ঢাকা   শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪ | ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

নজরুলের মা

Daily Inqilab জোবায়ের আলী জুয়েল

২৪ মে ২০২৪, ১২:২০ এএম | আপডেট: ২৪ মে ২০২৪, ১২:২০ এএম

নজরুলের পিতা কাজী ফকির আহমদের সঠিক জন্ম তারিখ পাওয়া যায় না। তিনি বাংলা ১৩১৪ সালের ৭ চৈত্র ইংরেজী ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে পরিণত বয়সে পরলোক গমন করেন। বয়স হয়েছিল ষাট বছর। তিনি আরবি, ফারসি জানতেন তবে তাঁর বাংলা ও উর্দূ ভাষার উপর রীতিমত দখল ছিল। তাঁর হস্তাক্ষর ছিল অতীব সুন্দর। চুরুলিয়া অঞ্চলের নামকরা দলিল লিখিয়ে ছিলেন তিনি। উচ্চাঙ্গের মিলাদ পাঠক বলেও তাঁর সুনাম ছিল। কাজী ফকির আহমদের পিতার নাম কাজী আমিনুল্লাহ।

কাজী ফকির আহমদ সুপুরুষ ছিলেন। পিতার ওয়ারিশ সুত্রে প্রায় চল্লিশ বিঘার মতো চাষের জমি পেয়েছিলেন। কিন্তু শেষ বয়সে এক বসত বাড়ী ছাড়া তাঁর বিষয় সম্পত্তি কিছুই ছিল না। তবে বিষয় সম্পত্তি হাতছাড়া হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল পাশাখেলা। এই খেলা তাঁকে প্রবল ভাবে পেয়ে বসেছিল। তাঁর এই পাশা খেলার অন্যতম জুড়ি ছিলেন মহানন্দ আশ নামক এক বণিক, তাঁর কাছেই কাজী ফকির আহমদ তাঁর বেশির ভাগ সম্পত্তি হেরেছেন পাশা খেলায়।

কাজী ফকির আহমেদ প্রথম স্ত্রীর নাম কাজী সৈয়দা খাতুন। তিনি চুরুলিয়া গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। তাঁর গর্ভে একমাত্র কন্যা সাজেদা খাতুন। সৈয়দা খাতুনের মৃত্যুর পর ফকির আহমদ বিবাহ করেন জাহেদা খাতুন কে। তিনি চুরুলিয়ার পাশ্ববর্তী ভূড়ি গ্রামের উচ্চ বংশজাত মহিলা ছিলেন। তিনি অতি দয়াবতী রমনী ছিলেন। জাহেদা খাতুনের গর্ভে তিন পুত্র এবং এককন্যা সন্তানের জন্ম হয়। কাজী সাহেব জান, কাজী নজরুল ইসলাম, কাজী আলি হোসেন ও বোন উম্মে কুলসুম। কাজী সাহেব জান পিতার দারিদ্য বশত উচ্চ শিক্ষা লাভের সুযোগ পাননি। পিতার মৃত্যুর পর অন্ন সংস্থানের জন্য রানীগঞ্জের কয়লা খনিতে চাকরি নিয়ে ছিলেন। দীর্ঘদিন কয়লা খনিতে নিযুক্ত থাকায় তাঁর স্বাস্থ্য ভঙ্গ হয় এবং অসুখে ভূগে পঞ্চাশ বছর বয়সে পরলোক গমন করেন। কাজী সাহেব জানও অবসরে দলিল লেখকের কাজ করতেন।

কাজী আলি হোসেন পড়াশুনা করেন কাজী পাড়ায় মক্তবে। পারিবারিক সূত্রে দলিল লেখকের কাজে পরবর্তীকালে নিযুক্ত হন এবং আইন আদালত বিষয়ে পাকাপোক্ত হয়ে ওঠেন। এলাকার কৃষক শ্রমিকদের হয়ে সমাজ সেবকের কাজ করতে গিয়ে গ্রামের তৎকালীন জমিদার জোতদারদের রোষানলে পড়েন এবং ১৯৫১ সালের ৭ জানুয়ারী নিজ গ্রামে প্রকাশ্য দিবালোকে খুন হন।

