(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

পরিবর্তনের এই পৃথিবী স্যার ফ্রান্সিস্ বেকন

Daily Inqilab ইসরাইল খান

১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৯:৪০ পিএম | আপডেট: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০২ এএম

সুদূর দক্ষিণের লোকেরা উত্তরের লোকদের ওপর কখনো অভিযান চালায় নাই। কিন্তু এর বিপরীতটা সবসময়ই হয়েছে। তা থেকে স্পষ্ট প্রতিভাত হয় যে দক্ষিণ ভূ-ভাগ প্রাকৃতিক কারণে যোদ্ধা সৃষ্টির অনুকূল ক্ষেত্র। এখন সেটা এ-অঞ্চলের গ্রহ-উপগ্রহের কারণেই হোক অথবা এজন্যে হোক যে, উত্তরাঞ্চলে মহাদেশগুলি অবস্থিত। অপরদিকে যতদূর জানা সম্ভব হয়েছে, দক্ষিণ ভূ-ভাগের প্রায় সম্পূর্ণটাই সাগর। অথবা এ কারণেও হতে পারে যে, গোটা দক্ষিণ অঞ্চলটাই হলো শীত প্রধান এবং সেজন্যে কোন প্রকার দৈহিক নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই সেখানকার অধিবাসীগণ ইস্পাত-কঠিন দেহ এবং অতিশয় শৌর্য-বীর্যের অধিকারী হয়ে থাকেন। যখন কোন বৃহৎ রাষ্ট্র এবং সাম্রাজ্য টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়ে তখন অনেক যুদ্ধ-বিগ্রহ সংঘটিত হয়। 
বিশাল সাম্রাজ্যসমূহ যতদিন টিকে থাকে ততদিন তারা নিজেদের সংরক্ষণশক্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত থেকে অধিকৃত দেশের জনগণের শক্তিকে খর্ব এবং দুর্বল করে চলে। কিন্তু একদিন যখন তাদের পতন সূচিত হয় তখন একে একে সব কিছুই ধসে পড়তে থাকে। তখন তারা নিজেরা অপরের শিকারে পরিণত হয়। পতনোন্মুখ রোম সাম্রাজ্যের বেলায় তা-ই হয়েছিল। 
অনুরূপভাবে চার্লস দ্য গ্রেটের পরবর্তী পর্যায়ে জার্মান সাম্রাজ্যেও একে একে সবগুলি দেশ যার যার পৃথক সত্তা ঘোষণা করেছিল। স্পেন সাম্রাজ্যেরও যদি পতন এগিয়ে আসে তাহলে একই নাটকের পুনরাবৃত্তি হবে। যখন এক রাজ্য অন্য রাজ্যের অঙ্গীভূত হয় এবং একাধিক রাজ্য পরস্পরের সাথে যুক্ত হয় তখনও যুদ্ধ-বিগ্রহ সংঘটিত হয়। কারণ যখনই কোন রাষ্ট্র আপন অধিকারের সীমা অতিক্রম করে তখনই তার ফলে সে রাষ্ট্র চারদিক থেকে যেন মহাপ্লাবনে আক্রান্ত হয়। রোম, তুরস্ক, স্পেন এবং অন্যান্য রাজ্যের বেলায় তাই ঘটেছিল। 
বর্তমান সভ্যযুগে যখন পৃথিবীতে আহারের পর্যাপ্ত সংস্থান ব্যতিরেকে মানুষ দারপরিগ্রহ করে সন্তানের জন্মের কারণ হতে চায় না, তখন আমরা দেখতে পাই কোন জাতির ওপর চারদিক থেকে বহিরাক্রমণের সম্ভাবনা কত বিরল। যখন কোন জাতির মাঝে জন্মের হার দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পায়–অথচ সেই সাথে খাদ্যের সংস্থান অপ্রচুর থেকে যায় তখন এক বা অন্ততঃ দুই যুগে একবার সেই জাতির জনগণের এক অংশকে আহার ও বসতির জন্যে বাইরে কোথাও পাঠাতে হয়। প্রাচীনকালে উত্তরাঞ্চলের লোকেরা এ কাজে অগ্রসর হতেন লটারি করে। তারা লটারি করে নির্ধারণ করতেন তাদের কারা দেশে থাকবেন আর কারা ভাগ্যান্বেষণে যাবেন বাইরের জগতে।
