ঢাকা   শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪ | ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

জসিমউদদীনের কবিতায় গ্রামীণ বিচিত্র রূপ

Daily Inqilab শাহনূর শহীদ

১৭ আগস্ট ২০২৩, ০৮:৪০ পিএম | আপডেট: ১৮ আগস্ট ২০২৩, ১২:০৮ এএম

আসমানীরে দেখতে যদি তোমরা সবে চাও,/রহিমদ্দির ছোট্ট বাড়ি রসুলপুরে যাও।
বাংলার গ্রামীণ জীবনের আবহ, সহজ সরল প্রাকৃতিক রূপ কবিতার উপজীব্য বিষয় করে- জসিমউদদীন একজন বিখ্যাত বাঙালি কবি, গীতিকার,নাট্যকার,ঔপন্যাসিক।তিনি বাংলাদেশে পল্লীকবি হিসেবে বিশেষভাবে পরিচিতি। নকশীকাঁথার মাঠ ও সোজন বাদিয়ার ঘাট কবির শ্রেষ্ঠ দুটি রচনা।জসিমউদদীনের কবিতা বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হয়েছে। ১৯০৩ সালের ১লা জানুয়ারি ফরিদপুর জেলার তাম্বুলখানা গ্রামে মাতুলালয়ে পল্লীকবি জসিমউদদীন জন্মগ্রহণ করেন।তাঁর বাবার বাড়ি একই জেলার গোবিন্দপুর গ্রাম।বাবা আনসার উদ্দিন মোল্লা,মা আমেনা খাতুন ওরফে রাঙাছুট।জসিমউদদীন ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজ থেকে আই এ ও বিএ পাস করার পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এম এ ডিগ্রি লাভ করেন।কলেজে অধ্যয়ন কালে কবর কবিতা রচনা করে তিনি খ্যাতি অর্জন করেন,এবং ছাত্রাবস্থায় কবিতাটি স্কুল পাঠ্যগ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়।১৯৩৩ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড.দীনেশচন্দ্র সেনের অধিনে রামতনু লাহিড়ী গবেষণা সহকারী পদে যোগ দেন।এরপর ১৯৩৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন।তাঁর রচিত কাব্যগুলোতে গ্রামীণ জীবনের যে নিখুঁত চিত্র, কুশলতার সাথে অংকিত হয়েছে- তাতে আধুনিক শিল্প চেতনার চাপ সুস্পষ্ট।
১৯৭৩ সালে বিবিসি লন্ডনের বেনারে সৈয়দ শামসুল হক পল্লিকবি জসিমউদদীনের একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন।এই দুর্লভ সাক্ষাৎকার থেকে আমরা পাই পল্লিকবি জসিমউদদীন গ্রামের সহজ সরল জীবন থেকে কিভাবে সাহিত্যের উপাদান খুঁজে নিয়েছিলেন তার বিচিত্র রূপ।
কবির ভাষায়--আমি কি চোখে গ্রামকে দেখি, তা হয়ত ব্যাখা করে বলতে পারবো না,তবে আমার ভালো লাগে,আমি ছোটকাল থেকে গ্রামে মানুষ হয়েছি, বিয়ে পর্যন্ত করেছি গ্রামে।সেই আমার বাড়ি গোবিন্দপুর সেখান থেকে শহরে পড়াশোনা করতাম।অনেক বয়স পর্যন্ত গ্রামেই ছিলাম।তাছাড়া আরেকটা জিনিস আমি মনে করতাম - গ্রাম তো আমার,গ্রামের সব লোকজন এরা তো আমার, এদের কথাই তো আমি বেশি জানি,তবে এদের কথা বা আমি কেন না লিখবো, এজন্য আমি একবার একটা প্রবন্ধ পড়লাম, ক্লাস নাইনে বোধহয় পড়ি তখন রুরাল লাইফ ইন ইংল্যান্ড সে ইংল্যান্ড এখন আর নাই। সেখানে সেই প্রবন্ধকার লিখেছেন--
