প্রতিভা বসুর বর্ণনায় ওস্তাদ নজরুল
০৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২:৩৬ এএম | আপডেট: ০৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২:৩৬ এএম
নজরুল ইসলাম অন্ধকারেও চোখে দেখতে পেতেন। এই ক্ষমতা তাঁর জেলের ‘সেলে’ আবদ্ধ থাকার সময়ে আয়ত্ত হয় । অন্ধকারে ঠিক বই পড়তে পারতেন কিনা জানি না তবে লিখতে কোনো অসুবিধে হতো না। এই কীর্তনটি তিনি রাত জেগে অন্ধকারে বসেই লিখেছিলেন। আমাদের চুঁচুড়ার বাড়িতে বিদ্যুৎ ছিল না, ঘুমের আগে সব আলো নিভিয়ে শোওয়া হতো। রাস্তায়ও বিদ্যুৎ ছিল না, দূরে দূরে গ্যাসপোস্ট থাকতো, তার আলো খুব নরম। কাজেই ঘরের আলো নিভে গেলে ঘোর অন্ধকারে ছেয়ে যেতো চার দেওয়ালের পৃথিবী। সেই অন্ধকারে তিনি কী করে সমস্ত লাইন সমানভাবে সাজিয়ে লিখতে পারতেন ভেবে খুব অবাক হতাম। শুধু ঐ কীর্তনই নয়, আমাদের কাছে থাকাকালীন বহু গান তিনি রাত্রি নিঃশব্দ হলে, সবাই ঘুমিয়ে পড়লে নির্জন অন্ধকারে বসে সুর করে লিখেছেন। আর সকালে উঠেই চ্যাঁচামেচি ‘এসো এসো তাড়াতাড়ি এসো, শিগ্গির সুরটা তুলে নাও হারমোনিয়মে—
যদি বলতাম, ‘কী করে মানুষ অন্ধকারে দেখতে পায়—-- হাসতে হাসতে অস্থির হয়ে বলতেন, ‘না না অন্ধকারে দেখবো কেন, মা যে একটা লণ্ঠন ধরিয়ে দিয়ে গেলেন। তাই না মা ?
মা মানে আমার মা। মা চায়ের কাপ এগিয়ে দিতে দিতে হাসতেন।
এরপরেই কীর্তনে পেয়ে বসলো ওঁকে। পর পর তিনটি কীর্তন লিখলেন। শেখানো হয়ে গেলে বললেন, ‘চলো, কলকাতা চলো, এবার। আমাদের কীর্তনের আসর বসাতে হবে নলিনীদার বাড়িতে। ঈশ্শ্, মন্টু নেই, কী মজাই হতো তবে।
মন্টু মানে দিলীপদা ততোদিনে শ্রীঅরবিন্দের শিষ্য হয়ে প-িচেরী নিবাসী হয়েছেন। লোকেরা বলতো উনি সন্ন্যাসী হয়ে চলে গেছেন। মনে আছে খবরটা পেয়ে খুব কেঁদেছিলাম। প-িচেরী যাবার আগে ঠিকানা জানিয়ে চিঠি লিখেছিলেন একটা। আমার মন খারাপের জবাবে ঠাট্টা করে লিখলেন, ‘ভয় পেয়ো না, আমি তেমন সন্ন্যাসী নই যে তোমাদের ভুলে গায়ে ভস্ম মেখে চিমটে হাতে গিরিগুহার অন্তরালে বসে দিনযাপন করছি। এখানে খুব আনন্দ, খুব শান্তি, খুব আড্ডা। রাতদিন বসে বই পড়ি, বই লিখি, গান গাই। আসবে নাকি একবার ?’
