একজন আসাদ চৌধুরী
১৭ নভেম্বর ২০২৩, ১২:১০ এএম | আপডেট: ১৭ নভেম্বর ২০২৩, ১২:১০ এএম
সব্যসাচী লেখক আসাদ চৌধুরী বাংলা সাহিত্যের একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র। কবিতা- তখন সত্যি মানুষ ছিলাম/আসাদ চৌধুরী
নদীর জলে আগুন ছিলো/আগুন ছিলো বৃষ্টিতে/আগুন ছিলো বীরাঙ্গনার/ উদাস-করা দৃষ্টিতে।/ আগুন ছিলো গানের সুরে/ আগুন ছিলো কাব্যে,/ মরার চোখে আগুন ছিলো/ এ-কথা কে ভাববে?/ কুকুর-বেড়াল থাবা হাঁকায়/ ফোসে সাপের ফণা/ শিং কৈ মাছ রুখে দাঁড়ায়।
জ্বলে বালির কণা।/ আগুন ছিলো মুক্তি সেনার/ স্বপ্ন -ঢলের বন্যায়-/ প্রতিবাদের প্রবল ঝড়ে/ কাঁপছিলো সব-অন্যায়।/ এখন এ-সব স্বপ্নকথা/ দূরের শোনা গল্প,
তখন সত্যি মানুষ ছিলাম/ এখন আছি অল্প।
প্রিয়কবি এবং ককথাসাহিত্যিক আসাদ চৌধুরী ১৯৪৩ সালে ১১ ই ফেব্রুয়ারি তৎকালীন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির বাকেরগঞ্জ জেলার মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার উলানিয়া জমিদার বাড়িতে একটি সম্ভ্রান্ত বাঙ্গালী মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার মাতার নাম সৈয়দা মাহমুদা বেগম এবং স্ত্রীর নাম সাহানা বেগম। তাঁর পূর্বপুরুষ শায়খ মহম্মদ আসাদ আলী পারস্য থেকে ভারতবর্ষের অযোধ্যায় এসেছিলেন। তারপর সেখান থেকে বাংলার মুর্শিদাবাদে আসেন। শায়খ মহম্মদ আসাদ আলীর নাতির ঘরের নাতির ছেলে মহম্মদ হানিফ ছিলেন সুবাহদার শায়েস্তা খাঁর অন্যতম একজন সেনানায়ক। যিনি মগ-পর্তুগিজ জলদস্যু দমনে কর্মরত এবং গোবিন্দপুরের সংগ্রাম কেল্লার জমাদার ছিলেন। হানিফ বৃহত্তর বরিশালের তেতুলিয়া গাঁওয়ে বসবাস শুরু করেন। এই বংশের মহম্মদ তকি তেঁতুলিয়া জমাদার বাড়ি ছেড়ে উলানিয়ায় বসতি স্থাপন করেন। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি তথ্য এই যে, তাঁর ছেলে হাসন রাজা হলেন আসাদ চৌধুরীর পরদাদা এবং তিনি তাঁর দুই ভাই কালা রাজা ও নয়া রাজার সাথে সুপারি, লবণ, চালের ব্যবসা করে কলকাতার মারোয়াড়িদের বিখ্যাত বণিক হুকুম চাঁদের সাথে মিত্রতা লাভ করেছিলেন। তিন পরদাদারা লালগঞ্জ, আলিগঞ্জ ও কালিগঞ্জ বন্দর প্রতিষ্ঠা করেন এবং প্রচুর ফুলুস জমা করে ইদিলপুর জমিদারী স্থাপন করেন। আসাদ চৌধুরীর বংশলতিকা হচ্ছে: আসাদ চৌধুরী ইবনে মহম্মদ আরিফ চৌধুরী ইবনে এছলাম চৌধুরী ইবনে মজিদ চৌধুরী ইবনে হাসন রাজা ইবনে মহম্মদ তকি।
কবি আসাদ চৌধুরীর শিক্ষা জীবনও বর্ণাঢ্য এবং আলোকোজ্জ্বল। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকে যাওয়ার পর কলেজে অধ্যাপনার মধ্য দিয়ে আসাদ চৌধুরীর চাকুরি জীবন শুরু হয়। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজে ১৯৬৪ থেকে ১৯৭২ পর্যন্ত শিক্ষকতা করেন। পরবর্তীকালে ঢাকায় স্থিত হবার পর তিনি বিভিন্ন খবরের কাগজে সাংবাদিকতা করেছেন। ১৯৮৫ থেকে ১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি ভয়েজ অব জার্মানীর বাংলাদেশ সংবাদদাতার দায়িত্বও পালন করেন। সবশেষে ঢাকায় বাংলা একাডেমিতে দীর্ঘকাল চাকুরীর পর তিনি পরিচালক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। বর্ণিল কর্মময় জীবনের বাঁকে বাঁকে তিনি আমাদের জন্য, বাংলা ভাষা এবং বাংলা সাহিত্যের জন্য লিখে গেছেন অনেক কালজয়ী গ্রন্থ। এই যেমন তার লেখা কাব্যগ্রন্থ- তবক দেওয়া পান (১৯৭৫), বিত্ত নাই বেসাত নাই (১৯৭৬), প্রশ্ন নেই উত্তরে পাহাড় (১৯৭৬), জলের মধ্যে লেখাজোখা (১৯৮২), যে পারে পারুক (১৯৮৩),
মধ্য মাঠ থেকে (১৯৮৪), মেঘের জুলুম পাখির জুলুম (১৯৮৫), আমার কবিতা (১৯৮৫), ভালোবাসার কবিতা (১৯৮৫), প্রেমের কবিতা (১৯৮৫), দুঃখীরা গল্প করে (১৯৮৭), নদীও বিবস্ত্র হয় (১৯৯২), টান ভালোবাসার কবিতা (১৯৯৭), বাতাস যেমন পরিচিত (১৯৯৮), বৃন্তির সংবাদে আমি কেউ নই (১৯৯৮), কবিতা-সমগ্র (২০০২)
কিছু ফল আমি নিভিয়ে দিয়েছি (২০০৩), ঘরে ফেরা সোজা নয় (২০০৬)। প্রবন্ধ-গবেষণা: কোন অলকার ফুল (১৯৮২) শিশুসাহিত্য: রাজার নতুন জামা (রূপান্তর, ১৯৭৯), রাজা বাদশার গল্প (১৯৮০), গ্রাম বাংলার গল্প (১৯৮০), ছোট্ট রাজপুত্র (অনুবাদ : ১৯৮২)
গর্ব আমার অনেক কিছুর (১৯৯৬), ভিন দেশের মজার লোককাহিনী (১৯৯৯), তিন রসরাজের আড্ডা (১৯৯৯)
কেশবতী রাজকন্যা (২০০০), গ্রাম বাংলা আরো গল্প (২০০০), তোমাদের প্রিয় চার শিল্পী (জীবনীগ্রন্থ, ২০০০)
জন হেনরি (আমেরিকার লোককাহিনী, ২০০১), মিকালেঞ্জেনো (জীবনী, ২০০১), ছোটদের মজার গল্প (২০০১) সোনার খড়ম (২০০৬), মুচি-ভ’তের গল্প (২০০৬)। জীবনীগ্রন্থ: সংগ্রামী নায়ক বঙ্গবন্ধু (১৯৮৩),
রজনীকান্ত সেন (১৯৮৯), স্মৃতিসত্তায় যুগলবন্দী (২০০১), ইতিহাস বিষয়ক গ্রন্থ: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ (১৯৮৩) অনুবাদগ্রন্থ: বাড়ির কাছে আরশিনগর : বাংলাদেশের উর্দু কবিতা (২০০০), প্যালেস্টাইন ও প্রতিবেশী দেশের প্রতিবাদী কবিতা (২০০৫), যাদের রক্তে মুক্ত এদেশ (১৯৯১ যুগ্মভাবে), ছয়টি রূপকথা (১৯৭৯)।
নিরীহ, নিভৃতচারী অথচ প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর কবি আসাদ চৌধুরীর জীবনে ব্যক্তিগত অর্জনও কম নয়। প্রতিভাদীপ্ত লেখার মাধ্যমে তিনি যেমন অসংখ্য পাঠকের হৃদয় জয় করেছেন; তেমনি পেয়েছেন অনেক সম্মাননা এবং পুরস্কার। এই যেমন: আবুল হাসান স্মৃতি পুরস্কার (১৯৭৫), অগ্রণী ব্যাংক শিশুসাহিত্য পুরস্কার (১৯৮২), বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৮৭),
শম্ভুগঞ্জ এনায়েতপুরী স্বর্ণপদক (১৯৯৯), ত্রিভুজ সাহিত্য পুরস্কার, বরিশাল বিভাগীয় স্বর্ণপদক, অশ্বনী কুমার পদক (২০০১), জীবনানন্দ দাশ পদক, অতীশ দীপঙ্কর স্বর্ণপদক, জাতীয় কবিতা পরিষদ পুরস্কার (২০০৬), বঙ্গবন্ধু সম্মাননা ১৪১৮, একুশে পদক (২০১৩), শব্দভূমি আজীবন সাহিত্য সম্মাননা (২০১৮) প্রভৃতি।
