ঢাকা   শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৫ আশ্বিন ১৪৩১

কবি বাড়ি

Daily Inqilab গোলাম মোর্তুজা

২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:১৪ এএম | আপডেট: ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:১৪ এএম

বাড়িটি একতলা। সামনে বড় বারান্দা। আলিসান দুটি আম গাছ। বাড়ির ভেতরের গাছটি বাড়িটাকে ছাপিয়ে উতরে উঠেছে। কাঁঠাল গাছে পাখিরা বাস করে নির্ভয়ে-নির্বিবাদে। ঘরের পূর্বকোণে বকুল ফুলের গাছ। বাড়ির ভেতরের সৌন্দর্যে যে কারোরই মনটাকে গলাবে-ভাসাবে। ছোয়াদ আলি বাড়ির মালিক। মেয়ে সোহানা ও রোহানা আর ছেলে গালিব এর খরচ জোগাড় করতে মাঠান জমি বিক্রি করেন্। দিনের বেলায় স্কুলে কেরানিগিরি আর বিকেল থেকে রাত অব্দি করেন ঢোপ দোকানে বেচাকেনা। এ যে ভাগ্যবিধাতার কারিশমা। দোকানে বিক্রি-বাট্টা কমে এলে অবসরে বেভুল হয়ে লেখেন কবিতা।

চাকরি শেষে পেনশন পেয়ে বাড়িটা কোনোমতে গড়েছেন। জীবনের সবকিছু নিঙড়ে ছেলেমেয়েগুলোকে শিক্ষিত করেছেন। ছেলেটি ভীনদেশি পথিক। একদিন কী হলো সরসর করে বিয়ে হয়ে গেল মেয়ে দুজনার। স্মরণীয় বিষয় হলো, একই দিনে একই গ্রামের দুঅভিভাবক এসে কাঁচা কথা পাকা করে দিন-ক্ষণ করে চলে গেলেন। বিয়েও হলো একদিনেই। স্বামীর চাকরির সুবাদে সোহানাকে থাকতে হয় চট্টগ্রামে আর রোহানাকে থাকতে হয় সিলেটে। ওরা যে যার মতো। ছোয়াদ আলির স্ত্রীও চলে গেছেন ওপারে। সেই থেকে বাড়িটি নিস্তব্ধতায় পরিবৃত। বছরে একবার আসে বাবার সাথে দেখা করতে। স্ত্রীর স্মৃতিচিহ্ন বুকের ভেতরে লেপ্টে আর কবিতার সাথে আঁতাত করে জীবনের অবশিষ্ট সময় পার করছেন তিনি। সময় যায় অবিশ্রান্ত গতিতে। দিনটি ছিল শুক্রবার। আজ আকাশে মেঘ দৌড়াচ্ছে। ছোয়াদ আলি বেলকনিতে বসলেন। রাাস্তার পাশের গাছগুলো যেন কিছু বলতে চায়। হাওয়া জেগেছে। ছোয়াদ আলি ফ্যাকাসে হলদে চোখে চেয়ে আছে বাইরে। কে যেন দাঁড়িয়ে। বাতাসের সাথে ধূলোও উড়ছে। একটু বৃষ্টি হলে ধূলো মাটির সাথে মাখামাখি করবে। ছোয়াদ আলি এক হাত চোখের কাছে প্রশ্বস্ত করতে করতে বললেন, কে ওখানে বৈরী আবহাওয়াতে এভাবে দাঁড়িয়ে। আসুন ভেতরে আসুন।’ বলেই বেলকনির বাইরের দরজাটি খুলে দিলেন। পরশ আলি দাঁড়িয়ে, যাকে চেনেন ছোয়াদ আলি। ‘ভাই, আমি পরশ’ বলেই সাইকেলসহ ঢুকলেন। অলস বৃষ্টি শুরু হয়েছে। পরশ আলি কিছুটা বৃষ্টির পরশ পেয়ে ভিজেও গেছেন। কী ব্যাপার সব চুপচাপ। পরশ আলিকে বসতে বলে অল্প সময়ের জন্য ছোয়াদ আলি কোথায় যেন নিরুদ্দেশ হলেন। কী আর করবেন! কবিতার থিম পেয়েছেন। সেটাই টুকে রাখতে পাশের ঘরে। থিম এমনি যে অন্য সময়ে হাজার চেষ্টা করলেও আসি আসি করে আর আসবে না। আকাশটাও আবার গড়গড় করল। কিন্তু গোটা বাড়ি যেন চুপ নগরের নিঝুম বাড়ি। ছোয়াদ আলি হাতে গামছা নিয়ে উদয় হলেন। বললেন, ‘ভিজে গেছেন দেখছি। মাথাটা মুছে নিন। আমি চিনি আপনাকে। আপনি প্রতিদিন এই রাস্তা হয়ে যান আর আমার বাড়ির পাশে এসে সাইকেলের বেল বাজান।’ পরশ আলির মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের হলো না। হাত বাড়িয়ে গামছা নিয়ে মাথা মুছতে মুছতে বললেন, জ্বি ভাই। কেন জানি এখানে আসলেই আমার হাত বেল বাজানোর জন্য নিসপিস করে। আপনার বাড়ি এত চুপচাপ বাইরে থেকে বোঝায় যায় না।’ পরশ আলির কথা যেন আকাশের বৃষ্টির মতোই রিমঝিম। ছোয়াদ আলি ঘর থেকে বারান্দার দিকে তাকালেন দুটি শালিক কাঁঠালের বড় পাতার নিচে গুটিসুটি মেরে বসলো। পরশ আলির সাথে কথা বলাও হয়নি ভেবে ছোয়াদ আলি প্রকৃতির সাথে না মিশে ঘুরে পরশ আলির প্রশ্নের জবাব দিলেন। বললেন, ‘না, আপাতত এখন আমার কাছে কেউ নেই তবুও অনেকেই আছে।’ কথার অর্থ পরশ আলির কাছে ধোয়াশার মতো ঠেকল। বৃষ্টিও নেই, পালিয়েছে। এবার যাওয়া দরকার। পরশ আলি আর কোনো কথা না বলে। একটাই কথা বলল,‘ভাই, এবার যাই। আমাকে আবার সওদা করতে হাটে যেতে হবে।’ ছোয়াদ আলি জানেন প্রতিদিন এই লোকটিই তো বাড়ির সামনে দিয়ে যান। দেখা তো হবে। বললেন, ‘ ঠিক আছে। ভালো থাকবেন।’ ছোয়াদ আলির রাতটা কাটলো অতীতের সময়ের ভারবাহী কথার সপাং সপাং মার খেতে খেতে। স্ত্রী মৃত্যুর পর ছোয়াদ বাড়িতে একা থাকেন। বকুল গাছটায় হেলান দিয়ে কবিতা লেখেন। বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় পাঠান। ছাপানোও হয়। চলছিল ভালই। কবিতা লিখে দুঃখ ভোলার একটা সহজ ও সুন্দর রাস্তা পেয়েছিলেন ছোয়াদ আলি।

