেখকদের মধ্যে চন্দ্রনাথ বসু, রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, রামদাস সেন, চন্দ্রশেখর মুখোপাধ্যায় প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। বঙ্কিমচন্দ্রের পর কিছুদিন সঞ্জীবচন্দ্র ও কিছুদিন শ্রীশচন্দ্র এই পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৩০৯ বঙ্গাব্দে রবীন্দ্রনাথ ্র বঙ্গদর্শন ্র এর সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর সময়ে (১৩০৯-১৩১২ বঙ্গাব্দ) বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের তীব্রতা ও স্বদেশি আন্দোলনের উন্মাদনা সমাজকে তুমুলভাবে আলোড়িত করেছিল। বঙ্গদর্শন পত্রিকায় সেই যুগলক্ষণের নির্ভরযোগ্য দলিল লিপিবদ্ধ হয়েছে। ১৮৭৭ সালে প্রকাশিত হয় ্র ভারতী ্র পত্রিকা। মূলত এটি ছিল ঠাকুরবাড়ির সদস্যদের আত্মপ্রকাশের মাধ্যম। এ পত্রিকার প্রথম সম্পাদক ছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর। পরবর্তী সম্পাদকদের মধ্যে ছিলেন স্বর্ণকুমারী দেবী, হিরণ্ময়ী দেবী, সরলা দেবী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়, সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। বাংলা গদ্যরীতির বিবর্তনে বিশাল ভূমিকা ছিল এই পত্রিকার। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের লেখকগোষ্ঠী শুরু করেছিলেন বাংলা গদ্য চর্চা। তা স্বাবলম্বী হয়ে ওঠে উনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে সাময়িকপত্র প্রকাশের মধ্য দিয়ে। কোনো কোনো সাময়িক পত্রকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে শক্তিশালী লেখকগোষ্ঠী। যেমন তত্ত্ববোধিনী, বঙ্গদর্শন এবং বিংশ শতাব্দীর কল্লোল›, পরিচয়, শনিবারের চিঠি প্রভৃতির নাম উল্লেখযোগ্য।
জাতির আশা-আকাঙ্খা, ভালো-মন্দ, আনন্দ-বেদনা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, স্বপ্ন, কল্পনা সমস্ত কিছুর প্রতিফলন ঘটেছে সূচনালগ্ন থেকেই সাময়িক পত্রপত্রিকার পাতায়। যার ধারাবাহিকতা রক্ষা করে চলছে আমাদের আজকের পত্রপত্রিকা গুলোও।
বিভাগ : সাহিত্য
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
বিজয় দিবস ঘিরে নিরাপত্তা ঝুঁকি নেই স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
ইইউ রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বিএনপি নেতাদের বৈঠক
সাবেক মন্ত্রী ফারুকসহ ৫ জনের রিমান্ড আবেদন,
হাসিনাকে ফেরত না দিলে আমাদের পরের সরকার ভারতকে ক্ষমা করবে না : দ্য হিন্দুকে ড. ইউনূস
৪৪তম বিসিএসের মৌখিক পরীক্ষা বাতিল ৪৬তম প্রিলির ফল পুনরায়
সাবেক খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম গ্রেপ্তার
কানাইঘাটে গ্রুপিং কোন্দলে প্রাণ হারলেন ছাত্রদল কর্মী
শাহজালাল বিমানবন্দরের সব নিরাপত্তা পাস স্থগিত
বিএনপির দুই গ্রুপের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে আহত ১০
সড়কে ফের তিতুমীরের শিক্ষার্থীরা, ভোগান্তিতে সাধারণ মানুষ
ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ, শিক্ষক-সাংবাদিকসহ আহত ১০
প্রাইম ব্যাংক’র সাথে চুক্তি করলো কাশপিয়া গ্রুপ
আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের সাথে হজ এজেন্সি প্রতিনিধিদের মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত
গফরগাঁওয়ে বালুর নিলাম সম্পন্ন
খামেনি কোমায়! ছবি প্রকাশ করে গুজব উড়িয়ে দিল ইরান
শাহজাদপুরে নিখোঁজের ১৫ দিন পর ব্যবসায়ীর গলিত লাশ উদ্ধার
হত্যাকে পুঁজি করে চাঁদাবাজি: সালথায় ফের গ্রেপ্তার হওয়া দুই আসামির জামিন নামঞ্জুর
ব্যাংকিং ডিপ্লোমা বাধ্যতামূলক রেখেই জিএম পদে পরিক্ষা
মন্দির থেকে চুরি হওয়া শিবলিঙ্গটি উদ্ধার, যুবক গ্রেপ্তার
রাঙামাটিতে অবৈধ অটোরিকশা বন্ধের দাবি