চণ্ডীমঙ্গলের মুকুন্দরাম চক্রবর্তী

মধ্যযুগের সমাজ দর্পণ

Daily Inqilab রেশম লতা

২৯ মার্চ ২০২৪, ১২:৩৩ এএম | আপডেট: ২৯ মার্চ ২০২৪, ১২:৩৩ এএম

মধ্যযুগের ষোড়শ শতাব্দীর কবি কঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর মত এত বড় বাস্তববাদী জীবনবাদী কবি আর দ্বিতীয়টি জন্মায়নি। বর্ধমান জেলার দামুন্যা গ্রামে পিতা হৃদয় মিশ্র, মাতা দৈবকীর কোলে জন্ম এই মহামনিষীর। শৈশব থেকেই দুর্গতির যে চিত্র তার মনে রেখায়িত হয়েছে তার ঘাত-প্রতিঘাতের অভিজ্ঞতা সুগভীর ও সূক্ষ্ম। ডিহিদারের অত্যাচারে মেদিনীপুর জেলার আড়রা গ্রামের ব্রাহ্মণ জমিদার বাঁকুড়া রায়ের আশ্রয়ে যাওয়া কবি এক সময় হয়ে উঠেন চ-ীমঙ্গল কাব্যের শ্রেষ্ঠ রূপকার। তার রচিত কালকেতু উপাখ্যান বাংলা সাহিত্যের জ্বলন্ত অগ্নি শিখা। চন্ডীমঙ্গল কাব্যে মুকুন্দরাম চক্রবর্তী ব্যক্তিজীবনের জীবনালেখ্য হলেও তা যেন সর্বজনীন। তৎকালীন সমাজের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থার যে নিদর্শন পাওয়া যায় তা তিনি দক্ষ রচনাশৈলীর মিশেলে চিত্রায়ণ করেছেন। মুকুন্দরাম সমাজের যে শ্রেণীর মানুষকে দেখেছিলেন ঠিক তাই কাব্য কাহিনীতে অবলীলায় ঠাঁই দিয়েছেন। গৃহ হতে নির্বাসনে তিনি যে দুঃখ ব্যক্তিজীবনে উপলব্ধি করেছিলেন তা গুজরাট নগর পত্তনকালে কালকেতুকে দিয়ে বুলান মন্ডলকে বলেছেন

‘শুণ ভাই বুলান মন্ডল।
আইস আমার পুর সন্তাপ করিব দূর
কানে দিব সোনার কু-ল।।
আমার নগরে বৈস যত ইচ্ছা চাষ চষ
তিন সন বহি দিও কর।।’
চ-ীমঙ্গল কাব্য মূলত দেবদেবীর মাহাত্ম্য প্রচারের উদ্দেশ্যে রচিত। এ কাব্যে তিনি বিষয়গত নতুনত্বের পাশাপাশি এর চরিত্র নির্মাণ, ভাষা, ছন্দ ও অলংকার প্রয়োগে অসামান্য কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। তাঁর এ অভিনব রচনা কৌশলের জন্য তিনি কালোত্তীর্ণ মহিমার দাবিদার। বাংলার সমসাময়িক সমাজ জীবনের পরিচয় দিতে গিয়ে তিনি কলিঙ্গ রাষ্ট্র ও গুজরাট রাষ্ট্রের বিবরণ টেনেছেন। তৎকালীন সমাজে রাষ্ট্রের প্রকৃতি, প্রশাসন ব্যবস্থা, উৎপাদন, বন্টন, আমদানি, রপ্তানি, কৃষি ও কৃষক, খাদ্যাভ্যাস, ব্যবসায়-বাণিজ্য, উৎসব, কুটির শিল্প, কর নির্ধারণ ব্যবস্থা, বিভিন্ন শ্রেণীর পেশাজীবী মানুষ ও তাদের জীবিকা সম্পৃক্ত জীবনাচরণ তথা ভাব, চিন্তা, কর্ম ও আচরণে জীবনের সার্বক্ষণিক অভিব্যক্তির চিত্র অত্যন্ত সার্থকভাবে তুলে ধরেছেন। মুকুন্দরাম মুসলমানদের সম্পর্কে লিখেছেনথথ ‘রোজা নামাজ না জানিয়া কেহ হৈল গোলা।