সেদিন ছিল শুক্রবার। বাড়ির বকুল ফুলের গাছটি যৌবনে ঢলঢল। পাতাগুলো ঢেউ খেলানো। ফুল ফুটেছে। ফুলগুলোর আকাশের শোভা বর্ধনকারী তারার মতো। কিছু পাখিরাও সেখানে আরামে আয়েশি ভঙিমায় ডালে-ডালে, পাতায়-পাতায়, ফুলে-ফুলে পায়চারি মারছে। আজ ‘কবি বাড়ি’ নামে নাতিদীর্ঘ একটা কবিতা লিখতে চেয়েছিলেন। অর্ধেক লিখেছেনও। কিন্তু পুরোটাু বুঝি লেখা হলো না। মনটা আচানক ধড়ফড় করে ওঠে। ভাটার টানে মনটা শুকিয়ে যায়। হাত থেকে কলম লুটিয়ে পড়ল। শক্তি উদাস হয়ে উধাও হলো। কলম পড়বার শব্দটি যেন আকাশ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল বিকট আওয়াজে। আম গাছের ডালপালায় থাকা কাকগুলো কা কা করতে থাকল। সেখানে পাখির আনাগোনা বাড়তেই থাকে। ছোয়াদ সাহেবের বাড়ির সীমানা ঘেঁষে থাকে অন্য পরিবার। মাঝে মধ্যে দেয়ালের এপার ওপার থেকে কথা আদান প্রদান হয়। আজ পাখিদের এমন অস্বাভাবিক ডাকাডাকিতে বিরক্ত হয়ে বলল, ‘ও চাচাজান পাখিগুলারে একটু খ্যাদান দেহি। ওগো চিৎকারে ঘরে থাকোন যায় না।’ এ কথা বেশ কয়েকবার বলার পরও কোনো জবাব আসে না। ভেতর থেকে মূল দরজাও বন্ধ। অনেক মানুষ জমায়েত হয়ে গেল। বাড়ির ভেতরে থাকা মানুষের কোনো আলাচালা নেই। মূল ফটকের দরজা ভাঙা গেলো না। অতি উৎসাহী কজন প্রাচীর টপকে ঢুকল। মূল ফটকের ছিটকানি খোলা হলো, তালা ভাঙা হলো। মানুষের ঢল নামল। ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ। ভাঙো দরজা। দরজা ভাঙাতে জনতারা পাকা। ঘরে তো দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। ছোয়াদ আলির নিথর দেহ পড়ে আছে। সাথে কলমটি। কাগজে লেখা কবিতা। অল্প কিছুক্ষণের ব্যবধানে চারদিকে ছড়িয়ে গেল ছোয়াদ আলি রাতের কোনো এক সময়ে মারা গেছেন। ছোয়াদ সাহেবের ছেলে মেয়েদের সাথে যোগাযোগের কোনো রাস্তা পাওয়া গেল না।