কাজী নজরুল কিশোর বয়সে সেই যে গৃহত্যাগ করলেন তারপর মায়ের সঙ্গে দেখা হয় তাঁর দীর্ঘ প্রায় দশ বছর পর পল্টন থেকে ফিরে ১৯২০ সালে একবার চুরুলিয়ায় গেলে সেখানে সপ্তাহ কাল ধরে অবস্থান করেন তিনি। এই সময় মায়ের সাথে তাঁর নানা বিষয়ে অনেক আলাপ হয়। শেষে কথায় কথায় ভীষণ ঝগড়া বেঁধে যায়। এই ঝগড়ার কারণ জানা যায়নি। নজরুল ও পরবর্তীতে এ বিষয়ে কাউকে কিছু বলেন নি। ঝগড়ার পর তিনি বাড়ি ছেড়ে কলকাতায় চলে আসেন। এরপর তাঁর মা যতদিন জীবিত ছিলেন কত অনুরোধ করেছেন কত আব্দার ধরেছেন ছেলেকে এক নজর দেখার জন্য কিন্তু নজরুলের জেদ আর অভিমান এতটা তীব্র ছিলো যে মায়ের অনুরোধ তিনি রাখেন নি। ইহকালে মায়েরও আর ছেলের মুখ দেখা হয়নি।

শোনা যায় নজরুলের মা জাহেদা খাতুন ছিলেন অপূর্ব সুন্দরী। সে সময় তাঁর বয়সও ছিল কম। একজন বয়স্কা সুন্দরী বিধবা রমনী সম্মানের সঙ্গে নিজের ইজ্জত আব্রু রক্ষা এবং নিজের ও সন্তানদের ভরণপোষণের নিশ্চয়তার জন্য যদি মৃতঃস্বামীর ভাইকে বিয়ে করেই থাকেন তাহলে অবস্থার প্রেক্ষাপটে সেটাকে কোন অন্যায় বলা চলেনা। তা ছাড়া ইসলামের দৃষ্টি কোন থেকে এ ধরণের বিয়েকে বরং উৎসাহিতই করা হয়েছে। তবে একথা মিথ্যে নয় যে, উভয় বঙ্গের গ্রামীণ পরিবেশের প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা এতটাই অনুদার যে, সম্পূর্ণ বৈধ হলেও এ ধরণের বিয়েকে অনেকে কিছুটা হেয় চোখেই দেখে থাকে। সম্ভবতঃ নজরুল ও সেই মানসিকতার উর্ধ্বে উঠে মায়ের দ্বিতীয় বিয়েকে মেনে নিতে পারেন নি। এমন ও হতে পারে নজরুলকে তাঁর মায়ের দ্বিতীয় বিয়ে নিয়ে কেউ হাসি-মসকরা করেছিলো যা তাঁর মনে গেঁথে গিয়েছিল এবং যা তিনিই কখনোই ভূলতে পারেন নি। তবে মায়ের সাথে নজরুলের ঝগড়া এবং অভিমানের কারণ জানা না গেলেও অনুমান করা শক্ত নয় যে, মায়ের কোনো আচরণের নজরুল একটা প্রচন্ড মানসিক আঘাত পেয়েছিলেন যার দরুন আর কোনো দিন চুরুলিয়া ফিরে যেতে রাজি হননি। এমন কি ১৯২৮ সালের ৩০ মে চুরুলিয়ায় মায়ের মৃত্যুর খবর পেয়েও নজরুল গ্রামের বাড়িতে যাননি। শেষবারের মতো মায়ের মুখ খানি দেখেন নি। অবশেষে একবুক কষ্ট নিয়ে জাহেদা খাতুন এ পৃথিবী থেকে চিরবিদায় গ্রহণ করেছেন। মা জাহেদা খাতুন পুত্র নজরুলকে এক নজর দেখার জন্য অন্তিম বাসনা প্রকাশ করেছিলেন। জাহেদা খাতুনের মাতৃ হৃদয়ের এই অতৃপ্ত হাহাকার কি নজরুল জীবনে কোনই প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেনি? কে জানে নজরুলের ৩৪ বছরের জীবন্ত-মৃত অবস্থার জন্যে তাঁর মায়ের অতৃপ্ত আত্মার অভিশাপই দায়ী কিনা। জীবদ্দশায় কবি কখনোই এ সম্পর্কে মুখ খোলেন নি। ফলে নজরুলের জীবনে এটি আজো অমীমাংসতি অধ্যায় হিসেবেই রয়ে গেছে। অভিমান বশে মায়ের সাথে নজরুল সম্পর্ক ছিন্ন করলেও পরবর্তী সময়ে নজরুলের বুভূক্ষ মন কিন্তু সবর্দা কাঙ্গালের মতো কেঁদে ফিরেছে মাতৃ¯েœহের সামান্যতম পরশ পাওয়ার জন্য। তাই আমরা দেখতে পাই বিভিন্ন সময়ে কতিপয় মহিয়সী নারীকে তিনি প্রাণ ভরে মা বলে সম্মোধন করেছেন। তাঁদেরকে কবি যেমন মায়ের মতোই অন্তর দিয়ে ভক্তি শ্রদ্ধা করেছেন। তেমনি তাঁরাও তাকে পুত্রবৎ ¯েœহ করেছেন। নজরুলের মা সম্মোধনে যারা ধন্যা হয়েছিলেন তাদের মধ্যে দৌলতপুরের আলী আকবর খানের মেজো বোন নার্গিসের খালা আম¥া এখতারুন্নেসা খানম, বিপ্লবী হেমপ্রভা দেবী, হুগলীর মিসেস এম.রহমান, কুমিল্লার বিরজা সুন্দরী দেবী এবং দেশ বন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের স্ত্রী বাসন্তী দেবী অন্যতমা, নজরুল নার্গিসের বিয়ের ব্যাপারে যখন খাঁ পরিবারের সকলেই ছিলেন গররাজি তখন এই এখতারুন্নেসাই সকলের ওপরে প্রভাব বিস্তার করে সেই বিয়েকে সম্ভব করে তুলেছিলেন। ১৯২১ সালের ১৭ জুন নজরুলের সঙ্গে নার্গিস আসার খানম বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন (বিয়ে নিয়ে অনেক মতানৈক্য আছে)। এই সময় এখতারুন্নেসা খানম মায়ের মতোই নজরুলের সকল আব্দার পূরণ করতেন। এখতারুন্নেসা ছাড়া আর কাউকে কবি পাত্তাই দিতেন না। নজরুলেেক তিনি এতটা আপন করে নিয়েছিলেন যে, ভাইদের কাছে প্রাপ্য তিনি তাঁর পৈত্রিক সম্পত্তি নজরুলের নামে লিখে দেওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছিলেন। তিনি ছিলেন নিঃসন্তান। বহুনারীর মাতৃ¯েœহ আদর, মমতা, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা পেয়েছেন কবি। এমনি ধরণের আরেক অগ্নি কন্যা হেম প্রভাবকে নজরুল “মা” বলে ডাকতেন। এই হেমপ্রভাকে নিয়ে কবি রচনা করেন “হৈমপ্রভা” কবিতাটি।