তাসন করিয়া নাম ধরাইল জোলা।
বলদ বাহির কেহো বোলায় মুকেরি।
পিঠা বেচিয়া নাম ধরাল্য পিঠারি।।’
ব্রাহ্মণদের সম্বন্ধে বলতে গিয়ে তুলে ধরেছেন
‘চন্দন তিলক পরে দেব পূজে ঘরে ঘরে।
চালের ফুচকা বান্ধে টান।।
ময়রা ঘরে পায় খন্ড গোস ঘরে দধিভা-।
তৈল ঘরে তৈল কুপী ভরি।।’

বস্তুবাদী শিল্প যে নিষ্ঠায় স্বতন্ত্র ও নিরপেক্ষ দৃষ্টি নিয়ে চরিত্র সৃষ্টি করেন তার অনেকটাই কবি কঙ্কনের আয়ত্তে ছিল। প্রধান অপ্রধান উভয় চরিত্রই তার হাতে চমৎকারভাবে জীবন্ত। কালকেতুই যেন মুকুন্দরামের মানসপট। পল্লী ভাষার সহজ সরল রূপ ও পল্লীর উৎপ্রেক্ষা তার কাব্যে প্রকাশ পেয়েছে। গ্রাম্য ভাষার যে শৈল্পিক নিদর্শন তা দেখি

‘নানা বস্তু কেনে হাটে হরিণ মহিষ কাটে
নিমন্ত্রণে আনে বন্ধুজন।
লৈয়া অধিবাস ডালা কিরাত নগরে গেলা
বন্ধু মেলি সোমাই ব্রাহ্মণ।।’
কবিকঙ্কন এর কৃতিত্ব প্লট ও কাহিনী সৃষ্টিতে নয়, কিছুটা সামঞ্জস্যবিধানে হতে পারে। কিন্তু তাঁর আশ্চর্য নৈপুণ্য হল বর্ণনাশক্তিতে। কি সমাজ ও ব্যক্তিসহ নিসর্গ, কি ঘটনা ও চরিত্রের বর্ণনা সর্বত্র তিনি অতিরেক সংক্ষিপ্ততার মধ্যবর্তী। কয়েকটি মাত্র বিষয় ও বাক্যে তিনি এমনভাবে বর্ণনা করছেন যা বাকি সব ব্যঞ্জনা আপনা হতেই ধরা দিয়েছে । আর সেই সাথে বর্ণিত বিষয়ের একটি পূর্ণাঙ্গ ছবিও ফুটে ওঠেছে। পশু শিকারে ব্যর্থ মনোরথ এবং মায়ামৃগ এর পিছনে ছুটে ক্লান্ত, তৃষ্ণার্ত ও ক্ষুধার্ত কালকেতু খালি হাতে ঘরে ফিরে চিত্রটা ঠিক এমনটাই যা তদানীন্তন পশু শিকারীর অব্যক্ত বর্ণানাই

‘অদ্ভুত মায়ামৃগ দেখি মহাবীর।
গুণহীন করি ধনুক সংবরিল তীর
কংস নদীর জলে কৈল ¤œান দান
তৃষ্ণায় আকুল হৈয়া কৈল জলপান।।’
মুকুন্দরাম নিজের মানসিক ঔদার্যে, স্বল্প পরিসরে সমাজ সংস্কৃতি ও মানব চরিত্র সম্পর্কে আশ্চর্য রকম বাস্তবতার পরিচয় দিয়েছেন। আভিজাত্যের গৌরবহীন সাধারণ বাঙালি জীবন অতীত উপকরণ সংগ্রহ করে তিনি সাহিত্যের চরিত্র সৃষ্টি করেছেন। ফলে প্রতিটি চরিত্রের চিন্তা-চেতনায়, মননে, বিশ্বাসে সে সময়কার মানুষগুলো উঠে এসেছে। যেমন কালকেতুর জন্মবাল্য ক্রীড়া, বিবাহ অনুষ্ঠান, কালকেতু ফুল্লরার জীবন সংগ্রাম, মুরারিশীল ভাড়ুদত্তের কপট আচরণ, কলিঙ্গ রাজের সাথে কালকেতুর যুদ্ধ প্রভৃতি স্থানে যে চিত্র মুকুন্দরাম এঁকেছেন তা ষোড়শ শতাব্দীর বাংলার মানুষ এবং মানুষের আচার-আচরণের এক জীবন্ত প্রতীক এবং তার বিশেষ রূপ দিতে তিনি সার্থকও হয়েছেন

