ঢাকা   বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪ | ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

শরৎচন্দ্রের ‘দত্তা’ আমি এবং বাবা

Daily Inqilab জসীম উদ্দীন মুহম্মদ

২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:১৪ এএম | আপডেট: ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:১৪ এএম

বলতে দ্বিধা নেই যার বই পড়ে কথাসাহিত্যে আমার হাতেঘড়ি তিনি আর কেউ নন; তিনি হলেন বাংলা সাহিত্যের একমাত্র ‘অপরাজেয় কথাশিল্পী’ সবার প্রিয় শরৎচন্দ্র চট্রোপাধ্যায়। আমার পাঠক জীবন মুলত প্রাইমারি স্কুল থেকে শুরু। বলাবাহুল্য আমি উত্তরাধিকার সূত্রেই পাঠক পরিবারের একজন গর্বিত সদস্য। জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই আমি পরিবারের সবার হাতে হাতে বই দেখেছি। সুতরাং আমার হাতে বই তুলে নিতে দুইবার ভাবতে হয়নি। শৈশবেই আমার হাতে পাঠ্যবইয়ের বাইরের বই দেখে অভিভাবকদের তেমন একটা হামকি-ধামকির মধ্যে পড়তে হয়নি। অবশ্য মা ছিলেন এ ক্ষেত্রে কিছুটা ব্যতিক্রম। তিনি মাঝে-মধ্যে পাঠ্যবই পড়ার তাগিদ দিতেন। তাই মায়ের সামনে পড়লে আমাকে কিছুটা লুকোচুরি করতে হতো বৈকি।

আপনার প্রিয় বই কোনটি? এই জাতীয় প্রশ্নে অনেকেই আমরা বিব্রত বোধ করি। থতমত খাই। তবে আমার ক্ষেত্রে বিষয়টি অন্যরকম। আমি কোনোরুপ বিব্রতবোধ করিনি। বরং সগৌরবে জানান দিই, আমার প্রিয় বই ‘দত্তা’। কী কারণে দত্তা আমার প্রিয় বইয়ের তালিকায় এক নম্বর স্থানটি অধিকার করে আছে তার হাজারটি কারণ আমি এক নি:শ্বাসে বলে দিতে পারব। তবে সবচেয়ে বড় কারণটি হলেন আমার প্রিয় বাবা। প্রায়ই বাবার হাতে দেখতাম দত্তা। শুয়ে শুয়ে পড়তেন। বসে বসে পড়তেন। বিশেষ করে আমার বাহির বাড়িতে প্রায় প্রতিদিনই বাবার নেতৃত্বে বিকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত একটি পাঠের আসর বসতো। সেই আসরে নানা বয়সী পাঠকের এক মিলনমেলায় চলতো। বাবা সবাইকে পাঠ করে শোনাতেন। শুধু তাই নয় মাঝে মাঝে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিতেন। অত:পর বাবা ক্লান্ত হয়ে গেলে আমাকে পড়তে হতো। কোনোদিন দত্তা, কোনোদিন বিষাদ সিন্ধু, কোনদিন গাজী কালু চম্পাবতীর পুঁথি কিংবা অন্য কোনো গ্রন্থ। আমি যখন দশম শ্রেণিতে পড়ি তখন একদিন বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে আসার পর দেখি বাবা দত্তা পড়ছেন। আস্তে আস্তে কাছে গেলাম। বাবার কাঁধের উপর হাত রেখে জিজ্ঞেস করলাম, বাবা এখন পর্যন্ত কতবার পড়েছেন? শান্ত, সৌম্য মুখ তুলে তিনি আমার দিকে তাকালেন। অত:পর জবাব দিলেন, একশত একচল্লিশবার। বাবা কি মনে করেন ভেবে আমি কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাইনি। তিনি আবার বললেন, তুমি পড়তে চাও? এই বলে আমার হাতে দিকে বইটি এগিয়ে দিলেন। আমার মনের ভাষা পড়তে পারার জন্য মনে মনে বাবার প্রতি শ্রদ্ধা এবং কৃতজ্ঞতা জানালাম। এ তো গেলো আমার দশম শ্রেণিতে পড়াকালীন হিসাব। এরপর বাবা আরও বত্রিশ বছর বেঁচে ছিলেন। এই বত্রিশ বছরে যে কতবার পড়েছেন, কত মানুষকে দত্তা পড়ে শুনিয়েছেন এবং দত্তার কাহিনি শুনিয়েছেন... তার কোনো ইয়ত্তা নেই। এই হলেন আমার বাবা। একজন আজন্ম একনিষ্ঠ পাঠক। সারাজীবন কেবল পাঠ করেছেন, কিন্তু লেখালেখি করেননি।

