কবি মলয় রায় চৌধুরী ও হাংরি আন্দোলন
০৩ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০৭ এএম | আপডেট: ০৩ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০৭ এএম
১৯৬১ সালের নভেম্বরে পাটনা শহর থেকে ইশতেহার প্রকাশের মাধ্যমে হাংরি আন্দোলনের সূত্রপাত করেছিলেন মলয় রায় চৌধুরী, সমীর রায় চৌধুরী ,শক্তি চট্টোপাধ্যায় এবং হারাধন ধারা ওরফে দেবী রায়। এ আন্দোলনে প্রায় চল্লিশজন কবি, লেখক ও চিত্রশিল্পী এই আন্দোলনে যোগ দেন, যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন বিনয় মজুমদার, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু, সুবিমল বসাক, বাসুদেব দাশগুপ্ত, ফালগুনী রায়, অনিল করঞ্জাই, রবীন্দ্র গুহ প্রমুখ।
এই আন্দোলনটি ছিল বাংলা সাহিত্যের প্রথম আন্দোলন, যা ১৯৬০ এর দশকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে আবির্ভূত হয়। হাংরি আন্দোলন একটি সামাজিক রাজনৈতিক এবং সাহিত্যের প্রলয়ংকারী তুফান হিসাবে আছড়ে পড়েছিল। বাঁধ ভাঙ্গার আওয়াজ তুলে ইশতেহার প্রকাশের মাধ্যমে বাংলা শিল্প ও সাহিত্যের যে একমাত্র আন্দোলন শুরু হয়েছে তার নাম হাংরি মুভমেন্ট বা ক্ষুধার্ত আন্দোলন।
স্পেংলার বলেছিলেন, একটি সংস্কৃতি কেবল সরলরেখা বরাবর যায় না; তা একযোগে বিভিন্ন দিকে প্রসারিত হয়। তা হল জৈবপ্রক্রিয়া, এবং সেকারণে সমাজটির নানা অংশের কার কোনদিকে বাঁকবদল ঘটবে তা আগাম বলা যায় না। যখন কেবল নিজের সৃজনক্ষমতার ওপর নির্ভর করে, তখন সংস্কৃতিটি বিকশিত ও সমৃদ্ধ হয়। তার সৃজনক্ষমতা ফুরিয়ে গেলে, তা বাইরে থেকে যা পায় ত-ই আত্মসাৎ করতে থাকে, খেতে থাকে, তার ক্ষুধা তখন তৃপ্তিহীন। সেকারণে মলয় রায়চৌধুরীকে হাংরি আন্দোলনের স্রষ্টা। হাংরি আন্দোলনকারীদের মনে হয়েছিল দেশভাগের ফলে উনিশ শতকের মণীষীদের পর্যায়ের বাঙালির আবির্ভাব আর সম্ভব নয়। সেকারণে হাংরি আন্দোলনকে তারা বললেন কাউন্টার কালচারাল আন্দোলন, এবং নিজেদের সাহিত্য কাউন্টার ডিসকোর্স। তারা বললেন, ইউরোপের শিল্প-সাহিত্য আন্দোলনগুলো সংঘটিত হয়েছিল একরৈখিক ইতিহাসের ধারণার বনেদের ওপর; কল্লোল বা কৃত্তিবাস গোষ্ঠী যে নবায়ন এনেছিলেন সে কাজগুলো ছিল কলোনিয়াল ইসথেটিক রিয়্যালিটি বা ঔপনিবেশিক বাস্তবতার চৌহদ্দির মধ্যে, কেন না সেগুলো ছিল যুক্তিগ্রন্থনা-নির্ভর, এবং তাঁদের মনোবীজে অনুমিত ছিল যে ব্যক্তিপ্রতিস্বের চেতনা ব্যাপারটি একক, নিটোল ও সমন্বিত।
হাংরি আন্দোলনকারিরা প্রধানত এক পৃষ্ঠার বুলেটিন প্রকাশ করতেন। যেগুলো পাটনা থেকে প্রকাশিত, সেগুলো ইংরেজিতে লেখা হয়েছিল। কখনও বা পোস্টকার্ড, পোস্টার এবং এক ফর্মার পুস্তিকা প্রকাশ করতেন। এক পাতার বুলেটিনে তারা কবিতা, রাজনীতি, ধর্ম, অশ্লীলতা, জীবন, ছোটগল্প, নাটক, উদ্দেশ্য, দর্শন ইত্যাদি বিষয়ে ইশতেহার লেখা ছাড়াও, কবিতা, গদ্য, অনুগল্প, স্কেচ ইত্যাদি প্রকাশ করেছিলেন। বুলেটিনগুলো হ্যান্ডবিলের মতন কলকাতার কলেজ স্ট্রিট কফি হাউস, পত্রিকা দফতর, কলেজগুলোর বাংলা বিভাগ ও লাইব্রেরি ইত্যাদিতে তারা বিতরন করতেন । ১০৮টি বুলেটিন প্রকাশ করা হয়েছিল, যার মাত্র কয়েকটি ‘লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি’ এবং ঢাকা বাংলা একাডেমিতে সংরক্ষণ করা গেছে। আমেরিকা ও ইউরোপে বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিন বিশেষ হাংরি আন্দোলন সংখ্যা প্রকাশ করেছিল যা ওই বয়সের কবি লেখকদের জন্য নিঃসন্দেহে অকল্পনীয়। কলকাতায় এই ধরনের সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল: ইহা কি বেহুদা পাগলামি?, দেবদূতেরা কি ভয়ংকর, চতুষ্পর্ণা, সাহিত্যে বিটলেমি কী এবং কেন?, হা-ঘরে সম্প্রদায়, কাব্যচর্চার নামে বিকৃত যৌন লালসা, পুলিশি বেটন কি শিল্প বিচার করবে?।