নজরুল তাঁকে নিয়ে গান লিখেছিলেন ‘সাজিয়াছ যোগী, বল কার লাগি, তরুণ-বিবাগী।’
.....নলিনীদার বাড়ির সমস্ত আবহাওয়াটাই এই হাসি আর গান আর আনন্দ নিয়ে গমগম করতো। ক্রমে আমার ঢাকা ফিরে আসার সময় ঘনিয়ে এলো। রেকর্ডিং শেষ, সুতরাং আর থাকার কোনো প্রশ্ন নেই। নজরুল ইসলাম গেরুয়া চাদর লুটিয়ে তুলে দিতে এলেন স্টেশনে। বললেন, ‘খুব শিগ্গির আবার চলে এসো।’ আমার মা বললেন, ‘আপনিও আর একবার আসুন না—’
আমি কিছু বললাম না। বলতে পারলাম না। বলতে না পারার পিছনে শুধু যে আমার বিচ্ছেদের বেদনাই লুকিয়ে ছিল তাই নয়, তার চেয়েও আরো অনেক গভীর বেদনা আমাকে লজ্জা দিচ্ছিলো ।
সেবার ঢাকা গিয়ে নজরুল ইসলাম যেদিন ঢাকা ছেড়ে ফিরে গেলেন, তার দু’দিন আগে সন্ধ্যাবেলা আমাদের বাড়িতে তাঁর গান আর আবৃত্তির একটি আসর বসেছিল। আসর ভাঙতে সামান্য দেরি হলো। সকলে চলে গেলে মা নজরুলকে খেতে দিলেন। রাত দশটা বেজে গেল। বাবা বললেন, ‘আপনি অপেক্ষা করুন, আমি সাইকেল নিয়ে গিয়ে একটা গাড়ি ডেকে আনি।’ নি বললেন, ‘পাগল নাকি ? আপনি গিয়ে আমার জন্য গাড়ি ডেকে আনবেন ? সে কখনো হয় ?’
বাবা বললেন, ‘পাড়াটা দেখছেন তো এইটুকু রাত্রিতেই কেমন থমথমে চুপচাপ হয়ে যায়? এখন কাছেপিঠে কোনো গাড়ি পাবার সম্ভাবনা নেই, বড় রাস্তার মোড়ে একটা ঘোড়ার গাড়ির আস্তাবল আছে, ভাড়া বেশি দিলে চলে আসবে। ‘
নজরুল হেসে খুন, ‘আমার কি রানুর মতো ভূতের ভয় আছে নাকি যে রাত বেশি হয়েছে বলে, পাড়া চুপ হয়ে গেছে বলে হেঁটে যেতে ভয় পাবো ?’ গানের কলি ভাঁজতে ভাঁজতে নেমে গেলেন রাস্তায়।
মা দোতলায় এসে বিছানা পাততে পাততে বাবাকে বললেন, ‘জান, আজ ও বাড়িতে এই বলে ইঙ্গিতে পাশের বাড়িটা দেখিয়ে দিলেন, (অর্থাৎ তাঁর পিত্রালয়ের পরশ্রীকাতর আত্মীয় বাড়িটা) ‘সারাদিন ধরে কী যে পরামর্শ চলছিল, কে জানে, কেবল বারান্দায় এসে এসে কয়েকটা ছেলে আমাদের বাড়িটা দেখছিলো, পা-া দেখলাম গু-ার সর্দার সেই অমুক সাহাটা—’
যখন দিলীপদা এসেছিলেন তখন ওঁরা একদিন দিলীপদাকে নিজের মেয়েদের গান শোনাবার জন্য নিমন্ত্রণ করে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন, দিলীপদা সেই নিমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তারপর থেকে ও বাড়ির সর্বময়ী কর্ত্রী বয়স্ক সুন্দরী আত্মীয়টি আর আমাদের সঙ্গে কথা বলতেন না। কর্তা এবং কন্যাদেরও বলতে দিতেন না। অতি পাশাপাশি বাড়ি, চোখাচোখি হয়ে যাবার সম্ভাবনায় বারান্দায় একটি চটও ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন। বাবা বলেছিলেন, ‘বেশ হলো। তোর মায়ের পিত্রালয়ের আত্মীয় প্রীতিটা একটু কমবে এবার।’ আমার বাবা ওদের ধরন-ধারণ কথাবার্তা জীবন-যাপনের প্রণালী কিছুই বিশেষ পছন্দ করতেন না।
মায়ের কথা শুনে বাবা বললেন, ‘ঐ গানটান হচ্ছিল তো, লোকজন এসেছিল, ওদের বলা হয়নি, তাই উকি-ঝুঁকি মেরে দেখছিল।’