প্রিয় পাঠক, চলুন সেই ‘দত্তা’ সম্পর্কে অন্তত কিছুটা জেনে নেয়া যাক। ‘দত্তা’ বাংলা সাহিত্যের অপরাজেয় কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অসাধারণ একটি উপন্যাস। তিনি ১৯১৮ সালে ‘দত্তা’ রচনা করেন। এখনো যারা বইটি পড়েননি তাদের এই না পড়ার জন্য আফসোস হতেই পারে! তবে আগেই বলে রাখা ভালো এই উপন্যাস আপনাকে খুব যন্ত্রণা দিবে, মানসিক পীড়ন দিবে। এই উপন্যাসে লেখকের গল্প বলার স্টাইলটাই সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। নায়ক এবং নায়িকা দুইজন দুইজনকে প্রচ- ভালোবাসেন। কিন্তু উপন্যাসের শুরু থেকে শেষ অবধি ভালোবাসা শব্দটি একটিবারের জন্যও নেই। প্রসঙ্গত বলা যায়, গল্পের ট্র্যাজেডি সৃষ্টির বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে প্রাচীন গ্রীক দার্শনিক অ্যারিষ্টটল বলেছিলেন-সাহিত্যে চরিত্র সৃষ্টি অপেক্ষা প্লটই মুখ্য। যদিও চরিত্র সৃষ্টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

উপন্যাসের মূল কাহিনির নেপথ্য নায়ক মূলত তিনজন। জগদীশ, বনমালী আর রাসবিহারী। তিনবন্ধু। বনমালী বাবু গ্রামের বিশাল জমিদার। বনমালী বাবুর একমাত্র কন্যা ‘বিজয়া’। বাপ মেয়েকে অগাধ স্বাধীনতা দিয়ে বড় করেছেন। বাবার মৃত্যুর পর শহর থেকে গ্রামে আসে বিজয়া, এখানে তার বাবার বাল্যবন্ধু রাসবিহারী বাবু তার অনুচ্চারিত অভিভাবক এবং তার ছেলে বিলাসবিহারীর সাথে বিজয়ার বিয়ে সেই আগে থেকেই ঠিকঠাক। এ হল রাসবিহারী এবং জগদীশবাবুর বাল্যকালের রসায়ন। সেই সূত্র ধরে রাসবিহারীর ছেলে বিলাসবিহারী বিজয়ার উপর অধিকার ফলাতো। কিন্তু বিলাসবিহারীর এই অধিকার ফলানোকে বিজয়া খুব একটা ভালো চোখে দেখতো না। এমন সময় নরেনের সাথে আলাপ হয় বিজয়ার। নরেন আলাভোলা ছেলে, কিন্তু স্টুপিড নয়; বিজয়া যে তাকে পছন্দ করে সেটা বিজয়া কারণে অকারণে তাকে বুঝিয়ে দেয়। কিন্তু হয় নরেন বোঝে না, নয়তো উল্টা বোঝে। তবে ধীরে ধীরে দুইজনের হৃদয়েই রসায়ন জমাট বাঁধতে শুরু করে। কিন্তু বুক ফাটলেও কারোই মুখ ফুটেনি। আর ঠিক এই জায়গাটাই হল দত্তা উপন্যাসের সবচেয়ে বড় ক্লাইমেক্স! ভাবটা অনেকটা এমন যে, ভালোবাসি তো বাসি না; আবার ভালোবাসি নাতো বাসি! কী দারুণ ব্যাপার, তাই না?

