নজরুলের মা
২৪ মে ২০২৪, ১২:২০ এএম | আপডেট: ২৪ মে ২০২৪, ১২:২০ এএম
নজরুলের পিতা কাজী ফকির আহমদের সঠিক জন্ম তারিখ পাওয়া যায় না। তিনি বাংলা ১৩১৪ সালের ৭ চৈত্র ইংরেজী ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে পরিণত বয়সে পরলোক গমন করেন। বয়স হয়েছিল ষাট বছর। তিনি আরবি, ফারসি জানতেন তবে তাঁর বাংলা ও উর্দূ ভাষার উপর রীতিমত দখল ছিল। তাঁর হস্তাক্ষর ছিল অতীব সুন্দর। চুরুলিয়া অঞ্চলের নামকরা দলিল লিখিয়ে ছিলেন তিনি। উচ্চাঙ্গের মিলাদ পাঠক বলেও তাঁর সুনাম ছিল। কাজী ফকির আহমদের পিতার নাম কাজী আমিনুল্লাহ।
কাজী ফকির আহমদ সুপুরুষ ছিলেন। পিতার ওয়ারিশ সুত্রে প্রায় চল্লিশ বিঘার মতো চাষের জমি পেয়েছিলেন। কিন্তু শেষ বয়সে এক বসত বাড়ী ছাড়া তাঁর বিষয় সম্পত্তি কিছুই ছিল না। তবে বিষয় সম্পত্তি হাতছাড়া হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল পাশাখেলা। এই খেলা তাঁকে প্রবল ভাবে পেয়ে বসেছিল। তাঁর এই পাশা খেলার অন্যতম জুড়ি ছিলেন মহানন্দ আশ নামক এক বণিক, তাঁর কাছেই কাজী ফকির আহমদ তাঁর বেশির ভাগ সম্পত্তি হেরেছেন পাশা খেলায়।
কাজী ফকির আহমেদ প্রথম স্ত্রীর নাম কাজী সৈয়দা খাতুন। তিনি চুরুলিয়া গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। তাঁর গর্ভে একমাত্র কন্যা সাজেদা খাতুন। সৈয়দা খাতুনের মৃত্যুর পর ফকির আহমদ বিবাহ করেন জাহেদা খাতুন কে। তিনি চুরুলিয়ার পাশ্ববর্তী ভূড়ি গ্রামের উচ্চ বংশজাত মহিলা ছিলেন। তিনি অতি দয়াবতী রমনী ছিলেন। জাহেদা খাতুনের গর্ভে তিন পুত্র এবং এককন্যা সন্তানের জন্ম হয়। কাজী সাহেব জান, কাজী নজরুল ইসলাম, কাজী আলি হোসেন ও বোন উম্মে কুলসুম। কাজী সাহেব জান পিতার দারিদ্য বশত উচ্চ শিক্ষা লাভের সুযোগ পাননি। পিতার মৃত্যুর পর অন্ন সংস্থানের জন্য রানীগঞ্জের কয়লা খনিতে চাকরি নিয়ে ছিলেন। দীর্ঘদিন কয়লা খনিতে নিযুক্ত থাকায় তাঁর স্বাস্থ্য ভঙ্গ হয় এবং অসুখে ভূগে পঞ্চাশ বছর বয়সে পরলোক গমন করেন। কাজী সাহেব জানও অবসরে দলিল লেখকের কাজ করতেন।
কাজী আলি হোসেন পড়াশুনা করেন কাজী পাড়ায় মক্তবে। পারিবারিক সূত্রে দলিল লেখকের কাজে পরবর্তীকালে নিযুক্ত হন এবং আইন আদালত বিষয়ে পাকাপোক্ত হয়ে ওঠেন। এলাকার কৃষক শ্রমিকদের হয়ে সমাজ সেবকের কাজ করতে গিয়ে গ্রামের তৎকালীন জমিদার জোতদারদের রোষানলে পড়েন এবং ১৯৫১ সালের ৭ জানুয়ারী নিজ গ্রামে প্রকাশ্য দিবালোকে খুন হন।
কাজী নজরুল কিশোর বয়সে সেই যে গৃহত্যাগ করলেন তারপর মায়ের সঙ্গে দেখা হয় তাঁর দীর্ঘ প্রায় দশ বছর পর পল্টন থেকে ফিরে ১৯২০ সালে একবার চুরুলিয়ায় গেলে সেখানে সপ্তাহ কাল ধরে অবস্থান করেন তিনি। এই সময় মায়ের সাথে তাঁর নানা বিষয়ে অনেক আলাপ হয়। শেষে কথায় কথায় ভীষণ ঝগড়া বেঁধে যায়। এই ঝগড়ার কারণ জানা যায়নি। নজরুল ও পরবর্তীতে এ বিষয়ে কাউকে কিছু বলেন নি। ঝগড়ার পর তিনি বাড়ি ছেড়ে কলকাতায় চলে আসেন। এরপর তাঁর মা যতদিন জীবিত ছিলেন কত অনুরোধ করেছেন কত আব্দার ধরেছেন ছেলেকে এক নজর দেখার জন্য কিন্তু নজরুলের জেদ আর অভিমান এতটা তীব্র ছিলো যে মায়ের অনুরোধ তিনি রাখেন নি। ইহকালে মায়েরও আর ছেলের মুখ দেখা হয়নি।
