খুনীর আংটি
৩০ মার্চ ২০২৩, ০৯:১৭ পিএম | আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ১১:৪৯ পিএম
মামাবাড়ি প্রথম কবে গিয়েছিলাম তা ভাল করে মনে নেই। তবে মামারা যে আমাকে ভালবাসে না তা নয়। ভালবাসে। প্রচ- বেশি ভালবাসে। তবে মাঝে মাঝে মনে হয়, সে ভালবাসার মাঝে একটা ফারাক রয়ে গেছে। আমি বুঝতে পারিনা সে ফারাকটা কিসের এবং কেন। মা মারা যাবার পর বড় মামীই আমাকে কোলে পিঠে করে মানুষ করছে- করে চলেছে। মা যেদিন দুনিয়া ছেড়ে চলে যায় তখন আমার বয়স নাকি চার মাস তেরো দিন। মামী বলেছে, কি না কি কারণে আমার মায়ের সাথে বাবার কথা কাটাকাটি হয়। রাগের মাথায় বাবা মাকে খুন করে লাশ গুম করে ফেলেছিল। বিচারে বাবার যাবৎজীবন সাজা হয়েছিল। সে সাজা আজো খেটে চলেছে। বাবার প্রতি আমার এক সমুদ্র ঘৃণার জন্যে তার সাথে কোনদিন দেখা পর্যন্ত করিনি- করতে ইচ্ছা হয়নি। সে অনেকবার আমার মুখটা অন্তত একবার দেখার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। আমিই রাজি হইনি। যে আমার মাকে খুন করেছে তার মুখও আমি দেখতে চাইনা।
সরকারী চাকুরীর সুবাদে বড় মামা ছিলুমবাড়িয়া গ্রাম ছেড়ে শহরে এসেছে মা খুন হবার কিছুদিন পর। গ্রামে এখন থাকে সেজো আর ছোট মামা। মেঝো মামা দশ এগারো বছর আগে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছিল; আর ফিরে আসেনি। শুনেছি সেখানে নাকি বিয়েও করেছে। দেশে আর ফিরবে বলে মনে হয় না। তার সাথে দু’একবার ফোনে কথা হয়েছে। কেমন আমি- এখন পড়াশুনা কেমন চলছে এর বেশি কিছু নয়। সেঝে আর ছোট মামা আমাকে বেশি ভালবাসে। যখন শহরে আসে তখন গ্রাম থেকে আম, লিচু, পেয়ারা বস্তা ভরে নিয়ে আসে আমাদের জন্যে ।
যখন বড় মামার বাসায় থাকতাম তখন তাদের সাথে বছরে দু’চার বার দেখা হতো। ক্লাস সিক্স-এ ওঠার পর কেন জানি অদৃশ্য কারণে মামা আমাকে একদিন ডেকে বললেন, ‘স্কুলটা বেশ দূরে; তাছাড়া আমি সারাদিন ব্যস্ত থাকি...’ মামা একটু থেমে বললেন, ‘কী করে যে কথাটা তোকে বলি?’ আমি মামাকে বললাম, ‘কি হয়েছে মামা? কোন সমস্যা?’
মামা আমতা আমতা করে বললেন, ‘তুই যদি আবার বিষয়টাকে অন্য ভাবে নিস?’ আমার বয়স সবেমাত্র দশ। সবকিছু হয়তো সঠিকভাবে বুঝতে নাও পারি। তবে আমার বয়সকে উপেক্ষা করে মামা আমার সামনে কঠিন সত্যটা বলতে দ্বিধাবোধ করছে দেখে নিজেকে অপরাধী মনে হয়। বললাম, ‘বলোনা মামা কী হয়েছে?’ ‘হোস্টেলে থেকে পড়াশুনা করতে পারবি?’
‘হোস্টেল কি মামা?’ বোকার মতো প্রশ্ন করি মামাকে। আসলে হোস্টেল সম্পর্কে তখন কিছুই জানতাম না। ‘বাড়ির মতোই। সেখানে থেকে পড়াশুনা করতে হয়। শুধুমাত্র স্কুল লম্বা ছুটি দিলেই বাড়ি আসা যায়।’
মামার জমজ দুই ছেলে। তারা আমার দুই বছরের ছোট। বুঝতে পারছিলাম মামা-মামী আমাকে বোঝা মনে করে দূরে সরিয়ে দিতে চাইছে। তবে আমি এও জানতাম, আমার মা নেই; আর বাবা থেকেও নেই। তাইতো কোন আগে পিছে না ভেবে সেদিন রাজি হয়েছিলাম। সবকিছু না বুঝলেও এটুকু অন্তত বুঝতে পেরেছিলাম আমার জন্যে তাদের সংসারে অশান্তি আসতে শুরু করেছে। পরদিনই মামা আমাকে হোস্টেলে রেখে আসেন। আমি মনে মনে মাস খানেক খুব কেঁদেছিলাম। যে কান্নার আওয়াজ মামা-মামীর কান পর্যন্ত পৌঁছায় না। শুনেছিল শুধুমাত্র আমার সহপাঠীরা; যারা আমাকে চিনতে শিখেছিল- জানতে শিখেছিল।
ক্লাস সেভেন পার হয়ে এইটে উঠেছি এবছর। মামা মাঝে মাঝে হোস্টেলে আমাকে দেখতে এলেও মামী কোনদিন আসেনি। তাতে আমি কষ্ট পাই না। বাড়ি তার কত কাজ! বাড়ির সব কাজ তাকেইতো সামলাতে হয় তা আমি ভাল করেই জানি। মামী আমার খোঁজ খবর না রাখলেও মামা রাখে এর চেয়ে বেশি আমার চাওয়া নয়। একদিনের বেশি ছুটি হলেই মামার বাসায় যাই। মামাতো ভাইদের সাথে আড্ডা দিই। তখন সময় কিভাবে পার হয় বুঝতেই পারিনা। অথচ স্কুলে আমার যেন সময়ই কাটতে চায় না। মামী আমার সাথে আগের মতো কথা বলে না। কেন বলে না জানিনা। তার কাছে কখনও জানতে চাইনি, ‘আমি কি কোন অপরাধ করেছি মামী? নিজের ছেলের মতো আমাকে যেভাবে ভালবাসতে-আদর করতে, মুখে তুলে খাওয়াতে; কই এখনতো তার কিছুই নেই?’