১৩৩২ বঙ্গাব্দের ২৯ ফাল্গুন কবি মাদারিপুরে মৎস্যজীবী সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। প্রগতিশীল শান্তি আন্দোলন ও নারী জাগরণের অগ্রসেনানী হেমপ্রভাও ঐ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। কবি এই মহীয়সী নারীকে নিয়ে ১৯২৬ সালে রচনা করেন হৈমপ্রভা কবিতাটি।

কোন অতীতের আঁধার ভেদিয়া/আসিলো আলোক জননী।
প্রভায় তোর উদিল প্রভাত/হেম-প্রভ হল ধরণী ॥
এসো বাংলার চাঁদ সুলতানা/বীর মাতা বীর জায়া গো।
তোমাতে পড়েছে সকল কালের/বীর নারীদের ছায়াগো ॥
শিব সাথে সতী শিবানী সাজিয়া/ফিরছি শ্মশানে জীবন মাগিয়া,
তব আগমনে নব বাঙালীর/কাটুক আঁধার রজনী ॥ (অসমাপ্ত)


বিভাগ : সাহিত্য


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের গল্প
গণ-অভ্যুত্থান ২০২৪ : সাহিত্য সংস্কৃতি ভাবনা
প্রার্থনার মূল কাজ সংযোগ স্থাপন
গ্রাফিতি বাংলাদেশ
তোমাকে
আরও

আরও পড়ুন

আমতলীতে তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে সাংবাদিকের ওপর সন্ত্রাসী হামলা। আহত -২

আমতলীতে তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে সাংবাদিকের ওপর সন্ত্রাসী হামলা। আহত -২

