বৈশাখী বায়না
১৯ এপ্রিল ২০২৪, ১২:১০ এএম | আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ১২:১০ এএম

কালু দুপুরবেলা বাড়ি ফিরে গা-গোসল দিয়ে খেতে বসলে তার ছয় সাত বছরের ছোট্ট মেয়ে ময়না কেঁদে কেঁদে বায়না ধরেছে তার কাছে। সে এবার ঈদের পর তাদের গাঁয়ের বৈশাখী মেলায় যাবে। তাই তাকে একটা ঘাগরগাঁথা লাল টুকটুকে কুচি দেওয়া বৈশাখী ফ্রক জামা কিনে দিতে হবে।
আর সেই সঙ্গে একটা লাল পাজামা আর জুতা ।
যে জামা কাপড় পরে সে এবার ঈদ করবে। আর বৈশাখী মেলাতে গিয়ে নাগর-দোলনায় চড়বে।
কালু একজন হতদরিদ্র ভান ওয়ালা। যার নিত্য দিন আনা দিন খাওয়ায় জীবন। বলা যায় যে, সে একেবারে ছা-পোষা নিঃস্ব অভাবী গরীব মানুষ। প্রতিদিনের আয়-রোজগারের উপর যার দাঁড়ির মুখে বেঁচে থাকার মত, দু,বেলা দু,মুঠো পেটের অন্ন জোটে। কালু সে তার ভাগ্যের চাকা ঘুরাতে রাতদিন কলুর বলদের মত খাটে।
কিন্তু খেটে সে কি করবে?
‘দুর্ভাগা যে, তার জীবনে কি আর কখনো দুরআশার অন্ধকার ঘুচে আশার আলো ফোটে?’
তবু কালু যে বড় আশাতে বুক বেঁধে নিত্যদিন হাড়ভাঙ্গা ঘাম ঝরানো কঠিন খাটুনি খাটে। এভাবে দিনের পরে রাত, রাতের পরে দিন আসে।
আর কালু সময় গুণতে থাকে। হয়তো কালকের প্রত্যুষে সুভাগ্য আপনা হতে তার ভাগ্যের দুয়ারে এসে ধরা দিবে। সেই আশাতে আবারো প্রতিক্ষা তার একটা নতুন প্রভাতের।
‘তার নিরাশায় ঘেরা জীবনে আশার বাহক হয়ে যদি কাল প্রভাতে নতুন সূর্য ওঠে সেজন্য।
কিন্তু কালু জানে না, কোন দুঃখীর কপালে কখনো সুখ নাহি জেটে।
আর তাইতো ময়নার জন্মের পরপরই কালুর স্ত্রী অর্থাৎ ময়নার মা- আয়না বেগমও বেশ অসুস্থ হয়ে পড়লো। জরায়ু আর মূত্রনালীর ইনফেকশনে ভুগছে সে। প্রতিদিন তার জন্য ওষুধ কিনতে হয়
কালুকে।
যাহোক, যেটা বলছিলাম ময়না বৈশাখী জামার জন্য বায়না করেই চলেছে। ময়নার মা- আয়না বললো, মা ময়না বিরক্ত করোনা তোমার বাবাকে।
একটু ধীরস্থির ভাবে তোমার বাবাকে খেতে দাও।
ময়না বললো, না আমার জামা কিনে দেবে কিনা
বলুক। আবার ময়না কাঁদতে কাঁদতে চোখের নাকের জলে একাকার হয়ে বলতে লাগলো ও বাবা...বাবা...বলো না...আমার জন্য লাল বৈশাখী জামা কিনে দেবে তো?
কালু তার ছোট্ট মেয়েটাকে কি করে বুঝাবে যে,
গরীবের কোন শখ আহ্লাদ থাকতে নেই’
এই পৃথিবীতে গরীবের জন্মই হয়েছে শুধু বুক ভরা আশা নিয়ে স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে জীবনের সাথে যুদ্ধ করে অবশেষে অপূর্ণ স্বপ্নের জন্য দীর্ঘ শ্বাসে হা-হুতাশ করার জন্য।
সে মনের কষ্ট মনেই চেঁপে মেয়ে ময়নার মাথায় হাত বুলিয়ে দু, চোখের জল মুছে দিয়ে বললো
ঠিক আছে মা, ময়না। তোমার জন্য একটা লাল
টুকটুকে কুচি দেওয়া ঘাগর গাঁথা বৈশাখী ফ্রক জামা কিনে আনবো। এবার তুমি খুশি তো? এবার চোখের জল মুছে একটু হাসো দেখি। ময়নার কেবল দাঁত পড়ে দাঁত উঠছে। আবার কিছু দাঁত এখনো ওঠেনি। সে দু,হাত দিয়ে চোখের জল মুছে তার ফোকলা দাঁত বের করে চান্দের আলো ঝরা
বিশ্বজয়ী হাসি হাসতে লাগলো। আর দু, হাত এক করে তালি দিতে দিতে বলতে লাগলো আহা কি মজা..কি মজা..আমার আব্বু আমার জন্য নতুন লাল বৈশাখী জামা কিনে দেবে।
ময়নার ছোট্ট সে কচি মুখের হাসির কাছে শুধু সাত রাজার ধন কেনো..পৃথিবীর সমস্ত সম্পদ এক করলেও সে হাসির সমতুল্য হবেনা।
কোনকিছু পাওয়ার আনন্দে অভাবী কোন পিতার সন্তানের মুখের মুক্তা ঝরানো হাসি কতোটা যে সুখের, কতোটা আনন্দের, কতোটা তৃপ্তিদায়ক তা-কেবল সেই পিতাই জানে।
কালুর স্ত্রী আয়না বললো, মেয়েকে জামা কিনে দিবে তো বললে। কি করে কিনবে? একে-তো নিজেদের খাওয়া জুটছে না। এই অভাবের মধ্যে..
কালু বললো ও নিয়ে তুমি চিন্তা করোনা ময়নার