প্রিয়কবি আসাদ চৌধুরীর আরও একটি বিখ্যাত কবিতার উদ্ধৃতি না দিয়ে পারছি না। কবিতার নাম-
সত্য ফেরারী/ আসাদ চৌধুরী
কোথায় পালালো সত্য?/দুধের বোতলে, ভাতের হাঁড়িতে! নেই তো/ রেষ্টুরেন্টে, হোটেলে, সেলুনে,/
গ্রন্থাগারের গভীর গন্ধে,/ টেলিভিশনে বা সিনেমা, বেতারে,/ নৌকার খোলে, সাপের ঝাঁপিতে নেই তো!
কবিতায় নেই, সঙ্গীতে নেই/ রমণীর চারু ভঙ্গিতে নেই/
পাগলের গাঢ় প্রলাপেও নেই/ নাটকের কোন সংলাপে নেই/ শাসনেও নেই, ভাষণে নেই/ আঁধারেও নেই, আলোতেও নেই/ রেখাতেও নেই, লেখাতেও নেই,/উত্তরে নেই, প্রশ্নেও নেই/ লেবাসে নেই, সিলেবাসে নেই/
পারমিটে নেই, বোনাসেও নেই/হতাশায় নেই, আশাতেও নেই/ প্রেম-প্রীতি ভালবাসাতেও নেই/ এমন কি কালোবাজারেও নেই/ কোথায় গেলেন সত্য?.সত্যান্বেষী
কবির কী অসাধারণ অনুভব! আমাদের ব্যক্তিগত জীবন থেকে বৈশ্বিক জীবন পর্যন্ত সবখানে আজ সত্যের সংকট। কোথাও যেন এর দেখা পাওয়া ভার! অত্যন্ত জীবন ঘনিষ্ঠ এবং দার্শনিক চেতনায় ভরপুর এই ‘সত্য ফেরারী’ কবিতাটি অবশ্যই বারবার পাঠ করার মতো।
বিভাগ : সাহিত্য
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
বাংলাদেশের বিপক্ষে যে একাদশ দিয়ে মাঠে নামছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ
কিশোরগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা আনোয়ার কামালসহ তিনজন গ্রেফতার
প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানের সাক্ষাৎ
বেইজিং সংস্কৃতি ও পর্যটন ব্যুরো ও আটাবের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত
উইন্ডিজের বিপক্ষে মাঠে নামছে বাংলাদেশ
গাজায় যুদ্ধবিরতি ছাড়া বন্দী বিনিময় হবে না : হামাস
শান্তিরক্ষা মিশন মোতায়েন করতে চায় জাতিসংঘ হাইতিতে
চকরিয়ার বিএনপি নেতা আবু তাহের চৌধুরীর মৃত্যুতে সালাহউদ্দিন আহমদ ও হাসিনা আহমদের শোক
পুতিন পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে দ্বিধা করবেন না : সার্বিয়া
ক্লাইমেট অর্থায়ন ইস্যুতে দেশগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব
লালমোহনে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত যুবদল নেতা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু
ট্রাম্পের অ্যাটর্নির বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন আটকে গেল
‘ফিলিস্তিনের পর ইরান, সউদী ও তুরস্ক হবে পরবর্তী টার্গেট’
প্রতি বছর ৩ লাখ নথিবিহীন অভিবাসীকে বৈধতা দানের ঘোষণা স্পেনের
প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে সবচেয়ে অসুখী দেশ জাপান-কোরিয়া
মুসলিম চিকিৎসক
শীর্ষে দিল্লি
সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সংবর্ধনা
ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর বোর্ড অব গভর্নর সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সম্বর্ধনা
বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার আহ্বান