 আবার কোন যোদ্ধা জাতি যদি কালক্রমে কোমল-স্বভাব ও স্ত্রৈণ হয়ে পড়ে তাহলে তারা অন্য জাতির শিকারে পরিণত হয়। শৌর্য-বীর্যের অবনতির সাথে যে-কোন জাতির ধন-সম্পদ বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। সেই ধন-সম্পদই আবার বাইরের শত্রুকে প্রলুব্ধ করে। এই ধর্মে যে-কোন জাতির অবনতি যুদ্ধ-বিগ্রহকে উৎসাহিত করে। 
এবার অস্ত্রশস্ত্রের কথা। অস্ত্রশস্ত্র কোন নিয়মের অনুভূতি নয়। তবে এদেরও যুগবিশেষ আছে এবং সে জগতেও পরিবর্তন আছে। আলেকজান্ডার যখন ভারত অভিযানে গিয়েছিলেন তখন তার দেশ মেসিডনের অধিবাসীরা সেখানে অস্ত্রাগার পেয়েছিলেন। যে-সব অস্ত্রের সাথে তাদের সাক্ষাৎ হয়েছিল তা তাদের কাছে বজ্র, বিদ্যুৎ এবং ইন্দ্রজাল বলে মনে হয়েছিল। ২০০০ বছর পূর্বেও যে চীন দেশে অস্ত্রাগার ছিল সে কথা তো সুবিদিত। উন্নত অস্ত্রের লক্ষণ বিচারে প্রথম দেখতে হবে অস্ত্রের ক্ষেপণ -শক্তির দৌড় কত দূর। এই দৌড়ের দৈর্ঘ্য যত বেশি হবে বহিরাক্রমণের সম্ভাবনা তত বেশি সীমিত হবে। দ্বিতীয়ত দেখতে হবে অস্ত্রের সংঘর্ষ-শক্তি কত বেশি। এই শক্তির বিচারে একই ধরনের প্রাচীন অস্ত্র অকেজো হয়ে দাঁড়াবে এবং আধুনিক অস্ত্রের জন্যে পথ ছেড়ে দেবে। তৃতীয় মাপকাঠি হবে অস্ত্রের ব্যবহারের সুবিধা-অসুবিধার প্রভেদ। যেমন, সে অস্ত্র সকল ঋতুতে ব্যবহারের উপযোগী কিনা, বহন করে নেয়ার ব্যাপারে সে অস্ত্র জটিলতামুক্ত কিনা, ইত্যাদি ।
যুদ্ধ পরিচালনায় প্রাচীনকালে মানুষ সর্বাপেক্ষা নির্ভরশীল ছিল সৈন্যসংখ্যার ওপর। সৈন্যদের সাহস ও শক্তির উপরও তেমনি আত্যন্তিক নির্ভরতা থাকতো। কতদিন খন্ডযুদ্ধ চলতে পারে, সে বিচারে সৈন্যসংখ্যা নিরূপণ করা হত। অগ্রপশ্চাৎ সম্ভাবনার বিচার, বুদ্ধি ও দূরদর্শিতার সাহায্যে সৈন্যদের সারিগঠন ও সুবিন্যস্ত অবস্থানের বিজ্ঞান তখন মানুষের অজ্ঞাত ছিল। পরবর্তী সময়ে মানুষ বেশি দৃষ্টি দিতে শুরু করল সৈন্য-সংখ্যার প্রতি নয় বরং সুশিক্ষিত সৈন্যদের সংখ্যার প্রতি। যুদ্ধক্ষেত্রে স্থান এবং চতুর পথ-বদলানো ইত্যাদির প্রতি বেশী দৃষ্টি দেওয়া হতে লাগল এবং সৈন্যদের সুবিন্যস্ত করার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হল।
যে-কোন রাষ্ট্রের প্রথম পর্যায়ে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি পায়। দ্বিতীয় পর্যায়ে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা বৃদ্ধি পায়। তারপর কিছুকাল এই উভয় ক্ষেত্রে উন্নতি অব্যাহত থাকে। পতনের যুগ এগিয়ে আসতে শুরু করলে আবার ব্যবসা-বাণিজ্য এবং প্রকৌশলী বিদ্যার খুব অগ্রগতি দেখা যায়। জ্ঞানচর্চারও শৈশব আছে–তখন সবেমাত্র শুরু হয় এবং সবকিছুতে শিশুসুলভতা দৃষ্ট হয়। 
তারপর আসে যৌবন যখন, পত্র-পুষ্পের সমারোহে সবকিছু সুষমা ও সৌন্দর্যে অপূর্ব হয়ে ওঠে। পরবর্তী পর্যায়ে তাতে আসে শক্তি ও স্থায়িত্ব। অবশেষে আসে বার্ধক্য–তখন তার সরসতা সীমিত হয়ে পড়ে এবং সবকিছুতে ক্লান্তির চিহ্ন দেখা দেয়। কিন্তু পরিবর্তনের এই চক্রের প্রতি বড় বেশি দৃষ্টি দিয়ে লাভ নেই। ফলে শুধু শিরঘূর্ণন হবে। পৃথিবীর এই উত্থান-পতনের কাহিনীর সীমা নেই, শেষ নেই। এ এক সীমাহীন কাহিনীর চক্র। বর্তমান পরিসরে তাই সেই প্রয়াস হবে অর্থহীন।” (সমাপ্ত)