আমাদের দেশের কবিরা তারা প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখার জন্যে,তারা সাময়িক ভাবে কখনও কখনও গ্রামে যায়- তা নয় তারা দিনের পর দিন,মাসের পর মাস গ্রামে বসে থাকে।যাই হোক আমার ভালো লাগে গ্রামে ঘুরতে, এককালে ঘুরেছি,খুব ঘুরেছি এতো ঘুরেছি সেই বাঁশের পাতা কোন সময় কেমন করে দোলে, সেই বেতুল ফুল-ফল কোন সময় পাড়া যায়,এই সব আমার ভালো লাগে। সেই গাবের পাতা যখন নতুন হয়,তখন সেই ঝালর দেওয়া গাব গাছের কাছে কতদিন দাঁড়িয়ে থেকেছি। সেই শস্যফুলে আমার বাড়ির সামনের মাঠ ভরে যেতো, নদীর ওপারের সেই চর সেই শস্যফুল বাতাসে ফুল দুলছে,তা না আমার মনে হতো সমস্ত বালুচরই দোলে উঠছে।এ আমার খুব ভালো লাগতো। সেই চরের মধ্যে ঘুরে বেড়াতাম।সেই শস্যক্ষেতের ভিতর ভিতরে মটরশুঁটির গাছ, সেই ছোট লাল টুকটুকে ফুল যেন ছোট্ট ঘোমটা পরা একটি বৌয়ের মতন মনে হতো। খুব ঘুরতাম, একবার ঘুরতে ঘুরতে সেই নবসূত্র পাড়ায় গেলাম,সেখানে দেখি যে খুব সুন্দর একটা বউ সে শাক তুলতেছে,সে কি আনন্দে শাক তুলতেছে!আমি ওখানে বসেই সেই কথা মনে রেখে শেষে আমার কবিতা লিখেছিলাম শাক তুলনী বলে।বাংলাদেশকে আমি ভালোবেসেছি।আমি দেখেছি সেই গ্রামের মেয়ে সে নকশীকাঁথা মেলন করে ধরে,সেই কাঁথার উপরে তার মনের যে আনন্দ সে প্রকাশ করতে চেষ্টা করছে।সে হয়ত রাসেলের ছবি যারা এখানে সূচি কার্যের ভিতর দিয়ে প্রকাশ করে,তারা হয়ত শিক্ষা পেয়েছে কোনো প্রতিষ্টানের,এ মেয়েটি কোনো শিক্ষা পায় নি কিন্তু তার মনের যে আনন্দ সে কয়টা তিনটা চারটা ফুল, তিনটা চারটা রকমের ফুল,তিনটা চারটা রকমের রঙে সেই কাঁথার মধ্যে দিয়ে প্রকাশ করতে চেষ্টা করছে। কাঁথা যখন আমি দেখি তখন সে গ্রাম্য মেয়েটির মনের যে আনন্দ,তার মনের যে দুঃখ এই সমস্ত প্রতীক ভাবে দেখতে পাই।তার ভিতরে হয়ত যে ফুলটা সে তৈরি করছে, সেই ফুলটার মতো হয় নাই কিন্তু তার মনের রঙ সেখানে আমি দেখতে পাই।(আংশিক)
পল্লিকবি জসিমউদদীন সারা জীবন গল্প,কবিতা,উপন্যাস,গানে গ্রামের মানুষের সুখ-দুঃখের কথা, প্রেম- বিরহ,গ্রামীণ জীবনের চালচিত্র, প্রাকৃতিক পরিবেশ তাঁর লেখনীতে মনের মাধুরি দিয়ে সাহিত্যের পাতায় এঁকেছেন,তা এই পরিসরে উল্লেখ করা সম্ভব নয়। দু-একটি উদ্বৃত্ত এখানে পেশ করছি।পল্লী জননী কবিতাটি কবির রাখালী কাব্যগ্রন্থ থেকে সংকলন করা হয়েছে। এ কবিতায় কবি গ্রামবাংলার রুগ্ণ পরিবেশে অসুস্থ সন্তানের শিয়রে এক পল্লীমায়ের পুত্রহারানোর শঙ্কা তুলে ধরেছেন। কবিতায় পল্লী প্রকৃতির বিভিন্ন অনুষঙ্গে গ্রামবাংলার একটি দরিদ্র পরিবারের করুণ কাহিনি ফুটে উঠেছে।কবি বলেন--রাত থমথম স্তব্দ,ঘোর-ঘোর- অন্ধকার,/নিশ্বাস ফেলি,তাও শোনা যায়,নাই কোথা সাড়া কার।/রুগ্ন ছেলের শিয়রে বসিয়া একেলা জাগিছে মাথা,/করুণ চাহনি ঘুম ঘুম যেন ঢুলিছে চোখের পাতা।/শিয়রের কাছে নিবু নিবু দীপ ঘুরিয়া ঘুরিয়া জ্বলে,/তারি সাথে সাথে বিরহী মায়ের একেলা পরাণ দোলে।...
জসিমউদদীন পল্লিগ্রামের মানুষের সহজ সরল জীবন যাপন,মানুষের আত্মিক বন্ধন, গ্রামের প্রাকৃতিক রূপ এবং গাছ-পালা,পাখপাখালির সৌন্দর্য রূপায়ণ করেছেন তাঁর ধানক্ষেত কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত নিমন্ত্রণ’কবিতার মাধ্যমে। কবির কাব্যিক উপস্থাপন --
তুমি যাবে ভাই – যাবে মোর সাথে, আমাদের ছোট গাঁয়,/গাছের ছায়ায় লতায় পাতায় উদাসী বনের বায়;/
মায়া মমতায় জড়াজড়ি করি/
মোর গেহখানি রহিয়াছে ভরি,/মায়ের বুকেতে, বোনের আদরে, ভাইয়ের স্নেহের ছায়,/তুমি যাবে ভাই–যাবে মোর সাথে, আমাদের ছোট গাঁয়,..