অবশ্য এসব কিছুর সাথে ধর্মীয় টানাপোড়েনও কিছুটা উত্রাপ ছড়িয়েছে বৈকি। রাসবিহারী এবং জগদীশ গোড়া হিন্দু হলেও বনমালী বাবু ছিলেন ব্রাহ্ম সমাজের অন্তর্ভুক্ত। ফলশ্রুতিতে এর প্রভাব পড়ে বিজয়া, নরেন এবং বিলাসবিহারীর উপর। যদিও শেষ পর্যন্ত এসব কিছুই ধোপে টিকেনি। তাছাড়া বিজয়ার বাবার কাছে নরেনের বাবার অনেক ঋণ ছিলো। মৃত্যুর আগে সেই ঋণ শোধ করতে পারেননি নরেনের বাবা। ফলে বসত ভিটে ছেড়ে দিতে হয় নরেনকে। তবুও সামগ্রিক বিচারে দত্তা একটি রোমান্টিক উপন্যাস। অবশ্য কেবল রোমান্টিক বললে কমই বলা হবে। বলতে হবে পিউর বা সলিড রোমান্টিক উপন্যাস। এই রোমান্টিসিজমের সাথে আছে উপন্যাসটির গ্রামীণ পরিবেশের কুটকৌশল, ষড়যন্ত্র এবং তার মধ্যেই নরেন ও বিজয়ার মূক ভালোবাসা, অভিমান এবং সবশেষে নরেন এবং বিজয়ার বিবাহের মাধ্যমে উপন্যাসের পরিসমাপ্তি।

সবশেষে বলতে চাই, আমার বাবা যে উপন্যাসটি শতশত বার পড়েছেন....আমিও কিন্তু বাবার মতো এতবার না হলেও শতবারের কম পড়িনি। কী আশ্চর্য! যখনই পড়েছি তখনই আমার কাছে মনে হয়েছে নতুন পড়ছি। বিশেষ করে এই উপন্যাস পাঠের মাধ্যমে আমি প্রিয় লেখক শরৎচন্দ্রের গুণমুগ্ধ একজন পাঠক হয়ে যাই। এরপর সেই আমার শরৎ সমগ্র বারবার পড়েও তৃপ্তি মিটেনি। এখনও পড়তে ইচ্ছে হয়। এখনও পড়ি। যাক বিগত সেপ্টেম্বর পনের তারিখ ছিল আমার প্রিয় লেখক শরৎচন্দ্রের জন্মদিন। তার জন্মদিনে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাই এবং নবীন লেখক এবং পাঠকদেরকে শরৎ পড়ার উদাত্ত আহ্বান জানাই।


বিভাগ : সাহিত্য


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

নাট্যকার হুমায়ূন আহমেদ
আত্মবেদনার করুণ কাহিনী ‘বিবি কুলসুম’
কুয়াশার চাদরে ঢাকা হেমন্ত
হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর তৈলতত্ত্ব ও আমাদের সাহিত্য সমাজ
জলের ঘ্রাণ
আরও

আরও পড়ুন

শহীদদের রক্তের সঙ্গে যাতে বেঈমানি না হয়, সুষ্ঠু নির্বাচনে সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা থাকবে : নতুন সিইসি

শহীদদের রক্তের সঙ্গে যাতে বেঈমানি না হয়, সুষ্ঠু নির্বাচনে সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা থাকবে : নতুন সিইসি

খালেদা জিয়াকে ১২ বছর সেনাবাহিনী থেকে দূরে রাখা হয়েছে : মির্জা ফখরুল

খালেদা জিয়াকে ১২ বছর সেনাবাহিনী থেকে দূরে রাখা হয়েছে : মির্জা ফখরুল

সংবিধানে আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা বিশ্বাস ফিরে আনতে হবে  -আল-কাউসার পরিষদ বাংলাদেশ