মাঝে মাঝে মায়ের কথা বড় বেশি মনে পড়ে। তাঁর মুখটা আমার মনে নেই। তবে মনের মাঝে তাঁর মুখটা আমি এঁকে রেখেছি অত্যন্ত স্বচ্ছতায়। ইদানিং প্রায় রাতে স্বপ্নে দেখি মাকে। সাদা শাড়ী পরা মা আমাকে ছুঁতে যায়। পারে না। দূরে একটা ভাঙা মন্দিরে দাঁড়িয়ে থেকে অপলক তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। কিছু একটা বলতে চাইলেও তাঁর কথা আমার কান পর্যন্ত পৌঁছায় না। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মাকে মনে হয় যোজন যোজন দূরে দাঁড়িয়ে আছে। আমি মা মা বলে চিৎকার করি। অথচ কোন এক অদৃশ্য শক্তি আমার মুখ থেকে শব্দ বের হতে দেয় না। ঘুম ভেঙে গেলে অঝোর ধারায় কাঁদি। মামা বাড়ি থাকলে মামা-মামী আর হোস্টেলে থাকলে সহপাঠীরা উঠে এসে জিজ্ঞাসা করে, ‘কি হয়েছে?’ কাউকে কিছু বলি না। স্বপ্নের কথা বলে দিলে যদি মা আর না আসে।
প্রতি রাতে অপেক্ষায় থাকি মায়ের। কখন আসবে মা। যখন চোখে ঘুম জুড়ে আসে তখন প্রতিক্ষিত মা আসে নিঃশব্দে। সেভাবে ভাঙা মন্দিরের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকে। কিছু একটা বলতে চায়। বরাবরের মতো তাঁর কথা আমার কান পর্যন্ত পৌঁছায় না। ঘুম ভেঙে গেলে আমি কাঁদি- কেঁদে কেঁদে বুক ভাসাই। মায়ের আগমনে বাবার প্রতি আমার ঘৃণা অনেকংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। তার মুখোমুখি হয়ে জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে করে, কী অপরাধ করেছিলাম আমি? আমাকে মা হারা করলেন কেন? আমাকে এতিম করে- মায়ের ¯েœহ মমতা থেকে বঞ্চিত করে কী সুখ পেয়েছেন আপনি। আপনাকে আমি ঘৃণা করি, খুব ঘৃণা করি।
গ্রীষ্মের ছুটি। একমাস স্কুল বন্ধ। স্কুল থেকে যখন মামার বাসায় পৌঁছাই তখন বিকাল পাঁচটা। মামা কিছ্ক্ষুণ আগে অফিস থেকে ফিরেছেন। আমাকে দেখে বললেন ‘কী ব্যাপার অমিও একদম বাড়িতে? স্কুল কী বন্ধ?’ আমি বললাম, ‘হ্যা মামা; গ্রীষ্মের ছুটি দিয়েছে’।
‘কয়দিন ছুটি?’
‘এক মাস মামা।’
‘তাহলেতো রুমোন-সুমনের স্কুলও ছুটি।’
‘তা জানিনা; হতে পারে।’
‘হতে পারে কি? অবশ্যই হবে। যেহেতু একই সিলেবাজ....।’
আমাদের কথার ভেতরে রুমোন- সুমন ছুটে আসে। সুমন বলল, ‘অমিও ভাইয়া তোমারও স্কুল ছুটি?’
আমি সম্মতিসূচক মাথা নাড়িয়ে বলি, ‘হ্যাঁ; এক মাস।’ রুমোন বলল, ‘কী এমন ছুটি তোমার! আমাদের চেয়েতো বেশি না।’
আমি চোখ কপালে তুলে প্রশ্ন করলাম, ‘কেন তোমাদের কয়দিন দিয়েছে?’