এ রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন পরশ আলি। সেখানে অনেক মানুষের ভিড়ে রাস্তা পার হতে পারছিলেন না। সাইকেল থেকে নেমে পথচারিদের জিজ্ঞেস করলেন, ‘ভাই, এ বাড়ির কার কী হয়েছে?’ একজন ভারাক্রান্ত স্বরে ও সুরে বললেন, ‘দেখতে পাচ্ছেন না! আজব মানুষ গো ভাই আপনি। সবাই কাঁদছে আর আপনি জিজ্ঞেস করছেন কী হয়েছে।’ পরশ আলি এদিক ওদিক তাকালেন। সবাই এখানে কেউ নীরবে, কেউ সরবে কাঁদছে। খাটিয়ার চারদিকে মানুষ আর মানুষ। হঠাৎ চোখ পড়ল বাড়ির ভেতরে উত্তর কোণায় ভার বয়স্ক একজন বারবার চোখ মুছছেন। কান্নার কোনো আওয়াজ নেই। পরশ আলি সামনে এগুচ্ছে। গন্তব্য একা একা কাঁদা লোকটির কাছে। এ বাড়িটি তার মনে হয় ািচর চেনা। টেবিলের মাঝ বরাবর বেশ কিছু কাগজ । কবিতা আর কবিতা। চেয়ারের সামনেই কয়েকটি কাগজ। ‘কবি বাড়ি’ শিরোনামে নাতিদীর্ঘ অসমাপ্ত কবিতা পাওয়া গেল।

‘উনি কবি ছিলেন। উনি কবি ছিলেন’-এমন কথার বাতাস সবাইকে ছুঁয়ে দিল। কিছু সাংবাদিকও হাজির হলেন। সাংবাদিকগুলো কবিতার চিরকুট দেখছিলেন। বলাবলি করছিলেন, কবি সাহেবের অতি আপনজন ছিলেন হয়তো পরশ আলি মাস্টার। তাই উনার নামেও কবিতা লিখেছেন। কে এই পরশ আলি-এ নিয়েও হইচই পড়ে গেল। পরশ আলি কবিতার কাগজটি সাংবাদিকের কাছে থেকে নিয়ে হাতে নিলেন। পড়লেন। চোখের কোনে অজান্তেই ক’ফটা অশ্রু ঝড়ল। শোনা যায় বেশ কিছুদিন পরে ছোয়াদ সাহেবের বাড়িতে সন্তানেরা এসেছিল। বকুল ফুলের ঘ্রাণে সন্তানরা আমোদিত নয়। বাবার মহৎ চিহ্নের চিহ্নগুলো পাথরের উপর খোদাই করার মতো জ্বরজ্বল করলেও সন্তানরা তা ভাবেনি, ভাববার সময় নেই ওদের। অবশেষে কবি বাড়িটি বিক্রি হয়ে গেল।