শোনা যায় নজরুলের মা জাহেদা খাতুন ছিলেন অপূর্ব সুন্দরী। সে সময় তাঁর বয়সও ছিল কম। একজন বয়স্কা সুন্দরী বিধবা রমনী সম্মানের সঙ্গে নিজের ইজ্জত আব্রু রক্ষা এবং নিজের ও সন্তানদের ভরণপোষণের নিশ্চয়তার জন্য যদি মৃতঃস্বামীর ভাইকে বিয়ে করেই থাকেন তাহলে অবস্থার প্রেক্ষাপটে সেটাকে কোন অন্যায় বলা চলেনা। তা ছাড়া ইসলামের দৃষ্টি কোন থেকে এ ধরণের বিয়েকে বরং উৎসাহিতই করা হয়েছে। তবে একথা মিথ্যে নয় যে, উভয় বঙ্গের গ্রামীণ পরিবেশের প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা এতটাই অনুদার যে, সম্পূর্ণ বৈধ হলেও এ ধরণের বিয়েকে অনেকে কিছুটা হেয় চোখেই দেখে থাকে। সম্ভবতঃ নজরুল ও সেই মানসিকতার উর্ধ্বে উঠে মায়ের দ্বিতীয় বিয়েকে মেনে নিতে পারেন নি। এমন ও হতে পারে নজরুলকে তাঁর মায়ের দ্বিতীয় বিয়ে নিয়ে কেউ হাসি-মসকরা করেছিলো যা তাঁর মনে গেঁথে গিয়েছিল এবং যা তিনিই কখনোই ভূলতে পারেন নি। তবে মায়ের সাথে নজরুলের ঝগড়া এবং অভিমানের কারণ জানা না গেলেও অনুমান করা শক্ত নয় যে, মায়ের কোনো আচরণের নজরুল একটা প্রচন্ড মানসিক আঘাত পেয়েছিলেন যার দরুন আর কোনো দিন চুরুলিয়া ফিরে যেতে রাজি হননি। এমন কি ১৯২৮ সালের ৩০ মে চুরুলিয়ায় মায়ের মৃত্যুর খবর পেয়েও নজরুল গ্রামের বাড়িতে যাননি। শেষবারের মতো মায়ের মুখ খানি দেখেন নি। অবশেষে একবুক কষ্ট নিয়ে জাহেদা খাতুন এ পৃথিবী থেকে চিরবিদায় গ্রহণ করেছেন। মা জাহেদা খাতুন পুত্র নজরুলকে এক নজর দেখার জন্য অন্তিম বাসনা প্রকাশ করেছিলেন। জাহেদা খাতুনের মাতৃ হৃদয়ের এই অতৃপ্ত হাহাকার কি নজরুল জীবনে কোনই প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেনি? কে জানে নজরুলের ৩৪ বছরের জীবন্ত-মৃত অবস্থার জন্যে তাঁর মায়ের অতৃপ্ত আত্মার অভিশাপই দায়ী কিনা। জীবদ্দশায় কবি কখনোই এ সম্পর্কে মুখ খোলেন নি। ফলে নজরুলের জীবনে এটি আজো অমীমাংসতি অধ্যায় হিসেবেই রয়ে গেছে। অভিমান বশে মায়ের সাথে নজরুল সম্পর্ক ছিন্ন করলেও পরবর্তী সময়ে নজরুলের বুভূক্ষ মন কিন্তু সবর্দা কাঙ্গালের মতো কেঁদে ফিরেছে মাতৃ¯েœহের সামান্যতম পরশ পাওয়ার জন্য। তাই আমরা দেখতে পাই বিভিন্ন সময়ে কতিপয় মহিয়সী নারীকে তিনি প্রাণ ভরে মা বলে সম্মোধন করেছেন। তাঁদেরকে কবি যেমন মায়ের মতোই অন্তর দিয়ে ভক্তি শ্রদ্ধা করেছেন। তেমনি তাঁরাও তাকে পুত্রবৎ ¯েœহ করেছেন। নজরুলের মা সম্মোধনে যারা ধন্যা হয়েছিলেন তাদের মধ্যে দৌলতপুরের আলী আকবর খানের মেজো বোন নার্গিসের খালা আম¥া এখতারুন্নেসা খানম, বিপ্লবী হেমপ্রভা দেবী, হুগলীর মিসেস এম.