বিভাগ : সাহিত্য


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

নাট্যকার হুমায়ূন আহমেদ
আত্মবেদনার করুণ কাহিনী ‘বিবি কুলসুম’
কুয়াশার চাদরে ঢাকা হেমন্ত
হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর তৈলতত্ত্ব ও আমাদের সাহিত্য সমাজ
জলের ঘ্রাণ
আরও

আরও পড়ুন

বড়কে মান্য করুন, বৃদ্ধকে সম্মান করুন-১

বড়কে মান্য করুন, বৃদ্ধকে সম্মান করুন-১

বড়কে মান্য করুন, বৃদ্ধকে সম্মান করুন-১

বড়কে মান্য করুন, বৃদ্ধকে সম্মান করুন-১

সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-৩

সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-৩

বেগম খালেদা জিয়াকে পেয়ে সেনাকুঞ্জ গর্বিত : প্রধান উপদেষ্টা

বেগম খালেদা জিয়াকে পেয়ে সেনাকুঞ্জ গর্বিত : প্রধান উপদেষ্টা

এক যুগ পর সেনাকুঞ্জে খালেদা জিয়া : যার হাসিতে হেসে উঠেছে বাংলাদেশ

এক যুগ পর সেনাকুঞ্জে খালেদা জিয়া : যার হাসিতে হেসে উঠেছে বাংলাদেশ

নতুন জেনারেশনের চিন্তা-চেতনা সবাইকে বুঝতে হবে : এ এম এম বাহাউদ্দীন

নতুন জেনারেশনের চিন্তা-চেতনা সবাইকে বুঝতে হবে : এ এম এম বাহাউদ্দীন

নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন : প্রধান নির্বাচন কমিশনার হলেন সাবেক সচিব এ এম এম নাসির উদ্দীন

নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন : প্রধান নির্বাচন কমিশনার হলেন সাবেক সচিব এ এম এম নাসির উদ্দীন

পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠক : শেখ হাসিনাকে ফেরানো নিয়ে আলোচনার সুযোগ রয়েছে

পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠক : শেখ হাসিনাকে ফেরানো নিয়ে আলোচনার সুযোগ রয়েছে

সেনাকুঞ্জে খালেদা জিয়াকে সম্মান জানানোয় গোটা জাতি আনন্দিত : মির্জা ফখরুল

সেনাকুঞ্জে খালেদা জিয়াকে সম্মান জানানোয় গোটা জাতি আনন্দিত : মির্জা ফখরুল

পররাষ্ট্র দপ্তরের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে মিলার :  বাংলাদেশে মানবাধিকার বহাল থাকবে এটিই যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাশা

পররাষ্ট্র দপ্তরের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে মিলার :  বাংলাদেশে মানবাধিকার বহাল থাকবে এটিই যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাশা

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিশেষ পরামর্শক নিয়োগ পেলেন টবি ক্যাডম্যান

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিশেষ পরামর্শক নিয়োগ পেলেন টবি ক্যাডম্যান

হাইকোর্টের অভিমত :  কুরআন অবমাননা ও মহানবীকে কট‚ক্তির শাস্তি মৃত্যুদন্ডের বিধান করতে পারে সংসদ

হাইকোর্টের অভিমত :  কুরআন অবমাননা ও মহানবীকে কট‚ক্তির শাস্তি মৃত্যুদন্ডের বিধান করতে পারে সংসদ

জ্বালানি তেলের দাম কমানোর সুযোগ আছে : সিপিডি

জ্বালানি তেলের দাম কমানোর সুযোগ আছে : সিপিডি

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল : খুনি হাসিনার পক্ষে লড়বেন জেড আই খান পান্না

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল : খুনি হাসিনার পক্ষে লড়বেন জেড আই খান পান্না

বিগত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে যারা অপরাধ করেছেন তাদের শাস্তির সুপারিশ : সম্পাদক ও সিনিয়র সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময়

বিগত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে যারা অপরাধ করেছেন তাদের শাস্তির সুপারিশ : সম্পাদক ও সিনিয়র সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময়

ডয়চে ভেলের প্রতিবেদন : ট্রাম্প ফেরায় বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগ বাড়ার সম্ভাবনা

ডয়চে ভেলের প্রতিবেদন : ট্রাম্প ফেরায় বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগ বাড়ার সম্ভাবনা

এডিস মশার ভয়াবহ রূপ : একদিনে ডেঙ্গুতে আরো ৯ জনের মৃত্যু

এডিস মশার ভয়াবহ রূপ : একদিনে ডেঙ্গুতে আরো ৯ জনের মৃত্যু

ব্যবসায়ীরা হতাশ : বাংলাদেশিদের ভিসা না দিয়ে উল্টো বিপাকে ভারত!

ব্যবসায়ীরা হতাশ : বাংলাদেশিদের ভিসা না দিয়ে উল্টো বিপাকে ভারত!

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৬ -এ পদার্পণ : শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৬ -এ পদার্পণ : শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি

ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণ প্রকল্প, ব্যয় ২৯৭ কোটি ১৬ লাখ টাকা

ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণ প্রকল্প, ব্যয় ২৯৭ কোটি ১৬ লাখ টাকা