বিভাগ : সাহিত্য


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

নববর্ষের ঘোষণা
রক্তমাখা শার্ট
জেগে থাকো পূর্ণিমা : সমাজ বাস্তবতার আখ্যান
বাংলাদেশের কবিতা ও সমকালীন সাহিত্য
ধৈর্যের বসতঘর
আরও

আরও পড়ুন

শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ওয়াশিংটনে ট্রাম্প

শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ওয়াশিংটনে ট্রাম্প

ইয়েমেন থেকে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা, ইসরাইলি বিমানবন্দর বন্ধ

ইয়েমেন থেকে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা, ইসরাইলি বিমানবন্দর বন্ধ

৬০০ টাকা কেজি দরে ইলিশ বেচবে সরকার, পাওয়া যাবে যেখানে

৬০০ টাকা কেজি দরে ইলিশ বেচবে সরকার, পাওয়া যাবে যেখানে

লাইফ সাপোর্টে কাজী নজরুল ইসলামের নাতি বাবুল

লাইফ সাপোর্টে কাজী নজরুল ইসলামের নাতি বাবুল

স্পেনের এনজিওগুলো ইলন মাস্কের বিরোধিতায় এক্স ছেড়ে যাচ্ছে

স্পেনের এনজিওগুলো ইলন মাস্কের বিরোধিতায় এক্স ছেড়ে যাচ্ছে

যে দেশ বা সমাজে ন্যায়বিচার নেই, সে জাতিকে ধ্বংস করে দেন আল্লাহ: আল্লামা মামুনুল হক

যে দেশ বা সমাজে ন্যায়বিচার নেই, সে জাতিকে ধ্বংস করে দেন আল্লাহ: আল্লামা মামুনুল হক

গাজায় প্রতিদিন ঢুকবে ৬০০ ট্রাক ত্রাণ

গাজায় প্রতিদিন ঢুকবে ৬০০ ট্রাক ত্রাণ

যুদ্ধবিরতির আনন্দে গাজায় কর্মরত সাংবাদিকদের আবেগ-উল্লাস

যুদ্ধবিরতির আনন্দে গাজায় কর্মরত সাংবাদিকদের আবেগ-উল্লাস

ফের শৈত্যপ্রবাহের পূর্বাভাস দিলো আবহাওয়া অফিস

ফের শৈত্যপ্রবাহের পূর্বাভাস দিলো আবহাওয়া অফিস

লিমায় স্প্যানিশ বিজয়ী ফ্রান্সিসকো পিজারোর মূর্তি পুনঃস্থাপন

লিমায় স্প্যানিশ বিজয়ী ফ্রান্সিসকো পিজারোর মূর্তি পুনঃস্থাপন

আবারও পেছাল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফেরাতে রিভিউ শুনানি

আবারও পেছাল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফেরাতে রিভিউ শুনানি

‘প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগ বাধ্যতামূলকভাবে করতে হবে’

‘প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগ বাধ্যতামূলকভাবে করতে হবে’

রাজনীতির মধ্যে ঢুকতে চায় না ইসি, ভোটার তালিকা হালনাগাদ শুরু সোমবার

রাজনীতির মধ্যে ঢুকতে চায় না ইসি, ভোটার তালিকা হালনাগাদ শুরু সোমবার

টিকটকের যুক্তরাষ্ট্রে পরিষেবা বন্ধ, আইনি নিষেধাজ্ঞার প্রভাব

টিকটকের যুক্তরাষ্ট্রে পরিষেবা বন্ধ, আইনি নিষেধাজ্ঞার প্রভাব

ইউল্যাবের হাল্ট প্রাইজ নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ

ইউল্যাবের হাল্ট প্রাইজ নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ

স্পিকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিকল্পনা করছিলেন হাসিনা : দ্য হিন্দু

স্পিকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিকল্পনা করছিলেন হাসিনা : দ্য হিন্দু

আওয়ামী দুঃশাসনের যেন পুনরাবৃত্তি না হয়: রিজভী আহমেদ

আওয়ামী দুঃশাসনের যেন পুনরাবৃত্তি না হয়: রিজভী আহমেদ

সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে বিএনপির ভরাডুবি, আ.লীগের জয়জয়কার

সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে বিএনপির ভরাডুবি, আ.লীগের জয়জয়কার

সাইফের হামলাকারী বাংলাদেশি?

সাইফের হামলাকারী বাংলাদেশি?

থানায় বসে ঘুষ গ্রহণ: সেই এসআই প্রত্যাহার

থানায় বসে ঘুষ গ্রহণ: সেই এসআই প্রত্যাহার