মা। দেখবে ঠিক এক উপায় হয়ে যাবে।
মেয়ে ময়না বললো, আব্বু তুমি না খুব ভালো। আর মা আয়নার দিকে ময়না তাকিয়ে বললো
মা তুমি খুব পচা। কালু বললো না মা ময়না, ও কথা বলতে নেই। তোমার আম্মুও অনেক ভালো।
ময়না বললো, তাই? আচ্ছা ঠিক আছে আম্মু তুমি ও খুব ভালো। ময়না খেলতে চলে গেলো।
কালু গুছিয়ে সে তার ভান নিয়ে বেরিয়ে পড়লো।
সে মনে মনে ভাবছে আজ থেকে তাকে আরো একটু বেশি রাত পর্যন্ত ভান চালাতে হবে। তাহলে
তার মেয়ের শখ পূরণ করতে পারবে। এবারের মত প্রতি বছর তাদের গাঁয়ে বৈশাখী মেলা বসে।
সে দুই তিন দিন দুপুরে বাড়ি না এসে বাড়তি আয়ের জন্য গাঁয়ের পার্শ্ববর্তী মফস্বল শহরে ভান চালাতে লাগলো।
বাড়িতে বউকেও বলে দিয়েছে দুপুরের জন্য তার
খাবার রান্না না করতে। দুপুরে কোন হোটলেও সে খায় না। খুব বেশি তৃষ্ণার্ত আর ক্ষিদে পেলে একটু জল খেয়ে নেয়। এভাবে সে না খেয়ে অর্ধাহারে অনাহারে থেকে গভীর রাত অবধি ভান চালায় টাকা জমায় তার মেয়ে ময়নার জামা জুতার জন্য। রাত পোহালেই ঈদ। আর ঈদের
তিন দিন পরেই বৈশাখী মেলা। আর তাই অনেক
রাত পর্যন্ত আজ বাজারের দোকানপাট খোলা।
কালু গভীর রাত পর্যন্ত ভান চালায় শেষে মেয়ে
ময়নার জন্য একটা লাল টুকটুকে ঘাগর গাঁথা কুচি দেওয়া ফ্রক লাল পাজামা আর জুতা কিনে
বাড়ি ফিরছে। না খেয়ে না দুয়ে শরীরটাও বেশ ক্লান্ত। মাথাটা কেমন যেনো ঘুরছে। চোখে মুখে যেনো অন্ধকার দেখছে সে। দুজন লোক বললো
ভাই সামনের মোড়ে নামবো যাবেন? কালু ভাবেেলা এ পথ দিয়েই তো আমি বাড়ি ফিরবো। যাওয়ার পথে যদি কয়টা টাকা হয় অসুবিধে কি?
সে বললো যাবো উঠেন। মফস্বল শহর ছাড়ায়
গাঁয়ের অন্ধকার রোড। ভানের সামনে হারিকেন রাখা।
তাতে কোন রকম পথ দেখার মত টিপটিপ
করে আলো জ্বলছে। হঠাৎ মাঠের মধ্যে আসলে
পিছন থেকে যাত্রী বেশে ছিনতাইকারী দুজন চাকু
বের করে বললো এই শালা ভান রাখ। দে- তোর
কাছে যাকিছু আছে বের কর। কালু তো হতভম্ব।
কিংকর্তব্য বিমূঢ় হওয়ার অবস্থা তার। কি করবে কিছুই ভেবে পাচ্ছে না। কালু বললো কে..আপনারা? কি করছেন কি? ওরা বললো আমরা কে বুঝতে
পারছিস না? চাকু পেটে ঠেকিয়ে বললো আমরা
ছিনতাইকারী শালা। দে- টাকা পয়সা আর যাকিছু
আছে দে। কালুর পকেট হাতড়িয়ে মাত্র পঞ্চাশ টাকা পেলো। আর একটা পলিথিনে কিছু ওষুধ
আর মেয়ের জন্য কেনা জামাকাপড় জুতা। কালু
বললো, এগুলো নেবেন না। এগুলো আমার মেয়ের জন্য কিনা। আর এই টাকাটা আমি দেবো না। আমার মেয়ে ঈদে মিষ্টি কিনে খাবে। ছিনতাইকারীরা বললো, দে, দে শালা বলছি দে।
না হলে কিন্তু একেবারে জীবনে মেরে ফেলবো।
এভাবে ধস্তাধস্তি করতে করতে একজন হঠাৎ চাকু বসিয়ে দিলো কালুর বুকে। কালু চিৎকার করে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। কিন্তু মেয়ের লাল
বৈশাখী জামা পাজামা জুতা ছাড়লো না। কিসের
একটা শব্দ আসতে ছিনতাইকারীরা পালিয়ে সরে
পড়লো। কালুর নিথর দেহ পড়ে থাকলো পথে।
সকালে লোকমুখে সংবাদ আসতে কালুর স্ত্রী আয়না মেয়ে ময়নাকে নিয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে হাজির হলো। অনেক লোকের সমাগম। পুলিশও আছে।কালুর লাশ দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো স্ত্রী আয়না। তখনো কালুর দু,হাতে বুৃকের সাথে ধরে রাখা রক্ত মাখা মেয়ে ময়নার বৈশাখী লাল জামাকাপড়ের ব্যাগ। ময়না কালুর লাশের উপর
আঁচড়া পিচড়ে খেয়ে কেঁদে কেঁদে বলতে লাগলো
আমি লাল বৈশাখী জামা চাইনে বাবা তুমি কথা বলো বাবা।কথা বলো বাবা..কথা বলো তুমি। ময়নার অমন আহাজারি করে করে কাঁদতে দেখে তখন উপস্থিত অন্যদের চোখেও জল চলে এলো...।
বিভাগ : সাহিত্য
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন

সউদীতে পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করতে পারেন ট্রাম্প

যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণে নাগরিকদের সতর্ক করল চীন

‘খুব ভালো চুক্তি’র ভবিষ্যদ্বাণী, চীনা প্রেসিডেন্টের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ট্রাম্প

নাইটক্লাবের ছাদ ধসে মারা গেলেন গায়ক রুবিও, নিহত বেড়ে ১৮৪

যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি দূতাবাস অভিমুখে মার্চ ফর প্যালেস্টাইনে জবির শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা

সড়কে ছিল না যানজট, পরীক্ষার্থীদের মুখে ছিল স্বস্তির হাসি

হিন্দি ইন্ডাস্ট্রির কেউ আমার কথা ভাবেনি–জিৎ

প্লট দুর্নীতি : হাসিনা-পুতুলসহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা

বায়ুদূষণের শীর্ষে দিল্লি, ২৮তম ঢাকা

ডোমিনিকান রিপাবলিকে নাইটক্লাবের ছাদ ধস : নিহত বেড়ে ১২৪

গাজায় আবাসিক ভবনে ইসরায়েলি বিমান হামলা, নিহত অন্তত ৩৮

দুপুরের মধ্যে ৬০ কিমি বেগে ঝড়ের পূর্বাভাস

টঙ্গীতে র্যাবের অভিযান মহানগর তাঁতীলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকসহ ৫জন গ্রেফতার

হিলিতে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ ভাবে অনুষ্ঠিত হচ্ছে এসএসসি পরীক্ষা

সুন্দরবনে ডাকাতদের কবল থেকে ছয় নারীসহ ৩৩ জেলে উদ্ধার

ইয়েমেনের বন্দরশহরে যুক্তরাষ্ট্রের বিমান হামলা : নিহত বেড়ে ১৬

গাজায় অভিযানে আপত্তি, পাইলটসহ বিমানবাহিনীর ৯৭০ কর্মীকে বহিষ্কারের হুমকি ইসরাইলের

শহীদদের রক্তের সাথে কোন আপোষ বরদাস্ত করা হবে না: ইশরাক

মেসির জোড়া গোলে দুর্দান্ত প্রত্যাবর্তনে সেমিতে মায়ামি

সৌদি আরবে নতুন ১৪টি তেল ও গ্যাসের খনির সন্ধান