‘সরকার হৈল কাল খীল ভূমি লেখে লাল
বিনি উপকারে খায় ধুতি।
পোতাদার হৈল যম টাকা আড়াই আনা কম
পায় লভ্য খায় প্রতি
ডিহিদার অবোধ খোজ কড়ি দিলে নাহি রোজ
ধান্য গরু কেহ নাহি কেনে।।’
তৎকালীন সমাজে উঁচু-নিচুর মধ্যে প্রবল বৈষম্য ছিল। তথাকথিত নি¤œ শ্রেণীর লোকেরা অতি দুঃখে জীবন যাপন করত। ফুল্লরা কালকেতুর সংসারে সারা বছর অভাব অনটন লেগে থাকত। অনাহারে অর্ধাহারে দিনাতিপাত করত। তাদের এই বারোমাসের দুঃখের জীবনযাত্রার চিত্রটি এভাবে ফুটে উঠেছে

‘মাস মধ্যে মাইসর আপনে ভগবান
হাটে মাঠে গৃহে সভাকর ধান।।
উদর পূরিয়া অন্ন দৈবে দিল যদি
যমসম শীত তথি নিরমাল্য বিধি।।’

তৎকালীন সমাজের মানুষ কুসংস্কারে ছিল বিশ্বাসী । যেমন, স্বর্ণগোধিকা যাত্রা মুখে দেখলে অকল্যাণের আভাস। বাম চোখ কেঁপে উঠলে অমঙ্গল হয়। ফুল্লরার বাম চোখ কেঁপে উঠায় সে অমঙ্গলের আভাস পায়। যাদু টোনারও বিশ্বাস করত। আর এই সমস্ত কিছুই মুকুন্দরাম খুব নিঁখুতভাবে চন্ডীমঙ্গলে কাব্যে কালকেতু উপাখ্যানে তুলে ধরেছেন। রাজনৈতিকভাবে পরাজিত ব্যক্তির শাস্তি জেল বা মৃত্যুদ-। তখনকার জেলখানা ছিল নরক সদৃশ। পরাজিত কালকেতুকে কলিঙ্গরাজ একটি মাত্র দরজা সম্পন্ন ছোট কোটরে শিকল দিয়ে বেঁধে রেখে তার বুকে পাথর চাপা দিয়ে ঘরের মধ্যে তুষের আগুনের ধোঁয়া সৃষ্টি করে শাস্তি প্রদান করে তখনকার রাজাদের আচরণ অপরাধীর প্রতি ঠিক এমনটাই ছিল। এই যে তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থা তা একমাত্র মুকুন্দরামের লেখাতেই পাওয়া গেছে। সামাজিক বিচার ব্যবস্থায় ভাড়ুদত্তের যে নির্মম শাস্তি তা অন্তজ শ্রেণীর প্রতীক। তাকে ন্যাড়া করে মাথায় ঘোল ঢেলে, ছেঁড়া জুতা মালা দিয়ে, গায়ে মুখে চুনকালি মাখানো হয়েছে এবং বাদ্যযন্ত্র সহযোগে রাস্তায় ঘুরানো যেন জ্বলন্ত উদাহরণ।

মুকুন্দরাম তাঁর চন্ডীমঙ্গল কাব্যে বাস্তব তথ্যের সাথে জীবনরসের ও সাহিত্যিক সত্যের এক অপূর্ব সমীকরণ ঘটিয়েছেন। কাব্যের সাথে জীবনের এক নিবিড় যোগ ইতঃপূর্বে বাংলা সাহিত্যে আর দেখা যায় নি। তিনি বাস্তব জীবনকে রূপায়িত করেছেন সত্য কিন্তু সে জীবন তার নিজস্ব অভিজ্ঞতার ছিল। যার দুঃখ তিনি একা ভোগ করেছেন। কাব্যের অন্তরীক্ষে তিনি সুন্দর, সাবলীল ও মর্মস্পর্শী করে তোলার জন্য আরবি, ফারসি, গ্রাম্য প্রভৃতি ভাষার শব্দসম্পদকে যেভাবে ব্যবহার করেছেন তা তার কাব্য প্রতিভার স্বাক্ষর হয়ে কালোত্তীর্ণ মহিমার দাবি রাখে।

