জসিমউদদীনের কবিতায় গ্রামীণ বিচিত্র রূপ

Daily Inqilab শাহনূর শহীদ

১৭ আগস্ট ২০২৩, ০৮:৪০ পিএম | আপডেট: ১৮ আগস্ট ২০২৩, ১২:০৮ এএম

আসমানীরে দেখতে যদি তোমরা সবে চাও,/রহিমদ্দির ছোট্ট বাড়ি রসুলপুরে যাও।
বাংলার গ্রামীণ জীবনের আবহ, সহজ সরল প্রাকৃতিক রূপ কবিতার উপজীব্য বিষয় করে- জসিমউদদীন একজন বিখ্যাত বাঙালি কবি, গীতিকার,নাট্যকার,ঔপন্যাসিক।তিনি বাংলাদেশে পল্লীকবি হিসেবে বিশেষভাবে পরিচিতি। নকশীকাঁথার মাঠ ও সোজন বাদিয়ার ঘাট কবির শ্রেষ্ঠ দুটি রচনা।জসিমউদদীনের কবিতা বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হয়েছে। ১৯০৩ সালের ১লা জানুয়ারি ফরিদপুর জেলার তাম্বুলখানা গ্রামে মাতুলালয়ে পল্লীকবি জসিমউদদীন জন্মগ্রহণ করেন।তাঁর বাবার বাড়ি একই জেলার গোবিন্দপুর গ্রাম।বাবা আনসার উদ্দিন মোল্লা,মা আমেনা খাতুন ওরফে রাঙাছুট।জসিমউদদীন ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজ থেকে আই এ ও বিএ পাস করার পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এম এ ডিগ্রি লাভ করেন।কলেজে অধ্যয়ন কালে কবর কবিতা রচনা করে তিনি খ্যাতি অর্জন করেন,এবং ছাত্রাবস্থায় কবিতাটি স্কুল পাঠ্যগ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়।১৯৩৩ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড.দীনেশচন্দ্র সেনের অধিনে রামতনু লাহিড়ী গবেষণা সহকারী পদে যোগ দেন।এরপর ১৯৩৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন।তাঁর রচিত কাব্যগুলোতে গ্রামীণ জীবনের যে নিখুঁত চিত্র, কুশলতার সাথে অংকিত হয়েছে- তাতে আধুনিক শিল্প চেতনার চাপ সুস্পষ্ট।
১৯৭৩ সালে বিবিসি লন্ডনের বেনারে সৈয়দ শামসুল হক পল্লিকবি জসিমউদদীনের একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন।এই দুর্লভ সাক্ষাৎকার থেকে আমরা পাই পল্লিকবি জসিমউদদীন গ্রামের সহজ সরল জীবন থেকে কিভাবে সাহিত্যের উপাদান খুঁজে নিয়েছিলেন তার বিচিত্র রূপ।
কবির ভাষায়--আমি কি চোখে গ্রামকে দেখি, তা হয়ত ব্যাখা করে বলতে পারবো না,তবে আমার ভালো লাগে,আমি ছোটকাল থেকে গ্রামে মানুষ হয়েছি, বিয়ে পর্যন্ত করেছি গ্রামে।সেই আমার বাড়ি গোবিন্দপুর সেখান থেকে শহরে পড়াশোনা করতাম।অনেক বয়স পর্যন্ত গ্রামেই ছিলাম।তাছাড়া আরেকটা জিনিস আমি মনে করতাম - গ্রাম তো আমার,গ্রামের সব লোকজন এরা তো আমার, এদের কথাই তো আমি বেশি জানি,তবে এদের কথা বা আমি কেন না লিখবো, এজন্য আমি একবার একটা প্রবন্ধ পড়লাম, ক্লাস নাইনে বোধহয় পড়ি তখন রুরাল লাইফ ইন ইংল্যান্ড সে ইংল্যান্ড এখন আর নাই। সেখানে সেই প্রবন্ধকার লিখেছেন--