রুমোন আমার কানের কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘আমাদেরও এক মাস।’ সবার স্কুল ছুটি একসাথে হয়েছে জেনে আমাদের মনে আনন্দ আর ধরে না। এই আনন্দকে বাড়িয়ে দিতে মামা বললেন, ‘সবার ছুটি যখন একসাথে তাহলে একটা কাজ করলে কেমন হয়?’ আমরা সমস্বরে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কী কাজ?’
‘ছিলুমবাড়িয়া গেলে কেমন হয়?’ মামার প্রস্তাবে আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠি আমরা। আমরা সবাই একসাথে বললাম, ‘অবশ্যই যাবো আমরা।’ আসলে মামার এই প্রস্তাব সময়োপযোগী। অনেকদিন গ্রামে যাওয়া হয়নি। ‘কবে যাচ্ছি আমরা মামা?’ মামাকে প্রশ্ন করি। মামা একটু ভেবে বললেন, ‘আমি অফিসে আগেই বলে রেখেছিলাম ছুটির কথা। কাল যেয়ে দেখি ক’দিনের ছুটি পাই। তাছাড়া তোর মামীর সাথে কথা বলতে হবে; সে কবে যেতে চায়।’
আমার বিশ্বাস গ্রামে বেড়াতে যাওয়ার ব্যাপারে মামী আপত্তি করবে না। আগে মাঝে মাঝে মামাকে বলতো গ্রামে বেড়াতে যেতে; মামা-ই রাজী হতো না। রাজশাহী থেকে ট্রেনে যখন যশোর এসে পৌঁছালাম তখন বিকাল সাড়ে পাঁচটা। প্লাটফরমে নামার পর আমার নাকে জন্মভূমির একটা গন্ধ এসে লাগে। এই ষ্টেশনে এর আগে কোনদিন এসেছি বলে মনে না পড়লেও মনে হয় অনেক দিনের চেনা। চারিদিকে একনজর চোখ রাখতেই দেখি দূরে দাঁড়িয়ে আছে মা; তার কোলে আমি। সে আমাকে দেখছে অপলক। একটা ব্যাপার আমার চোখ এড়ায় না। এতদিন দেখেছি কখনো মায়ের চোখে জল, কখনো করুণ মুখ। কিন্তু আজই প্রথম দেখলাম তার মুখে হাসির রেখা। আমি বুঝতে পারি না মায়ের মুখে এ হাসির রহস্য। আর তিন মাসের আমিইবা তার কোলে কেন? মনে মনে ভয়ের সঞ্চার হলেও নিজেকে সামলে নিই। আর যাই হোক সে আমার কোন ক্ষতি করবে না। কারণ সে আমার মা-তার নয়নের আলো আমি। আমার অস্বাভাবিকতা মামার চোখ এড়ায় না। কাছে এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘অমিও কিছু ভাবছিস?’ মামার কথায় আমি সম্বিৎ ফিরে পাই। বললাম, ‘মামা একটা প্রশ্ন করি?’ (অসমাপ্ত)
বিভাগ : সাহিত্য
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
বিজয় দিবস ঘিরে নিরাপত্তা ঝুঁকি নেই স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
ইইউ রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বিএনপি নেতাদের বৈঠক
সাবেক মন্ত্রী ফারুকসহ ৫ জনের রিমান্ড আবেদন,
হাসিনাকে ফেরত না দিলে আমাদের পরের সরকার ভারতকে ক্ষমা করবে না : দ্য হিন্দুকে ড. ইউনূস
৪৪তম বিসিএসের মৌখিক পরীক্ষা বাতিল ৪৬তম প্রিলির ফল পুনরায়
সাবেক খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম গ্রেপ্তার
কানাইঘাটে গ্রুপিং কোন্দলে প্রাণ হারলেন ছাত্রদল কর্মী
শাহজালাল বিমানবন্দরের সব নিরাপত্তা পাস স্থগিত
বিএনপির দুই গ্রুপের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে আহত ১০
সড়কে ফের তিতুমীরের শিক্ষার্থীরা, ভোগান্তিতে সাধারণ মানুষ
ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ, শিক্ষক-সাংবাদিকসহ আহত ১০
প্রাইম ব্যাংক’র সাথে চুক্তি করলো কাশপিয়া গ্রুপ
আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের সাথে হজ এজেন্সি প্রতিনিধিদের মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত
গফরগাঁওয়ে বালুর নিলাম সম্পন্ন
খামেনি কোমায়! ছবি প্রকাশ করে গুজব উড়িয়ে দিল ইরান
শাহজাদপুরে নিখোঁজের ১৫ দিন পর ব্যবসায়ীর গলিত লাশ উদ্ধার
হত্যাকে পুঁজি করে চাঁদাবাজি: সালথায় ফের গ্রেপ্তার হওয়া দুই আসামির জামিন নামঞ্জুর
ব্যাংকিং ডিপ্লোমা বাধ্যতামূলক রেখেই জিএম পদে পরিক্ষা
মন্দির থেকে চুরি হওয়া শিবলিঙ্গটি উদ্ধার, যুবক গ্রেপ্তার
রাঙামাটিতে অবৈধ অটোরিকশা বন্ধের দাবি