অলঙ্কার
১৬ আগস্ট ২০২৪, ১২:৩৫ এএম | আপডেট: ১৬ আগস্ট ২০২৪, ১২:৩৫ এএম
নিনা রিক্সায় করে বাসায় ফিরছে যখন, তখন পড়ন্ত দুপুর শেষে বিকেলের আগমনী পরিবেশ। পিচ ঢালা পথটি মেরামত করা জরুরী। এমন পথে যানবাহনে বসলে শরীরটাই যে ব্যথা হয়ে যায়। পথের ছোট ছোট গর্তে যানের চাকা এলোপাতাড়ি পড়লে পুরো শরীরের কলকব্জা যেন নড়ে ওঠে। নিনা যে রিক্সায় চড়েছে, সে রিক্সার করুন অবস্থা। রিক্সার ঝাকিতে নিনা বসতে যতটা না সচেতন, তারচেয়ে বেশি সচেতন কাধের ভ্যানিটি ব্যাগের দিকে। কারণ এই ভ্যানিটি ব্যাগে এক টুকরো কেক আছে টিস্যু পেপারে মোড়ানো। রিক্সার ঝাঁকিতে যেন ভ্যানিটি ব্যাগ এলোমেলো না হয়ে যায়, সেদিকে নিনার যথেষ্ট গুরুত্ব। তবে কেকের এই টুকরোটির ছোট্ট একটা ইতিবৃত্ত আছে। কলেজের ক্যান্টিনে যখন বান্ধবীদের নিয়ে গল্পের পসরা সেজেছে, লুবনা ফেসবুক ঘাটাঘাটি করে জেনেছে আজ তাদের প্রিয় বান্ধবী তামান্নার জন্মদিন। ব্যস, তারপর অপ্রত্যাশিত জন্মদিন পালনের ব্যাপারে সবগুলো হারামজাদি উঠে পড়ে লেগে কেক নিয়ে এসেছে তামান্নাকে শুভেচ্ছা জানাতে মোটামুটি দারুন সময় কাটল। তামান্না নিজ হাতে বড় সাইজের কেকটি টুকরো টুকরো করে বান্ধবীদের খেতে দেয়। কিন্তু নিনা খেতে গিয়ে অপূর্বকে মনে পড়লে সে আর কেকটি খেতে পারল না। বান্ধবীদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে টিস্যু পেপার বের করে কেকের টুকরোটি সেখানে মুড়িয়ে ব্যাগে ভরে ফেলল। এই কেক অপূর্বের জন্য। অপূর্ব কেক খুব পছন্দ করে। এমন না যে নিনারা অনেক গরিব। কেক কেনার সামর্থ্য নেই। সবাই আছে ওদের। কিন্তু ছোট ভাই অপূর্বের কেক প্রীতির কথা মনে হতেই কেকটি আর খেতে না পেরে কৌশলে ব্যাগে ভরে রাখল ।
অপূর্ব মহা খুশি কেকটি পেয়ে। ছোট ভাইয়ের এমন হাসি হাসি মুখটি দেখে মন ভরে গেল নিনার। কেক পেটে চালান দেওয়ার সুখে অপূর্ব কেকটি নিয়ে নাচতে নাচতে দক্ষিণের বারান্দায় চলে গেল। নিনাও পোষাক বদলে নেওয়ার তাড়নায় স্থান ত্যাগ করল।
বারান্দায় এসে অপূর্ব টিস্যু পেপার সরিয়ে কেকটি মুখে দেয়ার আগেই বিউটি বেগম এসে অপূর্বের হাত থেকে কেকটি থাবা দিয়ে বারান্দার জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দিলেন। মায়ের এমন কান্ডে হতবাক অপূর্ব প্রশ্ন করে, ‘এটা কেন করলে’? বিউটি বেগম কড়া গলায় বললেন, ‘তোকে কতবার না বলেছি নিনা বাইরে থেকে কোনো খাবার এনে দিলে খাবিনা। এসব খাবারে ও বিষ মেখে তোকে মেরে ফেলার ফন্দি করে। তুই মরে গেলে বাপের সব সম্পত্তি একা একা ভোগ করে খাবে আর বিয়ের পর স্বামীর সাথে আত্মসাৎ করে নেবে। সৎবোন কখনো আপন হয়না এগুলো আর কত শেখাব তোরে!’