হাংরি আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে মোকদ্দমা দায়ের হয় ১৯৬৪ সালে এবং তা চলে ৩৫ মাস, অর্থাৎ ১৯৬৭ পর্যন্ত। ১২০বি এবং ২৯৪ ধারা তুলে নিয়ে কেবল ২৯২ ধারায় চার্জশিট দেয়া হয় মলয় রায়চৌধুরীর বিরুদ্ধে তার প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার কবিতাটির জন্য ; বাদবাকি সবাইকে রেহাই দেয়া হয়। নিম্ন আদালতে সাজা হলেও, তিনি উচ্চ আদালতে মামলা জিতে যান। কিন্তু মোকাদ্দমাটির কারণে মলয় রায়চৌধুরী খ্যাতি সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলনটি নিয়ে মলয় রায়চৌধুরী হাংরি কিংবদন্তি নামে একটি গ্রন্থে আন্দোলনের ইতিহাস তত্ত্ব ও তথ্য নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন। পরবর্তীকালে প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় নথিপত্র, আদালতে সাক্ষ্য, আদালতের রায় এবং হাংরি আন্দোলনকারীদের সাক্ষাৎকার নিয়ে প্রকাশিত হয় হাংরি আন্দোলন গ্রন্থ। এ আন্দোলনের প্রধান ভূমিকা রাখায় তাকে উপাধি দেওয়া হয় ক্ষুধার্ত প্রজন্মের পিতা।
১৯৬৩ সালের শেষার্ধে সুবিমল বসাক, দেবী রায় ও মলয় রায়চৌধুরীর কিছু-কিছু কার্যকলাপের কারণে হাংরি আন্দোলন বাঙালির সংস্কৃতিতে প্রথম প্রতিষ্ঠান বিরোধী গোষ্ঠী হিসাবে পরিচিত হয়। বহু আলোচক হাংরি আন্দোলনকারীদের সে সময়ের কার্যকলাপে ডাডাবাদের প্রভাব লক্ষ করেছেন। এই কারণে শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় সতীন্দ্র ভৌমিক প্রমুখ হাংরি আন্দোলন ত্যাগ করেন।
হাংরি আন্দোলনের অবদান সম্পর্কে বিভিন্ন আলোচক বিভিন্ন মতামত দিয়েছেন। হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে এম ফিল এবং পি আইচ ডি গবেষণা হয়েছে।
(১) পত্রিকার নামকরণ : হাংরি আন্দোলনের পূর্বে পত্রিকার নাম হতো কবিতা, পূর্বাশা, অরণি কৃত্তিবাস, অগ্রণি, শতভিষা,উত্তরসূরী, ধ্রুপদী, সংবাদ, ক্রান্তি, চতুরঙ্গ ইত্যাদি। হাংরি আন্দোলনকারীরা যে-ধরনের নাম রাখার চল করলেন তা বৈপ্লবিক। ফলে তার পর থেকে পত্রিকার নামকরণে বিপুল পরিবর্তন ঘটল। যেমন, কৌরব, আবার এসেছি ফিরে, মানুষের বাচ্চা, ঢপের কাগজ, আমি আর লীনা হেটে চলেছি, ক্ষেপচুরিয়াস, দিল্লী হাটার্স ইত্যাদি।
(২) পাঠবস্তুতে মুক্তসূচনা ও মুক্তসমাপ্তির প্রচলন,বিশেষ করে প্রদীপ চৌধুরী, ফালগুনী রায়, মলয় রায়চৌধুরী, ত্রিদিব মিত্র ও শৈলেশ্বর ঘোষের কবিতা-বিশেষ যেখান থেকে ইচ্ছা পড়া যায়, স্তবক ও পঙ্খক্তি উপর-নিচ রদবদল করে পড়া যায়। একই প্রক্রিয়া গদ্যে এনেছেন সুভাষ ঘোষ, সমীর রায়চৌধুরী, ফালগুনী রায় ও সুবিমল বসাক।
(৩)তাদের পাঠ্যবস্তু সম্পর্কে গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের রিডার ড, শঙ্কর ভট্টাচার্য লিখেছেন যে সেগুলো সাধারণত প্রতিবাদ-মুখর, আনুষ্ঠানিকতা-বর্জিত, প্রাতিস্বিকতায় ভঙ্গুর, অস্হির, অস্বস্তিকারক ছকহিন, ঐক্যহীন, খাপছাড়া, এলোপাতাড়ি ও আয়রনিমূলক”। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগীব প্রধান ড. তরুণ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, ভাষায়, ছন্দে, অলংকার, স্তবকে তুমুল ভাংচুর” করেছেন তারা, এবং যৌনতার সঙ্গে এসেছে ব্যঙ্গ, আত্মপরিহাস ও অসহায় মানুষের নিস্ফলতার যন্ত্রণা; আত্মপ্রক্ষেপ ঘটিয়ে তঁরা নিরপেক্ষ হয়ে যান”। আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বি. দে মলয় রায়চৌধুরী ও হাংরি আন্দোলন বিষয়ে ৩৫০ পৃষ্ঠার গবেষণার জন্য পিএচ.ডি. সম্মান দ্বারা ভূষিত হয়েছেন।
