বাংলা সাহিত্যে নতুন ধারার অপরিহার্যতা
১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:১০ এএম | আপডেট: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:১০ এএম
সময় পরিবর্তনশীল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে একটি কালের আর্থ-সামাজিক ও রাজনীতির ক্ষেত্রে যেমন পরিবর্তন সাধিত হয়, তেমনি শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির পালাবদলও অবসম্ভাবী হয়ে ওঠে। সাহিত্যের ক্ষেত্রে তেমনটিই ঘটেছে বারবার। এসেছে নতুনত্ব, নতুন কিছু। আমরা দেখতে পাই, অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতকের মাঝামাঝি সময়কালে বাংলা কাব্য সাহিত্যের ইতিহাসের প্রথম নিদর্শন হিসেবে ‘চর্যাপদ’ রচিত হয়েছে। এটি পুরো বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের ধারায় প্রাচীনতম সাহিত্য নিদর্শনও বটে। চর্যাপদের লেখকগণ সহজিয়া বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্য ছিলেন বলে অনেক গবেষক মত দিয়েছেন। এটির ভাষা ‘সন্ধ্যা ভাষা’ বা ‘আলো আঁধারী’ ভাষা হিসেবে চিহ্নিত। এ সময়কালকে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসবিদগণ ‘প্রাচীন যুগ’ হিসেবে নামকরণ করেছেন।
ত্রয়োদশ শেকে চতুর্দশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যে কোনো নিদর্শন পাওয়া যায়নি। এজন্য এ সময়কালকে ‘অন্ধকার যুগ’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। আলো-আঁধারি ভাষার স্তর পেরিয়ে ১৩৫০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালকে ‘মধ্যযুগ’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। একালের লেখকগণ দু’ধারায় বিভক্ত। একদিকে হিন্দু কবিগণ বিভিন্ন দেবদেবির উপাসনা করে রচনা করেন ‘মঙ্গলকাব্যে’র ধারা। যেমন- দ্বিজ বংশীদাসের ‘মনসামঙ্গল’, মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর ‘চ-ীমঙ্গল’, ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের ‘অন্নদামঙ্গল’, রামপ্রসাদ সেনের ‘কালিকামঙ্গল’, বড়–-ীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’, বিদ্যাপতি, চ-ীদাস, জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাস প্রমুখের ‘বৈষ্ণব পদাবলী’, রামাই প-িতের ‘শূন্যপুরাণ’ প্রভৃতি।
অপরদিকে মুসলমান কবিগণ দেবদেবির পূজা-অর্চনার কাহিনিকে পাশ কাটিয়ে মানব-মানবীর অমর প্রেম কাহিনিকে কাব্যে বিষয়বস্তু হিসেবে উপজীব্য করে রচনা করেন ‘রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান’-এর ধারা। এ ধারার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো- শাহ মুহাম্মদ সগীরের ‘ইউসুফ-জুলেখা’, দৌলত উজির বাহরাম খানের ‘লায়লী মজনু’, সাবারিদ খানের ‘হানিফা-কয়রাপরী’, আলাওলের ‘পদ্মাবতী’, ‘সয়ফুলমুলুক-বদিউজ্জামাল’, মুহম্মদ কবীরের ‘মধুমালতী’,নওয়াজিস খানের ‘গুলে-বকাওলী’, দৌলত কাজীর ‘সতীময়না ও লোরচন্দ্রানী’ প্রভৃতি। দুই ধারার কবিদেরই সহজ স্বচ্ছন্দ ও সাবলীল ভাষার ব্যবহার পরবর্তী কাব্যধারার গতিকে তরান্বিত করেছে। বাংলা কাব্য সাহিত্যের ধারা এভাবে পরিবর্তন হতে থাকে।
মধ্যযুগের একটি উল্লেখযোগ্য রচনা হলো মৈমনসিংহ গীতিকা। কাহিনিকাব্যের আদলে রচিত এসকল পালা গান কয়েক শতাব্দীব্যাপী মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত রয়েছে। এ ধারার উল্লেখযোগ্য কাহিনিগুলো হলো- দ্বিজ কানাইয়ের ‘মহুয়া’ (১৬৫০), চন্দ্রাবতীর ‘মলুয়া’ ও ‘দস্যু কেনারামের পালা’, মনসুর বয়াতির ‘দেওয়ান ও মদিনা’ প্রভৃতি। ১৯২৩-৩২ সালে দীনেশচন্দ্র সেন এ সকল পালাকে একত্রিত করে নিজের সম্পাদনায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’ প্রকাশ করেন।