মায়ের এইসব পুরনো অভিযোগ এখন আর কানে তুলে না অপূর্ব। সে হাড়ে হাড়ে চেনে তার নিনা বুবুকে। হতে পারে নিনা বুবু তার সৎবোন, কিন্তু এমন অমানুষের মত ফন্দি যে নিনা বুবুর ভাবনার ধারেকাছেও নেই, এ ব্যাপারে অপূর্ব নিশ্চিত। সে এবার সেভেনে পড়ে। দিন দিন চিনতে জানতে শুরু করেছে কোনটা জল আর কোনটা অনল। অতএব সৎবোন নিনা বুবু তার চোখে অসাধারণ এক মানুষ।
অপূর্বও ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়। সে তেজি সুরে বলে, ‘তুমি সব সময় নিনা বাবুকে মিথ্যা সন্দেহ করো কেন? নিনা বুবু আমাকে মেরে ফেলবে কেন? সে তোমার মত গুটিবাজ নয়।’ পেটের পুত্রের কোথায় রেগে গেলেন বিউটি বেগম। দাঁতের উপর দাঁত চেপে বললেন, ‘যেদিন মেরে ফেলবে, সেদিন বুঝবিরে বেকুব। ওকে এত দরদ দেখাস কিসের আশায়? সৎবোনের কাছে কোনো কিছু আশা করা বোকামি। অপূর্ব মায়ের এসব কূটনীতিকে পরোয়া না করে বলে, ‘টাকা দাও। কেক ফেলে দিলে কেন? আজকে আমি কেক খেয়েই ছাড়ব। আমাকে টাকা দাও। বাজারে এসব জন্মদিনের কেক কোন দোকানে বিক্রি হয়, আমি চিনি। জলদি টাকা দাও বলছি।’ ছেলেকে ক্ষ্যাপা হতে দেখে বিউটি বেগম জিদ করে বললেন, ‘টাকা না দিলে কি করবি?’ অপূর্ব জবাব দেয়, ‘তুমি যে রোজ পাশের বাড়ির জয়ের মায়ের কাছে নিনা বুবুর নামে বদনাম করো, সব তারে বলে দেব। টাকা দিলে আর কিছু বলব না। বিউটি বেগম তর্কে না যেয়ে অপূর্বের গালে কষে এক চড় বসিয়ে দিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলেন দ্রুত পায়ে।
অপূর্ব কাঁদছে। মায়ের চড়ে তার গাল লাল হয়ে গেছে। কিন্তু কেকের লোভ কমছে না। জানালার ওপাশে ছুঁড়ে ফেলা কেকটির দিকে তাকালে জিভে যেন জল আসে বারবার। হঠাৎ কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ অনুভব করে অপূর্ব। চেয়ে দেখে নিনা বুবু। হাতে ৫০০ টাকার একটি কচকচে নোট অপূর্বের হাতে ধরিয়ে দিয়ে নিনা বলে, ‘এই নে টাকা। যা বাজারে যা। কেক কিনে খাস ভাই।’ অপূর্ব এই পরিস্থিতি কল্পনাও করেনি। অবাক কণ্ঠে বলল, ‘ইয়ে মানে। কেক কিনে খাব মানে? আমি তো তোর দেয়া কেক খেয়ে ফেলেছিরে।’ নিনা মলিন মুখে মরা হাসির রেখা টেনে বলল, ‘আমি মনে কষ্ট পাব বলে সব গোপন রাখার চেষ্টা করিস? আমি সব শুনেছিরে। কোনো কষ্ট পাইনি ভাই। নে, টাকাটা নিয়ে বাজারে গিয়ে কেক খেয়ে আয় আমার লক্ষ্মী ভাই।’
অপূর্ব আর না করে না। কেকের লোভ তাকে এতটাই লোভনীয় করে রেখেছে যে নিনার হাত থেকে টাকাটা নিয়ে এক দৌড়ে বাজারের দিকে পা বাড়ায়।
বারান্দার চেয়ারে বসে নিনা তাকিয়ে থাকে বাইরে ফেলে দেয়া কেকটির দিকে। কত যতœ করে এই কেক সে ভ্যানিটি ব্যাগে ভরে এনেছে। নিনা দেখতে পাচ্ছে সেই কেকটি এখন পাশের বাড়ির জয়দের পোষা বেড়াল খাচ্ছে, যে জয়ের মায়ের কাছে নিনার বদনাম করেছে তার সৎমা বিউটি বেগম।
সেই কোনো এক চৈত্রে হেদায়েত আলী তার মা মরা মেয়ে নিনার জন্য নিয়ে আসেন নতুন মা বিউটি বেগমকে। কিন্তু সেই নতুন মা কখনোই নিনাকে স্বীকৃতি দেননি কন্যার মর্যাদায়। নানান অবহেলায় দিন যেতে থাকে ছোট্ট নিনার। সেই ছোট্ট নিনা এখন কলেজে পড়ে। বিউটি বেগমের অবহেলাকে এখন আর গায়ে মাখে না।
সন্ধ্যার আবছায়া নামে বাড়ি জুড়ে। বাড়ি ফিরে আসে অপূর্ব। নিনা বুবুকে বারান্দায় আগের জায়গাতে বসে থাকতে দেখে বলে, ‘বুবু, এখনো এখানে বসে আছিস?’ অপূর্বের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে নিনা বলল, ‘মজা করে কেক খেয়েছিস তো?’ অপূর্ব জবাব দেয়, ‘না।’ নিনা অবাক হয় বলে, ‘কেন?’ অপূর্ব এদিক সেদিক তাকিয়ে পকেট থেকে এক জোড়া কানের দুল বের করে নিনাকে এগিয়ে দিয়ে বলে, ‘এটা তোর জন্য বুবু।’ নিনা আকাশ থেকে পড়ার ভঙ্গিমায় বলল, ‘মানে কি অপূর্ব? কানের দুল কেন?’ অপূর্ব মেঝেতে বসতে বসতে বলল, ‘কেক খেতে গেলাম। হঠাৎ বাজারের এক দোকানে এই দুল জোড়া দেখে মনে হল তোকেই মানাবে। তাই কিনে নিয়ে এলাম। কি সুন্দর না বুবু? দেখ, কানের দুল জোড়ায় কয়েকটি নকল পাথর চিকচিক করছে আসল পাথরের মত! নিনা দেখে সত্যি সত্যি নকল পাথর কয়েকটি চিকচিক করছে কানের দুল জোড়ায়। ঠিক যেভাবে এই মুহূর্তে নিনার চোখের কোনেও চিকচিক করছে কয়েক ফোঁটা নোনাজল। কিন্তু এ জল এসে অপূর্বকে দেখাতে পারবে না। অপূর্ব বলল, ‘কিরে বুবু, কথা বলিস না কেন? কানের দুল তোর পছন্দ হয়নি? ফিরিয়ে দিয়ে নতুন একজোড়া কিনে আনব?’