১৯৬৪ সালে হাংরি আন্দোলনের সাথে জড়িত সকল কবি, লেখক, চিত্রশিল্পী, সাংবাদিকদের নামে মামলা করা হয় আর ৬-৭ জনকে গ্রেফতার করা হয় কিন্তু উপযুক্ত প্রমাণ না পাওয়াতে আবার ছেড়ে দিতে হয়েছে অনেক জনকে। আর তারপরে ১৯৬৫ সালের শেষের দিকে এই আন্দোলন একদম থেমে যায়। এর পরেও কয়েকজন চেষ্টা করেছিলেন আন্দোলনকে টিকিয়ে রাখার জন্য কিন্তু তারা আর পেরে উঠতে পারে নি। ফলে ১৯৬৬ সালের গোঁড়ার দিকে এই আন্দোলন ইতিহাস হয়ে যায়।
হাংরি আন্দোলনকে কেন্দ্র করে তৎকালীন সময়ে (১৯৬১-১৯৬৫) অনেক কবি, সাহিত্যিক, লেখকগণ বিখ্যাত হংরিয়ালিস্ট কবিতা ও গদ্য রচনা করেন তন্মধ্যে।
বিখ্যাত কয়েকটি হাংরিয়ালিস্ট কবিতা:
উৎপলকুমার বসু রচিত পোপের সমাধি
মলয় রায়চৌধুরী রচিত প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার
শক্তি চট্টোপাধ্যায় রচিত সীমান্ত প্রস্তাব: মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি আবেদন বিনয় মজুমদার রচিত একটি উজ্জ্বল মাছ ত্রিদিব মিত্র রচিত হত্যাকাণ্ড কয়েকটি বিখ্যাত হাংরিয়ালিস্ট গদ্য:
সুবিমল বসাক রচিত ‘ছাতামাথা’, সমীর রায়চৌধুরী রচিত ‘স্মৃতির হুলিয়া’ ও প্রতুলের মা ওমলেট অবধি ফালগুনী রায় রচিত ‘কাঠের ফুল’ বাসুদেব দাশগুপ্ত রচিত ‘বমনরহস্য, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘বিজনের রক্তমাংস’, হাংরি জেনারেশনের লক্ষ্য ছিল সমাজকে উস্কে দেওয়া এবং প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিক রীতিনীতিকে চ্যালেঞ্জ করা তাদের ইশতেহার মলয় দ্বারা লিখিত প্রচলিত সাহিত্য প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা।
বিভাগ : সাহিত্য
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
বাংলাদেশের বিপক্ষে যে একাদশ দিয়ে মাঠে নামছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ
কিশোরগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা আনোয়ার কামালসহ তিনজন গ্রেফতার
প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানের সাক্ষাৎ
বেইজিং সংস্কৃতি ও পর্যটন ব্যুরো ও আটাবের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত
উইন্ডিজের বিপক্ষে মাঠে নামছে বাংলাদেশ
গাজায় যুদ্ধবিরতি ছাড়া বন্দী বিনিময় হবে না : হামাস
শান্তিরক্ষা মিশন মোতায়েন করতে চায় জাতিসংঘ হাইতিতে
চকরিয়ার বিএনপি নেতা আবু তাহের চৌধুরীর মৃত্যুতে সালাহউদ্দিন আহমদ ও হাসিনা আহমদের শোক
পুতিন পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে দ্বিধা করবেন না : সার্বিয়া
ক্লাইমেট অর্থায়ন ইস্যুতে দেশগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব
লালমোহনে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত যুবদল নেতা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু
ট্রাম্পের অ্যাটর্নির বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন আটকে গেল
‘ফিলিস্তিনের পর ইরান, সউদী ও তুরস্ক হবে পরবর্তী টার্গেট’
প্রতি বছর ৩ লাখ নথিবিহীন অভিবাসীকে বৈধতা দানের ঘোষণা স্পেনের
প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে সবচেয়ে অসুখী দেশ জাপান-কোরিয়া
মুসলিম চিকিৎসক
শীর্ষে দিল্লি
সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সংবর্ধনা
ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর বোর্ড অব গভর্নর সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সম্বর্ধনা
বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার আহ্বান