সংবিধানে আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা বিশ্বাস ফিরে আনতে হবে -আল-কাউসার পরিষদ বাংলাদেশ

সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের কুশল বিনিময়

সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের কুশল বিনিময়

নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে আইসিসি

নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে আইসিসি

শিখ নেতা হত্যা, মোদীর বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ কানাডার

শিখ নেতা হত্যা, মোদীর বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ কানাডার

দলীয় ভিত্তিতে প্রশাসন সাজিয়ে কেউ ক্ষমতায় আসতে পারবে না: এ এম এম বাহাউদ্দীন

দলীয় ভিত্তিতে প্রশাসন সাজিয়ে কেউ ক্ষমতায় আসতে পারবে না: এ এম এম বাহাউদ্দীন

আদানির সঙ্গে জড়িত মোদিও: রাহুল গান্ধী

আদানির সঙ্গে জড়িত মোদিও: রাহুল গান্ধী

আইসিসির প্রধান কৌঁসুলি ২৫ ন‌ভেম্বর ঢাকায় আস‌ছেন

আইসিসির প্রধান কৌঁসুলি ২৫ ন‌ভেম্বর ঢাকায় আস‌ছেন

সোহেল-টুকু-হেলালসহ খালাস পেলেন বিএনপির ২২ নেতাকর্মী

সোহেল-টুকু-হেলালসহ খালাস পেলেন বিএনপির ২২ নেতাকর্মী

ইরানে উদ্ভাবনে নারীদের অবদান ২৪ শতাংশের বেশি

ইরানে উদ্ভাবনে নারীদের অবদান ২৪ শতাংশের বেশি

প্রকাশায় ৯৩ শতাংশ নকল করেও পদোন্নতি পান রাবি অধ্যাপক সাহাল উদ্দিন

প্রকাশায় ৯৩ শতাংশ নকল করেও পদোন্নতি পান রাবি অধ্যাপক সাহাল উদ্দিন

বোরহানউদ্দিনে নিখোঁজের দুই ঘন্টা পর লেবু বাগানে মিললো শিশুর লাশ

বোরহানউদ্দিনে নিখোঁজের দুই ঘন্টা পর লেবু বাগানে মিললো শিশুর লাশ

নাবালক ছাত্রের সঙ্গে জবরদস্তি যৌন সঙ্গম, ৩০ বছরের জেল শিক্ষিকার

নাবালক ছাত্রের সঙ্গে জবরদস্তি যৌন সঙ্গম, ৩০ বছরের জেল শিক্ষিকার

সেনাকুঞ্জে আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ-এর প্রতিনিধি দলের অংশগ্রহণ

সেনাকুঞ্জে আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ-এর প্রতিনিধি দলের অংশগ্রহণ

মার্কিন সংসদের নারী শৌচাগার ব্যবহার করতে পারবেন না রূপান্তরকামী এমপি

মার্কিন সংসদের নারী শৌচাগার ব্যবহার করতে পারবেন না রূপান্তরকামী এমপি

বাগেরহাটে হত্যা মামলায় যুবকের যাবজ্জীবন কারাদন্ড

বাগেরহাটে হত্যা মামলায় যুবকের যাবজ্জীবন কারাদন্ড

অন্তবর্তীকালীন সরকারের নির্দেশনা পালনের প্রত্যয় ব্যক্ত করলেন জিওসি

অন্তবর্তীকালীন সরকারের নির্দেশনা পালনের প্রত্যয় ব্যক্ত করলেন জিওসি

কুড়িগ্রামের উলিপুরে অগ্নিদগ্ধ হয়ে শিশুর মৃত্যু

কুড়িগ্রামের উলিপুরে অগ্নিদগ্ধ হয়ে শিশুর মৃত্যু

ভারতে পাচারকালে সাতক্ষীরা সীমান্ত থেকে দুই নারী উদ্ধার

ভারতে পাচারকালে সাতক্ষীরা সীমান্ত থেকে দুই নারী উদ্ধার