আমাদের দেশের কবিরা তারা প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখার জন্যে,তারা সাময়িক ভাবে কখনও কখনও গ্রামে যায়- তা নয় তারা দিনের পর দিন,মাসের পর মাস গ্রামে বসে থাকে।যাই হোক আমার ভালো লাগে গ্রামে ঘুরতে, এককালে ঘুরেছি,খুব ঘুরেছি এতো ঘুরেছি সেই বাঁশের পাতা কোন সময় কেমন করে দোলে, সেই বেতুল ফুল-ফল কোন সময় পাড়া যায়,এই সব আমার ভালো লাগে। সেই গাবের পাতা যখন নতুন হয়,তখন সেই ঝালর দেওয়া গাব গাছের কাছে কতদিন দাঁড়িয়ে থেকেছি। সেই শস্যফুলে আমার বাড়ির সামনের মাঠ ভরে যেতো, নদীর ওপারের সেই চর সেই শস্যফুল বাতাসে ফুল দুলছে,তা না আমার মনে হতো সমস্ত বালুচরই দোলে উঠছে।এ আমার খুব ভালো লাগতো। সেই চরের মধ্যে ঘুরে বেড়াতাম।সেই শস্যক্ষেতের ভিতর ভিতরে মটরশুঁটির গাছ, সেই ছোট লাল টুকটুকে ফুল যেন ছোট্ট ঘোমটা পরা একটি বৌয়ের মতন মনে হতো। খুব ঘুরতাম, একবার ঘুরতে ঘুরতে সেই নবসূত্র পাড়ায় গেলাম,সেখানে দেখি যে খুব সুন্দর একটা বউ সে শাক তুলতেছে,সে কি আনন্দে শাক তুলতেছে!আমি ওখানে বসেই সেই কথা মনে রেখে শেষে আমার কবিতা লিখেছিলাম শাক তুলনী বলে।বাংলাদেশকে আমি ভালোবেসেছি।আমি দেখেছি সেই গ্রামের মেয়ে সে নকশীকাঁথা মেলন করে ধরে,সেই কাঁথার উপরে তার মনের যে আনন্দ সে প্রকাশ করতে চেষ্টা করছে।সে হয়ত রাসেলের ছবি যারা এখানে সূচি কার্যের ভিতর দিয়ে প্রকাশ করে,তারা হয়ত শিক্ষা পেয়েছে কোনো প্রতিষ্টানের,এ মেয়েটি কোনো শিক্ষা পায় নি কিন্তু তার মনের যে আনন্দ সে কয়টা তিনটা চারটা ফুল, তিনটা চারটা রকমের ফুল,তিনটা চারটা রকমের রঙে সেই কাঁথার মধ্যে দিয়ে প্রকাশ করতে চেষ্টা করছে। কাঁথা যখন আমি দেখি তখন সে গ্রাম্য মেয়েটির মনের যে আনন্দ,তার মনের যে দুঃখ এই সমস্ত প্রতীক ভাবে দেখতে পাই।তার ভিতরে হয়ত যে ফুলটা সে তৈরি করছে, সেই ফুলটার মতো হয় নাই কিন্তু তার মনের রঙ সেখানে আমি দেখতে পাই।(আংশিক)
পল্লিকবি জসিমউদদীন সারা জীবন গল্প,কবিতা,উপন্যাস,গানে গ্রামের মানুষের সুখ-দুঃখের কথা, প্রেম- বিরহ,গ্রামীণ জীবনের চালচিত্র, প্রাকৃতিক পরিবেশ তাঁর লেখনীতে মনের মাধুরি দিয়ে সাহিত্যের পাতায় এঁকেছেন,তা এই পরিসরে উল্লেখ করা সম্ভব নয়। দু-একটি উদ্বৃত্ত এখানে পেশ করছি।পল্লী জননী কবিতাটি কবির রাখালী কাব্যগ্রন্থ থেকে সংকলন করা হয়েছে। এ কবিতায় কবি গ্রামবাংলার রুগ্ণ পরিবেশে অসুস্থ সন্তানের শিয়রে এক পল্লীমায়ের পুত্রহারানোর শঙ্কা তুলে ধরেছেন। কবিতায় পল্লী প্রকৃতির বিভিন্ন অনুষঙ্গে গ্রামবাংলার একটি দরিদ্র পরিবারের করুণ কাহিনি ফুটে উঠেছে।কবি বলেন--রাত থমথম স্তব্দ,ঘোর-ঘোর- অন্ধকার,/নিশ্বাস ফেলি,তাও শোনা যায়,নাই কোথা সাড়া কার।/রুগ্ন ছেলের শিয়রে বসিয়া একেলা জাগিছে মাথা,/করুণ চাহনি ঘুম ঘুম যেন ঢুলিছে চোখের পাতা।/শিয়রের কাছে নিবু নিবু দীপ ঘুরিয়া ঘুরিয়া জ্বলে,/তারি সাথে সাথে বিরহী মায়ের একেলা পরাণ দোলে।...
জসিমউদদীন পল্লিগ্রামের মানুষের সহজ সরল জীবন যাপন,মানুষের আত্মিক বন্ধন, গ্রামের প্রাকৃতিক রূপ এবং গাছ-পালা,পাখপাখালির সৌন্দর্য রূপায়ণ করেছেন তাঁর ধানক্ষেত কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত নিমন্ত্রণ’কবিতার মাধ্যমে। কবির কাব্যিক উপস্থাপন --
তুমি যাবে ভাই – যাবে মোর সাথে, আমাদের ছোট গাঁয়,/গাছের ছায়ায় লতায় পাতায় উদাসী বনের বায়;/
মায়া মমতায় জড়াজড়ি করি/
মোর গেহখানি রহিয়াছে ভরি,/মায়ের বুকেতে, বোনের আদরে, ভাইয়ের স্নেহের ছায়,/তুমি যাবে ভাই–যাবে মোর সাথে, আমাদের ছোট গাঁয়,..