শিবালয়ে পরকিয়া প্রেমের বলি নুরজাহান ৪দিন পর পাষ-প্রেমিক আলিফ গ্রেফতার

শিবালয়ে পরকিয়া প্রেমের বলি নুরজাহান ৪দিন পর পাষ-প্রেমিক আলিফ গ্রেফতার

ভূঞাপুর শহরের প্রাণকেন্দ্রে ময়লা-আবর্জনার ভাগার

ভূঞাপুর শহরের প্রাণকেন্দ্রে ময়লা-আবর্জনার ভাগার

শাহজাহান ওমরের বিরুদ্ধে আরও এক মামলা

শাহজাহান ওমরের বিরুদ্ধে আরও এক মামলা

ধর্মগ্রন্থের পরে সত্য হিসেবে মানুষ সংবাদপত্রকে মনে করতো  - বিটিভি মহা পরিচালক

ধর্মগ্রন্থের পরে সত্য হিসেবে মানুষ সংবাদপত্রকে মনে করতো - বিটিভি মহা পরিচালক

নেতানিয়াহুকে গ্রেপ্তারে ‘প্রস্তুত’ ইউরোপের যে ৭টি দেশ

নেতানিয়াহুকে গ্রেপ্তারে ‘প্রস্তুত’ ইউরোপের যে ৭টি দেশ

প্রথম বার চার দরজার বিলাসবহুল গাড়ি আনছে জাগুয়ার

প্রথম বার চার দরজার বিলাসবহুল গাড়ি আনছে জাগুয়ার

৪ মাস যেতে না যেতেই ভেস্তে গেছে কোটি টাকার সোলার ফেনসিং প্রকল্প!

৪ মাস যেতে না যেতেই ভেস্তে গেছে কোটি টাকার সোলার ফেনসিং প্রকল্প!

২৯ বছর পর অবশেষে আলোর মুখ দেখলো শেরপুর আন্তঃজেলা পৌর বাস টার্মিনাল

২৯ বছর পর অবশেষে আলোর মুখ দেখলো শেরপুর আন্তঃজেলা পৌর বাস টার্মিনাল

মোটরসাইকেলের ভয়ংকর নেশা, বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল, ৫ মাসে নিহত হয়েছে ১৪ জন

মোটরসাইকেলের ভয়ংকর নেশা, বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল, ৫ মাসে নিহত হয়েছে ১৪ জন

বড় দরপতনের পর সোনার দামে আবার বড় লাফ

বড় দরপতনের পর সোনার দামে আবার বড় লাফ

রাজবাড়ীতে ছাত্রদল নেতা অপহরণ, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান গ্রেপ্তার

রাজবাড়ীতে ছাত্রদল নেতা অপহরণ, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান গ্রেপ্তার

ফার্মগেট মানসী প্লাজায় আগুন, নেভাতে কাজ করছে ফায়ার সার্ভিসের ৫ ইউনিট

ফার্মগেট মানসী প্লাজায় আগুন, নেভাতে কাজ করছে ফায়ার সার্ভিসের ৫ ইউনিট

মাদকের টাকা না পেয়ে মাকে কুপিয়ে হত্যা করে থানায় ছেলের আত্মসমর্পণ

মাদকের টাকা না পেয়ে মাকে কুপিয়ে হত্যা করে থানায় ছেলের আত্মসমর্পণ

তারেক রহমান ও কায়কোবাদের মামলা প্রত্যাহার না করলে আন্দোলনের হুমকি হিন্দু সম্প্রদায়ের

তারেক রহমান ও কায়কোবাদের মামলা প্রত্যাহার না করলে আন্দোলনের হুমকি হিন্দু সম্প্রদায়ের

সুরমা-কুশিয়ারার জন্য ১৭৮৫ কোটি টাকার প্রকল্প

সুরমা-কুশিয়ারার জন্য ১৭৮৫ কোটি টাকার প্রকল্প

নকলায় নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার

নকলায় নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার

কালীগঞ্জে বিএনপি'র মহাসচিব মির্জা ফখরুলকে ফুলের শুভেচ্ছা জানালেন হামিদ

কালীগঞ্জে বিএনপি'র মহাসচিব মির্জা ফখরুলকে ফুলের শুভেচ্ছা জানালেন হামিদ

পর্ন তারকা স্টর্মিকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘুষ প্রদান মামলার রায় স্থগিত করলো আদালত

পর্ন তারকা স্টর্মিকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘুষ প্রদান মামলার রায় স্থগিত করলো আদালত

দৌলতপুরে মাদকাসক্ত যুবকের হাতে মাছ ব্যবসায়ী খুন : যুবক আটক

দৌলতপুরে মাদকাসক্ত যুবকের হাতে মাছ ব্যবসায়ী খুন : যুবক আটক