বিভাগ : সাহিত্য


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

পয়েন্ট হারিয়েও শীর্ষে আর্জেন্টিনা,অবনতি বাংলাদেশের

পয়েন্ট হারিয়েও শীর্ষে আর্জেন্টিনা,অবনতি বাংলাদেশের

বিদেশে সাবেক ভুমিমন্ত্রীর আট হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি

বিদেশে সাবেক ভুমিমন্ত্রীর আট হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি

ইউনূস গুড উইলের প্রতিফলন দেখতে চায় জনগণ: রিজভী

ইউনূস গুড উইলের প্রতিফলন দেখতে চায় জনগণ: রিজভী

সময় থাকতে হাসিনাকে ফেরত পাঠান : ভারতকে দুদু

সময় থাকতে হাসিনাকে ফেরত পাঠান : ভারতকে দুদু

রুশ সেনা কুরস্কের দুটি শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে

রুশ সেনা কুরস্কের দুটি শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে

বিমানবন্দর এলাকা হবে শব্দদূষণ মুক্ত

বিমানবন্দর এলাকা হবে শব্দদূষণ মুক্ত

যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান ৭ দিনের রিমান্ডে

যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান ৭ দিনের রিমান্ডে

বিচার শুরু হলে হাসিনাকে ফেরত চাওয়া হবে : আইন উপদেষ্টা

বিচার শুরু হলে হাসিনাকে ফেরত চাওয়া হবে : আইন উপদেষ্টা

লোহাগড়ায় দিনে-দুপুরে বসতবাড়ি পুড়ে ছাই

লোহাগড়ায় দিনে-দুপুরে বসতবাড়ি পুড়ে ছাই

রাষ্ট্রীয় কল্যাণে অবদান রাখার সুযোগ দিন আলেমদেরকে

রাষ্ট্রীয় কল্যাণে অবদান রাখার সুযোগ দিন আলেমদেরকে

দুই মেডিকেল টেকনোলজিস্টের ওপর হামলার ঘটনায় বিএমটিএর নিন্দা

দুই মেডিকেল টেকনোলজিস্টের ওপর হামলার ঘটনায় বিএমটিএর নিন্দা

জিএম কাদের ও মজিবুল হক চুন্নুকে অবিলম্বে আটক করতে হবে : আবু হানিফ

জিএম কাদের ও মজিবুল হক চুন্নুকে অবিলম্বে আটক করতে হবে : আবু হানিফ

উপদেষ্টাদের আয় ও সম্পদ বিবরণী  প্রকাশের নীতিমালা অনুমোদন

উপদেষ্টাদের আয় ও সম্পদ বিবরণী প্রকাশের নীতিমালা অনুমোদন

সাবেক মন্ত্রী শ ম রেজাউল-এমপি হেনরিসহ ৩ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

সাবেক মন্ত্রী শ ম রেজাউল-এমপি হেনরিসহ ৩ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

পটুয়াখালী মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতিকে একবছর ,সাধারন সম্পাদককে দুই বছর একাডেমীক কার্যক্রম থেকে বহিস্কারসহ উভয়কে হোস্টেল থেকে আজীবন বহিস্কার।

পটুয়াখালী মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতিকে একবছর ,সাধারন সম্পাদককে দুই বছর একাডেমীক কার্যক্রম থেকে বহিস্কারসহ উভয়কে হোস্টেল থেকে আজীবন বহিস্কার।

ঢাবিতে যুবককে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগে ৫ শিক্ষার্থী গ্রেফতার

ঢাবিতে যুবককে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগে ৫ শিক্ষার্থী গ্রেফতার

রাজউক চেয়ারম্যানের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল

রাজউক চেয়ারম্যানের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল

‘স্পেন্ড অ্যান্ড উইন’ ক্যাম্পেইনের বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করেছে মাস্টারকার্ড

‘স্পেন্ড অ্যান্ড উইন’ ক্যাম্পেইনের বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করেছে মাস্টারকার্ড

সিটি ব্যাংক আনল অভূতপূর্ব ভিসা ইনফিনিট ক্রেডিট কার্ড

সিটি ব্যাংক আনল অভূতপূর্ব ভিসা ইনফিনিট ক্রেডিট কার্ড

শেখ হাসিনার কোনো ক্ষমা নেই, জবাব তাকে দিতেই হবে : মির্জা ফখরুল

শেখ হাসিনার কোনো ক্ষমা নেই, জবাব তাকে দিতেই হবে : মির্জা ফখরুল