বিভাগ : সাহিত্য


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

কবিতা
নষ্ট সময়
সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ : বাংলা সাহিত্যের স্বর্ণযুগের কারিগর
কবিতা
বাসের টিকিট ও মফিজের ভাবনা
আরও
X

আরও পড়ুন

নওগাঁর আত্রাইয়ে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অধিক জমিতে ভুট্টা চাষ: বাম্পার ফলনের সম্ভাবনা

নওগাঁর আত্রাইয়ে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অধিক জমিতে ভুট্টা চাষ: বাম্পার ফলনের সম্ভাবনা

মাগুরায় নিহত যুবদলের নেতা মিরাজের নামাজে জানাজায় গন মানুষের ঢল

মাগুরায় নিহত যুবদলের নেতা মিরাজের নামাজে জানাজায় গন মানুষের ঢল

গাজায় গণহত্যার প্রতিবাদে নোয়াখালীতে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ

গাজায় গণহত্যার প্রতিবাদে নোয়াখালীতে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ

ফিলিস্তিনে গণহত্যার প্রতিবাদে কয়রায় জামায়াতের বিক্ষোভ

ফিলিস্তিনে গণহত্যার প্রতিবাদে কয়রায় জামায়াতের বিক্ষোভ

মধ্য গাজায় ফিলিস্তিনিদের নতুন করে 'সরে যাওয়ার' নির্দেশ ইসরায়েলের

মধ্য গাজায় ফিলিস্তিনিদের নতুন করে 'সরে যাওয়ার' নির্দেশ ইসরায়েলের

ব্রাহ্মণপাড়ায় কলেজ ছাত্র ছফিউল্লাহ হত্যা ২ আসামীকে জেল হাজতে প্রেরণ

ব্রাহ্মণপাড়ায় কলেজ ছাত্র ছফিউল্লাহ হত্যা ২ আসামীকে জেল হাজতে প্রেরণ

স্বাধীন ফিলিস্তিনের দাবিতে উত্তাল দেশ

স্বাধীন ফিলিস্তিনের দাবিতে উত্তাল দেশ

ফিলিস্তিনে হামলার প্রতিবাদে উত্তরা জুড়ে বিক্ষোভ মিছিল

ফিলিস্তিনে হামলার প্রতিবাদে উত্তরা জুড়ে বিক্ষোভ মিছিল

‘বিশ্ব বিবেক কোথায়?’—রাবিতে ফিলিস্তিন ইস্যুতে হাজারো শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের গর্জন

‘বিশ্ব বিবেক কোথায়?’—রাবিতে ফিলিস্তিন ইস্যুতে হাজারো শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের গর্জন

নওগাঁর পোরশায় নিজ বাড়ি থেকে ভাই-বোনের মরদেহ উদ্ধার

নওগাঁর পোরশায় নিজ বাড়ি থেকে ভাই-বোনের মরদেহ উদ্ধার

বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন উদ্যোগ, গঠন করবে উদ্যোক্তা তহবিল

বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন উদ্যোগ, গঠন করবে উদ্যোক্তা তহবিল

ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই শিক্ষক বরখাস্ত

ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই শিক্ষক বরখাস্ত

৯ জেলায় বইছে তাপপ্রবাহ, অব্যাহত থাকতে পারে

৯ জেলায় বইছে তাপপ্রবাহ, অব্যাহত থাকতে পারে

ব্যবসা টিকিয়ে রাখার চাঞ্চল্যকর কৌশল আ. লীগের পলাতক নেতাদের!

ব্যবসা টিকিয়ে রাখার চাঞ্চল্যকর কৌশল আ. লীগের পলাতক নেতাদের!

ভারতে সোনার দাম পতনের আশঙ্কা, বিশেষজ্ঞদের পূর্বাভাস

ভারতে সোনার দাম পতনের আশঙ্কা, বিশেষজ্ঞদের পূর্বাভাস

বাগেরহাটের চিতলমারীতে বহুতল ভবনে আগুন, ১ নারীর মৃত্যু

বাগেরহাটের চিতলমারীতে বহুতল ভবনে আগুন, ১ নারীর মৃত্যু

যশোরে পুকুর থেকে নবজাতকের মরদেহউদ্ধার

যশোরে পুকুর থেকে নবজাতকের মরদেহউদ্ধার

বিশ্বনাথে কর্মরত সাংবাদিকদের নিয়ে অপপ্রচার : তিন সংগঠনের প্রতিবাদ

বিশ্বনাথে কর্মরত সাংবাদিকদের নিয়ে অপপ্রচার : তিন সংগঠনের প্রতিবাদ

গাজায় গণহত্যা বন্ধ ও স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে ছাত্রশিবিরের সপ্তাহব্যাপী কর্মসূচি ঘোষণা

গাজায় গণহত্যা বন্ধ ও স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে ছাত্রশিবিরের সপ্তাহব্যাপী কর্মসূচি ঘোষণা

ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের বর্বরোচিত হামলার প্রতিবাদে চাঁদপুরে বিক্ষোভ মিছিল

ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের বর্বরোচিত হামলার প্রতিবাদে চাঁদপুরে বিক্ষোভ মিছিল