অপূর্বের এই নিঃস্বার্থ ভালোবাসায় চোখের পানি কোনোভাবেই ধরে রাখা যাচ্ছে না। বুক চাপা কান্না গোপন রাখার অদম্য শক্তি দিয়ে সহজ কণ্ঠে নিনা বলে, ‘দেখরে, পুরো সন্ধ্যা হতে না হতেই কি সুন্দর চাঁদের আলো পড়ছে। আজ রাতে জোছনা হবে। আমরা গভীর রাতে উঠোনে দিয়ে জোছনা দেখব। তুই রাজী?’ অপূর্ব জবাব দেয়, সম্ভব না। এত রাতে উঠোনে গেলে ভুতে ধরবে। আমি যাব না। তুই যাস। একা একা দেখিস তোর জোছনার আলো।’ বলে অপূর্ব হাসতে লাগল। সেই সরল হাসি যেন নিনাকে আরো দুমড়ে মুছড়ে দিচ্ছে। নিনার বলতে ইচ্ছে করছে-তুই এত সরল আর এত কেন ভালোরে ভাই?
বিভাগ : সাহিত্য
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ফার্মগেট মানসী প্লাজায় আগুন, নেভাতে কাজ করছে ফায়ার সার্ভিসের ৫ ইউনিট
মাদকের টাকা না পেয়ে মাকে কুপিয়ে হত্যা করে থানায় ছেলের আত্মসমর্পণ
তারেক রহমান ও কায়কোবাদের মামলা প্রত্যাহার না করলে আন্দোলনের হুমকি হিন্দু সম্প্রদায়ের
সুরমা-কুশিয়ারার জন্য ১৭৮৫ কোটি টাকার প্রকল্প
নকলায় নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার
কালীগঞ্জে বিএনপি'র মহাসচিব মির্জা ফখরুলকে ফুলের শুভেচ্ছা জানালেন হামিদ
পর্ন তারকা স্টর্মিকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘুষ প্রদান মামলার রায় স্থগিত করলো আদালত
দৌলতপুরে মাদকাসক্ত যুবকের হাতে মাছ ব্যবসায়ী খুন : যুবক আটক
রাস্তা আটকে যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে বিক্ষোভ, অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা
পবিত্র কোরআন শরীফের পরে সত্য হিসেবে মানুষ সংবাদপত্রকে মনে করতো-বিটিভি মহা পরিচালক
লালমোহনে বিদ্যুৎ স্পৃষ্টে ৭০ বছরের বৃদ্ধ নিহত
বিচারের আগে ফ্যাসিস্ট আ. লীগের রাজনীতিতে ফেরার সুযোগ নেই : নাহিদ
ড. ইউনূসকে নিয়ে এক দশক আগে যা বলেছিলেন নরেন্দ্র মোদি
গাজীপুরে পিকনিকের বাসে বিদ্যুতের তারের স্পর্শে ৩ শিক্ষার্থীর মৃত্যু
লেবাননে জাতিসংঘ মিশনে হামলা, চার ইতালীয় সেনা আহত
এ আর রহমানের নামে মিথ্যাচার রটানোর অভিযোগে তীব্র ক্ষোভ ঝাড়লেন ছেলে এ আর আমিন
ধর্মদ্রোহী সরকারের সময় কোন ধর্মই নিরাপদ ছিল না-এড.আহমেদ আযম খান
শব্দের চেয়ে দ্রুতগতিসম্পন্ন বাধ মানে না এমন ক্ষেপণাস্ত্র প্রস্তুত আছে : পুতিন
ঢাকা আজ বিশ্বের দূষিত শহরের তালিকায় চতুর্থ
পলাতক পুলিশ সদস্যদের বেতন বন্ধ, হচ্ছে মামলা