 


বিভাগ : সাহিত্য


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

রোনালদো ফেরার ম্যাচে জিতল নাসের

রোনালদো ফেরার ম্যাচে জিতল নাসের

বাবর আজমের ব্যাটিংয়ের পর শাহিন আফ্রিদির বোলিং নৈপুণ্যে সমতায় সিরিজ শেষ পাকিস্তানের

বাবর আজমের ব্যাটিংয়ের পর শাহিন আফ্রিদির বোলিং নৈপুণ্যে সমতায় সিরিজ শেষ পাকিস্তানের

বার্নলির বিপক্ষে ঘরের মাঠে ইউনাইটেডের ড্র

বার্নলির বিপক্ষে ঘরের মাঠে ইউনাইটেডের ড্র

শার্ক ট্যাংক বাংলাদেশ’র প্রথম পর্বেই ১ কোটির বেশি বিনিয়োগ

শার্ক ট্যাংক বাংলাদেশ’র প্রথম পর্বেই ১ কোটির বেশি বিনিয়োগ

আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রাখতে কাজ করেছিল তিন বিদেশি শক্তি: জিএম কাদের

আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রাখতে কাজ করেছিল তিন বিদেশি শক্তি: জিএম কাদের

থাই ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহ্বান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর

থাই ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহ্বান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর

ইপিজেড ও বেপজা অর্থনৈতিক অঞ্চলে দক্ষিণ কোরীয় বিনিয়োগ চায় বাংলাদেশ

ইপিজেড ও বেপজা অর্থনৈতিক অঞ্চলে দক্ষিণ কোরীয় বিনিয়োগ চায় বাংলাদেশ

আরও কমলো স্বর্ণের দাম

আরও কমলো স্বর্ণের দাম

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ফুটবল খেলা শেষে হামলায় যুবক নিহত

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ফুটবল খেলা শেষে হামলায় যুবক নিহত

টিভিতে দেখুন

টিভিতে দেখুন

বিশ্বকাপ প্রস্তুতির লড়াইয়ে হারানো গৌরবের খোঁজে

বিশ্বকাপ প্রস্তুতির লড়াইয়ে হারানো গৌরবের খোঁজে

বন্যার পর এবার ঘন কুয়াশার চাদরে ঢাকা পড়লো দুবাই

বন্যার পর এবার ঘন কুয়াশার চাদরে ঢাকা পড়লো দুবাই

স্কোয়াশে শাহাদাত চাঁদনী চ্যাম্পিয়ন

স্কোয়াশে শাহাদাত চাঁদনী চ্যাম্পিয়ন

পাক-ভারত রোমাঞ্চের অপেক্ষায় যুবরাজও

পাক-ভারত রোমাঞ্চের অপেক্ষায় যুবরাজও

ফের জামালকে হারালো বসুন্ধরা

ফের জামালকে হারালো বসুন্ধরা

কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্য ও সুরক্ষাবিধি নিশ্চিতে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে : রাষ্ট্রপতি

কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্য ও সুরক্ষাবিধি নিশ্চিতে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে : রাষ্ট্রপতি

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নিখোঁজের চারদিন পর বৃদ্ধের লাশ উদ্ধার

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নিখোঁজের চারদিন পর বৃদ্ধের লাশ উদ্ধার

বিসিবির লেগ স্পিনার হান্ট

বিসিবির লেগ স্পিনার হান্ট

নারী লিগের সময় বদলে গেলে

নারী লিগের সময় বদলে গেলে

বর্তমান সরকার আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর : শেখ হাসিনা

বর্তমান সরকার আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর : শেখ হাসিনা