রহমান, কুমিল্লার বিরজা সুন্দরী দেবী এবং দেশ বন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের স্ত্রী বাসন্তী দেবী অন্যতমা, নজরুল নার্গিসের বিয়ের ব্যাপারে যখন খাঁ পরিবারের সকলেই ছিলেন গররাজি তখন এই এখতারুন্নেসাই সকলের ওপরে প্রভাব বিস্তার করে সেই বিয়েকে সম্ভব করে তুলেছিলেন। ১৯২১ সালের ১৭ জুন নজরুলের সঙ্গে নার্গিস আসার খানম বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন (বিয়ে নিয়ে অনেক মতানৈক্য আছে)। এই সময় এখতারুন্নেসা খানম মায়ের মতোই নজরুলের সকল আব্দার পূরণ করতেন। এখতারুন্নেসা ছাড়া আর কাউকে কবি পাত্তাই দিতেন না। নজরুলেেক তিনি এতটা আপন করে নিয়েছিলেন যে, ভাইদের কাছে প্রাপ্য তিনি তাঁর পৈত্রিক সম্পত্তি নজরুলের নামে লিখে দেওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছিলেন। তিনি ছিলেন নিঃসন্তান। বহুনারীর মাতৃ¯েœহ আদর, মমতা, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা পেয়েছেন কবি। এমনি ধরণের আরেক অগ্নি কন্যা হেম প্রভাবকে নজরুল “মা” বলে ডাকতেন। এই হেমপ্রভাকে নিয়ে কবি রচনা করেন “হৈমপ্রভা” কবিতাটি।
১৩৩২ বঙ্গাব্দের ২৯ ফাল্গুন কবি মাদারিপুরে মৎস্যজীবী সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। প্রগতিশীল শান্তি আন্দোলন ও নারী জাগরণের অগ্রসেনানী হেমপ্রভাও ঐ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। কবি এই মহীয়সী নারীকে নিয়ে ১৯২৬ সালে রচনা করেন হৈমপ্রভা কবিতাটি।
কোন অতীতের আঁধার ভেদিয়া/আসিলো আলোক জননী।
প্রভায় তোর উদিল প্রভাত/হেম-প্রভ হল ধরণী ॥
এসো বাংলার চাঁদ সুলতানা/বীর মাতা বীর জায়া গো।
তোমাতে পড়েছে সকল কালের/বীর নারীদের ছায়াগো ॥
শিব সাথে সতী শিবানী সাজিয়া/ফিরছি শ্মশানে জীবন মাগিয়া,
তব আগমনে নব বাঙালীর/কাটুক আঁধার রজনী ॥ (অসমাপ্ত)
বিভাগ : সাহিত্য
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
নরওয়েতে বাস দুর্ঘটনায় ৩ জন নিহত, ৪ জন গুরুতর আহত
ঐক্য-সংস্কার-নির্বাচন নিয়ে জাতীয় সংলাপ শুরু আজ
ইহুদিদের ইউসুফ (আঃ)- এর সমাধিতে নিয়ে গেল ইসরায়েলি সেনারা
কাকরাইলে সাদপন্থিদের জমায়েত নিষিদ্ধ করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়
ইয়েমেনে ইসরাইলি হামলা, অল্পের জন্য রক্ষা পেলেন ডব্লিউএইচও প্রধান
ইসরায়েলি হামলায় ইয়েমেন ও গাজায় ব্যাপক প্রাণহানি
হেলিকপ্টারে সফর নিয়ে বিতর্ক, ব্যাখ্যা দিলেন আসিফ মাহমুদ
কুমিল্লায় ছুরিকাঘাতে যুবক খুন
সচিবালয়ে আগুন: সংগ্রহ করা হলো সিসিটিভি ভিডিও
জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে বাশার আল-আসাদের স্ত্রী আসমা
টেস্ট ক্যারিয়ারের রেকর্ডময় ৩৪তম সেঞ্চুরি পূর্ণ করলেন স্মিথ
জাহাজে ৭ খুন : লাগাতার কর্মবিরতিতে পণ্যবাহী নৌযান শ্রমিকেরা
লেস্টার সিটিকে হারিয়ে ধরাছোঁয়ার বাইরে লিভারপুল
ফের্নন্দেসের লাল কার্ডের দিনে ফের হারল ইউনাইটেড
শেষের গোলে জিতে চেলসির জয়রথ থামাল ফুলহ্যাম
পরলোকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং: ভারতে ৭ দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা
কালীগঞ্জে রাঙ্গামাটিয়া ধর্মপল্লীর সংবাদ সম্মেলন
গ্রাম আদালত সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরিতে সমন্বয় সভা অনুষ্ঠিত
মিসরে প্রেসিডেন্ট সিসির বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ
কুর্দি যোদ্ধাদের ভয়ঙ্কর হুঁশিয়ারি এরদোগানের