বলতে বলতেই নিঃশব্দ পাড়া ভেদ করে একটা কোলাহল ভেসে এলো। সঙ্গে সঙ্গে মা ব্যাকুল হয়ে বললেন, আমার মনে হচ্ছে নজরুলকে ওরা আজ কিছু করবে, আমি দেখেছি নজরুল বেরুলো, আর ওদের বাড়ি থেকেও বেরিয়ে পড়লো কয়েকটা ছেলে--’
বাবা গেঞ্জি গায়েই দৌড়ে নিচে নেমে গেলেন, চটি পায়েই দরজা খুলে ছুটলেন।
আমি আর মা উৎকণ্ঠিত উদ্বেগে ঝোলানো বারান্দায় যতো দূর চোখ চলে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম।
খানিকক্ষণ পরেই দেখতে পেলাম বাবা আর নজরুল হেঁটে হেঁটে আসছেন। বাবা নজরুলকে ধরে ধরে আনছেন।
মায়ের মনে যে আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল সেটাই ঘটেছে। নজরুল যখন বনগ্রামের মোড় পেরিয়ে একটা আরো নির্জন রাস্তায় পৌঁচেছেন, বোধহয় সেটা ঠাটারি বাজারের মোড়, সেই মুখটাতে যেতেই জনা সাত-আট ছেলে লাঠি দিয়ে পিছন থেকে প্রচ- জোরে মাথায় আঘাত করতে করতে বললো, ‘দিলীপ রায়ের টাক মাথাটা ফাটাতে পারিনি, এবার তোর বাবরিচুলের মাথাটা আর আস্তো রাখবো না।”
নজরুল আচমকা আঘাত পেয়ে মুহূর্তের জন্য বিহ্বল হয়ে গিয়েছিলেন বটে, পরক্ষণেই ঘুরে দাঁড়িয়ে একটা ছেলেকে ধরে ফেলে তার হাতের লাঠি দিয়েই তাকে ধরাশায়ী করে সমানে সেই লাঠি বন বন করে ঘোরাতে ঘোরাতে বললেন, ‘কে আসবি আয়, কটা আসবি আয়Ñ লাঠি খেলা ছোরা খেলায় দক্ষ মেরুদ- সিধে একটা যুদ্ধফেরতা মানুষের সম্মুখে এই শৃগাল শূকরের দল কি কখনো দাঁড়াতে পারে ? তবু যতোক্ষণে তিনি ঐ ছেলেটাকে পিটিয়ে হাতের সুখ করেছেন ততোক্ষণে এরাও এলোপাথারি যে যেভাবে পারে মেরেছে তাঁকে। তারপর লাঠি ঘোরানো দেখে মাটিতে পড়ে থাকা ছেলেটাকে তুলে নিয়ে পালিয়েছে। মুহূর্তের মধ্যে ঘটে গেছে ব্যাপারটা। বাবা গিয়ে যখন পৌঁছেছেন তখন লাঠি ঘোরাতে ঘোরাতেই পথ হাঁটছেন নজরুল। বর্ধমান হাউসে যাবেন।
‘নজরুল, আমি। ---’ বাবার গলা পেয়ে থেমে গেলেন তিনি, বাবা তাঁকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘কোথায় যাচ্ছেন ? আমার সঙ্গে চলুন।’
নজরুল হেসে বললেন, ‘আপনার বাড়ি যাই বলে ওরা আমাকে মেরেছে, রানুকে নিয়ে অনেক কুৎসিত কথা বলেছে, এখন যদি আবার ওখানে যাই, এই শূকর সম্ভানগুলো তো বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেবে। আপনি কেন এলেন ? কী সাহসে এলেন ? ওরা কোথায় লুকিয়ে আছে ঠিক নেই, আপনাকে খুন করে ফেলবে ওরা। আমি ওদের সঙ্গে যুঝতে পারবো, আপনি পারবেন না।’
বাবা বললেন, ‘পারি না পারি সেটা আমি দেখবো। আমি আপনাকে ছেড়ে যাবো না।’ আমিও আপনার সঙ্গে যাবো না। রাত দশটা পর্যন্ত থেকেছি বলেই যেসব জঘন্য ভাষা প্রয়োগ করেছে, সারা রাত থাকলে কি উপায় রাখবে ? না না, আপনি ফিরে যান। আমি যাবো না।’
বাবা জোর করে ধরে নিয়ে এলেন। কী করে এবং কী দুরন্ত সাহসে যে উনি অতোদূর হেঁটে হেঁটে চলে যাচ্ছিলেন তা উনিই জানেন।