এ যুগেরই আরেকটি উল্লেখযোগ বাক বদল হয়েছিলো ‘বাউল গান’ রচনার মধ্য দিয়ে। বাউল গান ঐতিহ্যবাহী লোকায়ত সঙ্গীতের একটি উল্লেখযোগ্য ধারা। বৈষ্ণব সহজিয়া তত্ত্ব ও সুফিবাদ প্রভাবিত এ ধারায় ফকির লালন শাহ্, সিরাজ শাহ্, পাঞ্জু শাহ,্ দুদ্দু শাহ প্রমুখ এ ধারাকে স্বতন্ত্র উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে।
১৮০১ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে বাংলা গদ্যের উদ্ভবের মধ্যদিয়ে বাংলা সাহিত্যের ধারায় আধুনিক যুগের সূচনা হয়। যদিও এই যুগসন্ধিক্ষণেও ঈশ্বরগুপ্ত ব্যাপকভাবে লিখেছেন কবিতা। এর প্রায় ৫৮ বছর পর ১৮৫৮ সালে প্যারিচাঁদ মিত্রের ‘আলালের ঘরের দুলাল’ উপন্যাসের মধ্যদিয়ে উপন্যাস সাহিত্যের উদ্ভব ঘটে। মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩) চিরায়ত বাংলা কবিতার ধারাকে টপকিয়ে অমিত্রাক্ষর ছন্দে কবিতা রচনা করেন। তাঁর হাতে বাংলা কবিতা ও কাব্যের জগতে একটা বিরাট পরিবর্তন সাধিত হয়। বাংলা সাহিত্য জগতে যাঁকে আধুনিক রেনেসাঁর কবি নামে অভিহিত করা হয়। অন্ত্যমিল ঘুচিয়ে যত্রতত্র ছেদ চিহ্নের ব্যবহার ঘটালেন মধুসূদন। ইতালির কবি পেত্রার্কের অনুসরণে বাংলা কবিতায় সূত্রপাত করলেন ‘সনেটের।’ তাঁর ‘মেঘনাদবধ’ (১৮৬১) মহাকাব্য প্রাচ্যের ‘রামায়ণ’ ও ‘মহাভারত’ এবং ও পাশ্চাত্যের হোমারের ‘ইলিয়াড’, ‘ওডিসি’, জন মিল্টনের ‘প্যারাডাইস লস্ট’ দান্তের ‘ঈনিদ’ ত্যাসোর ‘জেরুজালেম ডেলিভার্ড’, প্রভৃতি কাব্য থেকে রস আস্বাদন করে তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সাহিত্যের অপরূপ সম্মিলন ঘটান। কায়কোবাদের ‘মহাশ্মশান’ নবতর সৃষ্টি।
মধ্যযুগের কাব্য ইতিহাসের একটা বিরাট সময়কাল ধরে মাইকেল মধুসূদনের যে ধারা চলে আসছিল তা ভেঙে দিলেন রবীন্দ্রনাথ (১৮৬১-১৯৪১)। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন পৃথিবীর কাব্য সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী কবি নিজস্ব কাব্য ভাষার সৃষ্টির মধ্য দিয়ে আপামর বাঙালি পাঠকের হৃদয়ে প্রবেশ করলেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবিতায় প্রেম, মমতা, সমাজ, ধর্ম, আধ্যাত্মিক, সামাজিকসহ যাবতীয় বিষয়াবলী ফুটিয়ে তোলেন। তাঁর বিচিত্র চিন্তা-চেতনা এবং নিজস্ব ধারায় বাংলা কবিতা হয়ে উঠেছিলো মানুষের কাছে আস্থার প্রতীক। এরপর নজরুল যুগ। কবি নজরুল তাঁর ‘অগ্নিবীণা’, ‘চক্রবাক’ কবিতায় বিদ্রোহ, দেশপ্রেম, জীবন, সমাজ, প্রতিবাদ, প্রতিশোধ ও প্রতিরোধের কথা ফুটিয়ে তুলেছেন। বিহারীলাল চক্রবর্তী বাংলা কাব্যে মিষ্টিসিজমের প্রয়োগ ঘটিয়ে বাংলা কবিতার ‘ভোরের পাখি’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন।
ত্রিশোত্তর বাংলা সাহিত্যে ‘কল্লোল গোষ্ঠী’র একদল লেখক ‘রবীন্দ্রবলয়’ থেকে বেরিয়ে এসে ইউরোপীয় সাহিত্যের ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হয়ে একটি ভিন্নতর সাহিত্যধারা সৃষ্টি করতে আগ্রহী হন এবং যথারীতি তাঁরা সার্থকতার সঙ্গে বাংলা সাহিত্যে একটি স্বতন্ত্র সাহিত্যধারার সৃষ্টি করেন। তাঁরা সিগমুন্ড ফ্রয়েড, কার্ল মার্কস, আল্বেয়ার ক্যামু, জেমস জয়েস, জ্যঁ পল সাঁর্ত্রে, ভার্জিনিয়া উলফ্, উইলিয়াম ফকনার প্রমুখ সাহিত্যিকের প্রভাবে মানুষের অন্তর্জগৎকে অবলম্বন করে সমকালীন জীবন, জগৎ, চিন্তা-চৈতন্য উপস্থাপন করেছেন। এ ধারার উল্লেখযোগ্য কবিগণ হলেন- জীববনানন্দ দাশ, অমিয় চক্রবর্তী, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত (১৯০৩-১৯৮৮), প্রেমেন্দ্র মিত্র (১৯০৪-১৯৮৮), বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-১৯৭৪) প্রমুখ। এ কালে পল্লী কবি জসীম উদ্দীনের ‘নক্সীকাথার মাঠ’, ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ প্রভৃতি কাহিনিকাব্য রচনার মধ্যদিয়ে বাংলা কাব্যে ভিন্নতর আবহ সৃষ্টিতে প্রয়াসী হন। ফররুখ আহমেদ কাব্যসাহিত্যের মাধ্যমে মুসলিম রেনেসাঁর জাগরণ ঘটান। তাঁর ‘সাত সাগরের মাঝি’, ‘সিরাজাম মুনীরা’, ‘হাতেম তাঈ’ প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থ রচনার মধ্যদিয়ে একটি স্বতন্ত্র কাব্যধারার সৃষ্টি করেন।
পরবর্তীতে আল মাহমুদ, শামসুর রাহমান, কাজী কাদের নওয়াজ, আবদুল মান্নান সৈয়দ, আলাউদ্দিন আল আজাদ, সৈয়দ আলী আহসান, আবুল হোসেন, রফিক আজাদ, আসাদ চৌধুরী, আবদুল হাই শিকদার, ওমর আলী, হাসান হাফিজুর রহমান, হাসান হাফিজ, আবিদ আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা, নাসির আহমেদ, মুহাম্মদ নূরুল হুদা, রেজাউদ্দিন স্টালিন প্রমুখ কবিগণ তাদের কবিতায় পূর্বের গতানুগতিকতাকে পরিহার করে নির্মোহ ও বাস্তবজীবনভিত্তিক কবিতা রচনা করেছেন।
সময় এভাবেই বদলে যায়। বদলে যায় সাহিত্য। পুরনো চিন্তাধারার রীতিনীতি পরিবর্তিতে হয়ে গড়ে ওঠে নতুন ধারা। মূলত বাংলা সাহিত্যে এই প্রথম কোনো কবিতার ধারা সর্বস্তরের মানুষের মাঝে পরিণত ও যুগোপযোগী মনে হয়েছে। আর এই নতুন ধারাকে একটি ভিন্ন গতিময়তা দান করেছেন কবি ফাহিম ফিরোজ। তাঁর সৃজনশীল চিন্তা-চেতনার সৃষ্টি এই নতুন ধারা।
নতুন ধারার কবিতা মূলত সমাজের প্রান্তিক খেটে খাওয়া মানুষ, স্বজন-বন্ধু, প্রকৃতি ও প্রেম, ভাষা-নৈপূণ্য এবং করণকৌশলের অভিনবত্বের ফলে সাধারণ পাঠকের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। নতুন ধারা অন্য কোনো বিদেশী সাহিত্যেও অকুকরণ বা অনুরণন নয়। এটি কবির একান্ত নিজস্ব সৃষ্টি- যা অনুভূতির গভীরে মিশে কবিতাকে আরো পরিপক্ক ও শ্রুতিমধুর করে। যার ফলে নতুন ধারার কবিতা হয়ে ওঠে প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক যুগের কবিতার তুলনায় উৎকৃষ্ট।
বিভাগ : সাহিত্য
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ফের চুক্তি লঙ্ঘন ইসরাইলের
চীনের সঙ্গে বন্ধুত্ব অব্যাহত থাকবে
চলতি মাসে পদোন্নতি পাচ্ছেন ২৫ ক্যাডারের উপসচিবরা
দুই মামলায় মির্জা ফখরুলকে অব্যাহতি
সেন্টমার্টিন দ্বীপে ভ্রমণ বিধিনিষেধ প্রত্যাহার হচ্ছে না
ফ্যাসিস্ট হাসিনা জানতেন না কুমিল্লা খন্দকার মোশতাকের নয়, মেজর গনি-ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের
৪৪তম বিসিএসের মৌখিক পরীক্ষা শুরু ২২ ডিসেম্বর
পক্ষভুক্তদের রুল শুনানি আজ
সংবিধান পুনর্লিখনের প্রস্তাব দিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন
রাঙামাটির সাজেকে দিনভর গোলাগুলি: ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা জেলা প্রশাসনের
'বিপ্লবোত্তর ছাত্র ঐক্য' জবিতে ১২ ছাত্রসংগঠনের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ
শেরপুরে সেনা সদস্যকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় ৩৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা : গ্রেপ্তার-৭
ঢাকায় তিন দিনব্যাপী ইরানি চলচ্চিত্র উৎসব শুরু
খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করলেন পাকিস্তানের হাইকমিশনার
ফিলিস্তিনে ইসরাইলের বর্বর হামলার প্রতিবাদে ঢাকায় আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত
বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের বিরুদ্ধে অবস্থাকারীরাই মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের দায়িত্বে
ভিভো ভি৪০ ফাইভজি, হালকা ওজনে শক্তিশালী ব্যাটারি
ভারতের শাসকগোষ্ঠী ও হিন্দুত্ববাদী শক্তি সম্প্রীতি চায় না: তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা
দিল্লী দিশেহারা হয়ে নানা ধরনের বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে: শাহীন শওকত
বাংলাদেশে ব্রিটিশ নাগরিকদের ভ্রমণে সতর্কতা জারি