বাড়িতে এনে বাবা বিছানায় শুইয়ে দিলেন, মা লণ্ঠন কাছে নিয়ে কোথাও জখম হয়েছে কিনা দেখবার জন্য ঝুঁকে পড়েই শিহরিত হলেন। হাতে পায়ে মাথায় পিঠে সর্বত্র গভীর আঘাতের চিহ্ন মোটা মোটা হয়ে রক্ত জমে ফুলে উঠেছে। কী করে যে সেই রাতটা আমরা কাটিয়ে ছিলাম, আমরাই জানি। মা ওঁকে একটা হোমিওপ্যাথি ওষুধ খাইয়ে দিলেন, আমাদের পরিচারিকা পুনার মা, যে ওঁকে কালোকৃষ্ণ বলেছিল, সে চোখ মুছতে মুছতে সমস্ত আহত জায়গা নারকোল তেল দিয়ে ভিজিয়ে দিল, মা বাতাস করতে লাগলেন, আমি আর বাবা প্রায় অচেতনের মতো মেঝেতে বসে রইলাম। রাত ভোর হয়ে গেল।
তার মধ্যে অবশ্য নজরুল ঠাট্টা-তামাসা করে আমাদের ভারী মন হালকা করার চেষ্টা করেছিলেন, ফলশ্রুতি শুধু অশ্রুর বন্যা। লজ্জা দুঃখ অসম্মান কী না নিহিত ছিল তার মধ্যে?
একাদিক্রমে অতগুলো দিন ওরকম একটা অনাবিল আনন্দের মধ্যে কাটিয়ে ঢাকা এসে যে মন বসতে চাইবে না সে কথা বলাই বাহুল্য।
(সংগৃহিত)
বিভাগ : সাহিত্য
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
এবার ভারতের মালদহে বাংলাদেশিদের জন্য হোটেল ভাড়া বন্ধ ঘোষণা
কিশোরগঞ্জের হাওর-অর্থনীতি বেগবান করতে চলছে কয়েকশ কোটি টাকার প্রকল্প
প্লাস্টিক ব্যবহার রোধে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে: অতিরিক্ত সচিব ফাহমিদা খানম
দেশের ৬৯ কারাগারের ১৯টি ঝুঁকিপূর্ণ, ৭০ জঙ্গিসহ ৭০০ বন্দি এখনো পলাতক
পায়রার রাজস্ব আয় বাড়বে তিনগুণ, দেশের অর্থনীতিতে রাখবে বড় ভূমিকা
মমতা ব্যানার্জির মনে গভীর কট্টরপন্থি হিন্দুত্ববাদ : রিজভী
কঠিন সময় পার করছে বাংলাদেশ : প্রধান উপদেষ্টা
কুড়িগ্রামে সাবেক এমপি পুত্র সবুজ গ্রেফতার
ভারতে ৫.৩ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্প
অমৃতসরে স্বর্ণ মন্দিরে পাঞ্জাবের সাবেক উপমুখ্যমন্ত্রী সুখবীর সিং বাদালের ওপর গুলিবর্ষণ
খুলনায় সন্ত্রাসী হামলায় আহত বিএনপি নেতার মৃত্যু
বাড়তি মেদ কমাতে ‘খাওয়া কমানো’ কতটা কার্যকর
কিশোরগঞ্জে সড়ক সংস্কার দাবিতে মানববন্ধন
আগরতলায় বাংলাদেশ উপ-দূতাবাসে হামলার প্রতিবাদে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে গভীর রাতে বিক্ষোভ
নগর ভবনের দায়িত্বশীলদের অবহেলায় নগরবাসীর দূর্ভোগসহ ঝুঁকিও ক্রমশ বাড়ছে
গ্যাস বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে ২৪ ঘণ্টা থাকবে না যেসব এলাকায়
চিন্ময় দাস ইস্যুতে উদ্দেশ্যমূলক প্রশ্নে মামলার তথ্য নেই বলে জানালো যুক্তরাষ্ট্র
রাজশাহীর পুঠিয়ায় সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ১
দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইউন সুক ইয়োলের বিরুদ্ধে অভিশংসন প্রস্তাব
মুন্নী সাহার অ্যাকাউন্টে ১৩৪ কোটি টাকা, নেটদুনিয়ায় আলোড়ন